মুক্তিযোদ্ধা রমজান আলী খানের অভিমান

মমতাজুল ফেরদৌস জোয়ার্দার
Published : 5 June 2018, 08:46 PM
Updated : 5 June 2018, 08:46 PM

১৯৭১ সালে যুদ্ধকালীন সময়েও ঈদ হয়েছিল। হয়তো অনেকেই সে উৎসব পালন করেছিলেন, অনেকেই হয়তো ঈদের কথা, কোনো আনন্দের কথা ভাবতেই পারেননি। তাদের মাথায় ছিল দেশের কথা, স্বাধীনতার কথা ও আত্মরক্ষার কথা। এদের মধ্যে কেউ হয়ত যুদ্ধাহত হয়ে হাসপাতালে শয্যাশায়ী ছিলেন। আলমডাঙ্গার মুক্তিযোদ্ধা জনাব রমজান আলী খান বাচ্চুও যুদ্ধে আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন একাত্তরে।

রমজান আলী খানকে আমি চাচা বলে ডাকি। উনি আমার রক্তের সম্পর্কের কেউ না হলেও আত্মার সম্পর্ক খুবই গভীর। আমার অনেক দাবি, আবদার উনি বিনাবাক্যে বিভিন্ন সময়ে পূরণ করেন। খুবই স্নেহ করেন আমাকে যা আমি আমার রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়-স্বজনদের কাছে পাইনি। আমি কিছু বললে সেটা উনি সবসময়ই বিবেচনা করেন। উনি সত্যবাদী, স্পষ্টবাদী, কারোর পিছনে কিছু বলেন না এবং সৎ মানুষ।

চাচা একদিন আমাকে নিয়ে ফ্রাঙ্কফুর্ট গেলেন। উনি মিউনিখ থেকে রওনা দিয়ে আমাকে নুরেনবার্গ থেকে উঠিয়ে নিলেন। সেদিন উনার সাথে অনেক কথা হয়েছিল।

একাত্তরে যখন উনি ভারতে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তখন আলমডাঙ্গায় ঘটে যায় বেশ কিছু মর্মান্তিক ঘটনা। এরকম একটা ঘটনার বলি হয়েছিলেন উনার বাবা শহীদ জিন্নাত আলী খান। উনার শবদেহটা পর্যন্ত পায়নি তাঁর পরিবারবর্গ। এমনকি তাঁর মৃত্যুদিনটা পর্যন্ত কেউ জানে না।

সেদিন বাচ্চু চাচা আমার সাথে কথা বলতে বলতে কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন। উনাকে খুব বেদনার্ত মনে হচ্ছিল। কথা প্রসঙ্গে আমাকে বললেন, "বাবা, আমি ঈদের সময় সবাইকে জামাকাপড় কিনে দিই, কিন্তু নিজে কোনো ঈদে নতুন জামাকাপড় পড়ি না।"

আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কেন চাচা?  উত্তরে উনি বললেন, "যখন আমার বাবা বেঁচে ছিল, তখন উনি আমাদের নতুন জামা  কিনে দিতেন, পড়তাম। বাবা মারা যাওয়ার পরে আর নতুন জামাকাপড় পড়তে ভালো লাগেনা।"

আমি নিজেও ঈদে নতুন জামাকাপড় নিয়ে ভাবিনা, কিন্তু আমার ব্যাপার আলাদা। আমি পরিনা আমার ব্যক্তিগত দর্শনের কারণে; কত গরীব মানুষের জামা নেই সেখানে আমি নতুন জামা পড়ার অর্থ তাদেরকে আরও বেশি করে বোঝানো তোমরা কত দরিদ্র, কত অসমর্থ। এটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত চিন্তা।

কিন্তু বাচ্চু চাচার ব্যাপার আলাদা, উনার কষ্ট বাবা হারানোর, বাবার স্নেহমাখা সেই উপহার আর না পাওয়া কষ্ট। এবার যখন উনি দেশে যাওয়ার আগে কিছু টাকা দিয়ে বললাম, চাচা আমার এক বন্ধুর জন্য কিছু জামাকাপড় লাগবে। বাংলাদেশ থেকে আপনার মাপে বানিয়ে অথবা কিনে আনবেন। এবং উনাকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে দিলাম কাপড়গুলো উনার পছন্দমত কিনতে। উনি দেশ থেকে জার্মানিতে ফিরে আমাকে ফোন করে জানালেন,  "তোমার বন্ধুর কাপড়চোপড় কিনে এনেছি। যেদিন তোমার সঙ্গে দেখা হবে সেদিন তোমার বইগুলো আর ওগুলো নিয়ে আসবো।"

