৭ই মার্চের পূর্ণাঙ্গ ভাষণ কি হারিয়ে গেছে?

মমতাজুল ফেরদৌস জোয়ার্দার
Published : 6 March 2018, 10:43 PM
Updated : 6 March 2018, 10:43 PM

একযুগ ধরে আমি প্রায় সব জাতীয় দৈনিক পত্রিকা থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছি। এখন পর্যন্ত কোন পত্রিকায় বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের পূর্ণাঙ্গ ভাষণটা ছাপা হয়নি। যদিও শিরোনামে লেখা হয়েছে ৭ই মার্চের পূর্ণাঙ্গ ভাষণ। কিন্তু সেগুলো পড়ার পর তার সত্যতা আমি খুঁজে পাইনি। ভাষণটা ছিল ১৮-১৯ মিনিটের মতো, যদি আরও সঠিকভাবে বলা হয় তাহলে ছিল ১৮ মিনিট ৩৯ সেকেন্ডের। কিন্তু বিভিন্ন পত্রিকা-বইয়ের লেখকরা যে অংশটুকু লিপিবদ্ধ করেছেন সেটা হল ১১ মিনিটের মতো। তারপর থেকে আমি এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ উৎসাহী হয়ে উঠি। প্রায় দু-তিন বছর অপেক্ষার পর পূর্ণাঙ্গ ভাষণের একটা অডিও আমার হাতে আসে গতবছর ৭ই এপ্রিল।

এই ভাষণের পূর্ণাঙ্গ অডিওর জন্য আমি প্রথমে যোগাযোগ করি কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে। উনাদের মধ্যে একজন তৎকালীন সময়ে সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য ছিলেন, একজন কেন্দ্রীয় কমিটির নেত্রীও ছিলেন। কিন্তু তেমন কোন আগ্রহ আমি তাদের মধ্যে লক্ষ্য করিনি। তারপর আমাদের এলাকার একজন প্রকৌশলী ছিলেন, যিনি বাংলাদেশ বেতারে কাজ করতেন- নাম বরকত আলী (প্রয়াত), তাকে অনুরোধ করলাম এই ভাষণের পূর্ণাঙ্গ একটা কপি জোগাড় করে দেবার জন্য। আমাকে জানালেন উনি এখন অবসরপ্রাপ্ত, কতটা কি করতে পারবেন জানেন না, তবে আন্তরিক চেষ্টা করবেন। এরপর তার সাথে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়, কারণ তিনি অসুস্থ হয়ে ভারতে চিকিৎসাধীন ছিলেন। এজন্য ফোনেও পাচ্ছিলাম না। এরকম অসুস্থ একজন মানুষকে কষ্ট দিতে ভালো লাগছিল না বিধায় আরও কয়েকজনের সাথে যোগাযোগ করি।

আমার এক মামা আওয়ামী লীগ নেতা, ওনাকে অনুরোধ করি। মামা বললেন, তথ্যমন্ত্রীর পিএ-র সাথে তার ভালো সম্পর্ক আছে, উনি কাজটা করে দেবেন। প্রায় এক বছর ২/৩ মাস পার করে মামা যা দিলেন তা সাত খণ্ড রামায়ণ পরে সীতা রামের মাসীর মতো অবস্থা! সেটাও পূর্ণাঙ্গ ভাষণ ছিল না। কিন্তু আমার মামাকে আন্তরিক ধন্যবাদ এইজন্য যে, ওটা একটা সরকারিভাবে দেওয়া বৈধ কপি। ওখানে ভাষণের যতটা অংশ আছে, আমাদের সংবিধানে তার চেয়ে কম অংশের লিখিত রূপ সংযোজন করা হয়েছে। এই কপিটার গুনগত মান খুবই ভালো, ভাষণটা পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে এখানে।

যা হোক এসবের পরও আমি হাল ছাড়িনি। এরপর আমি আমার বাল্যবন্ধু, পেশায় সাংবাদিক, কমরেড এনামুলের উপর চাপ সৃষ্টি করলাম ভাষণের পূর্ণাঙ্গ কপি জোগাড় করার জন্য। আমার বন্ধু আগের দুই বছর ব্যর্থ হলেও এবার সফল হল। সে বেতারের এক কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করল, আমিও তার সাথে কথা বলেছিলাম। তিনি বললেন, ভাই সরকারিভাবে দিতে পারব না, কিন্তু বেসরকারিভাবে পেতে পারেন। আমি তাকে বললাম সরকারি বা বেসরকারি কোন কথা না, পেলেই হবে। আপনি সরকারিভাবে দিলেও ওটা বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠ, বেসরকারিভাবে দিলেও বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠ।

