উপজাতি রাজাকাররা কি ধরা ছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাবে?

এম. মিজানুর রহমান সোহেল
Published : 26 August 2011, 03:12 PM
Updated : 26 August 2011, 03:12 PM

রাজাকার পরিচিতি
রাজাকার হচ্ছে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কর্তৃক গঠিত একটি আধাসামরিক বাহিনী। এটি অখন্ড পাকিস্তানপন্থী বাঙালী এবং উর্দুভাষী অবাঙালী অভিবাসীদের নিয়ে গঠিত হয়। অবরুদ্ধ বাংলাদেশে স্বাধীনতার জন্যে লড়াইরতমুক্তিবাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য ১৯৭১ সালের মে মাসে খুলনায় প্রথম রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। খানজাহান আলী রোডে একটি আনসার ক্যাম্পে ৯৬ জন জামায়াতে ইসলামী কর্মী সমন্বয়ে জামায়াতে ইসলামীর পূর্ব পাকিস্তান শাখার সহকারী আমীর মাওলানা এ কে এম ইউসুফ প্রথম রেজাকার বাহিনী গঠন করেন। তবে পরবর্তীতে জনগণের কাছে 'রেজাকার' শব্দটি 'রাজাকার' শব্দে পরিণত হয়। আরবী শব্দ রেজা এবং ফার্সী শব্দ কার যুক্ত হয়ে রেজাকার শব্দের উত্পত্তি হয়। এর অর্থ স্বেচ্ছায় যারা কাজ করে। রেজাকার বাহিনী শপথ নিতো, "I shall bear true allegiance to the constitution of Pakistan as framed by law and shall defend Pakistan, if necessary, with my life." অর্থাৎ, "আমি আইনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের সংবিধানের প্রতি সত্যকার আনুগত্য প্রদর্শন করব এবং জীবন দিয়ে হলেও পাকিস্তানকে রক্ষা করব।" পরবর্তীকালে টিক্কা খানের সরকার সারা প্রদেশে বাধ্যতামূলকভাবে অনেক চোর ডাকাত ও সমাজবিরোধীকে রেজাকার বাহিনীর অন্তর্ভূক্ত করে।

উপজাতি রাজাকার
বাংলাদেশের উপজাতি জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলো। তবে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে তাদের বসবাসের জায়গাটা সীমান্তবর্তী অঞ্চল হওয়ায় সেখানে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এবং মুক্তিবাহিনী- দুইপক্ষই ছিলো ভীষণভাবে তৎপর। এই পর্যায়ে এসে উপজাতিরা গোষ্ঠীগতভাবে সিদ্ধান্ত নেয় তারা কোন পক্ষে যাবে। সাওতাল এবং গারোরা সরাসরি পাকিস্তানের বিপক্ষে অবস্থান নেয়। আর চাকমারা নেয় পক্ষে। মগরা নিরপেক্ষ অবস্থান নিলেও তারা মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেছে আবার পাকিস্তানীদের বার্মায় পালাতেও সাহায্য করেছে। এটা গোষ্ঠীগত সিদ্ধান্ত, গোষ্ঠী প্রধানের নির্দেশ। এখানে সমর্থন অর্থে বলা হয়েছে। এই সমর্থনের অর্থ ইনটেলিজেন্স, আশ্রয় এবং লোকবল দিয়ে সহায়তা। চাকমাদের জন্য এই সিদ্ধান্তটা এসেছে রাজা ত্রিদিব রায়ের তরফ থেকে। তিনি গোষ্ঠীপ্রধান। ১৯৭১ সালে এপ্রিলের শুরুতেই রাঙ্গামাটিতে পাকিস্তান থার্ড কমান্ডো ব্যাটেলিয়ান অবস্থান নেয়। স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপের এলিট কমান্ডোদের প্রধান মেজর জহির আলম খান (শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করেছিলেন তিনিই) ত্রিদিব রায়ের সঙ্গে দেখা করে সবধরণের সহায়তার প্রতিশ্রুতি পান। সঙ্গে যোগ দেয় লালডেঙ্গার নেতৃত্বাধীন মিজোদের একটি ব্রিগেড। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে মুক্তিবাহিনী এবং বিএসএফের সম্ভাব্য তৎপরতা এবং তা ঠেকানোর জন্য সহায়তার কথা ছিলো সে প্রতিশ্রুতিতে। শুধু ত্রিদিব রায়ের ব্যক্তিগত দেহরক্ষী দলই নয়, রাঙ্গামাটিতে ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্সেস (ইপিসিএএফ) প্রাথমিকভাবে যোগ দেয় প্রায় শ'তিনেক চাকমা। যুদ্ধশেষে গোটা পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় বাহিনীর হাতে গ্রেফতারের সংখ্যাটা এক মাসে ছিলো দেড় হাজারের ওপর। যদিও সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আওতায় তাদের সবাইকেই পরে ছেড়ে দেওয়া হয়।
৩ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনী আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণার অনেক আগে থেকেই পাহাড় ছিলো উত্তাল। এখানে অপারেশনাল ছিলো মেজর জেনারেল সুজয় সিং উবানের তত্বাবধানে থাকা মুজিব বাহিনীর একটা অংশ (শেখ মনির নেতৃত্বাধীন) এবং উদ্বাস্তু তিব্বতীদের নিয়ে গড়া স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্স। চেহারায় সাদৃশ্য থাকার কারণে (মঙ্গোলয়েড) তিব্বতীরা নভেম্বরের শুরু থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামে অপারেশনে নামে (অপারেশন মাউন্টেন ঈগল)। এই লড়াইয়ে পাকিস্তানীদের পাহাড়ে গাইড এবং ইন্টেলিজেন্স দিয়ে সহায়তার দায়িত্ব পালন করে ইপিসিএএফের চাকমারা।

ত্রিদিব রায় কে ?
