দেশে চলছে গুপ্তহত্যার প্রতিযোগিতা

এম. মিজানুর রহমান সোহেল
Published : 11 Dec 2011, 02:17 AM
Updated : 11 Dec 2011, 02:17 AM

গুপ্তহত্যা-পরিস্থিতি এখন উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। মাঝেমধ্যেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তরুণ-যুবকদের ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কয়েক দিন পর কারও লাশ মিলছে, কেউ বা নিখোঁজই থাকছেন।
সরকারি কোনো বাহিনী এর দায় নিচ্ছে না। আবার এসব ঘটনার কোনো কিনারাও হচ্ছে না। কারা বা কোন সন্ত্রাসী বাহিনী এসব ঘটাচ্ছে, তার কোনো তদন্তও হচ্ছে না। ফলে এ নিয়ে জনমনে আতঙ্ক-উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, 'গুপ্তহত্যার বিষয় নিয়ে আমরা খুবই উদ্বিগ্ন। এ নিয়ে সরকারের সর্বোচ্চ মহলে কথা বলেছি। কিন্তু তাঁরা কিছুই বলতে পারেননি।'
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই উপদেষ্টা আরও বলেন, 'সব ঘটনার ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে, সাদা পোশাকের লোকজন এসব করছে। সেটা যদি সত্যি হয়, তাহলে দেশের জনগণের জন্য এটা খুবই উদ্বেগের। আর যদি তর্কের খাতিরে ধরে নিই এর সঙ্গে রাষ্ট্র জড়িত নয়, তাহলে যারা করছে, তারা কি রাষ্ট্রের চেয়েও শক্তিশালী?'
ঢাকা ও আশপাশের এলাকা থেকে এক বছরে (২০১১) ২২ জন নিখোঁজ হওয়ার তথ্য প্রথম আলোর কাছে রয়েছে। নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনেরা এসব ঘটনার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অভিযুক্ত করেছেন। এই ২২ জনের মধ্যে ১০ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তবে থানাগুলোতে নিখোঁজ ও অপহরণের অভিযোগে দায়ের হওয়া এ ধরনের মামলা ও জিডির (সাধারণ ডায়েরি) সংখ্যা আরও বেশি বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।
এভাবে মানুষ নিখোঁজ হওয়া ও গুপ্তহত্যার শিকার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হাসান মাহমুদ খন্দকার প্রথম আলোকে বলেন, শুধু অপহরণ নয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে আরও অনেক ধরনের অপরাধ হয়। অপরাধের সময় পুলিশ বা অন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নাম ব্যবহার করা অপরাধীদের একটা ধরন।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নামেও যে গুপ্তহত্যার মতো ভয়ংকর অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে, এ কথা এখন পুলিশ কর্মকর্তারা প্রকাশ্যেই স্বীকার করছেন। তাহলে কি বলা যায়, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুব খারাপ? সন্ত্রাসী বাহিনী এ ধরনের অপকর্ম করছে আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নীরব থাকছে? দায়িত্বশীল পুলিশ কর্মকর্তারা এসব প্রশ্নের জবাব দিতে চাননি।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশ কর্মকর্তারা বলেন, এ রকম ভয়াবহ পরিস্থিতির আশঙ্কা তাঁরা আগেই করেছিলেন। গত বছরের ৪ মে পুলিশের ত্রৈমাসিক অপরাধ পর্যালোচনা সভায় কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, কোনো এক বাহিনীর নাম করে লোকজনকে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এরপর তাঁর লাশ পাওয়া যাচ্ছে যেখানে-সেখানে। এভাবে কোনো বাহিনীর নাম করে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড হতে থাকলে সেটা ভয়ংকর আকার ধারণ করতে পারে।
মানবাধিকার সংগঠনের হিসাব: আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর ছয়জন গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছিলেন। চলতি বছরের নয় মাসে ১৫ জন নিখোঁজ হন। এঁদের মধ্যে পাঁচজনের লাশ উদ্ধার করা হয়। অধিকার-এর হিসাবে চলতি বছরের নয় মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে ১৭ জনকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর তাঁরা এখন পর্যন্ত ফিরে আসেননি। ২০১০ সালে সারা দেশে এভাবে ১৬ জন নিখোঁজ হন।
বিশেষজ্ঞ মত: আইনজ্ঞ শাহ্দীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, 'গুম হয়ে যাওয়া ও গুপ্তহত্যার ঘটনা ঘটতে থাকার মানে ব্যর্থ রাষ্ট্রের পদধ্বনি শোনা। ক্রসফায়ার যে ক্রমান্বয়ে এমন দিকেই এগিয়ে যাবে, সেটা মোটামুটি পরিষ্কার ছিল।'