স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্ব থেকেই জনমত তৈরিতে তৎকালীন রেডিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বলিষ্ঠ পদক্ষেপ হিসাবে 'রেডিও পাকিস্তান ঢাকা' নাম পরিবর্তন করে 'ঢাকা বেতার কেন্দ্র' রাখে রেডিও কর্মীরা এবং এই নামে প্রচার শুরু করে দেয়। সেসময় এত বড় পদক্ষেপ নেয়া যে কত সাহসের কাজ ছিল, তা স্বাধীন দেশে বসে অনুধাবন করা একটু কঠিনই। সমগ্র রেডিওর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহযোগিতা ছাড়া এ জাতীয় সাহসিকতা প্রদর্শন কিছুতেই সম্ভব ছিল না। বেতারের কর্মকর্তারা ভাষণটি সরাসরি সম্প্রচার করতে না পারলেও এটির পূর্ণাঙ্গ রেকর্ড করতে তারা সক্ষম হন। যা পরদিন বেতার কর্মী এবং জনগণের দাবির কারণে বেতার থেকে প্রচারিত হয়। এই ভাষণের অডিও রেকর্ডের জন্য সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা যিনি পালন করেন তিনি হচ্ছেন নাসার আহমেদ চৌধুরী, তখন রেডিও পাকিস্তানের ঢাকার অনুষ্ঠান সংগঠকের পদে তিনি কর্মরত ছিলেন।

১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ সরাসরি ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচার করার সব ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। পরিচালক আশরাফুজ্জামান খান রেডিওর কর্মচারীদের সব দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। রেসকোর্স মাঠে মঞ্চের উপরে পরিচালক আশরাফুজ্জামান, সহকারী পরিচালক আহমাদুজ্জামান এবং নাসার আহমেদ চৌধুরী থাকবেন। প্রকৌশল বিভাগ থেকে জনাব সামাদ ছিলেন। মঞ্চের নীচে জনাব শামসুল আলম, কাজী রফিক, রেডিওর ডিউটি রুমে বাহরামউদ্দিন সিদ্দিকী, সাভার প্রচার কেন্দ্রে প্রকৌশল বিভাগের কর্মচারীর সঙ্গে মীর রায়হান ছিলেন।

সকাল থেকেই ঘন ঘন প্রচার করা হচ্ছিল বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সরাসরি রেসকোর্স মাঠ থেকে প্রচার করা হবে। রেসকোর্স মাঠে তিল ধারণেরও জায়গা ছিল না। ঢাকা রেডিওর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা বেশ আগেই মঞ্চে উঠে মাইক্রোফোন সেট করে প্রস্তুত ছিল। নাসার আহমেদ চৌধুরী উনার সাথে নেন পোর্টেবল Uher (উহ্যার) টেপ রেকর্ডার। এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন, অনেকে লিখেছেন উনি একটা ইএমআই পোর্টেবল টেপ রেকর্ডার ব্যবহার করেছিলেন, এমনকি তার ব্লগেও সেরকমই বলা হয়েছে। এ ব্যাপারে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি আমাকে বলেন, ওরা ভুল লিখেছে। বর্তমানে নাসার আহমেদ আমেরিকার ফ্লোরিডাতে প্রবাসী। তার সাথে গত ১৯শে এপ্রিল ২০১৭ তারিখে আমার টেলিফোনে কথা হয়েছিল।

বঙ্গবন্ধু মঞ্চে উঠে ভাষণ শুরু করতে যাবেন, এমন সময় রেডিওর ডিউটি রুম থেকে ইন্টারকমের মাধ্যমে বাহরাম সিদ্দিকী মঞ্চের কর্মীদের জানান যে, এইমাত্র মেজর সিদ্দিক সালেক জানিয়েছেন, কোনমতেই শেখ মুজিবুরের ভাষণ প্রচার করা যাবে না, প্রচার করলে রেডিও উড়িয়ে দেয়া হবে। সঙ্গে সঙ্গে সরাসরি প্রচার বন্ধ করে দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধু তার ঐতিহাসিক বক্তৃতা শুরু করে দিলে নাসার আহমেদ চৌধুরী উনার সাথে নেওয়া ছোট্ট টেপ রেকর্ডারে রেকর্ডিং শুরু করে দেন সকল নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে। সহকারী পরিচালক আহমাদুজ্জামান একটি ছোট্ট চিরকুটে- 'আর্মি ভাষণ প্রচার করতে দিচ্ছে না'- লিখে মঞ্চে উপবিষ্ট পরিচালক আশরাফুজ্জামানের হাতে দেন। আশরাফুজ্জামান সাহেব সেটা টাঙ্গাইলের এমপির হাতে দেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর হাতে চিরকুটটি পৌঁছে দিয়েছিলেন। যারা বক্তৃতা শুনেছেন তাদের মনে থাকার কথা, বক্তৃতার এক পর্যায়ে (ঠিক ১৬ মিনিট ৪৬ সেকেণ্ডের সময়) বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, "এখনই শুনলাম আমার এই বক্তৃতা রিলে করা বন্ধ করে দিয়েছে।" তখন সারা মাঠে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।