ত্রিদিব রায়-এর প্রাথমিক পরিচয় তিনি চাকমাদের রাজা। এমন যদি হতো তিনি শুধু রাঙ্গামাটির চাকমাদের রাজা, বা অন্যরা তাকে রাজা বলে স্বীকার করতো না তাহলে ভিন্ন কথা। কিন্তু রাজার দায় তার গোষ্ঠীর ওপর খানিকটা বর্তায় বৈকি! পার্বত্য চট্টগ্রামের দুয়েকটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা বাদে চাকমারা তাই রাজার নির্দেশই পালন করেছে। কিংবা সে নির্দেশের বিপক্ষে যায়নি। ত্রিদিব রায় শুধু তার গোষ্ঠীকেই সহায়তার নির্দেশ দিয়ে বসে থাকেননি। নিজে মাঠে নেমেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কূটনৈতিক সমর্থন আদায় করতে গেছেন কলম্বো, সেখানে সিংহলীজ ছাত্রদের ধিক্কার শুনে ফিরেছেন। স্বাধীনতার পরপর পাকিস্তানকে সহায়তার জন্য যে ১২ জনের নাগরিকত্ব বাতিল এবং সহায়সম্পত্তি ক্রোক করা হয় আদালতের নির্দেশে সে তালিকায় গোলাম আজমের সঙ্গে রাজা ত্রিদিব রায়ও আছেন। তিনি নাগরিকত্ব ফিরে পেতে কোনো তদবির করেননি। যদিও সহায়সম্পত্তি ফিরে পেয়েছেন।
প্রশ্ন উঠতে পারে যে যুক্তিতে গোলাম আজমের বিচার করা যায়, সেই একই যুক্তিতে ত্রিদিব রায়কেও আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যায় কিনা। যদিও তিনি পাকিস্তানের নাগরিক হিসেবে সে দেশেই রয়ে গেছেন, কয়েকদফা মন্ত্রীত্বের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ধরাছোয়ার বাইরেই। বাকি থাকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহায়তাকারী অক্সিলারি ফোর্সের চাকমারা। কিন্তু তারা অন্যান্য রাজাকারদের মতো সাধারণ ক্ষমা পেয়েছে।
প্রাসঙ্গিক কিছু দালিলিক প্রমাণ যোগ করাটা কর্তব্য মানছি : ব্রিগেডিয়ার (অবঃ) জহির আলম খান পাকিস্তান ডিফেন্স জার্নালে একটি সাক্ষাতকার দিয়েছিলেন যেখানে মুক্তিযুদ্ধের কথাও ছিলো (একাত্তরের মাঝপথে তাকে পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরিয়ে নেওয়া হয়)। সেখানে চাকমাদের সহায়তার বিষয়ে তার উত্তরের খানিকটা তুলে ধরছি :
The Chakma and the Mizo tribesmen co-operated with the Pakistan Army in 1971. You were closely associated with them. How was the experience?
We landed in Rangamati just after nightfall, the next morning I called on Raja Tridiv Roy, the Chakma Chief, He lived in an old bungalow on an island separated from the mainland by a channel about fifty yards wide. I explained to the Raja that the army had come to re-establish the control of the Pakistan Government on the Hill Tracts and asked for his co-operation in maintaining peace and to keep me informed about any rebel movement, concentration, and activity, the Raja agreed and co-operated right upto the surrender. At the request of our government Raja Tridiv Roy came to West Pakistan before our surrender in East Pakistan, he was our ambassador in a number of countries and now lives in Islamabad.
২৬ সেপ্টেম্বর মার্কিন দূতাবাসের গোপন তারবার্তার বরাতে জানা যাচ্ছে যে রাজা ত্রিদিব রায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বিশেষ দূত হিসেবে শ্রীলঙ্কা যান। তারবার্তাটির বিস্তারিত জানা যাবে- The American Papers – Secret and Confidential India-Pakistan-Bangladesh Documents 1965-1973, University Press Limited, p.73 – 733. ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দৈনিক বাংলায় একটি তালিকা ছাপা হয় যেখানে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে সহায়তার অভিযোগে দালাল আইনে অভিযুক্তদের একটি তালিকা প্রকাশ করা হয় নুরুল আমিন, সবুর খান,গোলাম আযমসহ দালালদের সে তালিকায় ৮ নম্বরে ছিলো ত্রিদিব রায়ের নাম।

ইতিহাস কি আড়ালেই থেকে যাবে ?
