একজন ওমর আলী ও একটি গ্রামের দিন বদলের গল্প

মিজানুর কালিগঞ্জ
Published : 24 May 2012, 03:49 AM
Updated : 24 May 2012, 03:49 AM

একজন ওমর আলী। যিনি বদলে দিয়েছেন একটি গ্রামের অধিবাসিদের জীবন যাপনের গতিধারা। অভাবী মানুষগুলো তার দেখানো পদ্ধতি অনুসরন করে আজ স্বচ্ছল। যার প্রতিফন গ্রামের অধিকাংশ পাকা বাড়ি-বাড়িতে সৌর বিদ্যুতের ব্যবস্থা। ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার মহেশ্বরচাঁদা গ্রামের অভূক্ত মানুষের এ ভাগ্য বদলের রুপকার ওমর আলীর বাড়িটি আজও রয়ে গেছে চাঁটাই বেড়ায় ঘেরা।

ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার মহেশ্বর চাঁদা গ্রামে জন্ম নেয়া কমরেড ওমর আলীর প্রচেষ্টায় মহেশ্বর চাাঁদা গ্রামটি পরিচিতি পেয়েছে আদর্শ গ্রাম হিসেবে। অবহেলিত শোষিত এ গ্রামের অধিকাংশ মানুষকে এক সময় সংগ্রাম করতে হতো দু'মুঠো খাবার যোগাতে। বর্তমানে গ্রামের অধিকাংশ পরিবারই স্বচ্ছল বলে জানান, ওমর আলীর প্রচেষ্টায় গড়া মস্তবাপুর সম্মিলিত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক মিজানুর রহমান।

মহেশ্বর চাঁদা গ্রামের কৃষক হেলাল উদ্দীন জানান, ওমর আলীর চিন্তা ছিলো ভূখা নাঙা কৃষক নিয়ে। কিভাবে গ্রামের কৃষকদের অবস্থার উন্নতি করা যায়। তিনি আরো জানান, ১৯৮২ সালের কোন এক মাসে মহেশ্বর চাঁদা গ্রামের হাটখোলা নামক স্থানে ওমর আলী তাকে সহ গ্রামের কয়েকজন প্রভাবশালী কৃষকদের নিয়ে এক সভায় মিলিত হন। সভায় তাতনিক সিদ্ধান্ত নিয়ে জরুরী ভিত্তিতে গ্রামবাসীদের ডাকা হয়েছিলো। তারা গ্রামবাসীদের জানান ওমর আলীর চিন্তার কথা। সকলের সমর্থনে সেদিন গঠন করা হয়েছিলো সেবা সংঘ কৃষি কাব। পরে ঐক্যবদ্ধ গ্রামবাসিকে নিয়ে সেচ্ছা শ্রমের ভিত্তিতে মাঠ সমতল করলেন। তারপর খাল কেটে সেচের ব্যবস্থা করলেন। তিনিই প্রথম সেচের জন্য স্যালোমেশিনের ব্যবস্থা করেন। চাষীদের আধুনিক পদ্ধতিতে চাষে উদ্বুদ্ধ করেন। প্রথমবার মাঠজুড়ে করলেন গমের চাষ। ভালো ফলন পেল কৃষকরা। যাদের জমি ছিলোনা তারাও কাজের করার মাধ্যামে অর্থ আয়ের মুখ দেখলেন। দ্বিতীয় বার কৃষি গবেষণা ইন্সটিউট থেকে উন্নত জাতের ধান এনে চাষ করলেন। এবারো ভালো ফলন পেল। বিঘা প্রতি ৮ মন ধানের স্থলে ২০ মন ধান পেয়ে গ্রামের মানুষেতো আনন্দে আত্মহারা। এরপরও থাকেননি ওমর আলী। কৃষিতে আরো উন্নতি লাভের জন্য তিনি কৃষি বিষয়ক বিভিন্ন অফিসে যোগাযোগ ও কৃষি কর্মকর্তাদের তার গ্রামে আসার আমন্ত্রন জানাতে থাকেন। তারই প্রচেষ্টায় ১৯৯০ সালের শেষের দিকে কৃষিবিদ গুল হোসেন ও কৃষি কর্মকর্তা নাইমুজ্জামান মহেশ্বর চাঁদা গ্রামের কৃষকদের আধুনিক চাষ পদ্ধতিতে উৎসাহিত করতে আসেন। শেখালেন বিভিন্ন আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার। গ্রামের মানুষ স্বানন্দে গ্রহন করলেন প্রযুক্তি। সেই থেকে অভাবকে জয় করে এগুতে থাকলো গ্রামের কৃষকরা। সারা দেশব্যাপী চাষাবাদের এই আধুনিক পদ্ধতি ছড়িয়ে দিতে তিনি গ্রামে স্থাপন করলেন একটি কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট। এখানে বিভিন্ন এলাকার কৃষকেরা প্রশিণ নিতে আসতো। স্বচ্ছল গ্রামের মানুষ প্রশিনার্থীদের এক বেলা না খেয়ে যেতে দিতো না। কথা গুলো বলছিলেন, তারই এক সময়ের সহযোদ্ধা বাবর আলী মোল্লা। তিনি আরো জানান, আমিষের চাহিদা মেটাতে গ্রামের মানুষ নিয়ে ওমর আলী ১৫০ টির বেশি পুকুর খনন করেছিলেন। শুধু তাই নয় গ্রামের যেকোন বিবাদে কখনও কাউকে মামলা মোর্কদ্দমায় জড়াতে দিতেন না তিনি। নিজে এলাকার মানুষদের সাথে নিয়ে গ্রামেই বিবাদ মিমাংশা করে দিতেন। সবাই সন্তুষ্ট চিত্তে মেনেও নিতেন তার বিচার।

