জীবনের প্রথম অবরুদ্ধ অর্ধমাস ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বসবাস

এম. মিজানুর রহমান সোহেল
Published : 26 Feb 2012, 06:58 AM
Updated : 26 Feb 2012, 06:58 AM

[হাজত হচ্ছে পৃথিবীর ভেতর আরেকটি পৃথিবী। 'জীবনে একবারের জন্য হলেও হাজতে যাওয়া উচিত' এমন নীতি কথা হয়তো আমরা অনেকেই জানি কিন্তু সেখানে যাওয়ার সুযোগ অনেকেরই হয়ে ওঠে না। যারা অবরুদ্ধ কারাগার সম্পর্কে জানতে চান তাদের জন্য আমার অর্ধমাস হাজত বাসের অভিজ্ঞতা উত্সর্গ করলাম।]

যেভাবে আটক হলাম
রাতের ঘন কালো অন্ধকার শেষে পুব আকাশে সূর্য উঠলেই কাল থেকে শুরু হবে বহুল কাঙ্খিত প্রিয় বইমেলা । তাই প্রকাশনীতে সকাল থেকেই আমার ব্যস্ততা ছিল । বিকেলে আমার বন্ধু আরিফ ফোন করে আমার সাথে দেখা করতে চাইলো কিন্তু আমার অনেক ব্যস্ততার কারণে তাকে আর সময় দিতে পারলাম না । মধ্য রাতে যখন ঘরে ফিরবো তখন আরিফের সহধর্মিনী এলিসের মোবাইল থেকে একটা ফোন আসলো । কল রিসিভ করা মাত্রই সে প্রচন্ড কান্নাকাটি শুরু করে দিলো । আমি সান্তনা দিয়ে জানতে চাইলাম কোনো সমস্যা হয়েছে কিনা ? সে বললো আমার বন্ধু এক্সিডেন্ট করেছে এবং সে এখন মহাখালির ঢাকা মেট্রোপলিটন হাসপাতালে ভর্তি আছে । সে আরো বললো তার অবস্থা খুব খারাপ আমি যেন আসার সময় কিছু টাকা নিয়ে আসি । আমার কাছে তখন মাত্র পাচশত টাকা ছিল । ওই রাতেই একবন্ধুকে ফোন করে দশ হাজার টাকা চাইলাম । সে আসতে বললো আর সাত হাজার টাকা দিলো । আমি খুব দ্রুত টাকা নিয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন হাসপাতালের সামনে চলে আসলাম । আরিফের বড় ভাই মতিনও সেখানে ছিল । আমি মতিন ভায়ের কাছে জানতে চাইলাম আরিফের কি খবর ? সে আমাকে প্রশ্ন করলো তোমার রক্তের গ্রুপ কি ? আমি বললাম আমার রক্তের গ্রুপ বি পজিটিভ আর আরিফের রক্তও বি পজিটিভ আমি রক্ত দিতে পারবো, বন্ধুর জন্য রক্ত দিতে আমার কোনো সমস্যা নেই ….. আমার কথা শেষ হতে না হতেই সাদা পোশাকধারী পুলিশ হ্যান্ডকাপ বের করে বললো ইউ আর আন্ডার এরেস্ট । আমি কোনো কিছু বুঝে উঠার আগেই তারা আমাকে গাড়ীতে করে সোজা থানায় নিয়ে আসে। পরে থানায় এসে জানলাম আমার বন্ধু আর তার ফ্যামিলীর মানুষ আমাকে পরিকল্পিত ভাবে ধরিয়ে দিয়েছে । আমি আগে যে কোম্পানিতে চাকরি করতাম সে কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার কারণে পুলিশ কোম্পানির এমডিকে খুজছে কিন্তু তাকে না পেয়ে শেষমেষ আরিফকে আটক করে এবং তাদেরকে দিয়ে গল্প সাজিয়ে আমাকেও আটক করে । পুলিশ মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক ট্র্যাক করে ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাজিবকে আটক করবে বলে আমাদের জানালেও শেষ পর্যন্ত এমডির কোনো হদিস মেলেনি ।

থানার হাজতে ছিলাম দুইদিন
৩১ জানুয়ারিতে আমরা আটক হই । রাতে থানার হাজতে অন্য চার বন্দীর সাথে আমাদের ঘুমাতে দেওয়া হলো । জীবনের প্রথম থানা হাজতে বসবাস । রাতে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম কিন্তু ঘুম আর আসে না । শেষ রাতে দেখলাম নতুন কিছু অপরাধীদের ধরে আমাদের লকাপে রেখে দিয়েছে । সারারাত মশার অমানসিক অত্যাচার সহ্য করে ভোর পহালাম । পহেলা ফেব্রুয়ারি সকালে আমার শুভাকাঙ্খিরা খোঁজ খবর নিতে এলো । আমাদের সহবন্দীদের সাথে নানা গল্প গুজব করে কীভাবে চোখের পলকে যেন দিনটি পার হয়ে গেলো । প্রথম রাতে নিজেকে অনেক লাজুক মনে হলেও পরদিন আমি ছিলাম হিরো । কারণ হাজতে যে আগে আসে তার জানা শোনা একটু বেশি থাকে, সেই সুবাদে তার কর্তৃত্বও অনেক বেশি থাকে । ১ ফেব্রুয়ারি রাতে একটু আরাম করে ঘুমিয়ে ছিলাম । গত রাতের মত আজ রাতেও নতুন কিছু আসামী আমদানি হলো । আমি তাদেরকে আমাদের রুমে থাকার বন্দোবস্ত করলাম । আমাদের বাসা থেকে বেশি খাবার এসেছে বলে অন্যদেরকে আমাদের খাবার দিলাম । বালিশবিহীন মশাযুক্ত নোংরা ঘরে কাটিয়ে দিলাম আরো একটি রাত । দুইদিন থানায় রেখে ২ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার আমাদেরকে ৫৪ ধারায় (সন্দেহ জনক আটক মামলায়) কোর্টে চালান করে দেয় থানার পুলিশ ।

