হিজরাদের যন্ত্রনায় অতিষ্ট সাধারণ মানুষ

এম. মিজানুর রহমান সোহেল
Published : 2 May 2012, 05:10 AM
Updated : 2 May 2012, 05:10 AM

নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে হিজরারা
গ্রাম অঞ্চলে বা শহরতলীতে কোন বাচ্চার জন্ম হলেই এরা দলে দলে এসে ভিড় করে বলে ওঠে "দে নারে তোর মনিটারে একটু নাচাই" এই বলে নবজাতক কোলে করে নাচিয়ে বখশিশ নেয়, কিংবা শহরে মাঝে মাঝেই দেখা যায় এরা দলে দলে এসে বিভিন্ন দোকান থেকে চাঁদা তোলে। হিজরাদের নিয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে পাওয়া গেছে তাদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের নানা তথ্য। তারা চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, পতিতাবৃত্তি, মারামারিসহ নানা ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। এমনকি তাদের হাতে খুনের ঘটনাও ঘটেছে। তারা আবার সন্ত্রাসীদেরও আশ্রয় দিয়ে থাকে। হিজড়া হওয়ার সুযোগে তারা আইনশৃংখলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে করছে মাদক ব্যবসাও। দিনের বেলায় দোকানে দোকানে গিয়ে চাঁদা ওঠানো হিজরাদের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। আর রাতে ছড়িয়ে পড়ে পতিতাবৃত্তিতে। তাদের অনেকে ছিনতাইও করে। এছাড়া পাড়া-মহল্লায় তাদের সোর্স নিয়োগ থাকায় নবজাতক সন্তান জন্মানোর সঙ্গে সঙ্গে তারা জানতে পারে। এ জন্য সোর্সদের টাকাও দেয় তারা। পুরুষরা যখন বাসায় থাকেন না তখন তারা হামলে পড়ে ওই বাড়িতে।

হিজরারা যেভাবে নিজেদের দল ভারী করে
কথিত আছে যখন কারো হিজড়া বাচ্চা হয় তখন তা যদি হিজরারা জানতে পারে তবে তারা ওৎ পেতে থাকে তাকে নিজেদের দলে ভেড়ানোর জন্য। এক সময় ঠিকই তাকে হিজরাদের দলে নিযে যায়। আরো একটা কথা প্রচলিত আছে যদি না নিতে পারে তাহলে তারা দলবদ্ধভাবে এসে হাতে তালি বাজাতে থাকে যা তারা সবসময়ই বাজায় আর এ হাতে তালিতে নাকি কি এক অমোঘ আকর্ষন আছে যা শুনে অন্য হিজড়ারা আর ঠিক থাকতে পারে না সেও এসে তাদের এই হাতে তালিতে যোগ দেয়। যদিও এর কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নাই।

হিজরাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ ঢাকাবাসী
হঠাৎ বাসার গেটে হইচই। বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া মেয়েটি দরজা খুলে দিলো। হুড়হুড় করে ভেতরে ঢুকে পড়ল সালোয়ার-কামিজ এবং শাড়ি পরা সাত-আটজন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তারা ওই মেয়েটির কাছে টাকা দাবি করল। তাও অল্প নয়, ১০ হাজার টাকা। মেয়েটির চিৎকার শুনে তার মা এগিয়ে আসেন। টাকা দিতে না চাইলে তাদের ব্যাপক গালাগালি।

একপর্যায়ে দুই হাজার টাকা এবং একটি নতুন শাড়িতে রফা-দফা। খিলগাঁওয়ের একটি বাড়িতে এভাবেই মহাবিপদ থেকে রক্ষা পান মা-মেয়ে। রাজধানীর এই চাঁদাবাজদের নাম হিজরা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর সদস্যদের চোখের সামনেই চলছে তাদের চাঁদাবাজি। কেউ তাদের কিছু বললে সোজা থানা ঘেরাও। ফলে পুলিশও তাদের ভয় পায়।

হিজরাদের অভ্যন্তরীণ বিরোধ
রাজধানীতে চাঁদাবাজি ও এলাকার আধিপত্য নিয়ে সম্প্রতি হিজড়া সম্প্রদায়ের অভ্যন্তরীণ বিরোধ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। হিজরারা কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পারস্পারিক বিরোধে জড়িয়ে পড়েছে। কিছুদিন আগে শ্যামবাজার, মাহুতটুলী, যাত্রাবাড়ী, শ্যামপুর, বাড্ডাসহ রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে হামলা, মারধর ও সংঘর্ষে হিজড়া নেত্রী দিপালীসহ অন্তত ৩০ জন হিজড়া রক্তাক্ত জখম হয়েছে বলে জানা গেছে। আহত হিজড়া সুইটি, নীহার, টু¤পা, সীমা, নদী, চুমকি, রীতু, আঁখী, সুন্দরী, স্বপ্নাসহ কয়েকজন জানায়, প্রতিপক্ষের হামলার আশঙ্কায় কয়েকশ হিজড়া বাসাবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। এর মধ্যেও লাঠিসোটা, রড, হাতুড়িসহ অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ৭০-৮০ জন হিজড়া ক্যাডার ট্রাকযোগে বিভিন্ন মহল্লায় গিয়ে হানা দিচ্ছে, এক গ্র"প অন্য গ্র"পের ওপর আক্রমণ চালাচ্ছে। তাদের ভাষায়, প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেয়া প্রকৃত হিজড়ারা এখন হিজড়া বেশি পুরুষ মেজবাহ-রমজান চক্রের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে লিঙ্গচ্ছেদ করে কৃত্রিমভাবে হিজড়ায় রূপান্তর হওয়া পুরুষরা জোট বেঁধে প্রকৃত হিজড়াদের ওপর জোর-জুলুম ও নির্যাতন চালাচ্ছে। তারা হাট-বাজার, দোকানপাটে চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধ তৎপরতায় লিপ্ত। ইদানীং মাদক বাণিজ্যের সাথেও জড়িয়ে পড়েছে চক্রটি।

