আমার প্রবাস ডায়েরি

মু: গোলাম মোর্শেদ উজ্জ্বল
Published : 25 Feb 2015, 08:16 PM
Updated : 25 Feb 2015, 08:16 PM

দিন মাস যোগ করে আমার প্রবাস জীবনের বয়স তিন বছর নয় মাস।জীবনের বৃহৎ অংশ মাতৃভূমির আলো বাতাসে কাটানোর পর নিজের পরিকল্পনা ও চিন্তার বাইরে হঠাৎ করেই বিদেশ বিভূঁইয়ে চলে আসা।এই সময়ের মধ্যে সুখ , দুঃখ, হতাশা, প্রাপ্তি,হারানো নানা বৈচিত্রময় অভিজ্ঞতার সম্মুখিনের মধ্যদিয়ে আজকের এই পথচলা।গত ৩০ অক্টোবর থেকে আমার প্রবাস জীবনের সাথে যুক্ত হয়েছে আমার কন্যা মেহজাবিন মোর্শেদ (মিশেল) এবং আমার সহধর্মিনী জান্নাতুল ফেরদৌস (সুমি)।
ফরাসি ভূখন্ডে প্রবেশ করি ২০১১ সালে। এর পর থেকে নতুন দেশ,নতুন মানুষ,নতুন ভাষা,নানা প্রতিকূল পরিস্থিতি ও পরিবেশের সাথে নিজেকে টিকিয়ে রাখার এক সংগ্রামরত সময় পার করতে হয়েছে।এই প্রতিকূল সময়ে কিছু বন্ধুর বাড়িয়ে দেওয়া হাত ও সুপরামর্শ আমাকে এখানে টিকে থাকতে ও সঠিক পথে এগিয়ে চলতে সহায়তা করেছে।যাদের নাম ও সেই সময় আমার স্মৃতিতে চির অম্লান।

মে মাসের শুরু , ২০১১ সাল ।তখন সমস্ত ইউরোপের প্রকৃতিতে শীতের রিক্ততা ও শীক্ততাকে বিদায় দিয়ে গ্রীষ্মের আগমনী আয়োজন চলছে, তবুও শীতল শুষ্ক বায়ু মাঝে মাঝে শরীরে শিহরণ জাগিয়ে যাচ্ছে।এমনি এক সাঝ বেলায় চাঁদপুরের কবির ভাইয়ের সাথে প্যারিসের উদ্দেশ্যে জার্মানির বার্লিন রেলষ্টেশন থেকে ট্রেনে উঠে পড়েছিলাম।দ্রুতগামী ট্রেন বনবাদার মাঠ পাহাড় বিদীর্ণ করা রাস্তা ভেদ করে অন্ধকার এক নৈসর্গিক প্রকৃতির মধ্যেদিয়ে এগিয়ে চলছে।শংকিত মনে অজানা আশংকা দোল দিচ্ছে এই ভেবে যে, অচেনা প্যারিসে কোথায় উঠবো।কবির ভাইয়ের জন্য তার কলেজ জীবনের এক বন্ধু'র প্যারিসের গার দো লিষ্ট ষ্টেশনে অপেক্ষায় থাকার কথা রয়েছে। পঁচিশ বছর পর তাদের আবার দেখা হতে যাচ্ছে তাই তার মনে একটু পুলকিত শিহরণ জাগছে।যদিও আমাকে মাঝে মাঝে অভয় দিচ্ছে কোন চিন্তা না করার।বলছে,একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