ব্রিটিশরা ১৮৬০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম দখল করে নেয় এবং ১৮৮১ সালে সমগ্র জেলাকে তিনটি সার্কেলে বিভক্ত করে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে তিন সার্কেলে তিন রাজা ছিল। তাদের মধ্যে ছিল চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়, বোমাং রাজা অং শৈ প্রু চৌধুরী এবং মানিকছড়ির মং রাজা মং প্রু চাঁই চৌধুরী বা (মং প্রু সাইন)। মানিকছড়ির রাজা ছাড়া অন্য দুই রাজাই ছিল যুদ্ধাপরাধী। চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়ের সহযোগিতায় রাঙামাটিতে গণহত্যা চলে। এই সময়ে রাঙামাটি মুক্ত করতে যাওয়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের ছাত্র এবং এফ রহমান হলের আবাসিক ছাত্র ইফতেখারসহ ৮-১০ জনের একদল মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করা হয়। চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় তার বির্তকিত বই The Departed Melody -তে লেখে, ১৯৭১ সালের ১৬ এপ্রিল সকালে সে (রাজা ত্রিদিব রায়) তার ভগ্নিপতি কর্নেল হিউম, ম্যাজিট্রেট মোনায়েম চৌধুরী, মোহাম্মদ হজরত আলী এবং আরও কয়েকজন বাঙালি মুসলিম লীগ নেতাসহ চট্টগ্রামের নতুন পাড়ায় অবস্থিত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেন্টার-এর পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করে। পাকিস্তানি হানাদারদের সঙ্গে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হয় যে, ম্যাজিস্ট্রেট মোনায়েম চৌধুরী এবং রাজা ত্রিদিব রায়ের সঙ্গে আসা আরও কয়েকজন বাঙালি ঢাকা থেকে আসা জুনিয়র অফিসারকে সঙ্গে করে কাপ্তাইয়ে যাবে। ঠিক সেদিনই বিকেলে কাপ্তাই থেকে সেনাবাহিনীর একটি দল কয়েকটি লঞ্চ এবং স্পিডবোট নিয়ে রাঙামাটি আসে এবং বিনা প্রতিরোধে দখল করে নেয়।

উপজাতি রাজাকার সম্পর্কে রেফারেন্সভিত্তিক কিছু গ্রন্থের উদ্ধৃতি
• চট্টগ্রামের বলাকা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত (ফেব্রুয়ারি-২০১১) পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস বইয়ে জামালউদ্দিন লেখেন, …অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, পাক দালাল খ্যাত চিহ্নিত এক উপজাতীয় নেতার (রাজা ত্রিদিব রায়) বিশ্বাসঘাতকতায় ওই দিনই পাকিস্তানি বর্বর বাহিনী রাঙামাটিতে এসে চুপিসারে অবস্থান নেয়, যা মুক্তিযোদ্ধাদের জানা ছিল না। ভারত প্রত্যাগত মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল রাঙামাটি জেলা প্রশাসকের বাংলোর কাছাকাছি পৌঁছার সাথে সাথে সেখানে ওঁৎ পেতে থাকা পাকিস্তানি সৈনিকেরা মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে ফেলে। এই দলের মধ্যে ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইফতেখার (পৃষ্ঠা নম্বর ৩৭৯-৩৮০)।
• এর আগে রাঙামাটি মহকুমা সদরের এসডিও আবদুল আলী কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে দুটি স্পিডবোটে করে মহালছড়ি থেকে রাঙামাটি আসেন। স্পিডবোটে ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা এসএম কালাম, আবদুল শুকুর, শফিকুল ইসলাম, মামুন, শামসুল হক মাস্টার এবং রাঙামাটি হাইস্কুলের তদানীন্তন হেডমাস্টার রহমান আলীর ছেলে ইফতেখার। এর মধ্যে স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করার জন্য আবদুল আলীকে রাঙামাটিতে পুলিশ লাইনের এক ব্যারাকে আটক করে রেখে তার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ব্লেড দিয়ে আঁচড় দেয়া হয়েছিল। এরপর সেসব জায়গায় লবণ দেয়া হয়েছিল। তাছাড়া তাকে একটি জিপের পিছনে বেঁধে টেনে রাঙামাটির বিভিন্ন জায়গায় ঘোরানো হয়েছিল। সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রাম শরবিন্দু শেখর চাকমা, (অঙ্কুর প্রকাশনী, জানুয়ারি-২০০৬ পৃষ্ঠা ২৫)।
• ইফতেখার ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের ছাত্র এবং এফ রহমান হলের আবাসিক ছাত্র। সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নেয়া প্রথম ব্যাচের সদস্য ছিলেন তিনি। তার বাবা যেহেতু রাঙামাটি স্কুলের হেডমাস্টার, তাই রাঙামাটি গিয়ে বাড়ির সবাইকে দেখবেন এবং যুদ্ধ করে তাদের মুক্ত করে আনবেন এমন ইচ্ছায় সে টগবগ করছিলেন তিনি। নিজের ছাত্র ইফতেখার সম্পর্কে আমার একাত্তর (সাহিত্য প্রকাশন, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৭, পৃষ্ঠা নম্বর ৪৮) বইতে অধ্যাপক ডক্টর আনিসুজ্জামান লিখেছেন এই কথা।
• রাজা ত্রিদিব রায় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম থেকেই বাংলাদেশের বিরোধিতা করেছে। বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে বের হওয়া হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র (সশস্ত্র সংগ্রাম-১) নবম খণ্ডের (জুন ২০০৯) ৯৩ পৃষ্ঠায় মেজর জেনারেল (অব.) মীর শওকত আলী বীর উত্তম লেখেন- চাকমা উপজাতিদের হয়তো আমাদের সাহায্যে পেতাম। কিন্তু রাজা ত্রিদিব রায়ের বিরোধিতার জন্য তারা আমাদের বিপক্ষে চলে যায়। অন্যদিকে ১৯৭১ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সংস্থাপন বিষয়ক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম তার বই বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১-এর (মার্চ ২০০৪) ২৬০ পৃষ্ঠায় লেখেন- চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় প্রথম থেকেই নির্লিপ্ত এবং গোপনে পাকিস্তানিদের সাথে যোগাযোগ রাখছেন।
• চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়ের স্বাধীনতাবিরোধিতার আরো নমুনা আমরা পাই বাংলা একাডেমী থেকে বের হওয়া লেফটেন্যান্ট কর্নেল কাজী সাজ্জাদ আলী জহিরের (বীর প্রতীক) বই মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ক্যাপ্টেন আফতাব কাদের বীর উত্তম-এ (ডিসেম্বর ২০০৮)। বইটির ৬৩ পৃষ্ঠায় তিনি লেখেন- মার্চ মাসের প্রথম থেকেই রাজা ত্রিদিব রায় এবং মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা কোনো কারণে মুক্তিকামী বাঙালিদের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলতেন। আফসান চৌধুরী তার বই বাংলাদেশ ১৯৭১ : প্রথম খ–এর ৪১৩ পৃষ্ঠায় (ফেব্রুয়ারি ২০০৭, মাওলা ব্রাদার্স) লেখেন- পূর্বপাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত ১৬২টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং ময়মনসিংহের একটি আসন ছাড়া বাকি ১৬০টি আসনই লাভ করে। ময়মনসিংহ-৮ আসনে পিডিপি নেতা নুরুল আমিন এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বতন্ত্র প্রার্থী চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় আওয়ামী লীগের প্রার্থীর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয়ী হয়।
• ত্রিদিব রায় জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী চারু বিকাশ চাকমার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল, যে আসনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হয়। বলছেন মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক তার পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি প্রক্রিয়া ও পরিবেশ পরিস্থিতি মূল্যায়ন বইয়ের (ফেব্রুয়ারি ২০০১, মাওলা ব্রাদার্স) ৭৭ পৃষ্ঠায়।
• বাঙালির জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম বইয়ে ডা. মাহফুজুর রহমান (মার্চ ১৯৯৩, পৃষ্ঠা ৪৬৭) লিখেছেন, রাজা ত্রিদিব রায়, এস টি হোসেন প্রমুখের নেতৃত্বে রাঙামাটি মুসলিম লীগ তার রাজনীতি চালিয়ে যায়। তপন কুমার দে সম্পাদিত আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা (ফেব্রুয়ারি ২০১০, অন্বেষা প্রকাশন) বইয়ের ৫৩ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে- রাজা ত্রিদিব রায় ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের পক্ষ নেয়। অন্যদিকে আইয়ুব হোসেন এবং চারু হক-এর বই মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসীর (ফেব্রুয়ারি ২০০৮, ঐতিহ্য) ৮২ পৃষ্ঠায়ও রাজা ত্রিদিব রায়ের স্বাধীনতা-বিরোধিতায় প্রমাণ তুলে ধরা হয়েছে।
• রাজা ত্রিদিব রায় মনে করতো, পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হবে না, যদি ভারত পাকিস্তানকে যুদ্ধে পরাস্ত করতে না পারে। আর ভারত পাকিস্তানকে পরাস্ত করতে পারবে না। কারণ পাকিস্তানের সঙ্গে চীন এবং আমেরিকা রয়েছে। তারা কোনদিন পাকিস্তানকে ভারতের কাছে পরাজিত হতে দেবে না। সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রাম, শরবিন্দু শেখর চাকমা (জানুয়ারি ২০০৬, অঙ্কুর প্রকাশনী, পৃষ্ঠা ৩১)।
• এছাড়া চাকমা রাজপরিবার চিরদিনই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির বিরুদ্ধে থেকেছে। বিচারপতি আবু সায়েম দেশের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং রাষ্ট্রপতি হবার পর তিনি রাজা ত্রিদিব রায়ের মা বিনীতা রায়কে তার অন্যতম উপদেষ্টা করেন। সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রাম, শরবিন্দু শেখর চাকমা (জানুয়ারি ২০০৬, অঙ্কুর প্রকাশনী, পৃষ্ঠা ৩৫)।
• রাজা ত্রিদিব রায় মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে পাকিস্তানে চলে যায় এবং বাংলাদেশে স্বাধীন হলে আর দেশে ফিরে আসেনি। সে এখনও পাকিস্তানে আছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয় নিয়ে মাঝে-মধ্যে লেখালেখি করে। করাচি থেকে প্রকাশিত বিখ্যাত ইংরেজি দৈনিক ডন (উঅডঘ) পত্রিকার ৮ অক্টোবর ২০০০ সংখ্যায় তিনি চিটাগাং হিল ট্র্যাক্ট : লেট জাস্টিস বি ডান শিরোনামে একটি নিবন্ধ লেখে- (ইব্রাহিম, পৃষ্ঠা-৭৮) মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে নভেম্বর মাসের ১২ তারিখ তাকে (রাজা ত্রিদিব রায়) ইসলামাবাদ নিয়ে যাওয়া হয় এবং কয়েক দিন পর তাকে পাকিস্থানের সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে প্রথম শ্রীলঙ্কা, পরে বার্মা, থাইল্যান্ড প্রভৃতি বৌদ্ধ রাষ্ট্রে পাকিস্তানের পক্ষে প্রচারণা চালানোর জন্য পাঠানো হয়। (শরবিন্দু শেখর চাকমা, পৃষ্ঠা ৪১)।
• উইকিপিডিয়ার সূত্র মতে, বাংলাদেশের অধিবাসী কিন্তু পাকিস্তানের নাগরিক হিসেবে অধ্যাপক গোলাম আযমের পরই আছে রাজা ত্রিদিব রায়। সে বর্তমানে ফেডারেল মন্ত্রী হিসেবে ইসলামাবাদে বাস করছে এবং সেখানকার বুড্ডিস্ট সমাজকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। সে আর্জেটিনা ও শ্রীলঙ্কায় পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হিসেবেও কাজ করেছে।
