খাকি পোশাকধারী ঐ লোক গুলোরে, হে বঙ্গ জননী রেখেছ পুলিশ করে মানুষ করনি!

এম. মিজানুর রহমান সোহেল
Published : 26 Sept 2021, 05:03 PM
Updated : 23 August 2011, 12:48 PM

লেখাটি যখন লেখতে শুরু করেছি তার পর কতবার যে লেখার শিরোনাম পরিবর্তন করেছি তার হিসাব আমার মনে নেই । আমার জীবনে এমন ঘটনা এটাই প্রথম । কারণ মন খারাপ হলে লেখার শিরোনামেরও মন খারাপ হয়ে যায় । আসলে মন ভালো রাখার চেষ্টা করি কিন্তু যখন বাংলা ব্লগ এলাকাতে ঢু মারি বা ফেসবুকে বসি তখনই আবার মন খারাপ হয়ে যায় । কারণ সর্বত্রই সেই আলোচিত মিলনের লেখা পড়ছি । কিছুদিন আগে পাকিস্তানে ডাকাত সন্দেহে সরফরাজ নামের এক কিশোরকে গুলি করে হত্যা করে পাক আর্মি । সেই ভিডিও দেখে মনটা এখনও ক্ষতবিক্ষত। মনে সে দাগ শুকনোর আগেই আমার সোনার বাংলাদেশে তার চেয়েও ভয়ানক জঘন্য ঘটনা ঘটে গেলো। ২৭ জুলাই নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের চরকাঁকড়া গ্রামে এক নিরীহ গরিব নিরপরাধ অসহায় অবুঝ শিশু সামছুদ্দিন মিলনকে (১৬) ডাকাত বানিয়ে গণধোলাইয়ের মাধ্যমে কোম্পানীগঞ্জ থানার পুলিশ হত্যা করে। মিলন প্রসঙ্গে বাংলা ব্লগে বা ফেসবুকে অনেকের লোমহর্ষক মন্তব্য পড়ে বুকের মধ্যে ধক করে শব্দ হয়েছে, ধরে রাখতে পারিনি চোখের জল । শরীরের সব গুলো লোম দাড়িয়ে গেছে । শরীরের ঘাম ঝরেছে অবিরাম । আমি এ ধরনের খবর দেখে হতবাক হয়ে যাই,বাকরুদ্ধ হয়ে যাই, কথা বলার কোনো ভাষা থাকে না। মনে হয়েছে এ ঘটনা জানার আগেই আমার মৃত্যু হলো না কেন? আমি তো আর সহ্য করতে পারি না। মিলন যদি আমার সন্তান বা ভাই হতো আমি কি করতে পারতাম তার জন্যে ? একফোটা চোখের জল ফেলানো ছাড়া আর কিছুই করতে পারতাম না । কারণ পুলিশ যেহেতু তার বিচার সম্পন্ন করেছে তাই তার বিচার কখনই বাংলার মাটিতে আর বিচার হবে না!! ইতিহাস তো তাই বলে। মনে অনেক কষ্ট নিয়েই শেষ পর্যন্ত লেখাটি শেষ করতে পেরেছি ।