রাজধানী ঢাকা সহ বিভিন্ন জেলার কিনিকে পুংলিঙ্গ কেটে বানানো হচ্ছে হিজড়া
রাস্তায় হিজড়াদের দলবদ্ধ যাদের দেখা যায় তারা কি আসলেই হিজড়া? দেহাকৃতি হিজড়ার মতো হলেও তাদের অধিকাংশই এক সময় সাধারণ মানুষ ছিল। কিন্তু লিঙ্গ কর্তনের মধ্য দিয়ে হিজড়ার খাতায় নাম লেখায়। রাজধানীর শ্যামলী, ঢাকা জেলাধীন ধামরাই ও খুলনার ফুলতলায় কয়েকটি বেসরকারি কিনিকে পেশাদার ও ডিগ্রিধারী চিকিৎসকদের দিয়েই পুংলিঙ্গ কেটে হিজড়া তৈরি করা হয়। এসব ক্লিনিক যেন এক একটি হিজড়া তৈরির কারখানা। হিজড়া নামের আড়ালে লিঙ্গ কর্তন করা হাজার হাজার পুরুষ ঢাকাসহ সারাদেশে চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, খুন-খারাবিসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। চাঁদাবাজির টাকায় গড়ে তুলেছে বাড়ি-গাড়ি। অঢেল সম্পদ। পুংলিঙ্গ কর্তন করে হিজরায় পরিণত করার বিষয়টি লিঙ্গ কর্তনের সঙ্গে সম্পৃক্ত সার্জিক্যাল চিকিৎসকরাও স্বীকার করেছেন। সার্জিক্যাল ক্লিনিকে পুংলিঙ্গ কেটে বিশেষ বিশেষ ওষুধ সেবনের মধ্য দিয়ে তাদের লিঙ্গ কর্তন এবং শারীরিক অবয়বে পরিবর্তন আনা হয়। অনুসন্ধানে জানা যায়, লিঙ্গ কর্তনকারী হিজড়াদের মধ্যে খোদ রাজধানীতেই রয়েছে প্রায় ২০ হাজার। রাজধানীসহ সারাদেশে অশিতি, অভাবী ছেলেদের পাশাপাশি যেসব ছেলের একটু মেয়েলি ঢং রয়েছে এবং যেসব ছেলে বা পুরুষ সমকামিতায় আসক্ত তারা নানা ফাঁদে পড়ে বা প্রলুব্ধ হয়ে হিজড়ার খাতায় নাম লেখায়। তাদের সংগ্রহের জন্য রয়েছে দালাল চক্র। আবার চিহ্নিত কিছু হিজড়া নেতাও ওইসব ছেলেদের হিজড়া বানাচ্ছে। যারা হিজড়া হচ্ছে তারা সবাই ৩০ বছর আগেই এই অপকর্ম সেরে ফেলছে। যেসব হিজড়া পুরুষাঙ্গ কেটে হিজড়া হয়েছে, তারা সবাই হিজড়া হওয়ার পর পাল্টে ফেলে বাবা-মায়ের দেয়া নাম। হিজড়ার এ তালিকায় থাকা অনেকের স্ত্রী-সন্তান, পরিবার-পরিজন থাকলেও সহজ পথে, অল্প সময়ে এবং নিরাপদে অর্থ আয়ের জন্য এ পথ বেছে নিয়েছে। তবে তাদের অনেকেই এখন অনুতপ্ত। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে চাইলেও আর সম্ভব নয়। তাদের নিয়ে কাজ করে এমন বেসরকারি সংগঠন, সমাজবিজ্ঞানী ও হিজড়া সংগঠনের কর্মকর্তারাও এসব ঘটনা স্বীকার করেছেন। এমনকি লিঙ্গ কর্তনকারী চিকিৎসকরাও যুগান্তরের কাছে এসব নির্মম ঘটনার কথা স্বীকার করেছেন।

যেখানে পুরুষাঙ্গ কেটে হিজড়া বানানো হয়
ঢাকা জেলার ধামরাই এলাকার রোম আমেরিকান হাসপাতাল নামের একটি বেসরকারি ক্লিনিকে প্রতিমাসে ৪/৫ জনকে পুরুষাঙ্গ কেটে হিজড়া বানানো হচ্ছে। এছাড়া রাজধানীর শ্যামলী ও খুলনার ফুলতলার কয়েকটি কিনিকেও লিঙ্গ কেটে হিজড়া করা হয়। হিজড়াদের দলনেতারা নানা প্রলোভন দেখিয়ে উঠতি বয়সের ছেলেদের ওইসব হাসপাতালে নিয়ে তাদের হিজড়া বানিয়ে নিজেদের দল ভারি করছে। ১২ মার্চ ধামরাই থানা বাসস্ট্যান্ডের কাছে গিয়ে জানা যায় লোমহর্ষক এ ঘটনার সত্যতা। থানা বাসস্ট্যান্ডে থেকে ৫০ গজ দূরে মানিকগঞ্জ-ঢাকা প্রধান সড়কের পাশেই রোম আমেরিকান হাসপাতাল অনুসন্ধানে জানা যায়, ওই হাসপাতালের মালিক ডাক্তার গোলাম রহমান শাহজাহান নিজেই হিজড়া বানান। কর্মচারী মোশারফ জানান, প্রায়ই এ হাসপাতালে ছেলেরা এসে কিসব অপারেশন করে। এ জন্য ডাক্তার ১৫/২০ হাজার টাকা নেয়। হিজড়ারা তাদের নিয়ে আসে।

