টি এম আহমেদ কায়সারের একগুচ্ছ কবিতা

টি এম আহমেদ কায়সার
Published : 8 Sept 2011, 07:12 PM
Updated : 19 April 2022, 05:44 AM


চিত্রকর্ম: রাকীব হাসান

স্মৃতি ও বিভ্রম

ক্ষণে ক্ষণে জেগে উঠছে লক্ষ লক্ষ স্মৃতি ও বিভ্রম
মানুষ যেনবা সাপ আর সাপ যেন খরগোশের ছানা;
সস্নেহে জড়িয়ে ধরে কানে ও গলায় ভাবছি চুমো খাবো কিনা

ধারালো বর্শা হাতে যারা আজ দাঁড়িয়ে আছে, দূরে –
তাদের পেছনে আঁকবো কংসবতী নদী; পাশে –
নিরীহ নিরস্ত্র এক প্রাচীন মন্দির

জেগে উঠছে সব স্মৃতি..
মহিয়সী অরিহন্ত এক
নিজের আঙুল দিয়ে লিখেছেন এই পীঠে
জ্যোতির্ময় অক্ষরবৃন্দ, ফাল্গুন পূর্ণিমার রাতে
অনুমানে বলেছি, প্রেম – আঙুলের গতিবিধি বুঝে..

মাঝে মাঝে ভেবেছি চুম্বন
গুঢ় শব্দ ছিল আরো; আরো আরো গুঢ় অর্থ – কোনোদিন তলিয়ে দেখিনি

ঐসব মর্মলিপি – সবই কি খুয়েছি আমি দিনে দিনে অকাতরে
বিচিত্র বিচিত্র খেয়া, জীবনের বহুবিধ কূলে উপকূলে?

কে আছো শরীরবিদ, পীঠ খুঁড়ে দেখো কিছু
অবশিষ্ট আছে কিনা আজো!

ঐ যে স্পর্শটুকু, আঙুলের ঐসব অলৌকিক ভাষা
খুঁড়ে খুঁড়ে দেখি আজ কয়েক ছত্র লেখা যায় কিনা

শিশির

মধ্যরাতের পর আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে না

এই যে মাটির গভীর থেকে উঠে আসছে মৃত সব কংকালের বিলাপ
ঐ যে হাহাকার করে উঠছে একজোড়া একা ওষ্ঠ
আর এইসব আশ্চর্য পেখম –
কোথায় কোথায় যেন ভেসে চলছে সব
মাঝরাতের পর

যদি নিরীহ সব বায়ূ-রন্ধ্রে আচমকা ঢুকে পড়ে লোভ–
এই ভয়ে সঙ্গম পিপাসাও ধীরে মরে যায়

মাঝরাতের পর খুব মরে যেতে ইচ্ছে হয়
হামীর গাইতে গাইতে একটা একাকি নদীর জলধারা
গান্ধারে এসেই ভেঙ্গে পড়ছে অঝোর কান্নায়
তখন একবিন্দু শিশিরের ভেতর, ভাবি,
আরো একবিন্দু শিশির হয়ে ঢুকে পড়বো কিনা!

লাল পিঁপড়া

জগতের সব পদ্ম-সরোবর ব্যর্থ করে দিয়ে তুমি ফুটেছিলে বালু-তটে
একটা একেলা পাখি সমুদ্র-তীরে আমাদের শিয়রের পাশে বসেছিল অনেকক্ষণ

দীর্ঘশ্বাস..
দীর্ঘশ্বাস – বোধকরি আরো গভীর একাকিত্বে ডুবে যেতে যেতে তুমি অথবা আমিই ফেলেছিলাম, একান্ত গোপনে ..