তৎকালীন ঢাকা বেতারের কর্মচারীদের অনেকেই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু নাসার আহমেদ চৌধুরী পাকিস্তান রেডিওতে থেকেই দেশের জন্য কাজ করেছেন। বিভিন্ন রকম রেকর্ড ও তথ্য গোপনে বন্ধুদের দিয়েছেন। তিনি পাকিস্তান রেডিওতে থেকে যে ঝুঁকি নিয়েছিলেন তার জন্য অসীম সাহসের প্রয়োজন। তার জীবনের বড় ধরনের ঝুঁকি ছিল, কিন্তু তিনি তা উপেক্ষা করেছিলেন। আমি জানিনা তার এই দুঃসাহসিক কাজের জন্য এখন পর্যন্ত কোন সরকারি স্বীকৃতি পেয়েছেন কিনা। কিন্তু যেদিন আমি তার সঙ্গে ফোনে কথা বলি এবং যখন আমি উনার এই দুঃসাহসিক ঐতিহাসিক কাজের জন্য কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলাম, তখন অনেকটা আক্ষেপের স্বরেই তিনি বলেছিলেন, সরকার তো তা মনে করে না।

নাসার আহমেদ দুইটি টেপে সমগ্র ভাষণ রেকর্ড করে নেন। ভাষণ শেষে টেপ দুটো সাবধানে উনার জামার ভিতরে লুকিয়ে ফেলেন এবং দ্রুত মঞ্চ থেকে টেপ রেকর্ডার, স্ট্যান্ড নিয়ে নিচে নেমে যান। উনি পরিচালককে জানান যে গোপনে সব রেকর্ড করেছেন। উনি নাসার চৌধুরীকে বাহবা দেন। মাঠে যুগ্ম-সচিবকে জানান এবং প্রশ্ন রাখেন এখন উনারা কি করবেন? যুগ্ম-সচিব জহরুল হক সবাইকে পালিয়ে যাবার পরামর্শ দেন এবং সবাইকে নিজের বাসায় না থাকার পরামর্শ দেন। উনারা সেদিন সবাই হাতিরপুলে কাজী রফিকের বাসায় গিয়ে আশ্রয় নেন। সেখান থেকেই ডিউটি রুমে, সাভার ট্রান্সমিটারে জানিয়ে দেন সব প্রচার বন্ধ করে পালিয়ে যেতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সারা দেশের রেডিও প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। রেডিও প্রচার বন্ধ হলে দেশের যে কি অবস্থা হয় সেদিন দেশবাসী বুঝতে পেরেছিল। পূর্ব বাংলার চেয়ে বেশি বুঝতে পারলো পশ্চিম পাকিস্তানিরা। পূর্ব এবং পশ্চিমের একমাত্র সংযোগ মাধ্যম ছিল রেডিও। পশ্চিমারা অস্থির হয়ে উঠে পূর্ব পাকিস্তানে কি ঘটছে তা জানার জন্যে।

সারা রাত তারা কাজী রফিকের বাসায় কাটান। ইতিমধ্যে আর্মি তাদের পরিচালককে খুঁজে পান এবং তার কাছে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করেন। এই ছিল পাকিস্তান আর্মির প্রথম আত্মসমর্পণ। তারা আশরাফুজ্জামানকে জানান, আপনারা যা চান, যেভাবে চান পুরো ভাষণ প্রচার করুন, কিন্তু খোদার ওয়াস্তে রেডিও প্রচার চালু করুন। পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের সবাই অস্থির হয়ে গেছে। আশরাফুজ্জামান সাহেব এসে উনাদের বলেন, "আমাদের জয় হয়েছে। আর্মি পুরোপুরি আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। আমি তাদের বলে দিয়েছি কাল সকালের আগে রেডিও চালু হবে না এবং বঙ্গবন্ধুর ভাষণ পুরোপুরি প্রচার করতে দিতে হবে। তারা রাজি হয়েছে।"

আশফাকুর রহমান খান পূর্ব ঘোষণা লিখে ফেলেন। প্রকৌশলী সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হয় সকালে রেডিও খোলা হবে। সকালে ঘন ঘন ঘোষণার পরে নাসার আহমেদ চৌধুরীর রেকর্ড করা সেই টেপ দুটো বাজানো হয়। পূর্ব পাকিস্তানের সব অঞ্চলের লোক সেই ভাষণ শুনে বুঝতে পারলো স্বাধীনতার ডাক দেয়া হয়েছে। তারা সবাই স্বাধীনতার প্রস্তুতি নিতে শুরু করলো।

আমি নাসার আহমেদ চৌধুরীকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। বলা হচ্ছে আপনি ভাষণটা দুটো টেপে রেকর্ড করেছেন। যখন আপনি টেপ পরিবর্তন করেন তখন কি কিছু অংশ বাদ গেছে? উনি বললেন আমি খুব দ্রুততম সময়ে টেপ পরিবর্তন করেছিলাম অল্পকিছু অংশ বাদ যেতে পারে। আমি উনাকে বলেছিলাম ঠিক এই অংশটুকু বাদ গেছে। উনি একটু আশ্চর্য হয়েছিলেন আমি কেমনে জানলাম। আমি উনাকে বলেছিলাম যে অংশটুকু আপনি রেকর্ড করতে পারেননি সে অংশটুকু যারা ভিডিও করেছিল সেখানে আছে।