গল্প গুজব করতে করতে আলো-ঝলমল এক সকালে এসে আমরা পৌঁছুলুম প্যারিসের গার দো লিষ্ট ষ্টেশনে।ট্রেন থেকে নেমে প্লাটফর্ম দিয়ে একটু হাঁটতেই দেখা মিললো অপেক্ষমান দৃষ্টিতে দাড়িয়ে থাকা এক বাঙ্গালী দম্পতিকে।তাদের কাছে গিয়েই কবির ভাই চিনতে পারলেন তার সেই পঁচিশ বছর আগে দেখা বন্ধুটিকে , সাথে তার স্ত্রী।তারা আমাদের জন্যই অপেক্ষা করছিলো।এই দম্পতি শুধু তাদের বন্ধু কবির ভাইকেই নয় , সাথে আমাকেও তাদের বাসায় নিয়ে গেলেন। সেলিনা ভাবী রান্না করে খাওয়ালেন ,গল্প করলেন ,কুশলাদী জিজ্ঞেস করলেন,আশিক ভাই কয়েক জায়গায় ফোন করে মাসিক ভাড়ায় একটা থাকার ব্যবস্থা করেদিলেন।এরপর থেকে প্রতিদিন আশিক ভাই চাকুরী থেকে ফিরে ফোন করে আমার খোঁজ খবর নিতেন, বাসায় ভালোকিছু রান্না হলে ডেকে পাঠাতেন।একটা চাকুরির ব্যবস্থা করার জন্য তাদের পরিচিতদের অনুরোধ করতে লাগলেন।ছুটির দিনে আমাদের নিয়ে ঘুরতে বেড়িয়ে নানা পরামর্শ দিতেন।এই প্যারিসে আমার প্রথম পরিচয়ের মানুষ আশিক ভাই ও ভাবীর অভ্যর্থনার পর থেকে কখনো আমার মনে হয়নি যে এদের সাথে পূর্বে কোনো পরিচয় ছিলো না। অনুভূতিতে অনেকটা পরম আত্মীয়ের মত লাগতো।এখনো এই প্রবাসে কোন সমস্যা অনুভব করলে আশিক ভাইয়ের সাথে আলোচনার তাগিদ অনুভব করি একজন নিঃস্বার্থ বড় ভাইয়ের টানের অনুভূতির জায়গা থেকে।

প্যারিসের প্রথম দিকের দিনগুলোতে অচেনা পথঘাট চলতে শেখা,নানাবিধ পরামর্শ এবং যে মানুষটির বন্ধুসুলভ সঙ্গ আমাকে কখনোই হতাশ হতে দেয়নি, সে ঢাকা দোহারের নুরু ভাই।যার জন্য বন্ধুত্বের বিশেষ একটি জায়গা হৃদয় জুড়ে এখোনো বিদ্যমান রয়েছে।
তাছাড়া ঢাকা দোহারের জসিম ভাই, টাঙ্গাইলের হাশেম ভাই ,এদের প্রতিও আমার কৃতজ্ঞা কারণ প্রবাস জীবনের প্রাথমিক অবস্থায় এদেরকেই ভালো বন্ধুরুপে পাশে পেয়েছি।

যে মানুষটির সঠিক দিক নির্দেশনা ও পরিচর্যার ফলে আমাকে এই ফরাসি ভূখন্ডে আইন সম্মতভাবে বসবাসের পথকে সুগম করেদিয়েছে, তিনি আমার রাজবাড়ীর জেলা সদরের শ্রদ্ধেয় কামরুজ্জামান জুয়েল আংকেল।এই প্রবাসে তার সাথে সাৎক্ষাতের পর থেকে এখন পর্যন্ত অতি যত্নবান অভিভাবকের মত আমার যে কোন সমস্যায় ছায়ার মত পাশে আছেন।যদিও এখন পর্যন্ত আমি তার জন্য কিছুই করতে পারিনি।শুধু তাই নয়,এই নীতি ভ্রষ্টতার যুগে জ্ঞানহিতৈষী এই মানুষটির অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ও নীতিবোধ আমাকে আকৃষ্ট করে, যা অনুসরণীয়।
ঝিনাইদহের লিটন দা,আমার দিশেহারা সময়ের দিনগুলোতে একান্ত বন্ধুর ন্যায় পাশে থেকে সাহস যুগিয়ে লক্ষ্য স্থির রাখতে মানসিকভাবে অটল রেখেছেন।এখনো তার সাথে কাটানো সুখ ও বেদনা সংমিশ্রিত সময়গুলো অনেক রঙিন মনে হয়।যা প্রবাস জীবনের স্মৃতির মনিকোঠায় বিশেষ হয়ে থাকবে ।