ডা. গোলাম রহমান শাহজাহান গণবিশ্ববিদ্যালয়ের প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। চাকরির পাশাপাশি এই হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেছেন। এলাকাবাসী মানিক জানান, ২০০৬ সালের জানুয়ারি মাসে এ হাসপাতালটি থানা রোডের লুৎফর নায়েবীর ৩ তলায় শুরু করেন ডা. গোলাম রহমান শাহজাহান। ওই ক্লিনিকে সাধারণ কোন রোগী যান না। মূলত লিঙ্গ কেটে হিজড়া তৈরিই ওই ডাক্তারের মূল কাজ। সূত্র জানায়, একই কায়দায় খুলনা ফুলতলার একটি ক্লিনিকে লিঙ্গ কেটে হিজড়া বানানো হয়। এছাড়া রাজধানীর শ্যামলী এলাকায়ও একটি ক্লিনিক রয়েছে। সেখানে লিঙ্গ কাটতে গিয়ে এক যুবকের মৃত্যুর খবরও পাওয়া গেছে। তবে ওই ক্লিনিকটি কিছুদিন আগে সেখান থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে।

অভিযোগের বিষয়ে রোম আমেরিকান হাসপাতালের কর্ণধার ডা. গোলাম রহমান শাহজাহান ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, আমি তো জোর করে কারও পুংলিঙ্গ কাটি না। ছেলেরা ইচ্ছাকৃতভাবেই এসে পুরুষাঙ্গ কাটতে বলে। তিনি নিজেই কিছু তথ্য দেন। তিনি জানান, প্রতিমাসে ৩/৪ জন ছেলেকে অপারেশনের জন্য হিজড়ারা ধরে নিয়ে আসে। এরা আমার কাছে রোগী। কত দিন ধরে এ ধরনের কাজ করছেন এবং এ পর্যন্ত কতজনের পুরুষাঙ্গ কেটেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ২০০৬ সালের জানুয়ারিতে হাসপাতালের প্রতিষ্ঠা থেকেই পুরুষাঙ্গ কাটা হয়। প্রতিমাসে রোগী আসে। তবে এর সঠিক হিসাব জানা নেই। এসব অপারেশন করতে ১০ হাজার টাকা নিই। লিঙ্গ কাটতে গিয়ে কেউ মারা গেছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার হাসপাতালে কেউ মারা যায়নি।

হিজড়াদের সঠিক পরিসংখ্যন নেই
হিজড়াদের কাজ করেন এমন সংগঠন বা সমিতির কাছে এমনকি রাষ্ট্রের কাছেও হিজড়াদের কোন পরিসংখ্যন নেই। হিজড়াদের সংগঠন বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি সূত্রে জানা যায়, ঢাকায় ৪০ হাজার থেকে দেড় লাখ এমএসএম (পুরুষ সমকামী) রয়েছে। সারাদেশে হিজড়ার সংখ্যা ১০ থেকে ১৫ হাজার। বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা সূত্রে জানা যায়, সারাদেশে ৫০ হাজার হিজড়া রয়েছে। অন্যদিকে সমাজ বিজ্ঞানী ড. আমানুল্লাহ ফেরদৌস জানান, ডেমোগ্রাফি সূত্র অনুযায়ী বাংলাদেশে সমকামী ও হিজড়ার সংখ্যা প্রায় ৪ লাখ। এর মধ্যে ঢাকায় হিজড়ার সংখ্যা ২৫ হাজারের বেশি। ঢাকায় সমকামীর সংখ্যা প্রায় দেড় লাখ।

নকল হিজড়া পাকড়াও করতে আসল হিজড়ারা মাঠে
নকল হিজড়া ঠেকানোর ডাক দিয়েছে টঙ্গীর আসল হিজড়ারা। তাঁরা প্রচারপত্র বিতরণ করে বিভিন্ন এলাকায় দায়িত্বপ্রাপ্ত আসল হিজড়াদের বখশিশ দেওয়ার দাবি জানিয়েছে। তাঁদের অভিযোগ, ভুয়া হিজড়ারা তাঁদের পেশার সুনাম নষ্ট করে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। ওই প্রচারপত্রে হিজড়া সর্দারণী কাকলী তিনটি মোবাইল ফোন নম্বর দিয়ে নকল হিজড়াদের স¤পর্কে খোঁজ দিতে অনুরোধ জানানো হয়েছে। গত কয়েক দিন ধরে টঙ্গীর বিভিন্ন এলাকায় এ প্রচারপত্র বিলি করা হচ্ছে। টঙ্গীতে অর্ধশতাধিক আসল হিজড়া রয়েছে। কিছুদিন ধরে প্রায় দুই শতাধিক হিজড়ার আবির্ভাব ল্য করা গেছে। তাঁরা বিভিন্ন এলাকায় নবজাতক নাচাতে গিয়ে জানতে পারে হিজড়া পরিচয়ে কারা যেন বখশিশ নিয়ে যাচ্ছে। কয়েক বছর আগে একটি নবজাতক নাচাতে ২০০-৩০০ টাকা বখশিশ পেত। এখন কমপে দুই হাজার টাকা বখশিশ মেলে এ সুযোগ নিতে অনেক ভুয়া হিজড়া এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। প্রজনন মতাস¤পন্ন নারী-পুরুষরা হিজড়ার বেশ ধরে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। নকল হিজড়াদের কণ্ঠস্বর শুনলেই তাদের চিহ্নিত করা যাবে। জানা যায়, বিভিন্ন স্থানে ইতিমধ্যে নকল হিজড়া পাকড়াও করতে আসল হিজড়ারা মাঠে নেমেছেন। তবে সবাই নিজেদের আসল বলে দাবি করছেন। কোথাও কোথাও এ নিয়ে তুমুল বাগি¦তণ্ডা চলছে। গত কয়েক যুগ ধরে টঙ্গীর তুরাগের পারে আখড়ায় হিজড়ারা দলবদ্ধ হয়ে বসবাস করে আসছে। সম্প্রতি বিভিন্ন এলাকায় নতুন নতুন আস্তানা গড়ে উঠেছে। নাচ-গান করে হিজড়ারা নবজাতক নাচিয়ে ও হাটবাজারে গান গেয়ে বখশিশ আদায় করে জীবিকা নির্বাহ করে। এদের কজন আসল আর কজন নকল এ নিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে।