আমার জানামতে যে দুটো বইয়ে ভাষণটির সর্বোচ্চ অংশ ছাপা হয়েছে তার একটা হল, 'লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে' (এ টেল অব মিলিয়নস), লেখক রফিকুল ইসলাম। আরেকটা 'বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব', লেখক মযহারুল ইসলাম।

'লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে' বইটিতে রামেন্দু মজুমদার সম্পাদিত 'বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ' বইয়ের মত প্রথম দুটো শব্দ 'ভায়েরা আমার' নেই। এছাড়াও অনেক অসংগতি পাওয়া যাবে এই বইয়ে। এখানে অনেকটা নিজের ভাষায় লেখা ভাষণটা। বঙ্গবন্ধু কি বলেছেন হুবহু তুলে ধরা হয়নি। এই পরিবর্তন কোনভাবেই কাম্য না। লেখক তথ্যসূত্র হিসাবে উল্লেখ করেছেন ইত্তেফাক, ঢাকা, ৮ই মার্চ, ১৯৭১। এই দায় হয়তো লেখকের নয়, ইত্তেফাকের। কিন্তু খুব সহজেই লেখক এই ত্রুটিগুলো এড়িয়ে যেতে পারতেন।

প্রায় সবাই যারা ৭ই মার্চের ভাষণ নিয়ে লিখেছেন তারা বলেছেন বঙ্গবন্ধুর শেষ কথা ছিল- "এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।" কিন্তু এ কথা ঠিক না "বঙ্গবন্ধু এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।" এরপরেও বেশ কিছু কথা বলেছেন, তারপর জয় বাংলা বলে ভাষণ শেষ করেছেন। এর প্রমাণ ৮ই মার্চ, ১৯৭১ এর দৈনিক ইত্তেফাকে ও দৈনিক পূর্বদেশ বা 'লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে', অথবা মযহারুল ইসলামের 'বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব' বইটা পড়লে পাওয়া যাবে। কিন্তু এখানেও পুরো ভাষণটা নেই।

ড. মুনতাসীর মামুন তার '৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর অসামান্য ভাষণ' বইয়ে লিখেছেন, "বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ অপরাহ্নে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে যে ভাষণ দিয়েছিলেন-"। তারপর মুনতাসির মামুন ভাষণের অংশটা দেন। এটা কোনভাবেই পূর্নাঙ্গ ভাষণ না, কিন্তু সে কথাটা লেখক কোথাও উল্লেখ করেননি। তাছাড়া মুদ্রিত অংশের মধ্যে সুনিশ্চিত ভাবেই কিছু ভুল লক্ষ্য করা গেছে। কোথাও সমার্থক শব্দ বা কাছাকাছি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, কোথাও আবার অতিরিক্ত শব্দ যোগ করা হয়েছে। ভুলের সংখ্যা রামেন্দু মজুমদারের বইয়ের চেয়ে কম, তবে অন্তত বাইশটা ত্রুটি সেখানে পাওয়া যাবে।

এছাড়াও আমি অন্তত ৯-১০টা মুদ্রিত সংস্করণ পড়েছি। প্রথম কথা হল, এর কোনটাই পূর্ণাঙ্গ ভাষণ না এবং মুদ্রিত ভাষণের বিভিন্ন জায়গায় অনেক পার্থক্য চোখে পড়ে, প্রচুর ভুলে ভরা এসব মুদ্রিত সংস্করণগুলো। কিন্তু যারা এই মুদ্রিত সংস্করণের কাজটি করেছেন তারা উল্লেখ করেননি কোথা থেকে তারা এটা পেয়েছেন, তথ্যসূত্র কি? অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভাষণের সংক্ষিপ্ত সংস্করণ থেকেই মুদ্রণের কাজটা করা হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সেটা কোথাও উল্লেখ করা হয়নি। যার কারণে সাধারণ পাঠকের জন্য এটা বিভ্রান্তিকরও বটে। অনেকে আবার এই সম্পাদিত ভাষণটাকেই পূর্নাঙ্গ ভাষণ বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু একবারও খতিয়ে দেখেননি, এই ভাষণটা ছিল প্রায় ১৯ মিনিটের, কিন্তু যে অডিও টেপ থেকে উনারা মুদ্রণের কাজটা করছেন সেটা কত মিনিটের?