সেই ছেলেবেলার বন্ধু সাংবাদিক রিমন রহমান, যার সাথে রয়েছে জীবনের অনেক স্মৃতিবিজড়িত সময়।আমার ভালো মন্দের অনেক কিছুই তার জানা।সেই অধিকারের জায়গা থেকে এই প্রবাস জীবনের বিশেষ একটা সময় তার কাছে অনেকটা অসম্ভব কিছু চেয়েছিলাম।তার চরম কর্মব্যস্ত সময়ের মধ্যেদিয়েই সে আমার কাজগুলো করে দিয়েছে অত্যন্ত সুচারুরুপে।ওকে শুধু ছোট্ট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে অকৃতজ্ঞ হতে চাইনা। আমার অন্তরে বন্ধুত্বের বিশেষ আসনে ওর অবস্থান রইলো সারা জীবন।
সৌভাগ্যবোধ করি বরিশালের নিজাম ভাই ও মিতা আপা দম্পতিকে এই প্রবাসে পারিবারিক বন্ধুরুপে পেয়ে।যাদের শুভকামনা সবসময় আমার সাথে রয়েছে।তাদের জন্যও আমার ভালোবাসা ও শুভকামনা অন্তর থেকে।
ফ্রান্সে আইন সম্মতভাবে বসবাসের কাগজ পাওয়ার পর আমার সাথে বিভিন্ন প্রশাসনিক অফিসে গিয়ে আমার মুখের বাংলা ভাষাকে ফরাসি ভাষায় রুপান্তরের মাধ্যমে কর্মকর্তাদের বুঝিয়ে জটিল কাজগুলোকে সহজ করেদিয়েছেন প্যারিসের চারণ দার্শনিক রেজাউর রহমান মতি ভাই সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থভাবে। কৃতজ্ঞতা মতি ভাইয়ের কাছে, ও শুভকামনা তার জন্য।
আমার কন্যা ও স্ত্রীকে ফ্রান্সে আমার কাছে নিয়ে আসার জন্য প্রশাসনিক প্রক্রিয়াগুলোর ব্যাপারে শুশৃংখলভাবে নির্দেশনা দিয়েছেন হবিগঞ্জের কবি সুমন আজাদ ভাই।যার সাথে আমার চিন্তার আদান প্রদানে দারুন এক ছন্দের মিল রয়েছে।সুযোগ পেলেই ফোনে আমার ভালোমন্দের খোঁজ খবর রাখেন।সৌভাগ্য প্যারিসে তারমত মুক্ত চিন্তাধারার একজন কবি বন্ধু পেয়ে।প্রতিভাবান এই কবি বন্ধুর জন্য রইলো গুচ্ছ গুচ্ছ ভালোবাসা ।

আমার পরিবার ফ্রান্সে আসার পর প্রাথমিক যেসব ঝক্কি ঝামেলায় পড়েছিলাম সেই মূহুর্তে প্রশান্তির পরশের মত পাশে পেয়েছি ঢাকা দোহারের আতিয়ার ভাই, যাকে আমার দৃষ্টিতে একজন উদারমনা এবং মায়া মমতা-সম্পূর্ণ মানুষ মনে হয়েছে। এছাড়া মুন্সিগঞ্জের কবিতা অনুরাগী শামীম ভাইয়ের বন্ধুসুলভ সহমর্মিতা ও আন্তরিকতা আমাকে মুগ্ধ করেছে।

বড় বোনসম প্রিয় মানুষ এ্যাডভোকেট নাজনীন নাহার দীপু আপা,প্যারিসের কমিউনিটি ব্যক্তিত্ব নারায়নগঞ্জের শাহেদ আলী ভাই,পারিবারিক বন্ধু শিক্ষক শরিফুল ইসলাম বিপুল,ছোট ভাইসম মাসুদ রানা এদের আন্তরিক সহয়োগিতায় আমি ঋনি ।এদের প্রতিও আমার আন্তরিক ভালোবাসা।