পুলিশ। একটি অর্থবহ নাম। একটি আবেগহীন যন্ত্র। যেমন খুশি তেমন ভাবে সাজছে। চলছে তো চলছেই। চলছে গাড়ি যাত্রাবাড়ী। যেন অন্য কোনো গ্রহে বাস করছি। যেখানে কোনো আইন নেই, নিয়ম নেই। সর্বময় ক্ষমতার অধিকারি পুলিশ যা ইচ্ছা তাই করে যাচ্ছে। অপরাধ দমনের দায়িত্ব যাদের,সেই পুলিশই এখন অপরাধী কর্মকাণ্ডে বেপরোয়া। ঘুষ,ডাকাতি, ছিনতাই চাঁদাবাজি,নির্যাতন ব্লাকমেইলিংয়ের পাশাপাশি খুনের মতো গুরুতর অপরাধেও জড়িয়ে পড়ছে পুলিশ। প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে তারা এসব করে বেড়ালেও শাস্তি পেতে হয়েছে এমন নজির খুব কম। কোনো কোনো ঘটনার পর অনেকেরই সুবিধাজনক স্থানে পদায়ন হয়। সারা দেশে পুলিশের কয়েক হাজার সদস্যের বিরুদ্ধে পুলিশ সদর দফতরে এ ধরনের অভিযোগ জমা পড়লেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা ধামাচাপা পড়ে যায়। এ ছাড়া আদালতে মামলা হলেও পুলিশ সদস্যদের শাস্তি পেতে হয় না। তারা বাদীপক্ষকে বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি দেখিয়ে মামলা উঠিয়ে নিতে বাধ্য করেন। এ অবস্থায় অসাধু পুলিশ-সদস্যরা ক্রমশ হিংস্র হয়ে উঠছেন। বিপদের বন্ধু নয়, পুলিশ এখন আতঙ্কে পরিণত হয়েছে সাধারণ মানুষের। এই মুহুর্তে মনে পড়ছে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাসিমের ওপর অমানবিক পুলিশের নির্যাতন, চট্টগ্রামে বৃদ্ধ সাংবাদিকের ওপর অকারণে হামলা, জয়নুল আবদিনের ওপর অমানুসিক নির্যাতন, কোনো কারণ ছাড়াই গুলি করে লিমনের হাঁটুর বাটি উড়িয়ে দেয়া, যেখানে তদন্ত তো দূরের কথা ওর নামে কোন অভিযোগই নেই। কাদেরকে থানায় ধরে নিয়ে ডাকাত বানিয়ে অমানুসিক নির্যাতন, আমিন বাজারে ডাকাত বলে নিরীহ ছয় ছাত্রকে পুলিশের সামনে পিটিয়ে মেরে ফেলা, নোয়াখালিতে পুলিশ উস্কানি দিয়ে গণধোলাই-এর নাটক করে নিরাপরাধ মিলনকে মেরে ফেলা। আবার ডিবি পুলিশের পরিচয় পত্র দেখিয়ে যেখান সেখান থেকে সাদা গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কারা যেন ! তাদের লাশ পাওয়া যাচ্ছে নদী-বিলে,রাস্তা-ঘাটে !! কি নির্মম সব অপ্রত্যাশিত গল্প !!!
আমাদের দেশে একটা প্রবাদ আছে -বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা,পুলিশ ছুঁলে ছত্রিশ ঘা! সম্প্রতি বেচারা আবদুল কাদের (জীবিত বলে) তা বুঝতে পেরেছেন হাড়ে হাড়ে! আবদুল কাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র,তাই তাকে নিয়ে এখন বিরাট হৈচৈ হচ্ছে। পুলিশ তাকে নির্যাতন করেই ক্ষান্ত হয়নি,কয়েকটি বেহুদা মামলাতেও ঝুলিয়ে দিয়েছে। আপাতত জামিনে মুক্ত কাদেরকে নিয়ে হৈচৈ হবে আরো কিছুদিন। কাদেরের পরেই অবিশ্বাস্য আর অবাক করা গল্প নিয়ে হাজির হলো মিলন। এবার মিলনকে নিয়ে পত্র-পত্রিকায় বেশ কিছুদিন লেখালেখি হবে,টিভির টক শোগুলোতে তুখোড় আলোচনা হবে- বুদ্ধিজীবীরা বক্তব্য দেবেন। তারপর সব কিছু গল্প হয়ে যাবে। বাংলাদেশের হাইব্রিড মিডিয়া বাণিজ্যে উপযোগিতা শেষ হতেই মিলনের কথা ভুলে যাবে সবাই। আমরা যেমন ইতিমধ্যেই প্রায় লিমন ও কাদেরের কথা ভুলে গেছি। তারপর আবার নতুন কোনো লিমন বা কাদেরের খোঁজ। পুলিশ থাকবে পুলিশের মতোই। বরখাস্তরা পুনর্বহাল হবেন দায়িত্বে। নতুন কোনো কাদেরের পায়ে কোপ দিয়ে দেখা হবে,চাপাতির ধার ঠিক আছে কি না! সেই নতুন কাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো সর্বোচ্চ শিক্ষাপীঠের শিক্ষার্থী না হলে তার ভোগান্তি হবে আরো বেশি। সে খবর আমরা পাব না। পেলেই বা কী? সমস্যার তো সমাধান হবে না। হয় না কোনোকালেই।