ওমর আলীর সহচর বাবর আলী দুঃখ প্রকাশ করে জানান, ওমর আলী শুধু গ্রামের মানুষের উন্নতি নিয়ে ভেবেছিলেন কিন্ত নিজের উন্নতির জন্য কখনো ভাবেনি। তবে তিনি নিজের পরিবারের মুখে হাসি ফোটাতে না পারলেও অন্যের মুখে হাসি ফুটিয়েছেন। গড়ে গিয়েছেন তার উত্তরসূরী সোনাভান ও হেলাল উদ্দিনের মতো মানুষদের। ওমর আলীর দর্শনকে ধারন করা কৃষানি সোনাভান ও হেলাল উদ্দীন কেঁচো কম্পোস্ট সার তৈরী করে কৃষিতে নতুন বিপ্লব সাধন করেছেন। আজ তারা নিজেরা যেমন লাভবান হয়েছেন তেমনি কৃষকেরা। তাদের তৈরী সার এবং প্রযুক্তি এখন বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পৌঁছে গিয়েছে।

সরজমিনে মহেশ্বর চাঁদা গ্রামের মাঠ পরিদর্শনে দেখা গেছে, গ্রামের কৃষকরা এখনও চাষ করে ওমর আলীর দেখানো পদ্ধতি অনুসরনে। এক একটি স্যালোমেশিনকে কেন্দ্র করে এক একটি ব্লক ভাগকরা। মাঠ সমতল হওয়ায় মাঠের একপ্রান্ত থেকে সেচ দিলে অপর প্রান্তে পানি পৌঁছে যায়। এই ভাবে এখনও তারা ওমর আলীর দেখানো পদ্ধতিতে চাষ করে। ১৯৮০ সালের দিকে তাদের ধান হতো বিঘা প্রতি ৮ মন। এখন তাদের ধান হয় বিঘা প্রতি ৩০ মন। মহেশ্বর চাঁদার মাঠে এখন ১০০ টির বেশি স্যালো মেশিন। সংসারের প্রতি উদাসীন এই মহান মানুষটির সহধর্মীনি মাহীরুন্নেছা জানান, তিনি সারাটা জীবন পরের জন্য ছুটেছেন। মানুষের উন্নয়নে ছুটতে গিয়ে তাকেও সময় দিতে পারেননি। পারেননি নিজ পরিবারের জন্য কিছু করতে। তিনি আরো জানান, ওমর আলীর ইচ্ছা ছিল নিজের গ্রামকে মডেল হিসেবে উপস্থাপন করে দেশব্যাপী তা ছড়িয়ে দিয়ে বাংলাদেশকে একটি সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবে গড়ে তোলার। কিন্তু মরন নামক অনিবার্য সত্যের কাছে পরাজিত হয়ে ওমর আলী ২০০৪ সালের ৩ ফেব্রুয়ারী চিরনিদ্রায় শায়িত হন। গ্রামের মানুষ তাকে তার স্বপ্নের মাঠের এক প্রান্তে কবরস্থ করেন। আজও মানুষ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন ওমর আলীকে।