অবশেষে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আশা ও সমস্ত অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে আমার স্ত্রী ও কন্যাকে নিয়ে প্যারিসের সুউচ্চ পাহাড়ের উপর (মনমাদ) ছোট্ট এক বাসায় আমাদের নতুন সংসারের যাত্রা শুরু হয়েছে। আমাদের চার বছর আগের সংসারের সদস্য ছিলাম দুজন আর এখনকার নতুন সংসারে যুক্ত হয়েছে আমার কন্যা মিশেল। তাই নতুন সংসারের ভিন্নতর এক অনুভূতির মধ্যদিয়ে আমাদের নিত্য দিনাতিপাত ……। আমি যখন পরবাসের উদ্দেশ্যে বহির্পানে পা বাড়াই তখন মাতৃগর্ভে মিশেলের বয়স দুই মাস ,তাই তার পৃথিবীতে আগমনী আনন্দের মুহূর্তে পরিবারের সাথে আমার উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়নি।এই প্যারিস থেকেই শুনেছিলাম তার এই ধরণির বুকে পদার্পন বার্তা।ভূমিষ্টের পর থেকেই স্কাইপির কল্যাণে এই সারে সাত হাজার কিলোমিটার দূরত্বের ব্যবধান থেকেই ধীরে ধীরে মিশেলের সাথে আমার সখ্যতা গড়ে উঠেছিলো।স্কাইপিতেই দেখেছি তার এক পা দু পা করে হেঁটে চলার চেষ্টা, শুনেছি এলোমেলো শব্দের বুনোনে বাক্য বলা এবং মধুর শব্দ বাবা ডাক।সাক্ষাৎবিহীন এই দূরত্ব থেকেই ভিডিও কথোপকথনের মাধ্যমে মিশের জ্ঞানে আমার আবির্ভাব বাবারুপে । শুধু প্রতিক্ষা ছিলো সরাসরি কন্যাকে দেখা এবং ওর মুখ থেকে বাবা ডাক শোনার।আমার সেই প্রতিক্ষার যবনিকাপাত ঘটে গত ৩০ অক্টোবর প্যারিসের সার্স দ্য গল এয়ারপোর্টে।ওকে কাছে পেয়ে আমার ভেতরের পিতৃত্বের অনুভূতির আজ পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটেছে।এখন মিশেলের মিষ্টি কন্ঠের বাবা ডাক শোনার টানে দ্রুত ঘরে ফিরি ,ওর সাথে খেলা করি ,ঘুরতে বেরোই…ওর ছোট ছোট দুষ্টমিতে প্রতিমুহূর্তে আমাদের ঘর হয়ে ওঠে উৎসব আনন্দ-মুখর ….এ এক অন্যরকম ভালোলাগা…..।

ইতোমধ্যে আমাদের কন্যা একটি ফরাসি স্কুলে ভর্তি হয়েছে।গত ১১ ডিসেম্বর ২০১৪ ছিলো মিশেলের জীবনের প্রথম স্কুলের দিন।প্রথম দিকে বাংলা ভাষা আয়ত্ব করা শিশুটি ভিনদেশী ভাষার স্কুলে যেতে ভীতি ,অনিহা ও সংশয় প্রকাশ করলেও এখন নিত্যদিন মনমাদের পাহাড়ী কোলঘেষা পথ বেয়ে মিশেলের স্কুলে যাওয়া আসা স্বানন্দচিত্তে।আমাদের আদর ভালোবাসা শ্নেহ মায়া-মমতার মধ্যদিয়েই কাটছে মিশেলের প্রাত্যহিক দিনপঞ্জি ,সেই সাথে ধীরে ধীরে আয়ত্ব করছে এই মানব সভ্যতার জটিল নিয়ম কানুন।
তাছাড়া ,আমার স্ত্রী'র সুপ্ত-বাসনা ছিলো প্রবাস জীবনের দূরত্ব থেকে দেশের মাটির টান অনুভব করা এবং পৃথিবীর নানা বৈচিত্রময় চিন্তাধারা ও রঙয়ের মানুষের সাথে বসবাসের মাধ্যমে জীবনের স্বাদটাকে একটু ভিন্ন আঙ্গিকে উপভোগ করা ,তার সেই ইচ্ছাটাও পূরণ হয়েছে।

প্যারিসে ও বাংলাদেশে আমার অনেক প্রিয় মানুষ ,বন্ধু, শুভাকাঙ্ক্ষী রয়েছে যাদের ভালোবাসার জন্য পৃথিবীটাকে অনেক সুন্দর মনে হয়, ভালভাবে বেঁচে থাকার ইচ্ছে জাগে।তাদের জন্য আমার আশীর্বাদ, সৃষ্টিকর্তা সবাইকে সুস্থ সুন্দর জীবন দান করুন …….আমাদের জন্য সবাই দোয়া করবেন

……