কাজের বুয়ারাও হিজড়াদের সোর্স
কাজের মহিলা রোকেয়া। থাকে খুলনায়। কিন্তু ঢাকায় এসে হিজড়াদের সোর্স হিসেবে কাজ করে মাসে ১৫ হাজার টাকা কামিয়েছে অনুসন্ধানে এমন অভিযোগও পাওয়া গেছে। মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট সারা তানজিনা ইভা তার বুয়া রোকেয়ার হিজড়া কানেকশনের তথ্য দেন। তিনি বলেন, ৪০ বছর বয়স্ক রোকেয়া খুলনায় তার শ্বশুর বাড়িতে বুয়ার কাজ করত। কিছুদিন আগে সে ঢাকায় তার মিরপুরের বাসায় উঠে বলে আপা আপনার বাসায় কিছুদিন থাকব। আমি রোকেয়ার কথায় সরল মনে রাজি হয়ে যাই। আমার সন্তান তার কাছে রেখে আমি অফিসে চলে আসি। কিন্তু দেখতে পাই আমি অফিসে চলে আসার পর সে বাইরে কোথায় যেন চলে যায়। তাকে জিজ্ঞেস করলে বলে, আÍীয়ের বাসায় গিয়েছি। কিন্তু প্রায়দিন এভাবে সে না বলে বাইরে যায় এবং রাতে আসে। এটা দেখে আমাদের সন্দেহ হয়। তার গতিবিধি অনুসরণ করতে গিয়ে দেখতে পাই সে হিজড়াদের হয়ে কাজ করে। সোর্সের মতো তার কাজ। কোন বাসায় কার সন্তান হল অন্য কাজের বুয়াদের থেকে সে তথ্য নিয়ে সেই তথ্য হিজড়াদের জানায়। এতে সে প্রতিদিন অন্তত পাঁচশ টাকা করে পায় বলে স্বীকার করে।

ওদের পতিতাবৃত্তি এবং একটি খুনের ঘটনা
ফার্মগেট, পরীবাগ ফুট ওভারব্রিজ, মহাখালী ফাই ওভারের নিচে, রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, সংসদ ভবন এলাকা, চন্দ্রিমা উদ্যান, ধানমণ্ডি লেক, কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনসহ বিভিন্ন স'ানে রাতের আঁধার নামলেই পতিতাবৃত্তিতে নেমে পড়ে অনেক হিজড়া। পতিতার আড়ালে করে ছিনতাই। রাতে পথচারীরা রেহাই পায় না তাদের হাত থেকে। ফুট ওভারব্রিজগুলোতে উঠলেই তাদের ডাকে সাড়া দিতে হবে, নইলে টানাহিঁচড়া শুর" করে দেয়। অনেকে নারী ভেবে আমোদফুর্তি করার জন্য তাদের নিয়ে যায় বাসায়। পরে হিজড়া দেখে মারামারি এমনকি খুন-খারাবির ঘটনাও ঘটে। ২০০৪ সালের ২১ সেপ্টেম্বর রাতে ধানমণ্ডির কলাবাগান এলাকার এক শিক সোহাগী নামের এক হিজড়ার হাতে খুন হন। ওই ঘটনায় সোহগীকে গ্রেফতারও করে পুলিশ।

দুই হিজড়া নিহত হওয়ার পেছনের কথা
২১ ফেব্র"য়ারি রাতে রাজধানীর পল্লবী থানার ইস্টার্ন হাউজিংয়ের বকুলতলা থেকে আনোয়ার ওরফে আলাউদ্দিন (২৭) নামের এক হিজড়ার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তাদের অভ্যন-রীণ বিরোধের জের ধরে আলাউদ্দিন নিহত হয়। আলাউদ্দিনসহ ৫-৬ জন হিজড়া মিরপুরের বিভিন্ন এলাকায় চাঁদা তুলত বলে জানা গেছে। পল্লবী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইকবাল হোসেন জানান, লাশটি উদ্ধারের সময় তার মুখমণ্ডলে একাধিক আঘাতের চিহ্ন ছিল। গলায় পেঁচানো ছিল ওড়না। মেয়ে সেজে পতিতাবৃত্তি করতে গিয়ে সে খুন হয়েছে। এছাড়া চাঁদা তোলার জের ধরে এলাকার সীমানা নির্ধারণসহ নানা কারণে হিজড়াদের মধ্যেই গ্র"পিং ও আধিপত্য রয়েছে। এ ঘটনার জের ধরেও আলাউদ্দিন খুন হতে পারেন। ২২ ডিসেম্বর বাড্ডা এলাকার নয়ানগরের ৫ নম্বর রোডের ১৫ নম্বর বাসায় চাঁদা চাইতে যায় পাপিয়া হিজড়া। তার সঙ্গে আরও ৪ জন হিজড়া ছিল। বাড্ডা থানার এসআই শেখ সাইফুল ইসলাম জানান, সন্তান নাচাতে ৫ হাজার টাকা দাবি করে পাপিয়া। বাড়িতে কোন পুর"ষ না থাকায় টাকা দিতে অপারগতা জানায় ওই গৃহবধূ। টাকা না পেয়ে মারধর করে তাকে। এ সময় স'ানীয় জনগণ ছুটে এলে তারা ৫ তলা বাড়ির ছাদে পালিয়ে যায়। জনগণ ছাদে উঠলে পাপিয়া পাইপ বেয়ে নামতে গিয়ে হাত ফসকে মাটিতে পড়ে মারা যায়। থানায় অপমৃত্যু মামলা করা হয়।