ট্রেনে ফেরার পথে তুমি কি সত্যিই শরীরে ছেড়ে দিয়েছিলে ডাঁসা ডাঁসা লাল পিঁপড়া? গুচ্ছ গুচ্ছ বিষ-বিছা?
নিশিথ রাতেও এরা দলবেঁধে অঝোরে দংশিছে…

প্রেত-নৃত্য প্রহর

জেগে আছি

ভূবন তলিয়ে যাচ্ছে, ধীরে, নিদ্রায় আর অতলান্ত নৈশব্দ্যে
ইত্যবসরে কি আমরা উপনীত হয়েছি রক্তে কাঁটা দেয়া প্রেত-নৃত্য প্রহরে?
শুনতে পাচ্ছি- গোপনে কোথাও বেজে চলছে অলৌকিক ঘুঙুরগীতি
লক্ষ লক্ষ খেঁকশিয়ালের নিদ্রাতুর নিরব জৃম্ভণ!
আমাদের অতৃপ্ত পূর্বপুরুষেরা কি সহসা জেগে উঠে নিঃশব্দে মাতম জুড়েছে
এই নিষ্ঠুর 'রূপনারায়ণের কূলে', এই অগাধ নিশিথে?

জেগে আছি..
ঘুম-মগ্ন ভূবনের উপর নিরবে রচনা করছি নিজের ভাস্কর্য !

রাত তিনটে চল্লিশ মিনিট

দূর স্টেশনে ক্লান্ত রেলগাড়ির শব্দ মিইয়ে যাবার পর
রাত তিনটে চল্লিশ মিনিটে
ক্ষুদ্রান্ত্রে যে অদৃশ্য ক্ষুধাগুলি জেগে ওঠে ধীরে
যে ঘোড়ার খুরের শব্দ
অশ্রুতপূর্ব যে কথা-প্রবাহ তীক্ষ্ণ আর্তনাদ হয়ে বুকে লুটিয়ে পড়ে
যে মগ্ন শৈশব, যেসব অনুক্ত স্মৃতি ফিরে ফিরে আসে;
আর রক্তে বুদ্বুদ তোলে যে আত্ম-ধ্বংসের নেশা
এবং এই যে মনে হয় – সব ব্যর্থ, সব পরাজয়
বরং একটা একাকি গাছের গলা জড়িয়ে ধরে, ভাবি,
গলা ছেড়ে কেঁদে উঠি; আর লোকেরা ভাবুক
হয়ত একটা বিপন্ন ট্রাম রাস্তাচ্যুত হয়ে কোথাও থুবড়ে পড়েছে
এই যে প্রেম ও মৈথুন সব বৃথা বৃথা বৃথা মনে হয়..

এখন রাত তিনটে বায়ান্ন মিনিটে জানতে ইচ্ছে করছে
একজন ভাষাবিজ্ঞানী, একজন মনোবিজ্ঞানী
একজন পাঁড়-মূর্খ এবং একজন জ্ঞানী
একজন সফল এবং একজন বিফল প্রেমিক
এই বিষয়গুলো কিভাবে ব্যখ্যা করেন!

নাট্য-দৃশ্য

কিছু রক্ত সঞ্চয় করে রাখছি
পরবর্তী দৃশ্যের জন্যে…

এইসব স্থূল ঝড় থেমে যাবার পর
এক শান্ত ম্লান মাস্তুল-নোয়ানো সন্ধ্যায়
আমাদের দেখা হবে
মাঝখানে কালো গহবরের স্থলে
একটা নদী থাকলে ভাল হয়

এতকাল আত্ম-দহনে যদি তোমার মুখখানা পুড়ে যায়;
মুছে যায় চিবুকের অপার্থিব জ্যোতির্ময় রেখাগুলো
একখানা মশাল বরং জ্বালিয়ে রাখতে পারো মুখের কাছে

পরের দৃশ্যে
একটা লুপ্ত ভ্রূণ ডুকরে কাঁদবে
ধূপের সব আগুন নিভে যাওয়া অব্দি;
তোমার চোখও ঝাপসা হয়ে যাবার কথা, ক্রমে …

কিছু রক্ত সঞ্চয় করে রাখছি
এমন অমোঘ মঞ্চে
বক্ষ খুলে কাঁদতে পারি বলে ..