ভূমিকম্পে হাইরাইজ বিল্ডিং-এ আমি এবং মৃত্যুর প্রস্তুতি, অত:পর নতুন জীবন!!!

এম. মিজানুর রহমান সোহেল
Published : 19 Sept 2011, 05:14 AM
Updated : 19 Sept 2011, 05:14 AM

ঘড়ির কাটায় সন্ধা ৬ টা ৪০ মিনিট। আমি তখন মগবাজারের আগোরা (গুলফিশা প্লাজা) ১৫ তালা বিল্ডিং এর ১৩ তালায় আমার অফিসে অবস্থান করছি। আমার বন্ধু রাজিবের সাথে অফিসের খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কথা বলছি । কিন্তু অবাক করার কথা হচ্ছে এমন গুরুত্বপূর্ণ মুহুর্তে রাজিব আমার চেয়ার নড়াচ্ছে। আমি স্থির হয়ে তার দিকে তাকিয়ে দেখছি সে আমাকে শুধু শুধু নড়াচ্ছে কেন ? তাকিয়ে দেখি সে নিজেও নড়ছে ! ভাবলাম ভূতে ধরলো নাকি রাজিবকে ? ও দুলছে কেন ? আরে আমিও তো দুলছি !! হটাত আমার মাথায় প্রচন্ড পেইন শুরু করলো। কিছুক্ষণ পর আবিষ্কার করতে পারলাম আমাদের বিল্ডিং টা খুব জোরে-সরে দুলছে। তার মানে আমরা ভূমিকম্পের কবলে পড়েছি ? আমি রুম থেকে তাড়াহুড়া করে বের হতে না হতেই দেখি পাশের রুম থেকে আমার আরেক বন্ধু আরিফ (ওর আগামী শুক্রবার বিয়ে হওয়ার কথা) ভূমিকম্পের কথা বলে ঝটফট লাফিয়ে লাফিয়ে বের হচ্ছে। এবার আরো নিশ্চিত হলাম সত্তি সত্তি ভূমিকম্প হচ্ছে । আমরা তিন বন্ধু খালি হাতে দৌড় দিলেও অন্য অনেককেই দেখলাম এই কেয়ামত মার্কা মুহুর্তে নিজের যা কিছু অফিসে ছিল তা গুছিয়ে নিচ্ছে !

রুম থেকে অন্যদের মতো আমিও বের হলাম। আমরা ১৩ তালায় হাইরাইজ বিল্ডিং-এ। এখন কোথায় গেলে নিরাপত্তা অনুভব করতে পারবো ? লিফট তখনো চলছে। কেউ দৌড় দিয়ে লিফটে উঠলো। কেউ ১৩ তালা থেকে পরি-মরি করে সিড়ি দিয়ে নেমে গেল। কেউ লাফিয়ে লাফিয়ে উপরে উঠে গেল। কিন্তু আমি কি করবো ? নিচে নাকি উপরে যাবো ? উপরে যাওয়াটায় মনে হয় ভালো হবে। কিন্তু সমস্যা অন্য জাগায়। আমি কোনো দিনই এ বিল্ডিং-এর সাদে উঠিনি। সাদ খোলা কিনা তাও জানি না । না জেনেই আনমনে উঠে গেলাম ১৫ তালা বিল্ডিং-এর সাদে। ভাগ্গিস সাদ খোলা ছিল। আল্লাহর নাম নিতে নিতে সাদে চলে আসলাম। দেখলাম অনেকেই এসেছে এই শিবিরে। আরিফ বিল্ডিং এর কোনায় গিয়ে দেখছে অন্য বিল্ডিং গুলো সিনেমার মত ভেঙে ভেঙে পড়ছে কিনা (!) আর রাজিব সাদের উপরের একটি রড বন্দরের মত ঝুলে আছে । তখন ভূমিকম্প তার মাত্রা তুঙ্গে তুলেছে । ১৫ তালা যে ভাবে নড়ছে মনে হচ্ছিলো এখনই ভেঙে পড়বে। সবাই কালেমা পড়ছে। আমি কিছুই মনে করতে পারছি না। আমার বুদ্ধি লোপ পেয়ে গেছে। আমি মোটা-মুটি প্রস্তুত মৃত্যুর জন্য। কয়েক বার সবার সাথে আমিও শেষ বারের মত কালেমা পড়ে নিলাম। সারা শরীর ভয়ে কম্পিত হচ্ছে। এই বুঝি এখনই ইংলিশ মুভির মত আমাদের বিল্ডিংটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে।