অনেক কথা বলার আছে তবে আজ শুধু অসহায় মিলনের কথাই বলতে চাই। মিলন নামের এই কিশোরটির ভিডিওর দিকে যতবার তাকাচ্ছি ততবারই চোখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছি। এক ধরনের মস্ত অপরাধবোধে আমি তার চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারছি না।তার উপর অজস্র কিল,ঘুষি,লাথি পড়ছে একের পর এক,কিন্তু তার চেহারায় কোন যন্ত্রনার চিহ্ণ নেই। আছে একরাশ বিস্ময় মাখা প্রশ্ন। তার এই প্রশ্ন আপনার কাছে,আমার কাছে,সমাজের মানুষের কাছে, মানুষের বিবেকের কাছে,সর্বোপরি রাষ্ট্রের কাছে- কেন তাকে এভাবে মারা হচ্ছে? কী তার অপরাধ? সে জানে না। আপনি কি জানেন? আমি কি জানি? না,আমরা কেউই জানি না। যে পুলিশ তাকে চুলের মুঠি ধরে জনতার মাঝে ছুঁড়ে দিলো স্বাক্ষ্য প্রমাণ থেকে নিশ্চিত মিলনের অপরাধ সম্পর্কে সেও মিথ্যা বলেছে। যে জনগণ তাকে পিটিয়ে কুপিয়ে নাড়ি ভুড়ি কলিজা বের করে মেরে ফেললো তারাও তার অপরাধ সম্পর্কে নিশ্চিত ছিল না। পুলিশ বলেছে 'পিডি মাইরা হালাইতে" তাই তারা মেরেছে। একটিবারও ভাবেনি এই কিশোরটি তার ভাইয়ের মত, তার বন্ধুর মত,তার নিজের সন্তানের মত। কতটা বর্বর হলে,কতটা অসভ্য হলে পুলিশের নির্দেশে এভাবে লাথি,কিল,ঘুষি ,ইট দিয়ে মাথায় আঘাত করে একজন তরতাজা কিশোরকে প্রকাশ্যে মেরে ফেলা যায় ? এ কেমন নিষ্ঠুর,দয়ামায়াহীন মানুষ ? আমাদের পুলিশ বাহিনী এমন পিষাচ- যে সামান্য কিছু টাকার লোভে মানুষকে পশু পাখির মত হত্যা করে। এই পুলিশ-ই ৭১-এ রাজারবাগে প্রথম প্রতিরোধ করেছিল হানাদারদের-এই কথা নতুন জেনারেশন কি কোনদিনও মেনে নেবে?

পুলিশ যে এই পৈশাচিক হত্যার সাথে জড়িত তা ওই ভিডিও দেখে একজন শিশুও বুঝতে পারবে। পুলিশ কিশোরটিকে পুলিশের গাড়ি থেকে ধাক্কা দিয়ে,লাথি মেরে কিছু বর্বর পিশাচ লোকের হাতে তুলে দেয়। ঠাণ্ডা মাথায় পিটিয়ে মেরে ফেলার পর ওই গাড়িতে আসা পুলিশরাই লাশটিকে চরম অবজ্ঞার সাথে (যেন কোনো ইঁদুর) গাড়ির পেছনে ছুঁড়ে দেয়। যেন পুরো ব্যাপারটিই পূর্ব পরিকল্পিত। মনে হয় কোনো হরর ছবির দৃশ্য দেখছি। সারা জীবন এ দৃশ্য কেউ ভুলতে পারবে না।

