গ্রাম বাংলার বর্ষা

মঈনুল হোসেন টিপু
Published : 6 August 2017, 10:09 PM
Updated : 6 August 2017, 10:09 PM

টানা ঝুম বৃষ্টিতে চিরচেনা মাঠটাও অচেনা হয়ে যায়।পানিতে পানিতে পূর্ণ হয়ে যায় মাঠ ঘাট।ছোট ছোট আইলগুলো মিলিয়ে যায় পানিতে।জমির মালিকানার নিয়ম ভেঙ্গে প্রকৃতি মালিকানা পায়।হঠাৎ কোন কৃষক আইল ধরে যেতে চায় সামনে।চলাৎ চলাৎ শব্দে ঢেউ খেলে পানিতে,বৃষ্টিতে সেই ঢেউ মিলিয়ে যায়।নীল প্লাস্টিকের চাদরে মোড়া কৃষককে দূর থেকে দেখলে মনে হয় সাগরের বুকে পথ চলা একলা নাবিক।

চিরচেনা পথটা নরম হয়ে উঠে।হঠাৎ কোন পথিক এসে পায়ের চিহ্ন এঁকে যায় নরম মাটিতে।একটু পরেই বৃষ্টিতে মিলিয়ে যায় সেটি।আবার কোন পথিক আসে চেনা পথে,পদচিহ্ন এঁকে চলে যায় আপন পথে।শত সহস্র পদচিহ্ন ধরে রাখতে পারে না গাঁয়ের চিরচেনা পথটি,পথের বুকে রেখে যাওয়া চিহ্ন সেই পথই টের পায় শুধু।

বাতাসে বৃষ্টির গন্ধ,কাঁদার এটে গন্ধ মিলে দারুণ সুভাস ছড়ায়।ধুলো-বালি-কাদা মেখে বড় হওয়া গাঁয়ের মানুষগুলো সেই গন্ধ খুঁজে পায়।

কানায় কানায় পূর্ণ হওয়া পুকুরে অনবরত জল ঝরে।পাতা থেকে জমাট পানি পুকুরে পড়লে টুপ টাপ শব্দ করে।পুকুরের এক প্রান্তে আমিষপ্রিয় মানুষটি উজানের মাছ খুঁজে,হাতে কোঁচ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে।হঠাৎ উপরে উঠা কই মাছটাকে শক্ত করে ধরে,ঢুলায় ভরে বিজয়ীর হাসি হাসে অপেক্ষমাণ মানুষটি।ভরা পানিতে জাল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে কেউ কেউ।সেই পানিতে জাল মারা যেন সবার অধিকার,প্রকৃতি সেই অধিকার দিয়ে দেয়,মালিকানার নিয়ম সেখানে খাটে না।

দস্যি ছেলের দল নেমে পড়ে উঠোনে।কাঁদা আর পানিতে জলকেলি করে,মারামারি করে।হঠাৎ অন্যদিক থেকে ছোড়া কাদা চোখে পড়ে কারও।কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে,কিছুক্ষণ পর আবার হেসে শুরু করে দুষ্টুমি।ঘর থেকে বের না হওয়া সুবোধ বালকটি হঠাৎ আছাড় খেয়ে পড়ে যায়।বাকীরা হেসে উঠে,মজা নেয়।ভাবী কিংবা দাদু সম্পর্কের কেউ বলে উঠে,আছাড় খেয়েছো ভালোই হয়েছে,আছাড় খেলে রোদ উঠবে।আছাড় খাওয়া ছেলেটি এই কথা শুনে হেসে উঠে,আছাড় খাওয়ার অপমান নিমেষেই মিশে যায়।

কারো কারো ঘরে টিনের ফুটো দিয়ে পানি পড়ে।পাতিল দিয়ে রক্ষা করে কোনমতে,ভরা বর্ষণে সেটাও মানে না,স্যাঁতসেঁতে হয়ে যায় মাটির ঘর।স্যাঁতসেঁতে ঘরেও শঙ্কার মাঝে বৃষ্টিবিলাস চলে।নতুন চাল খোলায় ভাজা হয়, হরেক রকম ডাল দিয়ে তৈরি হয় করই।করই চিবুতে চিবুতে ভুলে যায় কষ্টের স্বাদ।একটু শীত শীত ভাব হলে আগুন পোহায় কেউ কেউ।উজান থেকে উঠা কই, শোল আর ঝিয়ল মাছের তরকারি রান্না হয় ঘরে ঘরে।

ঘরের এককোনে আশ্রয় নেয় মুরগিগুলো,ডানার ভেতর পরম মমতায় আগলে রাখে ছানাগুলোকে। সদ্য তাবাল হওয়া পাড়া বেড়ানো রাতা মোরগটি কেমন শান্ত হয়ে যায়।এদিন রাজা হওয়ার আর স্বাদ জাগে না,সবাই একসাথে বসে বৃষ্টি উপভোগ করে হয়ত।হাঁসগুলোর জন্য বৃষ্টি বেশ আনন্দের,ডানা ঝাপটিয়ে তাদের খুশির জানান দেয়।

রাত বাড়তে থাকলে অন্ধকারে চেয়ে যায় চারপাশ।ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘুমিয়ে পরে কেউ কেউ।পড়ুয়া ছেলেটি শব্দ করে করে পড়ে,সেই শব্দ বেশিদূর এগোয় না বৃষ্টির শব্দে।সুরেলা বৃষ্টিতে সদ্য বিয়ে হওয়া মেয়েটির প্রবাসে থাকা স্বামীর কথা ভীষণ মনে পড়ে,বৃষ্টি যত বাড়ে তার একাকীত্ব আরো বাড়ে।কৈশোরে রঙিন স্বপ্নে ভেসে যাওয়া ছেলেটির বৃষ্টির ছন্দের মত,ছন্দময় কোন কবিতার লাইন মনে পড়ে যায়।মেয়েটির কোন দুঃখ;বৃষ্টির জলের সাথে মিশে যায় নিরবে, নিবৃতে।

রাত বাড়ে।বৃষ্টি সুরেলা হয়।আরো ছন্দময় হয়।গ্রামীণ জনপদ ঘুমিয়ে পড়ে।আবার সকাল হলে সংগ্রাম শুরু হয়,প্রতিনিয়ত চলে সংগ্রাম, প্রতিদিনকার সংগ্রাম।

হাজার বছর ধরে, এভাবেই গ্রামীণ জনপদে বৃষ্টি হয়।এভাবেই ভিজিয়ে যায় চারপাশ,প্রকৃতি আর মন দুটোই।এটা আমার গ্রামের চিত্র,বৃষ্টির দিনে প্রতিদিনকার গ্রামীণ পল্লীর চিত্র।হয়তো আটষট্টি হাজার গ্রামের চিত্রও তাই।

এখানে বৃষ্টি হয় আজও। সেই চিরচেনা বৃষ্টি………।