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, এ ধরনের ঘটনার ক্ষেত্রে লোকে সন্দেহের আঙুল তুলতেই পারে। তবে এগুলো যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীই করছে, এই যোগসূত্র স্থাপন করাটা দুরূহ। পুলিশের উচিত সুষ্ঠু তদন্ত করে সঠিক তথ্য উদ্ঘাটন করা।
নিখোঁজ: রাজধানীর পুরানা পল্টন লাইনে বাসার নিচ থেকে ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক নেতা কে এম শামীম আকতারকে গত ২৯ সেপ্টেম্বর সকালে মুখে স্কচটেপ মেরে মাইক্রোবাসে ধরে নিয়ে যায় অজ্ঞাত ব্যক্তিরা। অপহূত শামীম ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সংসদের সাবেক সহসভাপতি ও খুলনা জেলা কমিটির সাবেক সভাপতি।
শামীমের মা জোহরা আক্তার অভিযোগ করেন, শামীমকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে সাদা পোশাকের লোকজন ধরে নিয়ে যায়। এরপর থেকে তাঁর খোঁজ নেই।
২০০৯ সালের ২৫ জুন নিখোঁজ হন বিএনপির নেতা চৌধুরী আলম। র‌্যাব পরিচয়ে একদল লোক তাঁকে ধরে নিয়ে যায়। দেড় বছরেও তাঁর খোঁজ নেই। মামলার তদন্তেরও কোনো অগ্রগতি নেই।
২০০৮ সালের ২৬ জুন নিখোঁজ হন যুবলীগের নেতা ও শীর্ষস্থানীয় সন্ত্রাসী লিয়াকত হোসেন। তাঁর পরিবারও একাধিকবার সংবাদ সম্মেলন করেছে, কিন্তু খোঁজ মেলেনি। লিয়াকতের পরিবারের অভিযোগ, র‌্যাবের পরিচয়ে তাঁকে ধরে নেওয়া হয়েছে।
ঢাকার বাইরে ২০০৮ সালের ২২ জুলাই তুষার ইসলামকে সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার ধুকুরিয়া বেড়া বাজারের গ্রামের বাড়ি থেকে র‌্যাব পরিচয় দেওয়া একদল সশস্ত্র ব্যক্তি ধরে নিয়ে যায়। এরপর থেকেই তিনি নিখোঁজ।
তুষারের বোন ফারজানা লাবণি বলেন, তাঁকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর ছোট ছেলে লিখনের বয়স ছিল পাঁচ মাস আর বড় ছেলে সাজ্জাদের পাঁচ বছর। ছোটটা এখন কথা বলে, বাবা ডাকে। কিন্তু বাবাকে পায় না। আর বড়টা এখন স্কুলে যায়। কিন্তু স্কুলের খাতায় বাবার নাম লিখলেও সে কখনো বাবাকে স্কুলে নিয়ে যেতে পারেনি। বাবা মৃত, সে কথাও লিখতে পারে না।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ের ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি নূর মোহাম্মদ হাজি ওরফে নূর হাজি (৭৫) গত ২০ অক্টোবর রাতে সাভারের বাসা থেকে নিখোঁজ হন। তাঁর বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসার অভিযোগসহ খুন ও বিভিন্ন অভিযোগে একাধিক মামলা রয়েছে। এরপর ৩ ডিসেম্বর ঢাকার শ্যামলী এলাকার নূর হাজির বড় মেয়ের স্বামী আবদুল মান্নান ও ইকবাল হোসেন নামের দুজনকে ধরে নিয়ে যায় অজ্ঞাত ব্যক্তিরা। তাঁদেরও খোঁজ নেই।
যাঁদের লাশ মিলেছে: গত ৩১ জুলাই গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) পরিচয় দেওয়া সশস্ত্র ব্যক্তিরা দয়াগঞ্জ বাজার এলাকা থেকে ধরে নিয়ে যায় জুয়েল সরদার, রাজীব সরদার ও মিজানুর হোসেন নামের তিন তরুণকে। পাঁচ দিন পর ঢাকা বাইপাসের পাশে গাজীপুরের পুবাইলে পাওয়া যায় জুয়েল আর মিজানের লাশ। রাজীবের লাশ মেলে ঢাকা-মাওয়া সড়কের পাশে সিরাজদিখানের নিমতলীতে। তিনজনেরই হাত-পা গামছা দিয়ে বাঁধা ছিল। এঁদের গুলি করে হত্যা করা হয়।
গত ২ জুলাই তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ডে রাখা দুটি পিকআপের মাঝে পাওয়া যায় মিজানুর রহমান ও আলী আকবর নামের দুই যুবকের লাশ। মিজানুরের হাতের কবজিতে জখম ছিল। তদন্ত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ধারণা, এটা হাতকড়া পরানোর দাগ।
গত ২৮ নভেম্বর রাতে রাজধানীর হাতিরপুল এলাকা থেকে অজ্ঞাতপরিচয় বন্দুকধারীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও সূর্য সেন হল ছাত্রদলের সাহিত্য ও গবেষণা সম্পাদক শামীম হাসান সোহেল, ৫০ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের সভাপতি ইসমাইল হোসেন ওরফে আল আমিন ও মাসুম হোসেন নামের তিনজনকে ধরে নিয়ে যায়। ৮ ডিসেম্বর মুন্সীগঞ্জের ধলেশ্বরী নদী থেকে পুলিশ দুটি গলিত লাশ উদ্ধার করে। এর একটি লাশ ইসমাইল হোসেনের বলে তাঁর স্বজনেরা বাসায় নিয়ে এসেছেন। অন্য লাশটি শনাক্ত করা যায়নি।
২ ডিসেম্বর সাভারে মহাসড়কের পাশ থেকে পৃথকভাবে দুটি গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তাঁদের একজন রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট থানা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক মাহামুদুল হক খান। আরেকজনের পরিচয় মেলেনি।

তথ্য সূত্র :