এই বাংলাদেশ দেখার জন্যতো বাংলার মানুষ স্বাধীনতা আনেনি। এই বাংলার মানুষ এই বাংলাকে আনার জন্যতো রক্ত বিসর্জন দেয়নি। মুক্তিযুদ্ধ,ভাষা আন্দোলন তো এই বাংলা পাওয়ার জন্য করা হয়নি। সবুজ এই বাংলায়তো শিশুদের রক্তে মানচিত্র লাল করার জন্য আমরা যুদ্ধ করিনি। পতাকায় সবুজের মাঝে লাল বৃত্ত-এর রক্ততো মানুষের তাজা রক্তে পরিণত করতে আমরা চাইনি। এ কি পৈশাচিকতা! প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে এই বাচ্চা সম্পর্কে কোন বাণী-ই এখনো শুনিনি।এখনো শুনিনি যে, অপরাধীদের মৃত্যুদন্ড হবে। স্বপ্রণোদিত হয়ে হাইকোর্টের কোন রুলনিশি জারির কথাও শুনিনি। একত্রে মানববন্ধন করার কথাও কোনো পত্রিকায় আসেনি, মিছিল মিটিং, আন্দোলন কোন কিছুরই আভাষ এখনো পাচ্ছি না। না পাওয়াটা স্বাভাবিক, কারণ এটা কোন রাজনৈতিক হত্যাকান্ড ছিল না।

মানুষের এই পরিবর্তন কিন্তু এক দিনের ঘটনা নয়। বহুদিন ধরে আমরা দেখে আসছি একের পর অপরাধের ঘটনা ঘটছে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে জনগণের জানমালের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়নি। বরঞ্চ দলীয় বিবেচনায় একাধিকবার খুনের আসামীকেও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ক্ষমা করায় জনগণের মাঝে প্রচলিত আইন সম্পর্কে আরো আস্থাহীনতার সৃষ্টি হয়েছে। প্রচলিত বিচার পদ্ধতিকে পাশ কাটিয়ে বিচার বহির্ভূত হত্যার মাধ্যমে অপরাধ দমনও সমাজে দারুণ ভীতির সৃষ্টি করেছে। মানুষ একে অপরকে আর বিশ্বাস করতে পারছে না।

যদি প্রশ্ন করা হয় মানুষের ভেতর থেকে মানবতার অনুভূতি কখন উঠে যায়? সহজ উত্তর,যখন অপরাধীরা অপরাধ করে সদর্পে ঘুরে বেড়ায়,যখন প্রচলিত আইন সঠিকভাবে প্রয়োগ হয়না,যখন হতাশ হতে হতে আর হতাশ হওয়া যায় না,তখন মানুষ অন্ধের মত আইন নিজের হাতে তুলে নেয়। আমাদের দেশের মানুষগুলি এখন তেমনই হয়ে উঠছে দিন দিন।

অন্যদিকে রাষ্ট্র কর্তৃক সাহসপ্রাপ্ত হয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোও হয়ে উঠছে বেপরোয়া। বিশেষ করে পুলিশ বাহিনীর বিভিন্ন সদস্যের অপরাধের কাহিনী প্রকাশ্য দিবালোকের মত সত্য হলেও আদতে এর কোন বিচার হয়নি। ফলে তাদের ভেতর এমন ধারনা জন্মে গেছে যে তাদের যা খুশি তাই করার নিত্য অধিকার আছে। সেই অধিকার বলেই তারা ছাত্রকে ডাকাত বানিয়ে জনগণ দিয়ে পেটাচ্ছে, নিরীহ ছাত্রকে থানায় আটকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে সন্ত্রাসী বানাচ্ছে,কিশোরের টাকা,মোবাইল ছিনিয়ে তাকে গণপিটুনি দিতে জনগণকে উৎসাহিত করছে,যাকে তাকে ধরে নিয়ে ক্রসফয়ারের কল্পিত কাহিনী তৈরি করছে,গুম করে দিচ্ছে লাশ।