আমি বললাম, চাচা কাপড়চোপড়গুলো আপনাকে আনতে হবে না। ওগুলো আপনার জন্য এবার ঈদে পড়বেন, তাহলে আমি খুব খুশি হব।

উনি একটু অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলেন। টেলিফোনে উনার চেহারা আমি দেখতে পারিনি, তবে কিছুটা যে আবেগপ্রবণ হয়ে গিয়েছিলেন সেটা অনুভব করেছি গলার স্বরে। আমাকে একটু কৃত্রিম বকাঝকা করলেন যে, তুমি আমাকে বোকা বানালে। কেন আগে বললে না?

আমি বললাম, যদি আপনাকে বলতাম তাহলে আপনি তো কিনতেন না। অতএব এই যৌক্তিক প্রতারণার আশ্রয় নেয়া ছাড়া আমার আর কোন উপায় ছিলনা। উনাকে আরও বললাম আপনার বাবার দেওয়া উপহারের মত স্নেহমাখা এগুলো কোনদিনই হবে না সেটা আমি জানি। তবে আপনাকে আমি ভালোবাসি, শ্রদ্ধা করি। আমার হৃদয় থেকে আপনার জন্য এগুলো। এখানে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার কমতি নেই। আপনি যদি এবার ঈদে জামা কাপড়গুলো পড়েন, আমি এবং আমরা খুশি হব। আমার ধারণা আলমডাঙ্গাবাসিও অত্যন্ত আনন্দিত হবে। আর একজন মানুষ যে আমাদের এই আনন্দ-উৎসবে বিশ্বাস করে, অথচ ৪৮ বছর ধরে পাকিস্তানিদের নৃশংসতার কারণে অভিমানে ঈদে নতুন জামাকাপড় পড়বে না তা হতে পারে না।

মুক্তিযোদ্ধা রমজান আলী খানের পরিবারের কেউও এ ব্যাপারটা খেয়াল করেননি এটা দুঃখজনক। উনার কোন বন্ধু-বান্ধবের চোখও ব্যাপারটা এড়িয়ে গেল, এটা একটু আশ্চর্যই লাগে আমার কাছে।

উনি কিন্তু সীমিত সামর্থ্যের মধ্যেও অনেক করেন মানুষের জন্য। অনেক দুঃস্থ মুক্তিযোদ্ধার জন্যও উনি সাহায্য পাঠিয়েছেন। কোনো কোনো বন্ধুকে, সহযোদ্ধাকে উনি চিকিৎসার জন্যও অর্থ সাহায্য করেছেন। কিন্তু স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে, জামাই, নাতি-নাতনি কেউ ব্যাপারটা লক্ষ করলেন না। কেউ  উনার এই ব্যথার ভাগিদার হলেন না। না কি উনি কাউকে এ ব্যথা জানতে দেননি?

সেক্ষেত্রে আমি অবশ্যই ভাগ্যবান যে এই ব্যথার কথা উনি আমাকে প্রথম জানিয়েছিলেন।

নীতিগতভাবে এই লেখাটা আমার হয়তো লেখা উচিৎ না। কিন্তু আমাদের সমাজের জন্য এর গুরুত্ব আমি অন্তত কোনভাবেই উপেক্ষা করতে পারিনি। মুক্তিযোদ্ধা রমজান আলী খানের পূর্ণ অনুমতি নিয়েই আমি এ নিবন্ধটা লিখেছি। আমার লেখার উদ্দেশ্য দেশে অনেক মুক্তিযোদ্ধা এখনও জীবিত তাদের কারো না কারো হয়তো কোন ব্যথা লুকায়িত আছে। আমরা যারা তাদের প্রিয়জন তারা যেন তাদের এই ব্যথার ভাগিদার হতে পারি বা পারেন।