কোটিপতি হিজড়া
হিজড়াদের মধ্যে কারও কারও রয়েছে অঢেল স¤পদ। তারা কিভাবে এসব স¤পদ গড়েছে সংশ্লিষ্টরা তার কোন জবাব দিতে পারেনি। তবে নানা মাধ্যমে অনুসন্ধান করে জানা গেছে, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, সন্ত্রাসীদের আশ্রয়সহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করে অঢেল স¤পত্তির মালিক হয়েছে অনেক হিজড়া। খিলতে এলাকায় দলনেতা নাজমার অধীনে রয়েছে ৪০ জন হিজড়া। ৩০ বছর আগে পুরষাঙ্গ কেটে হিজড়া হয়েছে নাজমা। সে এলাকায় মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে বেশ পরিচিত। তার প্রায় অর্ধকোটি টাকা বিভিন্ন গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের কাছে সুদে দেয়া আছে। সব মিলিয়ে বর্তমানে তার মাসিক আয় প্রায় ২ লাখ টাকা। ঢাকায় তার তিনটি বাড়ি ছাড়াও একাধিক প্লট রয়েছে। তার এসব বাড়ি সায়দাবাদ, খিলেেত ও গাজীপুর বোর্ডবাজার এলাকায়। খিলতে বটতলা এলাকার আলম জানান, বটতলা ক-১৮৩/৫ নং মায়ের দোয়া নাজমা ভিলায় থাকে নাজমা। এটি তার নিজের বাড়ি। খিলতে নামার বউরাইতে দুটি প্লটও রয়েছে তার। নাজমা একাধিক ছেলেকে ভারত, খুলনার ফুলতলা ও ধামরাইয়ের রোম আমেরিকান হাসপাতাল থেকে হিজড়া বানিয়েছে। ধলপুর এলাকার আবুল হিজড়াও দুটি বাড়ি ও কয়েক কোটি টাকার মালিক বনে গেছে মাদক ব্যবসা ও চাঁদাবাজি করে। তার ভাগ্নে রবিন জানান, গোলাপবাগ এলাকার ১৩/বি/১ নম্বরে ৫ তলা ও ধলপুর লিচুবাগানে একটি ৪ তলা ভবনের মালিক আবুল। দণিখান থানার মধ্য ফায়দাবাদ এলাকার দলনেতা রাহেলা হিজড়াও মাদক ব্যবসা ও চাঁদাবাজি করে টাকার পাহাড় গড়েছে বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে। তার আসল নাম মোহাম্মদ আলী। প্রায় ৩২ বছর আগে হিজড়া হয়েছে সে। তার নিজস্ব ক্যাডার বাহিনীও আছে দণিখান থানা এলাকায়।

৬৫ হাজার হিজড়া পুনর্বাসনে সরকারের উদ্যোগ
দেশের ৬৫ হাজার হিজড়া জনগোষ্ঠীকে সমাজের মূল স্রোতধারায় ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। এজন্য শিগগিরই বাস্তবায়ন করা হচ্ছে হিজড়া পুনর্বাসন প্রকল্প। এরই মধ্যে সমাজসেবা অধিদপ্তর এ নিয়ে তাদের চূড়ান্ত প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে। প্রস্তাবে দুই বছর মেয়াদি কর্মসূচির জন্য ১৫ কোটি টাকা ব্যয় বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে।

একইসঙ্গে প্রকল্পে মাসিক ভাতা, স্বাস্থ্য কার্ড বিতরণ, ুদ্র ঋণ দেয়াসহ বিভিন্ন সহায়তার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সমাজসেবা অধিদপ্তরের প থেকে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশের হিজড়া জনগোষ্ঠীর প্রাথমিক ও কারিগরি শিা, নিরাপদ বাসস্থান, চিকিৎসাসেবা, ভাতা প্রদান ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থাই হবে এ প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য। প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়েছে, চলতি
বছরের জুলাই থেকে ২০১৩ সালের জুন পর্যন্ত। ৬৪ জেলার হিজড়া জনগোষ্ঠী এ প্রকল্পের আওতায় আসবে।

ব্যাংকে খেলাপি ঋণের টাকা আদায়ে নিয়োগ হবে হিজড়া!
খেলাপি ঋণের টাকা আদায়ের জন্য গড়ে তোলা প্রশ্নবিদ্ধ রেসকিউ টিমে 'হিজড়াদের' সংযুক্ত করার জন্য কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংক নতুন নিয়ম চালু করেছে। হিজড়া সদস্য ব্যতীত 'টাকা আদায়কারী কমিশন এজেন্ট' নিয়োগ না দেওয়ার কথাও জানিয়ে দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তারা। তাদের অভিমত হচ্ছে, হিজড়ারাই কেবল দলবদ্ধভাবে বিভিন্ন গ্রাহকের বাড়ি গিয়ে হৈচৈ-হাঙ্গামা করে বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি এবং গ্রাহকদের সামাজিকভাবে পর্যুদস্ত করতে পারবে। ফলে বিপাকে পড়ে খেলাপি ঋণ গ্রাহকরা ঘরবাড়ি বিক্রি করে হলেও সুড়সুড় করে টাকা নিয়ে ব্যাংকে হাজির হতে বাধ্য হবেন। রেসকিউ টিম তৈরির কমিশন এজেন্ট হওয়ার নিয়ম-কানুনের গোপন ফিরিস্তি জানতে পারা গেছে। বেসরকারি দুটি ব্যাংকের কর্তৃপ 'যে কোনো গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা আদায়ের মতো প্রভাব-প্রতিপত্তি ছাড়াও প্রতি টিমে ৫ জন করে হিজড়া সদস্যকে' স¤পৃক্ত করার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন। হিজড়াদের নাম-ঠিকানা সংযুক্ত করে আবার আবেদন করা হলেই কেবল 'কমিশন এজেন্ট' হিসেবে ব্যাংক কর্তৃপ অনুমোদন দেবে বলেও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি বেসরকারি ব্যাংকের একজন উপ-মহাব্যবস্থাপক মর্যাদার কর্মকর্তা জানিয়েছেন, হিজড়া সদস্যরা দলবেঁধে ঋণখেলাপি গ্রাহকের বাড়ি গিয়ে পুরো পরিবারকে বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে ফেলতে পারে। গ্রাহকদের সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন না করা পর্যন্ত তারা স্বেচ্ছায় টাকা পরিশোধে আগ্রহী হয় না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

