‘বঙ্গবন্ধু’ উচ্চারণে আপত্তি কেন ড. কামাল হোসেনের?

মমতাজুল ফেরদৌস জোয়ার্দার
Published : 21 March 2019, 10:59 AM
Updated : 21 March 2019, 10:59 AM

বিশেষ কারণে ২০০৭ সালের কিছু পুরনো নিবন্ধে চোখ বুলাচ্ছিলাম। ওই বছর দৈনিক যুগান্তরে ৭ মার্চ উপলক্ষে ড. কামাল হোসেনের 'ঐতিহাসিক ভাষণের নেপথ্যে' শিরোনামে লেখাটা খুব মনোযোগ দিয়ে শুরু থেকে পড়ে শেষ করতে করতে হতাশ হলাম।

না, উনি কোনো তথ্য বিকৃতি ঘটাননি। আমি হতাশ হয়েছি এজন্য যে উনি পুরো লেখাতে জাতির জনক, জাতির পিতা বা বঙ্গবন্ধু শব্দগুলো সযত্নে এড়িয়ে গেছেন। অতীতে বিভিন্ন সময়ে উনি শব্দগুলো ব্যবহার করেছেন, বুঝতে পারছি না এই লেখায় কেন এর ব্যতিক্রম হলো।

লেখাটা পড়া শুরু করে আমার মনে হয়েছিল লেখক বোধহয় অন্য কোনো কামাল হোসেন হবেন। আমার ভুল ভাঙল লেখায় শেষে যখন লেখকের পরিচয় দেখলাম; ড. কামাল হোসেন, সভাপতি, গণফোরাম।

বাংলা ভাষায় ঐতিহাসিক গুরুত্ববহনকারী সুমিষ্ট কিছু শব্দের মধ্যে বঙ্গবন্ধু অন্যতম। বঙ্গ দিয়ে এখানে বাংলা ও বাঙালিকে বোঝানো হয়েছে। আর বন্ধু বলতে সেই সময়ে বাঙালির অধিকার আদায়ে যে ব্যক্তি ত্রাণকর্তার ভূমিকা পালন করেছেন সেই মহামানব শেখ মুজিবকে বোঝানো হয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের উপর বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। প্রায় এক ডজন প্রতিবেদন আমি মনোযোগ সহকারে পড়েছি। এ লেখাগুলোর মধ্যে ড. কামাল এবং নির্মল সেন তাদের লেখায় বঙ্গবন্ধু সম্বোধন করতে পারেননি।

পল্লীবন্ধু এরশাদের মত শেখ মুজিবুর রহমান নিজে নিজে গায়ে বঙ্গবন্ধু ছাপ মারেননি। ১৯৬৯ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি পাবার পর রমনার রেসকোর্স ময়দানে ২৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আয়োজিত গণসংবর্ধনায় ১০ লাখ জনতার উপস্থিতিতে তৎকালীন ডাকসুর ভিপি তোফায়েল আহমেদ বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রকৃত বন্ধু হিসাবে অভিহিত করে বঙ্গবন্ধু হিসাবে উল্লেখ করেন।

তারপর শেখ মুজিবুর রহমান উপস্থিত লাখো জনতার কাছে এ ব্যাপারে সমর্থন চাইলেন। তখন রমনা রেসকোর্সের দশ লাখ মানুষের উত্তাল সমুদ্র সম্মতি জানিয়ে দু'হাত ঊর্ধ্বে তুলে ধরে।

একথা খুবই সত্য যে শেখ মুজিব যদি বাঙালির চোখের মধ্যমণি না হয়ে উঠতেন তথা বঙ্গবন্ধু না হয়ে উঠতেন তাহলে বাংলাদেশ স্বাধীন করা সম্ভব হত না। আর সেক্ষেত্রে ড. কামাল যে স্বাধীন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করেছেন তা কি সম্ভব হত? পারতেন কি বাংলাদেশের সংবিধানের প্রণেতা হতে?

আওয়ামী লীগকে লেখা ড. কামালের সেই দীর্ঘ চিঠিটার কথা আজ আবার মনে পড়ছে। সেখানে কিন্তু তিনি বঙ্গবন্ধু সম্বোধন করেছিলেন এবং লিখেছিলেন জাতিসংঘে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মত সম্মানিত গুরুদায়িত্ব বঙ্গবন্ধু তাকে দিয়েছিলেন, এমন আরও অনেক কিছু।

আমার পরিষ্কার মনে পড়ছে বিবিসির জরিপে যখন বঙ্গবন্ধু সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি নির্বাচিত হন, তখন কামাল হোসেনের একটা সাক্ষাতকার প্রচার হয়েছিল।

সেদিন ড. কামাল তুরস্কে ছিলেন, টেলিফোনে বিবিসি সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিল। সেদিনও বঙ্গবন্ধুকে ড. কামাল বঙ্গবন্ধু সম্বোধন করেছেন। তার ভাষ্যে বঙ্গবন্ধু তাকে বিভিন্ন গুরুদায়িত্ব অর্পণ করে সম্মানিত করেছেন। বঙ্গবন্ধু পরবর্তী আওয়ামী লীগ সেটা করেনি বলে উনি নতুন দল করেছেন।

বঙ্গবন্ধুকে বঙ্গবন্ধু বলে আমি উপরে তুলতে পারবো না, না বলেও তার অবস্থান ছোট করতে পারবো না; তিনি যেখানে আছেন সেখানেই থাকবেন। তবে না বলার মধ্যে দিয়ে এক সংকীর্ণ আচরণের প্রকাশ পেয়ে যায়।

ড. কামাল হোসেনকে এখনও আমার আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন আইনজীবী বলতে বাধছে না। কিন্তু যখন দেখলাম বঙ্গবন্ধুর এক সময়ের বিশ্বস্ত অনুচর হয়েও ঐদিনের লেখায় বঙ্গবন্ধু বলেননি, তখন স্বাভাবিকভাবে আমার মনে কামাল হোসেনকে নিয়ে ধারনা বদলাবেই।