এই ভাষণের সরকারিভাবে একক কোন কপি ছাড়া হয়নি, যে কেউ মুদ্রণের কাজটা করলে সেটা ব্যবহার করতে পারে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নানাভাবে কাটছাঁট করে এটাকে সাধারণের কাছে উপস্থাপন করেছে, আর তাতেই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।

বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ২০১১ সালে সংবিধানে যে সংশোধনী বা সংযোজন করে (পঞ্চদশ সংশোধন, ২০১১ সনের ১৪ নং আইনের ৫৫ ধারা বলে), সেখানে সংবিধানের পঁচাত্তর পৃষ্ঠায় গেলে দেখা যাবে পঞ্চম তফসিলে (১৫০ (২) অনুচ্ছেদ) সেটা আছে। এই পঞ্চম তফসিলটাই হল ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ তৎকালীন ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেওয়া ঐতিহাসিক ভাষণ। সংবিধানে মুদ্রিত অংশটুকু নিশ্চিতভাবেই পুরো ভাষণ না, কিন্তু সে কথাটা কোথাও উল্লেখ করা হয়নি। আর এখানেও প্রচুর ভুল আছে। আর ভুলগুলোর সাথে রামেন্দু মজুমদারের বইয়ের ভুলের প্রায় হুবহু মিল আছে, শুধুমাত্র কয়েকটা জায়গা ছাড়া।

ভাষণটি যেমন ছিল তার অবিকল লিখিত রূপ:

"ভায়েরা আমার-

আজ, দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা- সবই জানেন এবং বোঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তারা আজ তার অধিকার চায়। কি অন্যায় করেছিলাম? আপনারা নির্বাচনে গিয়ে, নির্বাচনের পরে বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে, আওয়ামী লীগকে আপনারা ভোট দ্যান, আমরা ভোট পাই। আমরা দেশের একটা শাসনতন্ত্র তৈয়ার করবো। আমাদের ন্যাশনাল এসেম্বলি বসবে, আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করবো এবং এ দেশকে আমরা গড়ে তুলবো। এদেশের মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, ২৩ বৎসরের করুণ ইতিহাস বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস। ২৩ বৎসরের ইতিহাস মুমূর্ষু নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস। বাংলার ইতিহাস, এদেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস।

"১৯৫২ সালে রক্ত দিয়েছি। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারি নাই। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান মার্শাল-ল' জারী করে ১০ বছর পর্যন্ত আমাদের গোলাম করে রেখেছে। ১৯৬৬ সালে ৬ দফার আন্দোলনে ৭ই জুনে আমার ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৬৯-এ আন্দোলনে আইয়ুব খানের পতন হওয়ার পরে যখন ইয়াহিয়া খান সাহেব সরকার নিলেন তিনি বললেন, দেশে শাসনতন্ত্র দেবেন- গণতন্ত্র দেবেন, আমরা মেনে নিলাম। তারপরে অনেক ইতিহাস হয়ে গেল, নির্বাচন হলো।

আপনারা জানেন, দোষ কি আমাদের? আজকে তিনি, আমি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সাহেবের সঙ্গে দেখা করেছি, আপনারা জানেন আলাপ-আলোচনা করেছি। আমি পাক, শুধু বাংলার নয়, পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা হিসাবে তাকে অনুরোধ করলাম, ১৫ই ফেব্রুয়ারি তারিখে আপনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দ্যান। তিনি আমার কথা রাখলেন না, তিনি রাখলেন ভুট্টো সাহেবের কথা। তিনি বললেন, প্রথম সপ্তাহে মার্চ মাসে হবে, তিনি ম্যানে নিলেন, ম্যানে নিলেন। তিনি তারপরে, আমরা বললাম ঠিক আছে, আমরা এসেম্বলিতে বসবো। আমরা আলাপ-(অস্পষ্ট) আলোচনা করবো। আমি বললাম, বক্তৃতার মধ্যে, এসেম্বলির মধ্যে আলোচনা করবো- এমনকি আমি এ পর্যন্তও বললাম, যদি কেউ নেয্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও, একজন যদিও সে হয় তার নেয্য কথা আমরা মেনে নেব।"

তারপরে জনাব ভুট্টো সাহেব এখানে এসেছিলেন, আলোচনা করলেন। বলে গ্যালেন যে, আলোচনার দরজা বন্ধ না, আরও আলোচনা হবে। তারপরে পশ্চিম পাকিস্তানের জামায়েত ইসলামীর নেতা নুরানি সাহেবের সংগে আলাপ হল, মুফতি মাহমুদ সাহেবের সংগে আলাপ হল, তারপরে অন্যান্য নেতৃবৃন্দ তাদের সঙ্গে আলাপ করলাম- আসুন বসি, জনগণ আমাকে ভোট দিয়েছে ৬ দফা ১১ দফার মাধ্যমে শাসনতন্ত্র করতে, একে পরিবর্তন পরিবর্ধন করার ক্ষমতা আমার নাই। আপনারা আসুন বসুন আমরা আলাপ করে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করি। তিনি বললেন, পশ্চিম পাকিস্তানের মেম্বাররা যদি এখানে আসে তাহলে আমাদের, আমাদের উপরে তিনি দোষ দিলেন এখানে আসলে কসাইখানা হবে এসেম্বলি। তিনি বললেন, আমি ডাবল হোষ্টেজ হতে চাই না। তিনি বললেন, যে যাবে তাকে মেরে ফেলে দেওয়া হবে, যদি কেউ এসেম্বলিতে আসে তাহলে পেশোয়ার থেকে করাচী পর্যন্ত দোকান জোর করে বন্ধ করা হবে। তারপরেও যদি কেউ আসে তাকে ছান-নাছার করা হবে। আমি বললাম, এসেম্বলি চলবে। তারপরে হঠাৎ ১ তারিখে এসেম্বলি বন্ধ করে দেওয়া হল।

ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট হিসাবে এসেম্বলি ডেকেছিলেন। আমি বললাম যে, আমি যাবো। ভুট্টো সাহেব বললেন, তিনি যাবেন না। ৩৫ জন সদস্য পশ্চিম পাকিস্তানে-ত থেকে এখানে আসলেন। তারপরে হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হল, দোষ দেওয়া হল বাংলার মানুষকে, দোষ দেওয়া হল আমাকে যে, "আমার অনমনীয় মনোভাবের জন্য তিনি তা করতে পারলেন না।" তারপরে বন্ধ করে দেয়ার পরে এদেশের মানুষ প্রতিবাদ-মুখর হয়ে উঠল।

আমি বললাম, শান্তিপূর্ণভাবে আপনারা হরতাল পালন করেন। আমি বললাম, আপনারা কল-কারখানা সবকিছু বন্ধ করে দ্যান। জনগণ সাড়া দিল। আপন ইচ্ছায় জনগণ রাস্তায় বেরিয়ে পড়লো, তারা শান্তিপূর্ণভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাবার জন্য স্থির প্রতিজ্ঞবদ্ধ হোল। কি পেলাম আমরা? আমাদের যাদের অস্ত্র নাই আমাদের হাতে। যা-আমার পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছি বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য, আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে আমার দেশের গরীব-দুঃখী নিরস্ত্র মানুষের বিরুদ্ধে- তার বুকের উপরে হচ্ছে গুলি। আমরা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু, আমরা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু- আমরা বাঙালীরা যখনই ক্ষমতায় যাবার চেষ্টা করেছি, যখনই এ দেশের মালিক হবার চেষ্টা করেছি তখনই তারা আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। তারা আমাদের ভাই, আমি বলেছি তাদের কাছে একথা যে, আপনারা কেন আপনার ভায়ের বুকে গুলি মারবেন? আপনাদের রাখা হয়েছে যদি বহিঃশত্রু আক্রমণ করে তা থেকে দেশটাকে রক্ষা করার জন্য।

তারপরে উনি বললেন, যে আমার নামে বলেছেন, আমি নাকি বলে স্বীকার করেছি যে দশোই তারিখে রাউন্ড-টেবল কনফারেন্স হবে। আমি উনাকে একথা বলে দিবার চাই, আমি তাকে তা বলি নাই টেলিফোনে আমার সঙ্গে তাঁর কথা হয়। তাঁকে আমি বলেছিলাম, "জনাব ইয়াহিয়া খান সাহেব, আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, দেখে যান ঢাকায় আসেন কিভাবে আমার গরীবের উপরে, আমার বাংলার মানুষের বুকের উপর গুলি করা হয়েছে। কি করে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে, কি করে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আপনি আসুন, দেখুন, বিচার করুন। তারপরে আপনি ঠিক করুন" আমি এই কথা বলেছিলাম।

তিনি বললেন আমি নাকি তাকে, তিনি নাকি খবর পেয়েছিলেন নাকি আমি তাকে আর.টি.সিতে বসবো। আমি তো অনেক আগেই বলে দিয়েছি কিসের আর.টি.সি, কার আর.টি.সি, কার সঙ্গে বসবো? যারা আমার মানুষের বুকের রক্ত নিয়েছে, তাদের সঙ্গে বসবো? আপনি আসুন দেখুন জাতীয় পরিষদের জন্য আমার (যারা বা নেতারা কিছু একটা বলেছেন সেটা ঠিকমত বোঝা যাচ্ছে না) রক্ত দিয়েছে সত্য কথা কিন্তু তা কি আপনারা দেখেছেন? তারপরে তিনি আজকে, আজকে আমার দেশ এসেম্বলির- (জনতা কিছুটা অধৈর্য হলে) আহা বসেন আপনারা, সিট ডাউন। এসেম্বলির তিনি ২৫ তারিখে এসেম্বলি, এরপরে আপনারা জানেন আমি গ্যালাম, আমি গ্যালাম পল্টন ময়দানে, আমি বললাম সবকিছু বন্ধ। সরকারি অফিস বন্ধ, আহা ভাইরা আপনার স্টপ প্লিজ। আমি বললাম, আমার কথা সকলে মানল, সকলে আমাকে বললো এবং আপনারা আমাকে যে(সে) নেতৃত্ব দিয়েছেন। আপনারা, আমি বললাম কোন সরকারি অফিস চলবে না, কোন কিছু চলবে না। আমি কিছু কিছু জনগণের কষ্ট হয় সেটা স্লাক (slack শিথিল) করলাম। যে এই এই জিনিস চলবে, ঠিক সেভাবে চললো। হঠাৎ আমার সঙ্গে পরামর্শ না করে বা আমাদের সঙ্গে আলোচনা না করে, পাঁচ ঘণ্টা গোপনে বৈঠক করে যে বক্তৃতা তিনি করেছেন এবং যে বক্তৃতা করে এসেম্বলি করেছেন সমস্ত দোষ তিনি আমার উপরে দিয়েছেন, বাংলার মানুষের উপরে দিয়েছেন। আমরা গুলি খায় দোষ আমাদের। তিনি বাধা দিলেন যে আসতে পারবা না, গোলমাল হল না পশ্চিম পাকিস্তানে, গুলি করে মারা হল আমার বাংলার মানুষকে। আমি পরিষ্কার মিটিংএ বলেছি, "এবারের সংগ্রাম আমার মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।"