এ যেন ষাট এর দশকের ফেসিস্ট শাসিত কোন দেশের অভ্যান্তরীন চালচিত্র। অথচ বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ,যেখানে জনগণকে হেফাযতের অঙ্গীকার নিয়েই সরকার ক্ষমতায় আসে। মিলন নামের কিশোরটি এদেশের জনগণেরই একজন। তাকে নিরাপত্তা না দিতে পারার দায় রাষ্ট্রের, সরকারের। উন্নত বিশ্বের দেশ হলে এ ঘটনার দায়ে সরকারের পতন পর্যন্ত ঘটতো। কিন্তু বাংলাদেশে আমরা জানি,এসবের কিছুই হবে না। তিন চারজন পুলিশ সদস্য ক্লোজড হয়েছেন, বিচার বিভাগীয় তদন্তের সুপারিশ করা হয়েছে,মিডিয়ায় এ নিয়ে কিছুদিন হৈ চৈ হবে,টক শোতে সরকারকে তুলোধুনা করা হবে,আমরা খাওয়ার টেবিলে কদিন এ নিয়ে আলোচনা করবো, তারপর ক্রমশ ভুলে যাব সব। কেবল কিশোরটির হতবাক,বিমূঢ়,বিস্ময়মাখা চেহারায় প্রশ্নগুলো লেপ্টে থাকবে চিরকাল। সেটিকে পুঁজি করে ক্ষমতার পালাবদল হবে। কিশোরটির মা বিচারের আশায় বুক বাধবেন। তাহের পুত্র বিপ্লবের শিকার হওয়া হতভাগ্য নুরুল ইসলামের স্ত্রীর মতো বুক বাধতেই থাকবেন। আমরা কখনোই তাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে স্বপ্ন দেখাতে পারবো না,মেরুদণ্ড বাকা করে চোখ ফিরিয়ে নেবো। সবকিছু দুমড়ে মুচড়ে স্বপ্নবাজ হবার মতো সাহসী আমরা নই,এ দায় কেবল রাষ্ট্রেরই নয়- আমাদের সবার।

যেভাবে আমাদের দেশে একের পর এক ঠান্ডা মাথায়,পরিকল্পিতভাবে নির্বিকার হত্যাকান্ড ঘটে চলেছে তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। মধ্যযোগীয় বর্বরতার চাইতেও জঘণ্য আর হবেই-বা-না কেন কারণ আ. লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার লগি-বৈঠার অনুমোদনে যেখানে মানুষ মেরে লাশের ওপর লাফিয়ে আনন্দ উল্লাস করা হয়। যে সরকার ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের কথা না ভেবে দলীয় অনেকগুলো পেশাদার খুনের দায়ে মৃত্যূদন্ড প্রাপ্ত আসামীদেরকে ছেড়ে দেয় প্রেসিডেন্টর বিশেষ ক্ষমায়- সেখানে বা সেদেশে জনগণ এর চাইতে ভালো কি আর আশা করতে পারে ? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আর কত শাক দিয়ে মাছ ঢাকবেন,আর কত পূর্বের সরকারের দোহাই আর তুলনা করে দায়্ত্বি এড়িয়ে চলবেন ? সরকারের পুলিশ বাহিনী তো ২৫ মার্চকেও হার মানাতে যাচ্ছে,নব্য রাজাকার হিসাবে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে, ক্রমাগত মানুষ হত্যায় সাহায্য করছে। আর তার শাস্তি সাময়িক বরখাস্ত ??? কেন জেল জরিমানা বা গ্রেফতারী পরওয়ানা কি শুধু সাধারণ অসহায় নাগরিকদেরই জন্য? পুলিশ কি আইনেরও উর্ধে ? মনিষীরা বলেন "যে দেশে গুনের কদর নেই সে দেশে গুনীর জন্ম হয় না" আর যে দেশে বিচার নেই সেখানে সুন্দর সভ্যতার জন্ম হবে কি করে ? বিশেষত বেপরোয়া ক্রমবর্ধমান রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, সন্ত্রাস, দুর্নীতি(সর্বক্ষেত্রে),অতিলোভ (বিশেষত ব্যবসায়),নির্লজ্জপনা (বিশেষত ঘুষের ক্ষেত্রে),মিথ্যাচার (বিশেষত সুবিধা লাভের আশায়/ তোষামোদ করার ক্ষেত্রে ),আর প্রাতিষ্ঠানিকভাবে চড়া সুদ ইত্যাদি অতি শীঘ্রই কি আমাদের অসভ্য জাতি বা ব্যর্থ রাস্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করে দেবে না ?

