ডোল্যান্সার: অনলাইন আয়ের নামে প্রতারণা

এম. মিজানুর রহমান সোহেল
Published : 1 May 2012, 04:31 AM
Updated : 1 May 2012, 04:31 AM

আপনি বেকার, লেখাপড়া কম জানেন, নো টেনশন। ঘরে কম্পিউটার আর ইন্টারনেট থাকলেই হবে! আয় করতে পারবেন ডলার! ৫০টি বিজ্ঞাপনে ক্লিক করলেই প্রতিদিন এক ডলার! মাস শেষে ৩০ ডলার, যা বাংলাদেশী টাকায় আড়াই হাজার টাকারও বেশি। অথচ বিনিয়োগ করতে হবে এককালীন মাত্র সাড়ে সাত হাজার টাকা। এ ধরনের লোভনীয় অফারের কথা বলে ডোল্যান্সার (dolancer.com) নামের ইন্টারনেটভিত্তিক এমএলএম প্রতিষ্ঠান চটকদার ফাঁদ পেতে বসেছে। আর এদের প্রতারণার ফাঁদে পা দিচ্ছেন হাজার হাজার বেকার তরুণ-তরুণী। তাদের ফ্রিল্যান্স কাজের সুযোগ করে দেয়ার কথা বলে ভূঁইফোঁড় প্রতিষ্ঠানগুলো হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। এক হিসাবে দেখা গেছে, সারা দেশে প্রায় সাড়ে চার লাখ মানুষের কাছ থেকে সদস্য বানানোর কথা বলে এই প্রতিষ্ঠানটি এরই মধ্যে হাতিয়ে নিয়েছে ৫০০ কোটি টাকারও বেশি। বিভিন্ন ফ্রিল্যান্স কাজের কথা বলা হলেও করার মতো এতে আসলে কোনো প্রজেক্ট থাকে না। যে কোনো দিন ডোল্যান্সার অফিস গুটিয়ে উধাও হয়ে যাবে, এমন আশঙ্কাও করছেন অনেক সদস্য।

কিছু তথ্য জেনে নেয়া যাক
ডোল্যান্সার একমাত্র আউটসোর্সিং সাইট যাতে কাজ করার জন্য প্রথমেই জামানত দিতে হয়। অন্য কোনো আউটসোর্সিং কোম্পানিতে কাজ শুরু করার জন্য কোনো টাকা দিতে হয় না। ডোল্যান্সার ওয়েব সাইট বলে, এটি ইউএসএভিত্তিক প্রতিষ্ঠান। অথচ বাস্তবে বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোথাও তাদের কার্যক্রম দেখা যায়নি। অন্যান্য আউটসোর্সিং সাইটের কোনোটাই বাংলাদেশ থেকে পরিচালিত হয় না। সুতরাং তাদের লোকাল লেনদেন না হওয়াটা স্বাভাবিক। অথচ যেখানে ডোল্যান্সার বলছে তারা বাংলাদেশ থেকেই কাজ করছে, কিন্তু আবার ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন করছে না। তারা দেশি কারেন্সি ব্যবহার করছে না, ব্যবহার করছে ইউএস ডলার। তারা জমা নিচ্ছে ১০০ ডলার। যার পরিবর্তে আবার (পুরনো ইউজারের মাধ্যমে) দেয়া হচ্ছে ৭ হাজার টাকা। অথচ বর্তমানে ডলারের দাম ৮০ টাকার ওপর। তাদের ওয়েবসাইটে এমন বেশকিছু ত্রুটি দেখা যায়, যাতে বোঝা যায় যে এটি আমেরিকান কোনো সুপ্রতিষ্ঠিত কোম্পানির সাইট হতে পারে না। সাধারণ ব্যবহারকারীরা এটা বুঝতে না পারলেও একজন অভিজ্ঞ ওয়েব ডেভেলপারের পক্ষে বোঝা কঠিন নয়। এটি একটি এমএলএম কোম্পানি।