দেশে একমাত্র হিজড়া মেলা নাটোরের গুরুদাসপুরে
গত ১০ ফেব্র"য়ারী নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার নাজিরপুর ইউনিয়নের গুপিনাথপুর বাজারে দিনব্যাপী হিজড়া মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে। স্থানীয় সমাজসেবক ফজলুর রহমানের তার একক উদ্যোগে ব্যাতিক্রমী এই মেলার আয়োজন করেন। তিনি জানান, হিজড়া সম্প্রদায় মানুষ হলেও সমাজে তারা বঞ্চিত-অবহেলিত। তাদের কোথাও কোন বিনোদনের ব্যবস্থা নেই । মূলতঃ তাদের বিনোদন এবং আতœ সংশোধনী মূলক আলোচনায় অংশ নিতেই ব্যতিক্রমী এই মেলার আয়োজন করা হয়। মেলায় জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে মোট ১১৩ জন হিজড়া অংশ নিয়েছিলো। দিনব্যাপী এই মেলায় তারা নাচ-গান ও নাটিকা উপস্থাপন ছাড়াও আলোচনায় অংশ নেন। স্থানীয়দের সহযোগীতায় আয়োজিত এই মেলায় অংশগ্রহণকারী হিজড়াদের জন্য বিনামূল্যে দিন ও রাতে খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। একই সাথে বিভিন্ন ইভেন্টে অংশগ্রহণকারী হিজড়াদের পুরস্কৃতও করা হয়। দুবছর ধরে এই মিলনমেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তেবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান গোলাম সরোয়ার জানান, সাধারণত হিজড়াদের স্থায়ী কোনো ঠিকানা নেই। তবে নাটোর শহরের তেবাড়িয়াতে হিজড়া পাড়া আছে। সেখানে শ' খানেক অস্থায়ীভাবে বসবাস করে।

হিজড়াদের নিয়ে কাজ করা সংস্থা
ঢাকা শহরে বেশ কয়েকটি সংস্থা এদের নিয়ে কাজ করছে। বাঁধন, ২০৩, কুড়িল বিশ্বরোড। গুডপাপ, আব্দুলাহপুর, বাড্ডা। বল্কু, সোস্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি, কাকরাইল। সুস্থ জীবন প্রকল্প, শ্যামপুর।

হিজড়ারাদের গুরুই সব কিছু
এরা মূলত নতুন শিশু হলে যেখানে গিয়ে নাচ গান করে আয় রোজগার করে কিন্তু আজকাল এ পথ প্রায় বিলুপ্তির পথে। এরা এখন নানা পেশায় কাজ করে। বাড়ির কাজ, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মনোজ্ঞ জন্য, পতিতালয়ে, নৃত্যের জলসায়, যৌন কর্মী, সিনেমার এক্সট্রা প্রভৃতি হিসেবে কাজ করে থাকে। হিজড়ারা দলবদ্ধ হয়ে বাস করে। এদের বয়োজেষ্ঠতা বেধে গুরু মা, গুরু দাদা, গুরু নানা প্রভৃতি সম্ভোধনে ডাকা হয়। এরা প্রচলিত বিচার ব্যবস্থায় আসতে চায়না। তারা তাদের নিজস্ব গুরুর বিচারই সব কিছু বলে মনে করে। গুরু এদের লাল শাড়ী কপালে পড়িয়ে আচল ছুয়ে তাদের দলভুক্ত করে নেন। তারপর আর তাদের যাবতীয় বিষয় গুরুর। তাদের আয়ের সব টাকা গুরুর হাতে দেওয়া হয়। কোন সময় অপরাধ করলে সাধারণত তারা অর্থে দন্ডে দন্ডিত হয়।

ঢাকার হিজড়া সম্প্রদায়
সারা বিশ্বেই হিজড়ারা একটি কমিউনিটি মেইনটেইন করে এবং কমিউনিটি এর মধ্য তারা আবার যোগাযোগ রা করে। ঢাকাতেও তার বিকল্প নয়। ঢাকাতে হিজড়ারা মূলত পাঁচটি দলে বিভক্ত। এক দলের হিজড়ারা অন্য দলের এলাকায় গিয়ে টাকা তুলতে পারবে না। তাদের এই পাঁচটি দলের প্রত্যেকটিতে আছে একজন করে গুরু। এসব এলাকা আর
তাদের গুরু হচ্ছে।
১. শ্যামপুর, ডেমড়া ও ফতুল্লা, গুরু- লায়লা হিজড়া।
২. শ্যামলী, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, গুরু- হামিদা হিজড়া।
৩. সাভার, ধামরাই, গুরু- মনু হিজড়া।
৪. নয়াবাজার ও কোতোয়ালী, গুরু- সাধু হিজড়া।
৫. পুরোনো ঢাকা, গুরু- দিপালী হিজড়া।