ভায়েরা আমার, ২৫ তারিখে এসেম্বলি কল করেছে। রক্তের দাগ শুকায় নাই। আমি ১০ তারিখে বলে দিয়েছি ঐ শহীদের রক্তের উপর দিয়ে পাড়া দিয়ে আর.টি.সি- তে মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারে না। এসেম্বলি কল করেছেন, এসেম্বলি কল করেছেন, আমার দাবী মানতে হবে। প্রথম মিলি সামরিক আইন মার্শাল-ল' উইথ-ড্র করতে হবে। সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফেরত দিতে হবে। যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে। আর জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপরে বিবেচনা করে দেখবো, আমরা এসেম্বলিতে বসতে পারবো কি পারবো না। এর পূর্বে, এর পূর্বে এসেম্বলিতে বসা, আমরা এসেম্বলিতে বসতে আমরা পারি না। জনগণ সে অধিকার আমাকে দ্যায় নাই।

ভায়েরা আমার,
তোমরা, আমার উপর বিশ্বাস আছে? আমি- প্রধানমন্ত্রীত্ব- (এখানে কেউ কিছু বললে বঙ্গবন্ধু উত্তরে বলেছেন হ্যাঁ) আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না। আমরা এদেশের মানুষের অধিকার চাই। আপনারা জানেন, আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দিবার চাই যে, আজ থেকে এই বাংলাদেশের কোর্ট-কাচারী, আদালত-ফৌজদারি এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্দ থাকবে। গরীবের, গরীবের যাতে কষ্ট না হয়, গরীবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে সেইজন্য সমস্ত অন্যান্য যে জিনিসগুলি আছে, সেগুলোর হরতাল কাল থেকে চলবে না। রিকশা, ঘোড়ারগাড়ী চলবে, রেল চলবে, সব চলবে লঞ্চ চলবে- শুধু সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রিমকোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট তারপরে আর কি সেমি-গভর্নমেন্ট দপ্তর গুলো, ওয়াপদা কোনকিছু চলবে না। ২৮ তারিখে কর্মচারীরা যেয়ে বেতন নিয়ে আসবেন। এরপরে যদি বেতন দেওয়া না হয়, আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকদের উপর হত্যা করা হয়- তোমাদের উপর কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে, এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু- আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারবো, আমরা পানিতে মারবো। তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আর আমার বুকের উপর গুলি চালাবার চেষ্টা কোর না। ভাল হবে না, সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবে না।

আজ (এখানে বঙ্গবন্ধু কারো সাথে একটু কথা বলেছেন যেটা পরিষ্কার না) আর যে সমস্ত লোক শহীদ হয়েছে, আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, আমরা আওয়ামী লীগের থেকে, আমাদের আওয়ামী লীগ অফিসে রিলিফ কমিটি করা হয়েছে, যদ্দুর পারি তাদের সাহায্য করতে চেষ্টা করবো। যারা পারেন আমার রিলিফ কমিটিতে সামান্য টাকা-পয়সা পৌঁছিয়ে দেবেন। আর এই ৭ দিন হরতালে যে সমস্ত শ্রমিক ভাইরা যোগদান করেছেন, সন্ধ্যা আইনের জন্য যোগদান করতে পারেন নাই প্রত্যেকটা, প্রত্যেকটা শিল্পের মালিক তাদের বেতন পৌঁছাইয়া দেবেন। মনে রাখবেন। আর সরকারী কর্মচারীদের বলি, আমি যা বলি তা মানতে হবে। কাউকে যেন সেক্রেটারিয়েটে, হাইকোর্টে বা জজকোর্টে দেখা না হয়। দ্বিতীয় কথা যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হবে, খাজনা ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হোল- কেউ দেবে না।