ঠকানোর অভিনব কৌশল
সাবধান! এর আগেও অনেক এমএলএম কোমপানি আমাদের ফাঁকি দিয়ে পালিয়েছে। ক্লিকের জন্য টাকা? ক্লিক করলেন আর টাকা পেয়ে গেলেন। এই ক্লিকের ফলে কে কীভাবে উপকৃত হলো? বিষয়টি অযৌক্তিক নয় কি? ইন্টারনেট-প্রযুক্তি সম্পর্কে যাদের ধারণা নেই তাদের কাছে বিষয়টি অজ্ঞাত হলেও ওয়েব ডেভেলপাররা ঠিকই বোঝেন যে, এটি ধোঁকা দেয়ার কৌশল ছাড়া কিছু নয়। এখানে আয় শুধু সীমাবদ্ধই নয় বরং খুব কমও। একাটি অ্যাকাউন্ট থেকে দিনে সর্বোচ্চ এক ডলার। তাহলে একজন মাসে আয় করতে পারে ১ ডলার – ৩০ দিন – ৭০ টাকা = ২ হাজার ১শ' টাকা মাত্র। তাও ৭ হাজার টাকা নগদ বিনিয়োগ, কম্পিউটার, ইন্টারনেট খরচ এবং প্রতিদিন ডিউটি পালন করার পর। সব মিলিয়ে তারা খুব সীমিত টাকাই প্রদান করছে, আর এমএলএমের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে টাকাগুলো তাদের কাছেই রাখছে। যেভাবে একেকজন আগ্রহ দেখাচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে ইনকাম প্রচুর। এখানে দুটো বিষয়। প্রথমত, সত্যিই কি প্রচুর ইনকাম? উপরের অংকটা যদি সঠিক হয় তাহলে ইনকাম প্রচুর একথা বলা যায় না। দ্বিতীয়ত, যদি উপরের অংকটা সঠিক না হয়, অর্থাত্ প্রচুর ইনকামের সম্ভাবনা থেকে থাকে তাহলে ফাঁকিবাজির সম্ভাবনাটাও কিন্তু বাড়ে। শর্টকাটের লোভ আর খেটে খাওয়ার মানসিকতা না থাকার কারণেই এসব ধোঁকাবাজ বারবার চিট করার সুযোগ পাচ্ছে। তাই ইউএস ডলার, ইন্টারনেট, কম্পিউটার—এসব শুনেই বিভ্রান্ত হবেন না। হিসাব করুন এবং বোঝার চেষ্টা করুন, এটি এমএলএম ধোঁকাবাজির একটি ডিজিটাল সংস্করণ।

ডোল্যান্সারের আয়-রোজগার
আপনাকে দৈনিক ১০০টি (সম্ভবত) লিঙ্ক/অ্যাড দেয়া হবে। আপনি সেই লিঙ্কগুলোতে ক্লিক করবেন। প্রত্যেক ক্লিকে পাবেন ১ সেন্ট, ১০০ ক্লিকে ১ ডলার। সেই হিসেবে মাসে ৩০ ডলার, সেটা দিয়ে আপনি আপনার এক মাসের কিস্তি শোধ করবেন। ৩ কিস্তি শোধ করার পর আপনি নিজের পকেটে টাকা তুলতে পারবেন। থাকবে আপনার ধৈর্য? এই পিটিসির কাজই যদি করতে চান, অন্য কোনো বিশ্বস্ত সাইটে গিয়ে করুন। আজ থেকেই আপনার পকেটে টাকা আসা শুরু হবে।

ওয়েবসাইটে বিভ্রান্তিকর তথ্য
সদস্যরা যখন ক্লিকের অর্থ আদায়ের জন্য অফিসে ধরনা দিচ্ছেন দিনের পর দিন, তখন তাদের ওয়েবসাইটে ঢুকলে মূল পাতায়ই চোখে পড়ে কিছু তথ্য : (গতকাল পর্যন্ত) ফ্রিল্যান্স প্রফেশনালস ২,৯০,১৫৩ জন, ব্যবহারকারীদের ২০,০৮,০৮৭.০৭ ডলার, শেষ হওয়া মোট প্রকল্প ৮৫৬। কাজের ক্ষেত্র হিসেবে প্রজেক্ট বিবরণে আছে ৬৬টির নাম। ডোল্যান্সার তাদের মাধ্যমে ৮৩৬টি ফ্রিল্যান্স কাজ সম্পন্ন হওয়ার কথা দাবি করলেও সে সম্পর্কে কোনো তথ্য তো নেই-ই, আছে বড় ফাঁকির নিদর্শন। সাইটে বাংলাদেশের কোনো কার্যালয়ের ঠিকানা, ফোন নম্বর কিছুই নেই। ক্যালিফোর্নিয়ার 'ডোল্যান্সার ইনকরপোরেটেড' নামের একটি প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা ও ফোন নম্বর সাইটে দেয়া আছে, তবে গুগল দিয়ে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের কোনো প্রতিষ্ঠান থাকার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। জানা যায়, ইনটুইট ইনফোসিস নামের একটি সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানের মালিক রোকন ইউ আহমেদ এই ডোল্যান্সার গড়ে তুলেছেন।