এ দেশ যে 'মানুষের'বসবাসের জন্য সম্পুর্ন অযোগ্য হয়ে পড়েছে তা এ ঘটনার মধ্য দিয়ে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। এখানে রাস্ট্রের পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ উতসাহে এ ধরনের ঘটনা কেবল পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। কারণ স্বয়ং স্বরাস্ট্রমন্ত্রী যেখানে পুলিশের অন্যায় কাজকে সমর্থন করছেন সেখানে আইনের শাসন বাতুলতা মাত্র। স্বরাস্ট্রমন্ত্রী বুঝতেও চেষ্টা করেন না সন্তান হারানো মায়ের কষ্ট কি ? আর বুঝবেনই বা কি করে কারণ তার তো কোনো সন্তান নেই। পুলিশের অন্যায়ের তদন্ত নিরপেক্ষ কোনো তদন্ত সংস্থাকে দিয়ে করা হোক, তা না হলে যার ফলাফল সবারই জানা। যদিও পুলিশের বিচারের জন্য রয়েছে সিকিউরিটি সেল নামে রয়েছে একটি সংস্থা,কিন্তু এখবর কজনেরই বা জানা ? আমাদের দেশের তথাকথিত সুশীল সমাজের তো মৃত্যু ঘটেছে বলা যায়,কারণ দেশে এত ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত কিন্তু সুশিল সমাজ নিশ্চুপ। বেচে আছে তাদের মধ্যের কিছু সরকারের পা-চাটা দালাল এবং উচ্ছিষ্টভোগী। যার কারণে সরকার দেশের ভিতর কি হচ্ছে তা থেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ দুরত্বে।

আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন। দেশের সব অপ্রীতিকর ঘটনাই তার কাছে বিচ্ছিন্ন ঘটনা। দিনে দুপুরে পথেঘাটে মানুষ খুন হয়,মন্ত্রী মহোদয়া নিহতের বাড়িতে গিয়ে মিডিয়ায় বক্তব্য দেন,'এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো আছে।'এর পর তিনি যেকোনো 'বিচ্ছিন্ন ঘটনা'র বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পুলিশ ও নিরাপত্তারক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশ দেন। তার মানে কী,তার নির্দেশ না পেলে আমাদের নিরাপত্তারক্ষাকারী বাহিনী কোনো কাজ করে না? করলেই বা কী? আমাদের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশগুলোর সামনেই যে বেশি নিরাপত্তাহীনতা!