বেগম খালেদা জিয়ার জন্য আমাদের কারাগারে যেতে হলো !
থানায় অপেক্ষা করছি পুলিশের আসামীবাহী গাড়ীর জন্য । দুপুরের আগেই চলে এলো গাড়ী । আমরা গাড়ীতে উঠার আগে এস আই গোলাম রসুল এসে বললেন কোর্ট থেকে বিকেলে থানায় দেখা করে যাবেন আর আপনার মোবাইল, মানিব্যাগ, ঘড়ি ও বেল্ট নিয়ে যাবেন । এরপর আমরা গাড়ীতে উঠলাম । গাড়ীর ভেতর থেকে বাইরের ঢাকা দেখতে কেমন তা অনুভব করার চেষ্টা করলাম । কেমন লাগলো তা ঠিক বলতে পারবো না । তবে যানজট পেরিয়ে ঘন্টা খানিকের মধ্যে আমরা কোর্টে এসে পৌঁছে গেলাম । আমাদেরকে কোর্টের গারদে রাখা হলো । কোনো একজন এসে আমাদের থেকে ওকালতনামায় স্বাক্ষর নিয়ে গেলেন । গারদের ছোট্ট একটা রুমে গাদাগাদি করে প্রায় ৬০/৭০ জন লোক রাখা হয়েছে । এত কিছুর মধ্যেও কিছু লোক মনের সুখে গাজা টেনে যাচ্ছে । চেহারাতে বিন্দুমাত্র টেনশন নেই । কাছে গিয়ে কথা বলতে চাইলে সে জানতে চাইলো আমার লাগবে কিনা ? আমি বললম কীভাবে ? সে বললো টাকা দিয়ে । একটু অবাক হলাম এখানে টাকা আসবে কি করে ? দাম জানতে চাইলে বললো চারশত টাকা । আমি বললাম এত বেশি দাম কেন ? উত্তরে সে বললো 'আর' তাই দাম বেশি । কিছুক্ষণ পরে দেখা হলো হিযবুত তাহরীর সদস্য সন্দেহে আটক ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালের ডাক্তার গোলম হায়দার রসুলের সঙ্গে । অনেক ব্যাপারে তার থেকে জানতে চাইলাম । সে শুদ্ধ উচ্চারণে আমাকে নসিহত করলেন আর হিযবুত তাহরীর সম্পর্কে তার পূর্ণাঙ্গ কোনো ধারণা নেই বলে দাবি করলেন । অন্যান্য আসামীদের সাথে কথা বলছি আর অপেক্ষা করছি কখন আমাদেরকে ডাকা হবে । অপেক্ষা করতে করতে প্রায় বিকাল পাচটা বেজে গেলো । কিন্তু আমাদের আর ডাক পরলো না । জানতে পারলাম বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া কোর্টে এসেছেন বলে আমাদেরকে আজ আর কোর্টে তোলা হবে না । ঠিক তখনও বুঝতে পারছিলাম না এখান আমাদেরকে কোথায় রাখা হবে বা জামিন দেওয়া হবে কিনা ? কিছুক্ষণ পরে আমাদের পুলিশ ভ্যানে করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে নেওয়া হলো । ততক্ষণে বুঝতে পারলাম আমরা আজ অনাকাঙ্খিত ভাবেই শ্বশুরবাড়ীতে চলে এসেছি । গাড়ী থেকে নেমে সোজা চলে গেলাম অফিসরুমে । তারপর একে একে সবার নাম ডেকে তার বিস্তারিত বিবরণ লিখছেন একজন লেখক। আমরা সবাই লাইন ধরে আমাদের নাম তালিকাভুক্ত করলাম। এরপরেই আমাদের কারাগারে প্রবেশ করানো হবে।

অর্ধ উলঙ্গ করে চেকাপ অত:পর কারাগারে প্রবেশ
নিরাপত্তার জন্য দেশে-বিদেশে নিরাপত্তারক্ষীদের চেকাপ করার অনেক দৃশ্য দেখার সুযোগ আমার। আমি পৃথিবীর বেশ কয়েকটি দেশও ঘুরেছি । আমার চোখে দেখা সব থেকে বেশি চেকাপ করেছে এয়ারপোর্টে । যেখানে একটা সূচ থাকলেও ধরা পরে এবং তা কর্তৃপক্ষ নিয়ে নেন । তাদের থেকে বেশি চেকাপ আমার জীবনে আর দেখা হয়নি । এবার আজ দেখার ভাগ্য হতে যাচ্ছে । কারণ আমার আগে যারা আছেন তাদেরকে কারাগারে ঢোকার আগে অর্ধ উলঙ্গ করে লজ্জাস্থানের উভয় দিকে হাত দিয়ে ভালো মত ঘষে মেজে চেকাপ করা হচ্ছে । পোষাকে সে বড় অফিসার হোক বা কোন মাওলানা সাহেব, চেকাপ করার ক্ষেত্রে কারো রেহায় নেই । টাকা-পয়সা, বেল্ট, কলম, পানির বোতল, খাবার, মানিবেগ, আইডি/ভিজিটিং কার্ড কোন কিছুই ভেতরে নিয়ে প্রবেশ করা যাবে না। সবার মত আমিও আমার সব কিছু কারারক্ষী পুলিশকে দেখিয়ে তারপর কারাগারে প্রবেশ করলাম ।

কারাগারের ভেতরের জানা-অজানা গল্প
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের স্থানটিতে এক সময় ছিল মোঘল নওয়াব সুবেদার ইব্রাহিম খাঁর নির্মিত কেল্লা । এ কেল্লার মধ্যে ছিল মহল, বিচারালয়, টাকশাল । ঐতিহাসিকদের মতে ১৫৪৫ সালে শেরশাহের আমলে এখানে প্রথম কেল্লা তৈরি করা হয়েছিল । প্রাচীনতম নিদর্শন হিসেবে এবং বন্দী সংখ্যা বিবেচনায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ৷ ঢাকা বিভাগের এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন আদালতে সাজাপ্রাপ্ত আসামীদের এখানে দন্ডপ্রদানের জন্য আটক রাখা হয়। এছাড়াও ঢাকা শহরের বিভিন্ন থানার মামলায় বিচারাধীন লোকদিগকে, বিচারকালীন সময়ে আটক রাখার স্থান হচ্ছে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার। বিচারাধীন আটক ব্যক্তিকে বলা হয় হাজতী। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার এক কথায় সুন্দর । ভেতরে ঢোকা মাত্র ডান দিকে রয়েছে তাজমহলের ভাস্কর্য । বাম দিকে দেওয়াল জুড়ে লেখা নীতি বাক্য । একটু সামনে এগুতেই দুই দিকে সারিবদ্ধ গাছ দাড়িয়ে । কোথাও বিন্দুমাত্র কোন ময়লা-আবর্জনা বা নোংরা নেই । ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার অভ্যন্তরে বেশ কয়েকটি এলাকায় বিভক্ত। ওয়ার্ড ও এলাকাগুলো হচ্ছে – আমদানী, বহির্গমন, কেস টেবিল, খাতা, সেল, ফরেন সেল, মেন্টাল, দফা, চৌকা, দশ সেল, নব্বই সেল, কনডেমন্ড সেল, ফাঁসির মঞ্চ । অপ্রাপ্তবয়স্ক, বৃদ্ধ ও মহিলাদের পৃথক রাখা হয় । বিদেশী নাগরিকদের জন্যও রয়েছে পৃথক স্থান । আমরা প্রথমে এসে আমদানীতে উঠেছি । আমদানী হচ্ছে নতুন হাজতিদের প্রাইমারি স্কুল । যেখানে নতুন হাজতিদের কি করণীয় আর কি বর্জনীয় তা শিক্ষা দেওয়া হয় ।