ডোল্যান্সারের সদস্য ফি
dolancer.com নিজেদের পরিচয় দেয় ফ্রিল্যান্সিং সাইট হিসেবে। দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ফ্রিল্যান্সিং সাইটগুলো হলো odesk.com, freelancer.com, elance.com, guru.com ইত্যাদি। আপনি এসব সাইটে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন যে এ সাইটগুলোর কোনোটাতেই সদস্য হতে টাকা লাগে না। অথচ এই ডোল্যান্সারে সদস্য হতে আপনাকে দিতে হবে ১০০ ডলার, যার ১০ ডলার সদস্য হওয়ার সময় আর বাকি ৯০ ডলার তিন মাসে সমান কিস্তিতে।

ডোল্যান্সারের বয়স ১২ বছর!
এটি একটি ডাহা মিথ্যা কথা। এই সাইটের ডোমেইন কেনা হয়েছে এড়উধফফু থেকে, রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছে ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১১। হালনাগাদ করা হয়েছে গত বছর ২৭ সেপ্টেম্বর। হোস্টিং কেনা হয়েছে ঝড়ভঃখধুবত্ নামক সস্তা একটি প্রতিষ্ঠান থেকে। ডোমেইন নাড়ি-নক্ষত্রের লিঙ্ক http://who.godaddy.com/whois.aspx?
domain=dolancer.com&prog_id=GoDaddু

ডোল্যান্সারের ডলারের মূল্য ৭০ টাকা!
সদস্য ফি ১০০ ডলার। অথচ সেটা নেয়া হয় বাংলাদেশী টাকায় ৭ হাজার টাকা। ইউএস ডলারের বর্তমান বাজার দর ৮০-৮৫ টাকা, সেই হিসেবে ১০০ ডলার হওয়ার কথা ৮০০০-৮৫০০ টাকা! বাকি টাকা কি তারা পকেট থেকে দেন? আরেকটা বিষয়, এই সাইটের ৯৯.১ ভাগ ভিজিটর বাংলাদেশ থেকে! সাইটের কাজের পরিসংখান দেখতে গিয়ে জানা যাচ্ছে, এটি হচ্ছে The world's largest outsourcing & Website leasing marketplace! অথচ এখন পর্যন্ত তাদের সদস্য সংখ্যা ২৭৮৪৯১, প্রজেক্ট আছে ৮৩৬টি আর এখান থেকে সম্পন্ন হওয়া প্রজেক্টের সংখ্যা শূন্য। সদস্যরা মোট আয় করেছেন ২০০৯৭৪৫.৭৬ ডলার।

ডোল্যান্সারের সাইটের অবস্থা
Freelancer.com-এর সঙ্গে যারা পরিচিত তাদের কাছে Dolancer-এর চেহারাটা চেনা মনে হবে! যখন ডুল্যান্সার জন্ম নেয়, তখন Freelancer.com-এর ঠিক এরকমই চেহারা ছিল। শুধু রঙের একটু তারতম্য! এই সাইট কোড-ইগনিটার পিএইচপি ফ্রেমওয়ার্কে করা হয়েছে। যারা জানেন, তারা ঘটনা আঁচ করেছেন। সাইটের ঝছখ ইনজেক্ট করা যায়! কয়েকটি লিঙ্ক দেখলে কিছুটা বুঝতে পারবেন।