আতংকিত সময়টুকু পার করতে যেন আমাদের কয়েক যুগ সময় লেগেছে । ভূমিকম্প অনুভূতি যখন শেষ হয়ে এলো তখন ক্রমশঃ আস্তে আস্তে আমার সব কিছু মনে হচ্ছিলো । ঝাপসা আর ধাধানো কল্প যুগ থেকে ধীরে ধীরে সুস্থ জীবন ফিরে পেলাম। নিজেকে চিমটি কেটে দেখলাম আমি সত্তি সত্তি বেচেঁ আছি তো ? কারণ আমি জানতাম কোনো ভাবেই আমি আর এই সুন্দর পৃথিবীতে ফিরে আসতে পারবো না । একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে সাদ থেকে নিচে চলে এলাম। মৃত্যুর খুব কাছা-কাছি থেকে সামান্য অনুভূতি নেওয়ার পর একদম নতুন একটি জীবন ফিরে পেলাম। ১৩ তালায় এসে আমার একমাত্র সন্তান সাইফকে ভিশন মিস করছিলাম। কিন্তু ততক্ষণে মোবাইল নেটওয়ার্কে কল ফেইল দেখাতে শুরু করেছে। অনেকক্ষণ চেষ্টা করে অবশেষে আমার আত্মার খোঁজ নিয়ে জানলাম তারা ভালো আছে। মাকে ফোন করে জানলাম মা ভয় পেলেও কোনো সমস্যা হয়নি। অন্য সব বন্ধুদেরও খোঁজ-খবর নিয়ে জেনেছি প্রত্যেকেই ভালো আছে। আমি শুধু হাইরাইজ বিল্ডিং এ ছিলাম বলে আমার ভূমিকম্পের অনুভূতিও ছিল বেশি ভয়ও ছিল বেশি।

উল্লেক্ষ্য গত ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১১ রোববার বাংলাদেশের ইতিহাসে সব থেকে বেশি সময় ধরে এবং সব থেকে বড় ভূমিকম্প হয় বাংলাদেশসহ ভারত ও নেপালে। রিখটার স্কেলে ৬.৯ মাত্রার এই ভূমিকম্পের কেন্দ্র ছিল ভারতের সিকিম থেকে ৬৯ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে এবং ঢাকা থেকে ৪৯৫ কিলোমিটার দূরে। যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা- ইউএসজিএসের তথ্য অনুযায়ী সন্ধ্যা ৬টা ৪০ মিনিটে শুরু হওয়া এ ভূমিকম্পের স্থায়িত্ব ছিল কয়েক সেকেণ্ড। ভূমিকম্পের পরপর ইউএসজিএসের ওয়েবসাইটে এর মাত্রা ৬ দশমিক ৮ বলা হলেও পরে তা সংশোধন করে ৬ দশমিক ৯ উল্লেখ করা হয়।

ভূমিকম্পের কেন্দ্র ছিল সিকিম-নেপাল সীমান্তের মঙ্গম ও সাক্যং নামক স্থানে যার দূরত্ব গ্যাংটক থেকে ৫০ কিলোমিটারের বেশি। কেন্দ্রস্থলটি ভারতের শিলিগুড়ি থেকে ৬৯ কিলোমিটার উত্তর উত্তর-পশ্চিমে, নেপালের নামচে বাজার থেকে ১৩৩ কিলোমিটার পূর্বে এবং ভূটানের থিম্পু থেকে ১৬৬ কিলোমিটার পশ্চিমে।

এর আগে গত ২৭ অগাস্ট চাঁদপুর অঞ্চলে ৪ মাত্রায়, ২৮ জুলাই নওগাঁ অঞ্চলে ৪ দশমিক ৪ মাত্রার ভূকম্পন অনুভূত হয়।

২২ জুলাই বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী অঞ্চলে ৪ দশমিক ১ মাত্রার, ১৫ জুলাই নেপাল-চীন সীমান্ত অঞ্চলে ৪ দশমিক ৪ মাত্রার, ১৪ জুলাই রাঙ্গামাটি অঞ্চলে ৩ দশমিক ২ মাত্রার, ১০ জুলাই মায়ানমারে ৪ দশমিক ২ মাত্রার এবং ১০ জুলাই মায়ানমারে ৪ দশমিক ৮ মাত্রায় ভূকম্পন অনুভূত হয়।