আমদানী স্কুলের প্রথম ক্লাসে যা শিখলাম
আমদানীতে প্রবেশমাত্র আমাদেরকে চার জন করে ফাইলে বসতে বললো । ফাইল কি তখনও জানিনা । কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর আমাদের প্রত্যেকের নাম, পিতার নাম ও থানার নাম জানতে চাইলো । এরপর আবারও শুরু হয়ে গেলো চেকাপ । তবে এবার অর্ধউলঙ্গ না করলেও তার বাকি ছিল না । এরপর ক্লাস । একজন দাড়িয়ে তার লেকসার শুরু করে দিলেন । বললেন জেলখানা খুবই কষ্টের জায়গা । এখানে পানি সংকট, তাই বাথরুমে হাফ বদনার বেশি পানি ব্যবহার করবেন না । গোসল করতে পারবেন না । ভাত খাওয়ার আগে যদি হাত ধুতে চান তবে পানি যেন কব্জির উপরে না ওঠে, উঠলে কিন্তু অপমান হবেন । এই ওয়ার্ডে (যমুনা -৪ এ) প্রায় ২০০ জন লোক থাকে কিন্তু বাথরুম দুইটা তার মধ্যে একটা নষ্ট, তাই বাথরুমে ঢুকতে হলে সিরিয়ালে প্রবেশ করুন । রাতে ঘুমানোর সময় আমরা যেভাবে ঘুমাতে দিবো তার ব্যতিক্রম হলে পরিনাম ভালো হবে না । সকাল ৪ টায় সবাইকে ডেকে দেওয়া হবে । ঘুম থেকে উঠে বাইরে লাইন ধরে বের হবেন । তারপর কি করতে হবে ওখান থেকেই বলে দেওয়া হবে । মনে রাখবেন এখানে কেউ সুখ করতে আসে না । তবে টাকা থাকলে সুখের অন্ত নেই ! যারা হাজতখানায় ভালো থাকতে চান তারা সামনের দিকে বসুন । আমরা সামনের দিকে বসলাম । কিছুক্ষণ পর আমাদের রাতের খাবার হিসেবে খিচুরী দেওয়া হলো । সারাদিন ঠিক মত খাওয়া হইনি । প্রচন্ড খুদা লেগেছে । খিচুরী পাওয়া মাত্র জিব্বায় জল চলে আসলো । হাত কব্জি পর্যন্ত ধুয়ে খিচুরী মুখে নেওয়া মাত্রই বমি চলে আসলো । অসম্ভব তিতা আর গন্ধ । ক্ষুধার্ত বলে কষ্ট করে খাওয়ার চেষ্টা করলাম । যতবার মুখে লোকমা নিয়েছি ততবারই আখরি বা খোয়া পেয়েছি । মুখ থেকে কোনো ময়লা ফেলানোর জায়গা নেই বলে তা পানিদিয়ে গিলে খেয়ে ফেলেছি । খাওয়া শেষে আবারও ক্লাস শুরু। আগের বক্তা আবারও তার বক্তব্য শুরু করলেন । তিনি প্রথমেই বললেন আপনারা নতুন বলে জেল কর্তৃপক্ষ আজকে উন্নতমানের খিচুরী দিয়েছেন (!) তবে আগামীকাল থেকে আপনাদের নিয়মিত খাবার খেতে হবে । তিনি আরো বললেন যারা জেলখানায় ভালো থাকতে চান তাদের জন্য আমরা বিশেষ ব্যবস্থা রেখেছি । অন্যদেরকে খাবার তুলতে তিনবার লাইন ধরতে হয় । একবার ভাতের লাইন এবং অন্য দুইবার ডাউল ও সবজির লাইন । যারা লাইনে খাবার তুলেন তাদের সারাদিন খাবার তুলতেই সময় চলে যায় । কিন্তু আপনাদের লাইন ধরে খাবার তুলতে হবে না আর বাইরে যে খাবার খেয়েছেন এখানেও সেই খাবার খেতে পারবেন । অন্যরা খাওয়ার আর গোসলের পানির জন্য প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে । কিন্তু আপনাদের পানি সব সময় প্রস্তুত থাকবে । অন্যরা রাতে ঘুমানোর সময় একজনের মুখের ওপর অন্যজন পা দিয়ে ঘুমায় । কিন্তু আপনারা আরাম করে ঘুমাতে পারবেন । বিনিময়ে আপনাদেরকে সপ্তাহে মাত্র ২৫০০ টাকা দিতে হবে । যাদের স্বামর্থ আছে তারা চূড়ান্ত ভাবে নাম লেখা দিলেন । অন্যরা রাতে শুধুমাত্র কত হয়ে ঘুমানোর জায়গা পেলেও আমরা একটু আরাম করে ঘুমিয়েছিলাম ।

ভোর চারটায় দ্বিতীয় ক্লাসে জেলারের সাথে সাক্ষাতকার
রাতে আমরা অনেক দেরি করে ঘুমালেও ঘড়ির কাটায় যখন ভোর চারটা তখন আমাদেরকে ডেকে দেওয়া হলো । তারাহুরা করে ঘুম থেকে উঠলাম । রুমের বাইরে আমাদেরকে যেতে বলা হলো । এরপর আবারও চার সদস্য বিশিষ্ট ফাইল করতে বলা হলো । কোন অনিয়ম করা হলে কঠিন ব্যবস্থা নেওয়া হবে বললেন দায়িত্বে থাকা একজন কয়েদী। আমাদের প্রত্যেকের নাম ডেকে সিরিয়াল ধরে দুই পায়ের ওপর ভোর করে বসতে বলা হলো । এরপর শিক্ষা দেওয়া হলো যে যখন জেলার সাহেব আসবেন তখন একজন দাড়িয়ে বলবে- "বন্দীরা সা-ব-ধা-ন" তখন সবাই দাড়িয়ে বলবেন- "আসসালামুআলাইকুম" । তিনবার আমাদেরকে প্যাকটিস করানো হলো । মধ্য বয়স্ক একজন জেলার সাহেব আসলেন আমরা নিয়ম অনুসরণ করে তাকে সালাম দিলাম । এরপর তার উপস্থিতিতে আমাদের কোর্টের তারিখ দেওয়া হলো ২৩ ফেব্রুয়ারি । আবার লাইন ধরে আমাদেরকে দাড়িয়ে তিনবার আলাদা করে ওজন, শরীরের বিশেষ চিহ্ন এবং শরীরের মাপ নিলেন । সব শেষে আমাদের ছবি তুলে প্রায় চার ঘন্টার ক্লাসের সমাপ্তি হলো । এবার আমাদের যমুনা-৪ ভবনে এসে রেগুলার খাবার খাওয়ার পালা । আজকেও খিচুরি দিয়েছে কিন্তু কালকেরটা শক্ত ছিল আর আজকেরটা এত পাতলা যে দেখে মনে হচ্ছে হাত ধোয়া হলুদ রঙের পানি। কিছুই করার নেই তাই চুমুক দিয়ে খিচুরি খেয়ে ফেললাম !

চার হাজার টাকা দিয়ে আমাদের কিনে নিলেন জল্লাদ শাহজাহান
যদিও সকালের লাইনে দাড়িয়ে সবাইকে ছাপিয়ে ইয়া বড় গোপওয়ালা এই লোকটি আমাকে একবার বলেছিলেন আমি কোথাও নাম লিখিয়েছি কিনা ? আমি উত্তরে বলেছিলাম আমদানীতেই আমাদের নাম লেখা হয়েছে । এবার তিনি এসেছেন আমদানীর নীলাম অনুষ্ঠানে । অনেকের মধ্যে তিনি আরিফ, মাকসুদ, রাসেল, আসাদ ও আমাকে আটশত টাকা করে চার হাজার টাকায় কিনে নিলেন । ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রধান জল্লাদ মো: শাহজাহান ভূঁইয়া । এরশাদ শিকদার, বাংলাভাই ও বঙ্গবন্ধুর খুনিসহ অন্যান্য ৩৩ জন আসামিকে তিনি ফাসি দিয়েছেন । সেই জল্লাদ আমাদেরকে নিয়ে তার মেঘনা-২ কক্ষে নিয়ে গেলেন । তার বিছানায় নিয়ে আমাদেরকে বসিয়ে অনেক উপদেশ দিলেন । আর আমাদের থেকে বাড়ির লোকদের মোবাইল নাম্বার নিলেন তাদের খবর দেওয়ার জন্য যে আমরা ক্যান্টিনে খাবো তার বিনিময়ে আমাদেরকে সপ্তাহে ২৫০০ টাকা দিতে হবে । যথারীতি ফোন করে খবর দিলে তাকে আমরা টাকা পরিশোধ করে দেই । জামিন না পাওয়া পর্যন্ত এই কক্ষেই ছিলাম । এসময় অনেক দাগী দাগী আসামী-হাজতির সঙ্গে পরিচয় হয়েছে । হয়েছে অনেক অভিজ্ঞতা । এবার সে সম্পর্কেই কিছু আপনাদের বলবো ।

হাজতে সারাদিন যেভাবে কেটে যেত
ঢাকায় আমার বাড়ি লালবাগ কেল্লা এলাকায় । এই কারাগারটিও আমাদের এলাকার পাশে অবস্থিত । আমি যে ভবনে থাকতাম সেখান থেকে আমাদের লালবাগ শাহী মসজিদের মিনার দেখা যেত । প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে মিনার দেখে নিজের সন্তানকে ভিশন মিস করতাম । কারণ সে তো ওই মিনারের পাশেই থাকে । তবে তার আগে ভোর ছয়টায় আমাদেরকে কক্ষ রাইটার মুন্না ভাই সবাইকে ঘুম থেকে ডেকে দিতেন ফাইল করার জন্য । ঘুম থেকে উঠে প্রথমে চারজন করে ছয় গুনটি দিতে হয় । কয়েদী-হাজতিদের গুনতে ঠিক ছয়টার সময় চলে আসেন জমাদার । আমাদের রুমে ৬৭ জন লোক থাকার কথা থাকলেও সেখানে থাকেন গরে ২৭০ জন মাত্র !! জমাদার তার গণনা শেষ করে চলে গেলে আমরা বাইরে বের হতাম মর্নিং ওয়ার্ক আর ব্রাশ হওয়ার জন্য । ফ্রেশ হয়ে এসে মোটা লাল রুটি দুই পিস আর ঘন ডাউল পেতাম সকালের নাস্তা করার জন্য । রুটির ময়লা ফেলে তারপর আমরা কয়েক বন্ধু মিলে সকালের ব্রেকফার্স্ট শেষ করতাম । খাওয়া শেষে গোসল করতাম । একদম মাপা ছোট একবালতি পানিতে গোসল করতে হতো । এরপর মনে চাইলে একটু গড়াগড়ি বা বাইরে গিয়ে আমতলায় আড্ডা দিতাম। সকাল ছয়টা থেকে বিকাল সাড়ে তিনটা পর্যন্ত কেউ দেখতে আসলে দেখা করতে যেতাম । ঠিক দুপুর বারোটার আগে আমাদেরকে রুমে ঢুকতে হতো । কারণ এখন বারো গুনতি হবে। সবাই চার সদস্যবিশিষ্ট ফাইল করে বসে যেতাম তারপর জমাদার এসে গুনে চলে গেলে ফাইল শেষ হতো । এরপর দুপুরের খাওয়ার পালা। সাধারণত দুপুরে আমরা মোটা চাউলের ভাত, ডাল আর আলু ভর্তা খেতাম। দুপুরের খাওয়া শেষ হলে আবার লকাপ খুলে দেওয়া হতো। আমরা আবারও বাইরে বের হতাম । বদ্ধ সীমানা পাচীর ঘেরা এলাকায় হাটাহাটি করতাম আর কারো সাথে পরিচয় হলে তার মামলার কাহিনী শুনতাম। বিকাল পাচটা বাজার আগে আমাদেরকে ঘরে ফিরে যেতে হতো । এবার পাচ গুনতির পালা। সকাল ছয়টা পর্যন্ত লকাপ করার আগে জমাদার এসে আমাদেরকে গুনে তারপর চলে যেতেন। ঘন্টা খানিক পর সন্ধা ছয়টায় আমাদের রাতের খাবার দিতো। রাতের খাবার শেষ হলে বিছানা ঠিক করে দিত জল্লাদের বাহিনীরা। প্রথম প্রথম সন্ধায় ঘুম আসলেও পরে মধ্য রাতের আগে আর ঘুম আসতোনা না। রাতে বাথরুমে যেতে বড়ই কষ্ট হতো। ২৭০ জন লোকের মাত্র ২টি বাথরুম! রাতে বাথরুমে গেলে রীতিমত যুদ্ধ করতে করতে যেতে হতো। কারণ একেতো সিরিয়াল দ্বিতীয়ত অন্যরা ঘুমিয়ে পড়লে মানুষ ডিঙ্গিয়ে বাথরুমে যেতে হয়। একবার তো একজন বলে উঠলেন- "কপালে পারা দিবি, বুকে পারা দিবি মাগার বালিশে পারা দিতে পারবি না" !! এভাবেই রাতের পর দিন আর দিনের পর রাত কেটে যেত।

ফাইল ফাইল আর ফাইল
সারাদিনে প্রত্যহ বেশ কয়েকবার কারাবন্দীদের সংখ্যা গণনার জন্য একেকটি সারীতে ৪ জন করে বসিয়ে সর্বমোট সারীর সংখ্যা গুনে বন্দীদের সংখ্যা বের করা হয়। চারজনের একেকটি সারীকে ফাইল বলা হয়। ভোর ৬ টায় যার যার ওয়ার্ডে একবার ফাইল হয়, তারপর দুপুর ১২ টায় একবার এবং লকআপের সময় (আসরের নামাজের পর) বিকেল ৫ টায় আরেকবার ফাইল বসিয়ে গনণা করা হয়। গণনার পূর্বে ফাইল ঠিক, ফাইল ঠিক বলে সবাইকে সতর্ক করে দেয়া হয়। তারপর সকল এলাকার ও ওয়ার্ডের যোগফলসমূহ কেসটেবিলে সুবেদার সাহেবের কাছে প্রেরণ করা হয়, তিনি সম্পূর্ণ জেলখানার হিসাব বের করেন এবং জেলার মহোদয়কে অবহিত করেন। এছাড়া আরও যেসব ফাইল রয়েছে- তিন সারী ঘুমানোর জায়গায় মধ্যখানে যারা ঘুমান তাদেরকে বলা হয় "মাজ ফাইল", সন্ধায় গুনতির পর ভাজা মাছ ফাইলবদ্ধ করে দেওয়া হলে বলা হয় "মাছ ফাইল", বাইরে থেকে কেউ দেখতে আসলে তাদেরকে মাইকে "মসজিদ ফাইলে" অর্থাৎ ওয়ার্ডের মসজিদ এলাকায় অপেক্ষা করতে বলা হয়, বৃহস্পতিবারে সারা জেলখানা ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করা হয় তখন জেল খানার দায়িত্বপ্রাপ্ত সাহেব দেখতে আসলে তাকে বলা হয় "সাহেব ফাইল", ভাত খাওয়ার আগে সবাইকে ফাইল করে বসতে বলা হয় এই বসাকে "ভাত ফাইল" বলে। এছারাও আরো অসংখ্য ফাইলের জন্মস্থান এই কারাগার। অবস্থা দেখে মনে হয় এখানে জীবনটা যেন ফাইলময়!

কারাগারে কি আছে কি নেই ?
আমাদের মেঘনা-২ এর গেটের পাশে একটি প্লেটে লেখা আছে- এই ওয়ার্ডে কতজন জন বন্দী আছে। কত গুলো কম্বল, চাদর, থালা, বাটি, লুডু, টিভি, রেডিও, কেরাম বোর্ড ইত্যাদি আছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের কথা হচ্ছে এখানে একটি টিভি আছে তাও বিটিভি ছাড়া অন্য চ্যানেলের দেখা পাওয়া মেলা ভার। আর বিনোদনের অন্যান্য সরঞ্জামের সাথে কারো সাক্ষাত মেলে না। দরজার পাশে যে নোটিশ লেখা আছে তা সর্ব শেষ চক দিয়ে লেখা ২০০৩ সালের মে মাসের ৫ তারিখ পর্যন্ত আপডেট করা আছে!

কারাগারের কিছু ভালো দিক
এখানে রাস্তা-ঘাট, ড্রেন,রুম সব কিছু সব সময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকে, আর এ জন্য সারা কারাগারে খুজলে একটি মশাও পাওয়া যাবে না। এখানে নিয়ম শৃঙ্খলা সব সময় বজায় রাখা হয়, বিনোদনের জন্য প্রত্যেকটি রুমে একটি করে টিভি রয়েছে। যাদের খাওয়ার সমস্যা তাদের জন্য ক্যান্টিনের ব্যবস্থা করা আছে। নারী-শিশু ও বিদেশীদের জন্য পৃথক পৃথক থাকার ব্যবস্থা আছে।কারাগারকে গণমুখী প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের লক্ষ্যে সিটিজেন চার্টার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে । হাজতী বন্দীদের সাথে ৭ দিন অন্তর একবার আর কয়েদী বন্দীর সাথে ১৫ দিন অন্তর একবার দেখা করা যাওয়ার নিয়ম থাকলেও কারারক্ষীদের ব্যানসন সিগারেটের প্যাকেট ঘুষ দিলেই দিনে যতবার খুশি দেখা করা যায়। কেউ অসুস্থ হয়ে পরলে তার জন্য কারাগারে রয়েছে কারা হাসপাতাল। কারাগারে আটক বন্দীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও তাদের আগ্রহ অনুসারে বিভিন্ন ট্রেডে যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয় যেমন- টেলিভিশন, ফ্রিজ, এসি, রেডিও, ফ্যানসহ ও অন্যান্য ইলেকট্রিক সামগ্রী মেরামত, গবাদি পশুপালন, মৎস চাষ, বেকারী দ্রব্যাদি ও বিভিন্ন ধরনের প্যাকিং ম্যাটেরিয়াল প্রস্তুত ইত্যাদির বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে । এছাড়া প্রাথমিক শিক্ষা ও ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে।

কারাগারের কিছু খারাপ দিক
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অনেক অনেক খারাপ দিক রয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখ যোগ্য হচ্ছে – এই কারাগারে সর্বমোট বন্দী ধারণ ক্ষমতা ২৫০০ সেখানে গড়ে বন্দী থাকে দশ হাজার ! এক হাত জাগায় এক জনের বুকে মুখে আরেক জনের পা দিয়ে চার জনকে ঘুমানোর চেষ্টা করানো হয়! কতটা অমানবিক ও অমানসিক কষ্টে এখানে সাধারণ বন্দীরা থাকেন তারায় শুধু জানেন। সারা কারাগার মিলে পানি উঠানোর জন্য মোটর রয়েছে মাত্র দুইটি ! কোন কোন সময় দুইটিই নষ্ট হয়ে যায়। বাইরে থেকে পানি নিয়ে আসার ব্যবস্থা রাখা হয়নি বলে সব সময় এখানে পানির জন্য যুদ্ধ করতে হয়। খাওয়া বা বাথরুমের পানি যতটুকু দরকার তার থেকে অনেক কম দেওয়া হয়। প্রত্যেকদিন সরকার নির্ধারিত খাবার দেওয়ার কথা থাকলেও নোংরা পানি দিয়ে রান্না করা তেল-লবন ছাড়া সবজি ডাউল খেতে দেওয়া হয়। আর যে ভাত খেতে দেওয়া হয় তা এদেশের ভিক্ষুকেরাও খায় না। ভাত মুখে দেওয়া মাত্রই বমি চলে আসে। ভাতে প্রচুর পরিমানে আখরি আর খোয়া। সম্ভবত এক কেজি চাউলে প্রায় আধপোয়া খোয়া দেওয়া হয়। বিনোদনের জন্য শুধু কাগজে কলমেই সরঞ্জাম রয়েছে কিন্তু বাস্তবে কিছুই নেই। সরকার কর্তৃক ধুমপান কারাগারে নিষিদ্ধ থাকলেও খুব প্রকাশ্যে সব সময় ধুমপান করা হয়। যার কারণে অধুমপায়ীদের অসম্ভব কষ্ট হয়। কারাগারে সর্ব মাদক নিষেধ হলেও কারারক্ষীরা এখানে মাদক ছাপ্লাই দেয়। অথচ অন্যদের কাছে তা থাকলে তাত্ক্ষণিক সর্ব শাস্তি দেওয়া হয়। মাইকে সকাল থেকে যে কজন পুরুষ কন্ঠ দেন তারা অনেক ক্ষেত্রেই ঠিক ঠাক মত নাম উচ্চারণ করতে পারেন না বলে অনেক কিছুই ভুল হয়ে যায়। যিনি কাগজে লিখে স্লিপ পাঠান তার লেখাও অনেক অস্পষ্ট বলে অনেক ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি হয়। মাইক শুধু রুম ও মসজিদ ফাইলে দেওয়া হয়েছে কিন্তু বাইরে দেওয়া হয়নি বলে যারা অবসর সময় বাইরে হাটাহাটি করেন তারা কিছুই শুনতে পান না।

ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষ্যে আল্লাহর ঘরে সিগারেট দান করুন !!!
আমরা জেলে আসার পর ৫ ফেব্রুয়ারি সোমবার ছিল ঈদে মিলাদুন্নবী। এ উপলক্ষ্যে জল্লাদ শাহজাহান তার ওয়ার্ডে বিশেষ দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজনের প্লান করেন। তার কয়েকদিন আগে থেকেই তার মাধ্যমে নামাজ এলাকায় ঘোষণা হলো- আগামী সোমবার ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষ্যে মিলাদ হবে, যারা অংশ গ্রহণ করতে চান তারা আল্লাহর ঘরে এসে সিগারেট দান করুন। প্রথমে একটু অবাকই হয়েছিলাম। পরে জানতে পারলাম কারাগার নামক এই দেশে কারেন্সির নাম হচ্ছে "সিগারেট"। অনেকেই সিগারেট দান করলেন। প্রায় সাড়ে সাত হাজার টাকা হয়েছিল। তার সাথে সাড়ে তিনহাজার টাকা যোগ করে জল্লাদ শাহজাহান ওই ওয়ার্ডে প্রত্যেকের জন্য এক প্যাকেট ডিম বিরিয়ানী ও মিষ্টির ব্যবস্থা করেন। উল্লেক্ষ্য জল্লাদ শাহজাহান ওই দিন মেঘনা-২ এর সকল কয়েদী-হাজতিদেরকে সন্ধার নামাজে অংশগ্রহন করান। আরেকটি কথা, এই ওয়ার্ডে যে কয়েক ওয়াক্ত নামাজ জামাতের সাথে আদায় করা হয় সে কয় ওয়াক্তে পিনপতন নিরবতায় নামাজ আদায় করা হয় জল্লাদ আর রাইটারের সহযোগিতার কারণে। যা কেন্দ্রীয় কারাগারে খুবই বিরল।

বন্দী হাবিবুর রহমান পিতা মরণ চন্দ্র দাস !
যদিও লোকটির সাথে একবারের জন্য হলেও আমার দেখা হয়নি তবে সে আমাদের সাথে একই দিনে জেলে এসেছেন। নাম তার হাবিবুর রহমান আর পিতার নাম মরণ চন্দ্র দাস ! নাম শুনে অবাক হয়েছিলাম । মাইকে কয়েক দিন ধরে নানা কারণে তার পিতার নামসহ ডাকা হয়। পরে জানতে পারলাম সে হিন্দু থেকে মুসলমান হয়েছেন। মূলতঃ সে একজন মুসলিম মেয়েকে ভালোবাসতো আর তাকে বিয়ে করার জন্যই ধর্ম ত্যাগ করেন। কারাগারে থাকা অবস্থায় সুমন মল্লিক ও মাহবুবুর রহমান পিন্টু নামের আরো দুই নব মুসলিমের সাথে পরিচয় হয়। তাদের প্রত্যেকের ধর্ম ত্যাগের ঘটনা একই। কিন্তু ধর্ম ত্যাগ করে মুসলিম হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মেয়ের পরিবার তা মেনে নিতে পারেন না বলে মামলা করে দেন। মেয়ে অনেক ভালোবাসলেও যেমন তাদের খোজ খবর নিতে পারে না তেমনি ধর্ম ত্যাগ করার করণে পারিবারিক ভাবেও তারা কোন প্রকার সহযোগিতা পান না। এত কষ্টের পরেও জানতে চেয়েছিলাম আগের ধর্মে ফেরত যাওয়ার ইচ্ছা আছে কিনা ? উত্তরে তারা প্রত্যেকে বলেছেন ইসলাম শান্তির ধর্ম, এই ধর্ম রেখে কোথায় যাবো ?

অদ্ভুত কিছু নাম
যারা ক্রাইম জোনে বসবাস করেন তারা হয়তো নিজেদের বিকৃতি নামই বেশি পছন্দ করেন। সবাই তাদের বিকৃতি নামেই ডাকেন। এই নামগুলো আবার তাদের ন্যাশনাল আইডি কার্ডেও উল্লেখ আছে। অনেকের কাছে এই অদ্ভুত নামগুলো নতুনত্ব বহন না করলেও আমার কাছে একটু অন্যরকম মনে হয়েছে। যতটুকু মনে রাখতে পেরেছি ততটুকুই বলছি – জাউড়া রাজিব, জারজ মাছুম, ঘাউড়া মাসুদ, চিটার সেলিম (তার বাবার নামও চিটার দিয়ে শুরু), কুত্তা ফারুক, শুয়োর রবিন, গলাকাটা রাসেল, প্যাটকাটা শানু, চাল্লি লিটন, চোর সুলতান, কসাই আরিফ, বিচ্ছু রুবেল, পচার বাচ্ছা, পিচ্চি রফিক, কালা পাঠা, মাথা নষ্ট হারুন, রামদা গোপাল, টিকটিকে শাহজাহান, ঘোরার ডিম, হাবা হাকিম, ৪৭ ওসমান, বাট্টু বাট, ধলা মানিক, ফাউল সুজন ইত্যাদি।

এটিএম কার্ডের বিকল্প পিসি কার্ড
হ্যাঁ, কারাগারে স্বাচ্ছন্দ জীবনযাপন করার জন্য আছে প্রায় সব ব্যবস্থা যদি টাকা থাকে। যেকোন প্রকার খাবার থেকে শুরু করে নিত্য ব্যবহার্য যে কোন পণ্য এখানে কিনতে পাওয়া যায়। কিন্তু তা নগদ টাকায় নয়। পিসি কার্ডের মাধ্যমে আপনার বিল পে করতে পারবেন। আপনার আত্মীয়স্বজন আপনার পিসি কার্ডে ব্যালেন্স লোড করে দিলে আপনি তা মনের সুখে ব্যবহার করতে পারবেন।

কঠোর নিরাপত্তা রক্ষী ও অন্যান্য কর্মকর্তা ও কর্মচারী
কারাগারের বাইরে আমরা যে কোন নিরাপত্তা রক্ষীদের দেখলে সামান্যও ভয় পাই না অথচ এখানে যারা দায়িত্বে আছেন মাত্র একটি ডান্ডা হাতে করে তাদেরকে সকল কারা বন্দীরা যমের মত ভয় পায়। কারণ এখানে সামান্য একটু ভুল হলে তাকে যেমন খুশি তেমন পেটানো হয়। কারও কিচ্ছু বলার নেই। এছাড়া কেউ কারও নামে বিচার দিলে বিচারে উভয়কে সমান ভাবে পেটানো হয়। বড় বিচার হলে আমদানীতে নিয়ে গিয়ে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে হাত ঝুলিয়ে কয়েকজন মিলে পেটায়। কারা অভ্যন্তরের সরকারি নিরপত্তা রক্ষীদের মিয়াসাব বলা হয়, মিয়াসাবদের উপরে রয়েছেন জমাদার সাহেবগন এবং তাদের তত্ত্বাবধানে থাকেন সুবেদার সাহেবগন। রয়েছেন একাধিক সাব‌জেলার ও একজন জেলার মহোদয়। আর সর্বোপরী রয়েছেন জেল সুপার মহোদয় ও ডিআাইজি প্রিজন। এখানে কয়েদীদেরও পদবী রয়েছে। তারা কারা অভ্যান্তরে অনেক কাজ করে থাকেন। এখানে দন্ডপ্রাপ্ত আসামীদের কারাভোগের মেয়াদের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন পদবী দেয়া হয়। পদবী অনুযায়ী পোষাক ও কাজের ধরনের পরিবর্তন ঘটে। মাঝে মাঝে পুরাতন ওভারসীয়ার কয়েদীদের মধ্যে কেহ শিক্ষিত হলে, তাকে কারাফটকে অবস্থিত অফিসে দাপ্তরিক কাজও করতে দেয়া হয়। আর তাদের পদবী গুলো হচ্ছে- সাধারণ কয়েদী, রাইটার, পাহাড়া, মেইট, সিআইডি, ওভারসীয়ার ইত্যাদি।

লোভী উকিলের কান্ডকারখানার জন্য দীর্ঘসময় জেলে থাকতে হলো
আমাদেরকে ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের ৫৪ ধারায় (সন্দেহ জনক) মামলা দেওয়া হয়েছে। কোন অপরাধ প্রমাণিত না হলে কোর্টে তিন শত টাকা জমা দিয়ে এসব মামলা থেকে খারিজ পাওয়া যায়। উকিল না থাকলেও মহুরীর মাধ্যমে জামিনযোগ্য এসব লোকদেরকে মহামান্য কোর্ট খারিজ করে দেন। কিন্তু আমাদের উকিল টাকার লোভে সামান্য এই নামকা ওয়াস্তে মামলাকে পৃথিবীর সব থেকে কঠিন মামলা সাজিয়ে আমাদেরে ফ্যামিলি থেকে টাকা খাওয়ার ধান্দা করে। আমাদের বৃহস্পতিবার কারাগারে নিয়ে এসেছে, উকিল চাইলে শুক্রবার বিশেষ কোর্টের মাধ্যমে আমাদেরকে জামিনের ব্যবস্থা করতে পারতেন। কিন্তু তার প্লান ছিল আমাদের যতদিন আটকিয়ে রাখতে পারবে তার তত ডিমান্ড বাড়বে। তার কথা মতো আমাদের ফ্যামিলীর মানুষদেরকে পরের সপ্তাহের মঙ্গলবার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলে। মঙ্গলবার কোর্টে না উঠেই উকিল জানিয়ে দেয় – ওই পক্ষের (পুলিশের) তিনজন উকিল দাড়িয়েছে (?) দেড় লাখ টাকার নিচে জামিন করা সম্ভব নয়!! উকিলের কথা শুনে মামলা সহজে অপসারণ করার লক্ষে আমাদের ফ্যামিলীর লোক আরো একজন উকিল ম্যানেজ করেন। কিন্তু এবার এই উকিলের কথা শুনে আগের উকিলের ম্যাজাজ বিগ্রে যায়। সে আর কোন ভাবেই এই মামলায় সহযোগিতা করতে রাজি হয়নি। সুযোগ বুঝে পরে আসা উকিলও তার রেট বাড়াতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত ৭৩ হাজার টাকার বিনিময়ে আমাদের জামিনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। আর এসব কারণেই আমাদের জেলখানায় থাকতে হলো অর্ধমাস।

অবশেষে ১৪ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পেলাম
আমাদের ফ্যামিলীর লোকজন তো প্রতিদিনই আশ্বাস দিয়ে যেত আমাদের আগামীকালই মুক্তি হচ্ছে। মূলতঃ উকিল যেভাবে বলতো তারাও আমাদেরকে সেভাবে বলতো। ৩১ জানুয়ারি থেকে পহেলা বসন্ত অর্থাৎ ১৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রতিদিনই জানতাম আজ আমারা জামিন পাবো। সারাদিন অপেক্ষা করেও দেখতাম জামিন হচ্ছে না। মাইকে যখন নাম ঘোষণা করা হয় তখন নিজের নামের আশে-পাশে কারো নাম ডাকলে বুকের মধ্যে ধরপর শুরু হয়ে যেত। তীব্র আকাঙ্খা ম্লান হলে কার ভালো লাগে ? এসময় বুঝতাম অপেক্ষার প্রহর কত কঠিন। পহেলা বসন্তেও যখন ছাড়া পেলাম না তখন অনেকটা আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। আমাদের রুমের বিটিভিতে দেখলাম রঙ্গিন বসন্ত পালন হচ্ছে। গতবছর এই দিনে কত মজা করেছি অথচ আজ এখন আমি জেলে। বসন্তের প্রথম প্রহর শেষ হয়ে পরদিন যখন দ্বিতীয় প্রহর তথা ১৪ ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিবসের প্রহর শুরু, তখন অনেকটা ভুল করেই যেন মাইকে শুনতে পেলাম আমাদের জামিন হয়েছে। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। খুশির খবর পেয়ে তারাহুরা করে ফ্রেশ হয়ে সকালের নাস্তা করলাম অত:পর প্রস্তুতি নিলাম বের হওয়ার জন্য। জল্লাদ আমাদেরকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য আমাদের সাথে বের হলেন। সাথে আমার বেডমেট মাকসুদও বের হলো। ওর সাথে এখানে এসেই পরিচয় হয়েছে। এই অল্প কয়েক দিনে দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব এত বেশি গভীর ছিল যে রাতে আমি ঘুমানোর সময় ওর গায়ে পা দিয়ে আরাম করে ঘুমাতাম। বয়সে আমার থেকে বড় হলেও একজন ভালো বন্ধু যেমন হওয়া দরকার মাকসুদ ঠিক তেমন। সে আমার সাথে নিচ পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে যখন তার সীমানা শেষ তখন আমার গলা ধরে কিছক্ষণ ফুফরিয়ে কান্নাকাটি করেছে। আমিও আমার চোখের জল ধরে রাখতে পারিনি। তাকে রেখে আমার চলে আসতে অনেক কষ্ট হচ্ছিলো। আমার যেতে ইচ্ছা করছিলো না। কিন্তু নিয়মের বাইরে এখানে একমিনিটও চলা সম্ভব নয় বলে আমার প্রিয় বন্ধু মাকসুদকে রেখেই আমাকে চলে আসতে হলো। জামিন টেবিলে আসলে তারা আমার কাগজ-পত্র চেকাপ করে অফিসে পাঠিয়ে দিলো। আমার সাথে একত্রে ১১০ জন বন্দী জামিন পেয়েছেন। কিন্তু আমার সহধর্মিনীর বড় ভাই নাসির আমাকে তারাতারি বের করার জন্য অফিস কর্মকর্তাকে টাকা দিলে তারা আমার সিরিয়াল ৯৮ থেকে ৩ নাম্বারে নিয়ে এসে আমাকে কারাগারের বাইরে বের করার ব্যবস্থা গ্রহণ করে। সকাল আটটা থেকে আমাদের বের করার প্রস্তুতি নিলেও বিশেষ ব্যবস্থায় আমার বের হতে সাড়ে এগারোটা লেগে যায়। আহ্ খাঁচার বন্দী খাঁচা থেকে বের হলে যে কি পরিমাণ আত্মতৃপ্তি পায় তা আজ অনুভব করতে পারলাম। স্বাধীনতা অনুভব করা যায় কিন্তু প্রকাশ করা যায় না। লাল কংক্রিট ঘেরা পাচীর পেরিয়ে অবরুদ্ধ ফটক থেকে বের হয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম, অত:পর স্বাধীন চিত্তে শান্তির নীড়ের দিকে রওয়ানা হলাম।

কারাগারে ঢোকার আগে ও পরে তোলা আমার ছবি এখানে যুক্ত করলাম ।

(আমার আরো অনেক কিছু বলার ছিল কিন্তু সময় কম আর পাঠকদের কথা বিবেচনা করে লেখা আর লম্বা করলাম না। আর হ্যাঁ প্রাসঙ্গিক মনে করলাম বলে লিখলাম, একই কারাগারে একসময় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বন্দী অবস্থায় ছিলেন এবং তিনি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের একটি স্মৃতি কথা লিখেছিলেন তা এখানে লিংক এর মাধ্যমে উপস্থাপন করলাম।