• অন্য যুদ্ধাপরাধী বোমাং সার্কেলের রাজা অং শৈ প্রু চৌধুরীও ছিল স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী। প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য ও মন্ত্রী এই রাজা পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করে এবং হানাদার বাহিনীর সক্রিয় সদস্য ছিল। সে ১৯৬৫ সালে মুসলিম লীগের টিকিটে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রিসভায়ও যোগ দিয়েছিল। তার পরিবারের লোকজনও পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করে। তবে বোমাং রাজা অং শৈ প্রু চৌধুরী স্বাধীনতার পর জেলে বন্দি হয়। (ইব্রাহিম পৃষ্ঠা- ৭৮)। হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, সপ্তম খ-ের (জুন ২০০৯) ৫৪০ পৃষ্ঠায় আছে, পাকিস্তান সরকারের তৎকালীন মন্ত্রিসভায় একজন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হিসেবে মনোনীত হয় বোমাং রাজা অং শৈ প্রু চৌধুরী। প্রদেশের মনোনীত সংখ্যালঘু মন্ত্রী অং শৈ প্রু অন্য সবার সাথে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে পারেনি। কারণ সে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা আসার জন্য নির্দিষ্ট বিমানে আরোহণ করতে পারেনি। তাকে বন, সমবায় ও মৎস্য দফতরের দায়িত্ব দেয়া হয়। সে সংখ্যালঘু বিষয়ও দেখাশোনা করেছে।
• চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় এবং বোমাং রাজা অং শৈ প্রুর নাম বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে তৈরি যুদ্ধাপরাধীর তালিকায় রয়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের বই যুদ্ধাপরাধ-এর (ফেব্রুয়ারি ২০০৮) ৮১ পৃষ্ঠায় এই দুই রাজার নাম জ্বলজ্বল করছে তাদের সেই সময়ের সহযোগী গোলাম আযম, আলী আহসান মুজাহিদ বা ফজলুল কাদের চৌধুরীর নামের পাশে। অন্যদিকে ডা. এমএ হাসানের বই যুদ্ধাপরাধীর তালিকা ও বিচার প্রসঙ্গতেও (ফেব্রুয়ারি ২০০৯, তাম্রলিপি, পৃষ্ঠা ১৫২) আছে দুই রাজাকার রাজার নাম। তাদের রাজাকার নম্বর ৯৪৮ এবং ৯৫২ : 948. Mr. Raja Tridiv Roy, Father Late Raja Nalinakhya Roy, Village Rajbari Rangamati, Thana Kotwali, Chittagong. 952. Mr. Aung Shwe Prue Chowdhury, Father Thwi Aung Prue, Village Bandarban, Bandarban, Bandarban.
• শুধু রাজা নয়, চাকমা যুবকরা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান নেন এবং সিভিল আর্মড ফোর্স বা সিএএফ অথবা রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেয়। চাকমা যুবকদের রাজাকার বাহিনীতে প্রশিক্ষণ নেয়া প্রসঙ্গে মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম বীর প্রতীক তার পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি প্রক্রিয়া ও পরিবেশ পরিস্থিতি মূল্যায়ন বইয়ের ৭৭ পৃষ্ঠায় লেখেন- উপজাতীয় যুবকদের কিছুসংখ্যক মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলেও অধিকাংশই পকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক গঠিত সিভিল আর্মড ফোর্স বা সিএএফ (রাজাকার বাহিনী হিসেবে পরিচিত)-এ যোগ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী তৎপরতায় অংশ নেয়। তৎকালীন রাজাকার বাহিনীতে চাকমাদের সংখ্যাই বেশি ছিল। অনেকেই বেতন এবং অস্ত্রের লোভে সিএএফে যোগ দেয়। রাজা ত্রিদিব রায় তার সার্কেলে বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে গিয়ে জনগণকে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহায়তা করার জন্য প্রচারণা চালাতে থাকে। চাকমা যুককেরা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, পানছড়ি প্রভৃতি এলাকায় স্থাপিত পাকিস্তানি ট্রেনিং ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। উপজাতিদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষক হিসেবে ছিল রাজশাহী বিভাগ থেকে পালিয়ে আসা ইপিআরের হাবিলদার মিস্টার নলিনী রঞ্জন চাকমা এবং হাবিলদার মিস্টার অমৃতলাল চাকমা। এরা প্রশিক্ষণের পাশাপাশি দোভাষীর কাজও করতো। উপজাতি যুবকেরা টেনিং ক্যাম্প ৩০৩ রাইফেল, কারবাইন, স্টেনগান, এলএমজি চালনার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতো। আফসান চৌধুরী লিখেছেন- (বাংলাদেশ ১৯৭১ : প্রথম খ-, ফব্রে. ২০০৭, মাওলা ব্রাদার্স, পৃষ্ঠা ৪৩২) : উপজাতি অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামে মিজো এবং চাকমা উপজাতি পাক সৈন্যদের সাহায্য করে।
• বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, উপজাতিচাকমা রাজাকারদের নিয়ে সবচেয়ে মজার দুটি উদাহরণ পাওয়া যায়। তপন কুমার দে সম্পাদিত বই উপজাতি মুক্তিযোদ্ধা (ফেব্রু-২০১০, পৃষ্ঠা ৫৩) এবং তার দুবছর আগে প্রকাশিত আইয়ুব হোসেন ও চারু হকরে বই মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসীতে (ফেব্রুয়ারি ২০০৮ পৃষ্ঠা ৮৩) লেখক- সম্পাদক তনিজন একটি শব্দও পরিবর্তন না করে লেখেন- মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ থেকে বঞ্চিত হয়ে পরবর্তীকালে এদের (চাকমাদের) মধ্যে কেউ কেউ হতাশাগ্রস্ত হয়ে ও পাকসেনার ইন্ধনে সিভিল আর্মড ফোর্স অথবা রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেন।

জামাতী রাজাকার ও উপজাতি রাজাকারের মধ্যে কি কোনো তফাত আছে ?
