একটি হোসেন ব্রাদার্স ও মহাসড়কে লাশের মিছিল…

মোহিব্বুল মোক্তাদীর তানিম
Published : 2 June 2012, 06:25 AM
Updated : 2 June 2012, 06:25 AM

নব্বই দশকজুড়ে যারা কক্সবাজার শহরের বিভিন্ন স্কুল-কলেজে পড়ালেখা করেছেন তাদের কাছে হোসেন ব্রাদার্স এক সু-পরিচিত নাম। পরীক্ষার আগের দিন তড়িঘড়ি করে 'কলম-পেন্সিল-রাবার-রোলার' কেনা থেকে শুরু করে নিউজপ্রিন্ট পেপার কিংবা ডিমাই কাগজের খাতা কেনা অথবা পছন্দের জ্যামিতি বক্স নেওয়া; সব ব্যাপারেই একমাত্র গন্তব্য হোসেন ব্রাদার্স। শিক্ষার উপকরণ সামগ্রী বিক্রয়ের পেশাদারিত্ব নিয়ে এ প্রতিষ্ঠানটি শুধু ব্যবসায়িক মুনাফা অর্জন করেছে বললে প্রতিষ্ঠানটির প্রতি অবিচার হবে; ছাত্র-ছাত্রীদের চাহিদার সঙ্গে যোগানসই সবধরনের শিক্ষা-সামগ্রী সব-সময় মিটিয়ে অর্জন করেছে সবার আকণ্ঠ ভালবাসা।

লক্ষ করুন- প্রথাগত ভাবে হোসেন ব্রাদার্স একটি স্টেশনারি দোকান হলেও কক্সবাজার শহরবাসীদের কাছে এটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মতই আবেগঘন ও ভাললাগার এক গন্তব্য।। শহরজুড়ে আজ অনেক স্টেশনারী দোকানের ভীড়ে ও 'হোসেন ব্রাদার্স' এখনো ছাত্র-ছাত্রী আর অভিভাবক মহলে সমান গ্রহনযোগ্য, চিড় ধরেনি জনপ্রিয়তায় বিন্দুমাত্র।

শশ্রুমণ্ডিত হোসেন সাহেবের আন্তরিক ব্যবহার ও তার ভাইদের সহ-উপস্থিতি ও পারিবারিক অর্থনৈতিক অবলম্বনের এ প্রতিষ্ঠানটি তাদের পারিবারিক বন্ধনকে করেছে সুসংহত, সমাজের শিক্ষিত সমাজে তারা পেয়েছেন গ্রহনযোগ্যতা, সম্মান ও জনপ্রিয়তা।

উপরোল্লিখিত এ ধরনের হোসেন ব্রাদার্স বাংলাদেশের প্রতিটি মফস্বল শহরে হয়ত খুজে পাওয়া যাবে, কক্সবাজারের 'হোসেন ব্রাদার্স' হয়ত আজ থেকে সেই আগের মত সমহিমায় উদ্ভাসিত আর হবে না, পরীক্ষার আগের দিন অভিভাবক কিংবা ছাত্র-ছাত্রীরা উদ্ভিগ্ন হয়ে কলম-পেন্সিল কিনতে গিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলবেন, স্মৃতি হাতড়াবেন।।

গত ১লা জুন কক্সবাজারের চকরিয়ার ডুলহাজারায় বাস-মাইক্রো সংঘর্ষে নিহত সাতজনের ছয় জনই যে কক্সবাজার হোসেন ব্রাদার্স ফ্যামিলির।

আগের দিন ঢাকার কেরানিগঞ্জে একই পরিবারের বারজনের নিহত হওয়ার খবরে হোসেন সাহেবকে সতর্ক করা হয়েছিল যাতে অন্তত পক্ষে মাইক্রো করে না যায়। একমাত্র ছেলে সদ্য বিবাহিত আশিকের শশুর বাড়ি ফেনীতে যাওয়ার জন্য উৎসব মুখর এসব যাত্রা তে কি আর সতর্কতা প্রশ্রয় পায়? হাত-পা মুড়ি দিয়ে বাসায় বসে থাকায় কি সতর্কতা? ফেনী পৌছানোর কথা ছিল দুপুরের আগেই। কিন্তু হায়! আশিক কে সারা জীবনের জন্য বোবা কান্নার অংশীদার বানিয়ে দিল নিষ্ঠুর বাস। মুহুর্তেই বাবা-মা-চাচা-বোন হারাল সে।

কক্সবাজার শহরবাসী হারাল এক প্রানবন্ত হোসেন ব্রাদার্স । লক্ষাধিক জনতা অশ্রুসজল বিদায় জানাল হোসেন ব্রাদার্স ফ্যামিলি কে কক্সবাজার স্ট্যাডিয়ামে।

এতেই আমাদের দায়িত্ব শেষ। আমরা আবার ভাগ্যর হাতে সর্পে দিব নিজেদের। আমাদের মতই কেউ না কেউ কিংবা আপনজন আবারো দুমড়ে-মুছড়ে যাবে এক-দুজনের মুহুর্তের অসতর্কতার কারণে।
মিশুক মনির – তারেক মাসুদ দের লাশের মিছিল হতে আশার আলো ছিল প্রশাশন উদ্যোগী হবে, অপরাধীরা(খুনী ড্রাইভার) শাস্তি পাবে, গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে ডিভাইডার থাকবে… আরো কত কি।

নিন্দুকেরা বলবে "এটা তো স্রেফ দূর্ঘটনা"
আমরা বলব "এটা দূর্ঘটনা নয়, এটা খুন"।।

সড়ক পথে এসব যানবাহন সংঘর্ষ নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে, দায়িত্বশীল রা যখন গরু-ছাগল চেনাটাই ড্রাইভারের দায়িত্ব বলতে দ্বিধা করেনা; ওখানে এসব প্রতিকারের কথা বার বার বলাটা ছন্দহীন তবলা বাজানোর মতই ঠেকে। হতাশ জাতি তারপর ও আশায় থাকে। রাজপথে প্রশাসনের রক্তচক্ষু দেখা জাতি মহাসড়কে ও প্রশাসনের উদ্যোগপূর্ণ স্ব-উপস্থিতি আশা করতেই পারে।

আমরা এখনো বিশ্বাস করি… দোষীদের শাস্তি দেওয়া আর ড্রাইভারদের সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া সহ সামগ্রিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমরা এই যান সংঘর্ষের ভয়াবহতা কিছুটা অন্তত লাঘব করতে পারি।

পরিশেষে বিনম্র শ্রদ্বা আর ভালবাসা হোসেন ব্রাদার্স ফ্যামিলির প্রতি।।