ঢাকার হিজড়া ও তাদের আয়
তাদের স্বপ্রণীত আইন অনুযায়ী ছেলে সন্তান হলে পাঁচ হাজার টাকা, মেয়ে সন্তানের জন্য ৩ হাজার টাকা ও বিয়ের জন্য ৫ থেকে ১০ হাজার, অন্যান্য অনুষ্ঠানে আরও কয়েক হাজার টাকা দিতে হয়। এছাড়া দোকানে দোকানে দলবেঁধে গিয়ে চাঁদাবাজি করে। চাঁদার টাকা না দিলেই গালাগাল করে। টাকা না পেয়ে দোকানের মালামাল নিয়ে যায় তারা। ঢাকার হিজড়ারা ৫ টি জোনে বিভক্ত ৬ জন গুরুর অধিনে। শ্যামপুর, ডেমরা, ফতুল্লা- গুরু লালন হিজড়া। শ্যামলী, মোহাম্মদপুর, মিরপুর- হামিদা হিজড়া। নয়া বাজার, কতোয়ালী- গুরু লাল হিজড়া। সাভার, ধামরাই- গুরু মনু হিজড়া। পুরান ঢাকা- গুরু দিপালী হিজড়া। নিচে পেশা অনুসারে এদের দৈনিক আয়ের একটি তালিকা দেওয়া হল নবজাতকের উৎসবে- ১,০০০ থেকে ৫,০০০ টাকা। চাঁদা (দোকান)- ৫০০ থেকে ৫,০০০ টাকা। বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাঁদা- ৫০০-৫,০০০ টাকা। যৌন কর্মী- ০ থেকে ৩০০ টাকা। অন্যান্য- ০ থেকে ২,০০০ টাকা। এদের আয়ের সব টাকাই এরা গুরুর হাতে দিয়ে দেয়। তাই দেখা যায় হিজড়াদের অনেক গুরুরই ঢাকার শহরে বাড়ি রয়েছে। আয়ের বেশিরভাগ টাকাই এরা সাজে ব্যবহার করে থাকে।

হিজড়াদের চিকিৎসা
প্রাথমিক ভাবে চিকিৎসা করলে হিজড়ারা সুস্থ হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু অস্ত্র পাচারের মাধ্যমে বয়স বেড়ে গেলে তা আর পারা যায় না। দেরীতে হলেও বাংলাদেশে ঢাকা মেডিকেল, বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমান মেডিকেল কলেজে এর চিকিৎসা ব্যবস্থা চালু হয়েছে।

হিজড়াদের স্বীকৃতি
হিজড়ারা আমাদের কারো না কারো পরিবারের সদস্য। প্রকৃতির নিয়মে এরা এসেছে তাই এদের অবজ্ঞা না করে সমাজে মুল স্রোতে নিয়ে আসতে হবে। দেরীতে হলেও নির্বাচন কমিশন এদের ভোটার তালিকায় নিবন্ধন করেছেন। হয়তো নতুন সূর্যোদয়ের কোন এক সকালে আমাদের দেশে ও এদের সহজ করে নেয়া হবে।

হিজড়াদের শেষকৃত্য
হিজড়াদের মারা গেলে কবর দেয়ার বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে। ঘরের ভিতরে যে বিছানায় থাকে তার নিচেই তাদের দাফন করা হয়। এখন অবশ্য জায়গার অভাবে যেখানে সেখানে দেয়া হয়। কবরে প্রথমে লবন তার পর লাশ তারপর ফুল ও লবন দিয়ে কবর দেওয়ার বিশ্বাস। এতে তার পরবর্তীতে পূর্ণ পুরুষ অথবা নারী হয়ে জন্মাবে।

আইনে যা বলা আছে
ব্রিটিশ শাসনামলে হিজড়াদের বিতাড়িত করার পাশাপাশি তাদের যৌনতার বির"দ্ধে আইন করা হয়। ওই আইনে হিজড়াদের যৌনতাকে সডোমি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। পেনালকোডের ধারা ৩৭৭-এ বলা হয়েছে, এটা শাসি-যোগ্য অপরাধ। বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস-বায়ন সংস'ার মহাসচিব অ্যাডভোকেট সিগমা বলেন, এদের নিয়ে আলাদা কোন আইন নেই। পরিবারের কাছে এবং সমাজের কাছে তাচ্ছিল্যের শিকার। বেঁচে থাকার তাগিদে তারা দোকানে দোকানে ও বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাঁদা উঠায় বলে শুনেছি। তবে এদের বিষয়ে ভাবা উচিত। বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটির ডেপুটি ম্যানেজার এএসএম রহমত উল্লাহ ভূঁইয়া বলেন, হিজড়াদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড কোন মতেই মেনে নেয়া যায় না। যারা এ ধরনের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত তাদের আইনগতভাবে শাসি- হওয়া দরকার।"

বিশেষজ্ঞরা যা বললেন
হরমোন বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. মোঃ হাফিজুর রহমান বলেন, পুরুষাঙ্গ কেটে হিজড়া হলে তাদের জীবনে ভয়াবহ ঝুঁকি থাকে। দেহের হাড় য় হয়, শারীরিক শক্তি কমে যায়। এছাড়া নানা রোগের সৃষ্টি হয়। তিনি বলেন, আমাদের সমাজে হিজড়া বলতে তাদের বোঝায় যারা শারীরিকভাবে পুরুষ কিন্তু মানসিকভাবে নিজেদের মেয়ে ভাবে, মেয়েদের পোশাক পরতে ও মেয়েদের মতো ব্যবহার করতে পছন্দ করে। এটা হরমোনজনিত বিষয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, জাতীয় এইডস বিশেষজ্ঞ ও সমাজ বিজ্ঞানী ড. আমানুল্লাহ ফেরদৌস বলেন, লিঙ্গ কাটলে তাদের হিজড়া বলা যাবে না। তারা হল বিকলাঙ্গ। লিঙ্গ কাটার কারণে ওই ব্যক্তি পারিবারিক সমস্যা, সামাজিক সমস্যা, সাাংস্কৃতিক সমস্যা ও হীনমন্যতায় ভুগবে। সমাজ তাকে দূরে রাখবে। লিঙ্গ কাটা সমাজে মারাÍক ধরনের অপরাধ। এর সঙ্গে যে দুষ্টচক্র জড়িত তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয়ভাবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া দরকার। তিনি বলেন, রাষ্ট্রীয় কাঠামো দুর্বল হওয়ার কারণেই এ ধরনের ঘটনা ঘটাচ্ছে দুষ্টচক্রটি। রাষ্ট্রকে এর বিহিত করতে হবে, নইলে সমাজ অধপতনের দিকে ধাবিত হবে। পুংলিঙ্গ কেটে হিজড়া হওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার মহাসচিব অ্যাডভোকেট সিগমা হুদা বলেন, তার জানামতে, অনেক ছেলে স্বেচ্ছায় হিজড়া হচ্ছে। জয়া হিজড়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, চট্টগ্রামের ছেলে জয় পুংলিঙ্গ কেটে এখন জয়া। তাকে নিয়ে আমি টেলিভিশনে একটি প্রোগ্রামও করেছি। পরে জেনেছি তার হিজড়া হওয়ার কাহিনী। তাদের নিয়ে আলাদা কোন আইন নেই।