লিমন-কাদেরের ঘটনা নিয়ে দেশে-বিদেশে সরকার অনেক সমালোচিত হয়েছে। বাংলাদেশের মানবাধিকার ইস্যু নিয়ে চিন্তিত পুরো বিশ্ব। এবার মিলনের ঘটনা নিয়ে পুলিশ জল ঘোলা করছে। বিশ্ব দরবারে আবারও ক্ষুণ্ন হচ্ছে বাংলাদেশের ইমেজ। ২০০৫ সালের বসুরহাট হাজি এন্ড সন্স দোকান ডাকাতির ঘটনায় পুলিশের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তুললে পুলিশের নির্বিচার গুলিতে ৫ জন নিরিহ লোক মারা যায়। সেই ঘটনার বিচার ৬ বছরেও হয়নি। পুলিশ বরখাস্ত হয়,আবার ঘটনা নিভে গেলে সব অন্ধকারে হারিয়ে যায়। এবারের মিলনকে হত্যার পেছনে পুলিশই দায়ী এটা এসপিও স্বীকার করেছেন। কিন্তু আমি খুব অবাক হয়ে গেলাম মিলনের ঘটনায় যখন সারা দেশের মানুষ শোকে কাতর, তখন কেরানীগঞ্জের রাজেন্দ্রপুর এলাকায় নির্মাণাধীন কারাগার পরিদর্শন উপলক্ষে সেখানে আয়োজিত এক সভায় মিলনের প্রসঙ্গ উঠলে স্বরাস্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন মিডিয়াকে জানান দিলেন 'আইনশৃঙ্খলার উন্নতি হয়েছে। জঙ্গিবাদ,সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি অনেকটাই কমেছে।দেশের সার্বিক পরিস্থিতি ভালো আছে, মিলনের ঘটনাটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা।''!!!

ঠিকই তো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি বলতে পারেন, দেশের মানুষ ৪ বেলা পেট ভরে খায়, বানিজ্যমন্ত্রী ফারুক খান যদি দ্রব্যমূল্য কমাতে কম খেতে বলেন, অর্থমন্ত্রী আবুল যদি বলতে পারেন শেয়ার বাজারের বিক্ষোভকারীরা ফটকাবাজ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন না হয় এ দুর্যোগ মুহুর্তে বলেছেন দেশের সার্বিক পরিস্থিতি ভালো আছে। সবার দেখা-দেখিতে জন সাধারণকে নিয়ে এক-আধটু বিরূপ মন্তব্য কিংবা জোকস করলেন আর কি ! এই ধরণের জোকস না করলে মেয়াদের বাকী সময়টা কিভাবে পার করবে সরকার ?

সাহারা খাতুনের এই মন্তব্য করার পর ব্লগের এক পাঠক মনের কষ্টে লিখেছেন-'শাবাস এই না হলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী! জয় সাহারা খাতুনের জয়। জয় গণপিটুনির জয়। জয় পুলিশ প্রশাসনের জয়। জয় গুপ্তহত্যার জয়। জয় ছাত্রলীগের জয়। লিমন-কাদের-মিলনসহ আমিনবাজারের ছয় ছাত্র নিপাত যাক। শিক্ষকরা ছাত্রলীগের কাছে পিটুনি খাক। পুলিশের গণপিটুনি বৈধতা পাক।' আরেকজন লিখেছেন –

আমরা নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী,
খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মানুষ মেরে সুখ শান্তি আনি।
আর কত কাল এভাবে অপবাদ রাখব মানিয়ে;
ভবিষ্যত প্রজন্মকে আর আমরা কত বলব বানিয়ে?

হয়তো আগামীতে বিক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষ কেবল আর ঘরে বসে বসে পদ্য-কবিতা কিংবা ছড়া লিখে সময় নষ্ট করবে না, অপশক্তি সেটা যেখানে হোক না কেন তার দাত ভাঙ্গা জবাব দেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে নামবে- আর তখন আমাদের এদেশের ঝিম মেরে বসে থাকা তথাকথিত বুদ্ধিজীবিরা বসে বসে হয়তো পর্যবেক্ষণ করবেন দেশে কি হচ্ছে। এটা সমাজের জন্যে, দেশের জন্যে, পুরজাতির জন্যে লজ্জাকর । সুতরাং ক্ষমতাবানরা সাবধান, আশা করি ক্ষমতার অপবেবহার করবেন না। দেশ ও জাতি আপনাদের একটি সুন্দর সিদ্ধান্তের জন্যে অপেক্ষমান।

লেখক: এম. মিজানুর রহমান সোহেল, সম্পাদক, ফ্রাইডে ঢাকা টাইমস
m.mrsohel@yahoo.co.uk