কিন্তু প্রশ্ন হলো, দেশ স্বাধীন করতে আসা কোনো মুক্তিসেনা কি হতাশ হয়ে শক্রপক্ষের থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজ দলের উপর সশস্ত্র হামলা চালাতে পারে বা প্রশিক্ষণও কি নিতে পারে? যদি করে তাহলে তাদের মাঝে আর জামাতীদের মাঝে পার্থক্যটা কোথায়? জামাতী রাজাকারদের ন্যায় তারাও কী তাহলে রাজাকার যুদ্ধাপরাধী বলে গণ্য হয় না? স্বাধীন বাংলাদেশে সঙ্গতকারণেই কী জামাতী রাজাকারদের ন্যায় এসব আদিবাসী দাবিদার রাজাকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হওয়া উচিত নয়?
আদিবাসী দাবিদার রাজাকার যুদ্ধাপরাধীদের বংশধররা বংশ পরস্পরায় বাংলাদেশের বিরোধিতা করে আসছে। বর্তমান তাদেরই আবার দেশের প্রতিনিধি বানানো হয়েছে জাতিসংঘে। যুদ্ধাপরাধী চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় এবং বিচারপতি সায়েমের উপদেষ্টা ত্রিদিব রায়ের মা বিনীতা রায়ের বংশধর এবং উত্তরাধিকারী ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে। মইত্যা রাজাকার ও মইজ্যা রাজাকারের মতো তার গাড়িতেও বাংলাদেশের পতাকা উড়েছে। সে সম্প্রতি মেক্সিকোর কানকুনে শেষ হয়ে যাওয়া জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি দলের পক্ষে কাজ করেছে। জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক সংগঠন ইউএনএফসিসিসি এবং ইউ এন পার্মানেন্ট ফোরাম অন ইনডিজিনাস ইস্যুর বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছে। রাজাকার ফজলুল কাদের চৌধুরীর পুত্র হিসেবে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ওআইসির মহাসচিব পদের জন্য নির্বাচন করায় দেশের ভাবমর্যাদা নষ্ট হয়েছে তাহলে কেন ত্রিদিব রায়ের মতো প্রমাণিত রাজাকারের পুত্র বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবে? এখন তো মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে উজ্জীবিত সরকার। এ সময়েও কেন আদিবাসী দাবিদার রাজাকার যুদ্ধাপরাধের কেন বিচার হবে না?

উপজাতিদের আদিবাসী শব্দ উদ্দেশ্যমূলক
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আদিবাসী শব্দটি উদ্দেশ্যমূলক ও দুরভিসন্ধিমূলক। জাতিসংঘের স্পেশাল রাযাপের্টিয়ার মি. হোসে মার্টিনেজ কোবোর যে সংজ্ঞা জাতিসংঘ ওয়ার্কিং ডেফিনেশন হিসেবে ১৯৮৪ সালে গ্রহণ করেছে, তাতে বলা হয়েছে: আদিবাসী সম্প্রদায়, জনগোষ্ঠী ও জাতি বলতে তাদের বোঝায় যাদের ভূখন্ডে প্রাক-আগ্রাসন এবং প্রাক-উপনিবেশিককাল থেকে বিকশিত সামাজিক ধারাসহ ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা রয়েছে, যারা নিজেদের উক্ত ভূখন্ডের কিয়দাংশে বিদ্যমান অন্যান্য সামাজিক জনগোষ্ঠী থেকে স্বতন্ত্র মনে করেন। বর্তমানে তারা সমাজে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীভুক্ত এবং নিজস্ব সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য, সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও আইনি ব্যবস্থার ভিত্তিতে জাতি হিসেবে তাদের ধারাবাহিক বিদ্যমানতার আলোকে তারা তাদের পূর্ব-পুরুষদের ভূখ- ও নৃতাত্ত্বিক পরিচয় ভবিষ্যৎ বংশধরদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
মোট কথা, আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী বলতে তাদের বোঝায় যারা বহিরাগত কর্তৃক দখল বা বসতি স্থাপনের পূর্ব থেকে নির্দিষ্ট ভূখন্ডের মূল অধিবাসীর বংশধর। এদিকে ১৯৮৯ সালে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ১৬৯ নং কনভেনশনে বলা হয়েছে: স্বাধীন দেশসমূহের জাতিসমূহ, যারা এই মর্মে আদিবাসী হিসেবে পরিগণিত যে, তারা ওই দেশটিতে কিংবা দেশটি যে ভৌগোলিক ভূখন্ডে অবস্থিত সেখানে রাজ্য বিজয়, কিংবা উপনিবেশ স্থাপন, কিংবা বর্তমান রাষ্ট্রীয় সীমানা নির্ধারণকাল থেকে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর বংশধর, যারা তাদের আইনসঙ্গত মর্যাদা নির্বিশেষে নিজেদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কাঠামোর অংশবিশেষ বা সম্পূর্ণ লালন করে চলেছেন। বিশ্ব ব্যাংক কার্যক্রম নীতিমালায় আদিবাসী শব্দটি সার্বিক অর্থে স্বতন্ত্র ঝুঁকিগ্রস্ত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এক জনগোষ্ঠীকে বোঝানো হয়েছে, যাদের মধ্যে বিভিন্ন মাত্রায় এই বৈশিষ্ট্যগুলো বিদ্যমান থাকে:
১. একটি স্বতন্ত্র আদিবাসী সংস্কৃতির অধিকারী জনগোষ্ঠী হিসেবে যারা নিজেদের মনে করেন এবং অন্যরাও এই পরিচিতির স্বীকৃতি দেন, ২. প্রকল্প এলাকায় ভৌগোলিকভাবে পৃথক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আবাসভূমি অথবা পুরুষানুক্রমিকভাবে ব্যবহৃত ভূখ- এবং এতদাঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদের সাথে যাদের যৌথ সম্পৃক্ততা রয়েছে, ৩. তাদের প্রথাগত সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দেশের প্রধানতম সমাজ ও সংস্কৃতি থেকে আলাদা এবং ৪. যাদের একটি ভাষা রয়েছে, যা সচরাচর দেশের সরকারি ভাষা বা ওই অঞ্চলের প্রচলিত ভাষা থেকে পৃথক।
আন্তর্জাতিক সংজ্ঞানুসারে, যারা সংশ্লিষ্ট অঞ্চল, ভূমি বা দেশের প্রথম আদিবাসী; উপনিবেশিক ও বৈশ্বিক পরিবর্তন বা কর্তৃত্ববাদী জনগোষ্ঠীর আগ্রাসনের শিকার, যাদের সাংস্কৃতিক ও আর্থসামাজিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে স্বতন্ত্রভাবে চিহ্নিত করা যায় এবং যাদের স্বকীয় নৃ-তাত্ত্বিক পরিচয় ধরে রাখার প্রচেষ্টা রয়েছে, তাদের আদিবাসী জনগোষ্ঠী হিসেবে আখ্যায়িত হবে। অন্যদিকে Indigenous People, A Global Quest for Justice, A Report for the Independent Commission on International Humanitarian Issues

গ্রন্থে আদিবাসীর চারটি প্রধান বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ রয়েছে:
১. পূর্ব থেকেই নির্দিষ্ট স্থানে বা ভূখণ্ডে অন্যান্য জনগোষ্ঠীর আগমনের আগে বসতি স্থাপন, ২. আধিপত্য বিস্তারকারী গোষ্ঠী নয়, ৩. স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য এবং ৪. নিজেরা নিজেদের আদিবাসী পরিচয়ে পরিচিত করতে চান।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বাংলাদেশে কোন আদিবাসী নেই। জাতিসংঘকে এমন স্পষ্ট তথ্য দেয়া হয়েছে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে। এছাড়া ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে যে শান্তিচুক্তি করা হয়েছে তার বাস্তবায়ন নিয়ে আদিবাসী বিষয়ক জাতিসংঘের স্থায়ী ফোরাম যে কথা বলেছে তার সঙ্গে বাংলাদেশ দ্বিমত পোষণ করেছে।
জাতিসংঘে নিয়োজিত বাংলাদেশের ফার্স্ট সেক্রেটারি ইকবাল আহমেদ এ কথা বলেছেন জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক গত ১৬ই মে অনুষ্ঠিত হওয়া বিশেষ সম্মেলনে। লার্স অ্যান্ডার্স বায়ের বাংলাদেশের উপর যে রিপোর্ট তৈরি করেছে তা নিয়ে ওই সম্মেলনে আলোচনার কথা। কিন্তু বাংলাদেশ এতে কোন সরকারি প্রতিনিধি পাঠায়নি। গালফ টাইমসে প্রকাশিত এক রিপোর্টে এসব কথা বলা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়, ইকবাল আহমেদ ওই সম্মেলনে বলেছেন, বাংলাদেশে কোন আদিবাসী নেই। শান্তিচুক্তি দিয়ে আদিবাসীদের জন্য করার কিছুই নেই। তিনি বলেন, বাংলাদেশ বারবার তার অবস্থান স্পষ্ট করেছে। এই ফোরাম হলো আদিবাসীদের বিষয় নিয়ে আলোচনার। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি নিয়ে কথা বলার জায়গা নয়। আমরা এই ফোরামের কাছে আহ্বান জানাবো- তারা যেন সারা বিশ্বের কোটি কোটি আদিবাসীর সমস্যা নিয়ে মূল্যবান সময় খরচ করে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক কোন কোন মহলে প্রশ্ন সৃষ্টি হতে পারে- এমন বিষয় নিয়ে যেন সময় নষ্ট না করা হয়।

যেসব কারণে উপজাতিরা আলোচনায়
ওদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা সম্প্রদায়ের প্রধান রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় বলেছে, এই ফোরাম আদিবাসীদের ইস্যু নিয়ে আলোচনার জায়গা। তা সরকার উপজাতি, সংখ্যালঘু জাতিসত্তা বা অন্য কিছু নিয়ে যা-ই বলুক। শান্তিরক্ষা মিশনে অন্তর্ভুক্ত করার আগে প্রতিটি দেশের সেনাবাহিনীর মানবাধিকার রেকর্ড খতিয়ে দেখার সুপারিশ করেছেন জাতিসংঘের একজন পর্যবেক্ষক। নিউইয়র্কে আদিবাসী বিষয়ক জাতিসংঘের স্থায়ী ফোরামে (ইউএনপিএফআইআই) পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক দশম অধিবেশনের দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ বৈঠকে ফোরামের সাবেক সদস্য লার্স অ্যান্ডার্স বায়ের এ সুপারিশ করে বলে জাতিসংঘের ওয়েবসাইটে জানানো হয়। ১৯৯৭ সালের পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের অগ্রগতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করে তিনি বলেন, সেখানে আদিবাসীদের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। ইউএনপিএফআইআই-এর সাবেক সদস্য লার্স অ্যান্ডার্স বায়ের গত বছরের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশে মন্ত্রিসভার সদস্য, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও পার্বত্য এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে ১৯৯৭ সালের পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের অগ্রগতি শিরোনামে ওই প্রতিবেদন তৈরি করেন। ফোরামের নবম অধিবেশনে বাংলাদেশের উপর প্রতিবেদনটি তৈরির দায়িত্ব পান তিনি। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের কার্যনির্বাহী পর্ষদকে বায়ের প্রস্তাব দিয়েছে, "কোন দেশের সেনা সদস্যদের জাতিসংঘের পৃষ্ঠপোষকতায় শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণের অনুমোদন দেয়ার আগে অবশ্যই তাদের মানবাধিকার ইতিহাস নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।" চলতি বছর ১৮ই ফেব্রুয়ারি উপস্থাপিত ওই প্রতিবেদনে স্থায়ী ফোরামের দ্বাদশ অধিবেশন আদিবাসীদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে কৌশলগত আলোচনা আয়োজনেরও সুপারিশ করা হয়। তবে জাতিসংঘ বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারি ইকবাল আহমেদ আদিবাসী ফোরামের দশম অধিবেশনে পার্বত্য চুক্তি বিষয়ে প্রতিবেদন উপস্থাপনের বিরোধিতা করে বলেন, বাংলাদেশে কোনো আদিবাসীই নেই। পার্বত্য শান্তি চুক্তি বিষয়ে আলোচনার এখতিয়ারও জাতিসংঘ আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরামের নেই। তাই জাতিসংঘের আদিবাসী ফোরামের উচিত মূল্যবান সময় নষ্ট না করে প্রকৃত আদিবাসীদের জন্য কাজ করা।
বাংলাদেশ প্রতিনিধির এ বক্তব্যের পরও ডেনমার্ক, গুয়াতেমালা ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো পার্বত্য শান্তি বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়েছে। তারা বলেছে, বাংলাদেশ সরকার যেন চলমান সংবিধান সংশোধনে তাদের আদিবাসী হিসেবে কবুল করে নেন। তবে এ দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন ইকবাল আহমেদ। তিনি বলেন, ১৯৯৭ সালে সই করা চুক্তিতে আদিবাসী বিষয়ে কিছু উল্লেখ করা হয়নি। আদিবাসীবিষয়ক স্থায়ী ফোরামের এখতিয়ার আদিবাসীদের বিভিন্ন বিষয় দেখভাল করা, বাংলাদেশের পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে নাক গলানো নয়।লার্স অ্যান্ডার্স বায়েরের প্রতিবেদনের ৫৬ ও ৫৮(এ) অনুচ্ছেদের বিষয়টি তুলে ধরে ইকবাল আহমেদ বলেন, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে যোগদানের আগে মানবাধিকারের প্রতি সেনাসদস্যরা কতটা শ্রদ্ধাশীল ছিলেন, তা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণের উপায় খোঁজার কথা বলা হয়েছে প্রতিবেদনের ৫৬ অনুচ্ছেদে। অন্য দিকে ৫৮(এ) অনুচ্ছেদে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সাথে জড়িত বাংলাদেশের সেনাসদস্যদের জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে না নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। পার্বত্য চুক্তি বিষয়ে প্রতিবেদন তৈরিকে স্বার্থান্বেষী মহলের ষড়যন্ত্র বলে উল্লেখ করে ইকবাল আহমেদ বলেন, ষড়যন্ত্রে সময় নষ্ট না করে বিশ্বের লাখ লাখ আদিবাসীর সমস্যা সমাধানে মূল্যবান সময় কাজে লাগানোর জন্য আমরা আদিবাসীবিষয়ক স্থায়ী ফোরামের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। বাংলাদেশ প্রতিনিধির বক্তব্য শেষে ডেনমার্ক ও গুয়াতেমালার সরকারি প্রতিনিধি, এশিয়া অঞ্চলের আদিবাসী প্রতিনিধিদল, আন্তর্জাতিক আদিবাসী সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো অভিযোগ তোলে, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে বাংলাদেশ যথেষ্ট উদ্যোগ নেয়নি।
কেবল আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি নয়, আইএলও সনদ ১৬৯ অনুস্বাক্ষরের জন্য বাংলাদেশের উপর চাপ দিয়েছে জাতিসঙ্ঘের আদিবাসী ফোরাম। তারা আইএলও সনদের ১৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী উপজাতি বা আদিবাসীদের ঐতিহ্যগতভাবে ব্যবহৃত ভূমির মালিকানা বা দখলদারিত্বের অধিকার নিশ্চিত করবে সরকার। সনদের ১৩ অনুচ্ছেদে উপজাতি বা আদিবাসীদের সংস্কৃতি ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের সাথে সম্পৃক্ত ভূমি বা অঞ্চলের প্রতি সরকারকে শ্রদ্ধাশীল হয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। সূত্র মতে, বর্তমানে উপজাতিরা পার্বত্য চট্টগ্রামে তাদের মালিকানাধীন জমির অতিরিক্ত বিভিন্ন স্থানে ধর্মীয় উপাসনালয় গড়ে নিজেদের দখলে নেয়ার প্রক্রিয়া চালাচ্ছে। পাহাড়ি-বাঙালি সঙ্ঘাতের এটি অন্যতম একটি কারণ। আইএলও সনদ ১৬৯ অনুস্বাক্ষর করলে ঐতিহ্যগতভাবে ব্যবহৃত ভূমি বা সংস্কৃতি ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের সাথে সম্পৃক্ত ভূমি বা অঞ্চল হিসেবে উপজাতিদের এ দখলপ্রক্রিয়াকে স্বীকৃতি দিতে হবে। এ কারণে সরকার সনদটি অনুস্বাক্ষরে বিরত রয়েছে।

লেখক : এম. মিজানুর রহমান সোহেল সম্পাদক, ফ্রাইডে ঢাকা টাইমস m.mrsohel@yahoo.co.uk