আপনারা আমার উপর ছেড়ে দ্যান, আন্দোলন কি করে করতে হয়। শোনেন মনে রাখবেন, একটা অনুরোধ আপনাদের কাছে, শত্রু বাহিনী ঢুকেছে ছদ্মবেশে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে। এই বাংলায়- হিন্দু-মুসলমান, বাঙালী, নন-বাঙালী যারা আছে তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের উপরে, আমাদের যেন বদনাম না হয়। মনে রাখবেন, দ্বিতীয় কথা হল এই যে যদি আবার কোন রকমের কোন আঘাত আসে, আমি যদি হুকুম দেবার না পারি, আমার সহকর্মিরা হুকুম দেবার না পারে, মনে রাখবেন আরেকটা কথা অনুরোধ করছি রেলওয়ে চলবে সত্য কথা। কিন্তু সামরিক বাহিনীর লোকদের কোন জায়গা থেকে, এক জাগা আরেক জাগা নেবার চেষ্টা করবেন না। তাহলে দুর্ঘটনা ঘটলে আমি দায়ী হব না। প্রোগ্রামটা বলছি আমি শোনেন রেডিও, টেলিভিশন, নিউজ পেপার। মনে রাখবেন, রেডিও টেলিভিশনের কর্মচারীরা যদি রেডিওতে আমাদের কথা না শোনে তাহলে কোন বাঙালী রেডিও স্টেশনে যাবেন না। যদি টেলিভিশন আমাদের নিউজ না দেয়, কোন বাঙালী টেলিভিশনে যাবেন না। (এখানে বঙ্গবন্ধু একটু থামেন কারণ একটা যুদ্ধ বিমান প্রচণ্ড শব্দে ঐ এলাকা দিয়ে উড়ে যাওয়ায়) রেডিও যদি আমাদের নিউজ না দেবার দেয় কোন বাঙালী রেডিও ষ্টেশনে যাবেন না। টেলিভিশনে যদি আমাদের নিউজ না দেওয়া হয়, কোন বাঙালী টেলিভিশন অফিসে যাবেন না। ২ ঘণ্টার মত ব্যাঙ্ক খোলা থাকবে, যাতে মানুষ তাদের মাইনা-পত্র নিবার পারে। কিন্তু পূর্ববাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও চালান হতে পারবে না। টেলিফোন, টেলিগ্রাম আমাদের এই পূর্ববাংলায় চলবে এবং বিদেশের সংগে নিউজ পাঠাতে হলে আপনারা চালাবেন। কিন্তু যদি এই দেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা করা হয়, বাঙালীরা বুঝেশুনে কাজ করবেন। আমার কিছু বলার থাকবে না, দরকার হয় চাকা বন্দ করে দেওয়া হবে।

ভায়েরা আমার-
আমার কাছে, এখনই শুনলাম আমার এই বক্তৃতা রিলে করা বন্ধ করে দিয়েছে। আমি আপনারা আমার প্লেয়ার চালায়ে দেন, কারো হুকুম মানতে পারবেন না। তবে আমি অনুরোধ করছি আপনারা আমাদের ভাই আপনারা দেশকে একেবারে জাহান্নামে ধ্বংস কোরে দিয়েন-না। জীবনে আর কোনদিন আপনাদের মুখ দেখাদেখি হবেনা। যদি আমরা শান্তিপূর্ণভাবে আমাদের ফায়সালা করতে পারি তাহলে অন্ততপক্ষে ভাই, ভাই হিসাবে বাস করার সম্ভাবনা আছে। সেইজন্য আপনাদের অনুরোধ করছি আমার এই দেশে আপনারা মিলিটারি শাসন চালাবার চেষ্টা আর করবেন না। দ্বিতীয় কথা প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায়, প্রত্যেক ইউনিয়নে, প্রত্যেক সাব-ডিবি-সনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল। এবং তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো। এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ্‌। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।

ভায়েরা আমার-
যেভাবে আপনাদের, আপনারা ঠাণ্ডা হবেন না, ঠাণ্ডা হয়ে গেলে জালেম আত্মা আরম্ভ করবে আক্রমণ করতে। আপনারা হুশিয়ার থাকবেন এবং প্রস্তুত থাকবেন। পজিশন চলবে, কিন্তু মনে রাখবেন, ডিসিপ্লিন সোলজার ছাড়া, ডিসিপ্লিন ছাড়া কোন জাতি জিততে পারেনা। আপনারা আমার উপরে বিশ্বাস নিশ্চয়ই রাখেন, জীবনে আমার রক্তের বিনিময়েও আপনাদের সংগে বেঈমানি করি নাই। প্রধানমন্ত্রীত্ব দিয়ে আমাকে নিতে পারে নাই, ফাঁসি-কাষ্টের আসামি দিয়ে আমাকে নিতে পারে নাই। যে রক্ত দিয়ে আপনারা একদিন আমাকে জেলে থেকে ব্যার করে নিয়ে এসেছিলেন, এই রেসকোর্স ময়দানে আমি বলেছিলাম,"আমার রক্ত দিয়ে, আমি রক্তের ঋণ শোধ করবো।" মনে আছে? আমি রক্ত দেবার জন্য প্রস্তুত, আমাদের মিটিং এখানেই শেষ। আস্-সালামো ওয়ালাই-কুম।
জয় বাংলা।"

এরকম একটা জাতিয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ কারো একার পক্ষে ৯৯% সঠিকভাবে করা সম্ভব বলে আমি মনে করি না। তবে আমি আমার সর্বোচ্চ শ্রম ও মেধার প্রয়োগ এখানে করেছি। আগামীতে যারা এনিয়ে কাজ করবে আশা করি আমার এই প্রয়াস তাদের সাহায্য করবে।
জয় বাংলা।জয় বঙ্গবন্ধু।