ভুক্তভুগী
মালিবাগ রেলগেট এলাকার ৩৮/এ নম্বর রোডের ৩ তলা বাড়ির কেয়ারটেকার রাজিব। মাসখানেক আগে তার ছেলে সন্তান জন্মেছে। খবর পেয়ে একদল হিজড়া তার বাসায় হাজির। তার সন্তান আরিফকে নাচাবে। এ জন্য ৫ হাজার টাকা দাবি করে। রাজিব বলেন, ৫ হাজার দিতে পারব না জানালে তারা গালাগাল শুর" করে। একপর্যায়ে আমার ঘরের আসবাবপত্র ভাংচুর করে। মোহাম্মদপুরের শিয়া মসজিদের কাছে ২৪/এ বাসার ৬ তলায় একদল হিজড়া চাঁদা আদায় করতে যায়। চাঁদার টাকা না পেয়ে তারা ওই বাড়ি ভাংচুর করে। থানায় এব্যাপারে অবহিত করলেও তার কোন ব্যবস্থা নেওয়া হনি বলে অভিযোগ করেন ভুক্তভুগী আশরাফ। যাত্রাবাড়ীর চায়ের দোকানদার খলিল বলেন, কি বলব ভাই। হিজড়াদের টাকা না দিয়ে উপায় নেই। আগে ৫ টাকা দিলে নিত। এখন ১০ টাকার কমে নিতে চায় না। টাকা না দিলেই দোকানের কাস্টমারের সামনে কাপড়-চোপড় খুলে ফেলে। মিরপুরের সিএনজি চালক আব্দুল কুদ্দুস সালমান বলেন, তাদের টাকা দিতেই হবে। নইলে মান-সম্মান যাবে।

সরেজমিন
এখন ঢাকা মহানগরীতে হিজড়াদের প্রতিনিয়ত চোখে পড়ে। নারীর পোষাক পড়ে সুন্দর মেকাপ করে তারা মাঠে নামে। সরেজমিনে দেখা যায় লালবাগের পোস্তা এলাকার রিয়াজ উদ্দিনের বাড়িতে একটি ছেলে সন্তান হলে সেখানে হানা দেয় একদল হিজড়া। ৫০০০ হাজার টাকা না দিলে কোন ভাবেই যাবে না বলে জানান দেয়। অবশেষে বাধ্য হয়ে পুরো ৫০০০ হাজার টাকা দিলে তারা চলে যায়। মালিবাগ হোসাফ শপিং মলের সামনে দেখা গেলো একদল সুন্দরী হিজড়া প্রত্যেক চায়ের দোকান থেকে টাকা তুলছে। মাইনুদ্দিন নামের এক চায়ের দোকানদার টাকা দিতে না চাইলে তারা মুহুর্তের মধ্যেই দোকানের সব মালামাল রাস্তায় ফেলে দেয়। তাদের আচরণ দেখে অন্য দোকানিরা পড়ে টাকা দিতে বাধ্য হয়। মহাখালীর একটি কর্পোরেট অফিসে দেখা গেলো একদল হিজড়া টাকার জন্য অফিসে এসে গন্ডগোল শুরু করে দেয়। পড়ে বাদ্য হয়ে অফিস কর্তৃপ টাকা দিলে তারা অফিস থেকে চলে যায়।

কর্তৃপক্ষ যা বললেন
র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উনংয়ের পরিচালক কমান্ডার সোহায়েল বলেন, দিনে দিনে হিজড়ার উৎপাত বাড়ছে। এদের সদস্য সংখ্যাও বাড়ছে। এটা উদ্বেগের বিষয়। উত্তরা এলাকায় হিজড়াদের তৎপরতা বেশি। অনেকে মাদক ব্যবসা ও পাচারের সঙ্গে জড়িত। বিশেষ করে টেকনাফ থেকে ঢাকায় যেসব ইয়াবা আসে তার সঙ্গে জড়িত হিজড়াদের একাংশ। তিনি জানান, অনেক হিজড়া ছিনতাইয়ের সঙ্গেও জড়িত আছে। বাসায় বাসায় গিয়ে চাঁদার টাকা চায়। টাকা না দিলেই ৫০/৬০ জন হিজড়া জড়ো হয়ে আপত্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি করে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের উপ-কমিশনার মনিরুল ইসলাম অভিনব পন্থায় হিজড়া তৈরির খবর শুনে বিস্মিত হন। তিনি বলেন, পুংলিঙ্গ কেটে হিজড়া বানাচ্ছে এ ধরনের কোন অভিযোগ আমাদের কাছে নেই। কারও অঙ্গহানি করা পেনালকোডে ৩২৬ ধারায় অপরাধ। তবে এ ধরনের কর্মকাণ্ডের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।

আমার এই লেখাটি গতকাল ১ লা মে দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত হয়েছে ।