আরও যারা প্রতারণা করছে
ঢাকা মহানগরীসহ সারা দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় ক্লিকের নামে অবাধে প্রতারণা চলছে। সাধারণ মানুষ ইন্টারনেট সম্পর্কে ভালোভাবে অবগত না থাকার কারণে এক্ষেত্রে প্রতারণার সুযোগ পাচ্ছে সব প্রতিষ্ঠান। এমএলএমের নামে ব্যবসা করলেও অধিকাংশ কোম্পানি বলছে তারা আউটসোর্সিং কোম্পানি। ইন্টারনেটভিত্তিক এসব প্রতিষ্ঠান প্রতিনিয়ত প্রতারণা করলেও দেখার যেন কেউ নেই! সুযোগ বুঝে দেশে ক্লিকের নামে প্রতারণা করা কোম্পানির সংখ্যা বেড়েই চলেছে। অনুসন্ধানে ক্লিকের নামে যেসব প্রতিষ্ঠান প্রতারণা করছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অনলাইন ক্লিক এমএলএম কোম্পানিগুলো হচ্ছে—ল্যান্সটেক, রিয়েল সার্ভে অনলাইন, স্কাইলান্সার, পেইড টু ক্লিক, অ্যাড আউটসোর্সিং, স্কাই ওয়াকার, মাস্টার ক্লিকার, শেরাটন বিডি, নিউ শেরাটন বিডি, পয়সা.কম, ইউনিক রেঞ্জ, আর্ন টু অনলাইন, অনলাইন অ্যাড ক্লিক ইত্যাদি।

ফ্রিল্যান্সাররা বলছেন প্রতারণা
ইন্টারনেটে ফ্রিল্যান্স কাজ করায় অভিজ্ঞ তাহের চৌধুরী সুমন বলেন, ডোল্যান্সার কোনো ফ্রিল্যান্সিং সাইট নয়। লোকজনকে ফ্রিল্যান্স কাজের প্রলোভন দেখিয়ে অনেক টাকা নিয়ে তাদের যুক্ত করা হচ্ছে। ফ্রিল্যান্সার রুবেল আহমেদ বলেন, ডোল্যান্সারের কারণে সাধারণ মানুষ ফ্রিল্যান্সিং মানে এখন ওয়েবসাইট ক্লিক করাকে বোঝেন। এ ধরনের ওয়েবসাইট ক্লিক করে টাকা আয়ের চিন্তা যারা করবেন, তারা জীবনেও সফল হবেন না। বিশ্বের প্রতিষ্ঠিত ফ্রিল্যান্স কাজের সাইটগুলো কোনো অর্থ নেয় না বলেও জানান ফ্রিল্যান্সাররা। 'আমাদের প্রযুক্তি' ফোরামের সঞ্চালক সবুজ কুমার কুণ্ডু জানান, 'তরুণদের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে এক ধরনের জোচ্চোর ও প্রতারক ইন্টারনেটে প্রতারণার ব্যবসা খুলে বসেছে। যারা ফ্রিল্যান্সার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করতে চান তাদের এখনই সতর্ক হতে হবে। নতুবা বড় ধরনের সর্বনাশ হতে পারে। কাজের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত মার্কেট প্লেস যেমন ওডেস্ক.কম, ফ্রিল্যান্সার.কম, ইল্যান্স.কম-এর মতো সাইটে কাজ শুরু করতে হবে। যেসব সাইটে কাজ শুরু করতে টাকার প্রয়োজন হয়, সেগুলো এড়িয়ে চলতে হবে।

প্রতারণা বন্ধে প্রয়োজন আশু পদক্ষেপ
এটা জানেন নিশ্চয়ই, এই উড়ষধহপবত্-এ কারও রেফারেন্স ছাড়া সদস্য হওয়া যায় না। পুরো এমএলএম, স্বার্থ কোথায় বুঝছেন? অনেক কিছু জানলেন, এরপর আপনি কি করবেন সে সিদ্ধান্ত নেবেন আপনি। আউটসোর্সিং যদি আপনার উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তাহলে নিরাপদ ও বিশ্বস্ত পথে আসুন। ক্লিকের নামে তথাকথিত অলস কাজ করে আর প্রতারিত হবেন না। এতে একদিকে একজন লোক পিসি বা ল্যাপটপের সামনে বসে থেকেও শুধু ক্লিক ছাড়া কিছু শিখতে পারছে না, অপরদিকে প্রতারিত তো হচ্ছেই। তাই সবার সাবধান থাকার পাশাপাশি এসব প্রতারণা বন্ধে কর্তৃপক্ষের আশু আইনানুগ পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি।
mmrsohelbd@gmail.কম

আমার এই লেখাটি আজ ১ লা মে ২০১২ ইং মঙ্গলবার দৈনিক আমারদেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে|