বৈশাখের আমন্ত্রণে কাতালোনিয়ার রাজধানী বার্সেলোনা ঘুরে এসে (পর্ব-২)

মু: গোলাম মোর্শেদ উজ্জ্বল
Published : 4 Oct 2016, 06:01 PM
Updated : 4 Oct 2016, 06:01 PM

আর্ক দো ত্রিওফ মেট্র ষ্টেশন থেকে পাতাল ট্রেনে আমরা নামলাম প্লাস দো কাতালোনিয়ায়।কিছুটা পথ হাটতে হলো।উজ্জ্বল ভাই শহরের কিছু নিয়ম কানুন সম্পর্কে ব্যাখা করতে লাগলেন।ট্রাফিক সিগন্যাল সম্পর্কে প্যারিসের সঙ্গে এই শহরের পার্থক্য বুঝিয়ে দিলেন।প্যারিসে ট্রাফিক সিগন্যালের সবুজ বাতি নেভার পরও পথচারী রাস্তা পারাপারের কিছুটা সময় পান কিন্তু বার্সেলোনায় সবুজ বাতি নেভার সঙ্গে সঙ্গে গাড়ী চলাচল শুরু হয়ে যায় সুতরাং অভ্যাসবসত আমরা যেন এখানে সবুজ বাতি নেভার পর রাস্তা পারাপার না হই।এ ব্যাপারে আমাদের প্রথমেই সতর্ক করলেন। যে এলাকা দিয়ে উজ্জ্বল ভাই আমাদেরকে নিয়ে যাচ্ছিলো সেই এলাকার বিল্ডিং,ওলিগলিগুলো সম্পূর্ণ আমাদের পুরান ঢাকার মত।আমার কিছুতেই মনে হচ্ছিলোনা আমি ইউরোপের কোন আধুনিক শহরে প্রবেশ করেছি।

পুরাতন স্থাপত্য শৈলির দালানগুলোর প্রতিটি ফ্লাটের বেলকুনিগুলোতে কাঁচা কাপড় শুকোতে দেওয়া হয়েছে,যা অসংখ্য।সাধারণত প্যারিসে এমন দৃশ্য দেখা যায়না তাই একটু হোঁচট খেলাম।ছোট ছোট ওলিগোলির মধ্যদিয়ে দু একজন ফেরিওলারও দেখা মিললো।প্যারিসের মত এখানেও ইউরোপিও ইতিহ্যবাহী রুটি ও কেকের দোকান রয়েছে,ময়দার তৈরির নানা প্রকার খাদ্য সামগ্রির আকৃতিগত নান্দনিকতার মিল থাকলেও স্বাদের তারতম্য রয়েছে।ফ্রান্সে এমন খাবারের দোকানগুলোকে বলা হয় বুলোনজারি।এমন একটি খাবারের দোকান থেকে উজ্জ্বল ভাই আমাদের সকালের নাস্তার জন্য কিছু বাহারি স্বাদ ও আকৃতির খারার কিনলেন।প্লাসা মাগবা'র পাশেই এমন একটি এলাকাতে উজ্জ্বল ভাই প্যারিসের পাশাপাশী এখানে ছোট্ট এক নীড় বেধেছেন।সেই নীড়ে গত পাঁচ মাস আগে ছোট্ট এক অথিতির আগমন ঘটেছে,তার নাম রাখা হয়েছে উজ্জ্বল ভাইয়ের শাশুড়ি অর্থাৎ লুনা ভাবির মায়ের মায়ের নাম অনুসারে 'আঞ্জু'।আঞ্জু'র বড় বোন ফিরোজা,বয়সে আন্জু'র দের বছরের বড়।ফিরোজার নাম রাখা হয়ছে উজ্জ্বল ভাইয়ের মায়ের নাম অনুসারে।নাম রাখার এই অভিনব কৌশলের মাধ্যমে তাদের দুই মায়ের স্মৃতির বন্ধনকে অটুট রাখার প্রয়াস চালানো হয়েছে।পিটাপিটি দু বোনের হাসিখুশি খেলাধুলা আর উজ্জ্বল ভাই লুনা ভাবির আদর ভালোবাসায় ভরপুর ছোট্ট বাসাটি যেন একটুকরো স্বর্গ। সেই স্বর্গে প্রবেশ করতে এক আনন্দের বন্যা বয়ে গেলো।অনেক দিন পর অতি পরিচিত আপন মুখগুলো একসাথে দেখে সবার মধ্যে পুলক অনুবভ হলো। রাতভর যাত্রার ক্লান্তি সবার চেহারায় ফুটে উঠেছে,সবাই গোছল ও সকালের নাস্তা সেরে নেয়ার পর কিছু সময় রেষ্ট নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম উজ্জ্বল ভাইয়ের নির্দেশনায় বার্সেলোনা শহর পরিভ্রমনে, সঙ্গে দুই ক্ষুদে পর্যটক আঞ্জু ও ফিরোজা।

প্রথমেই আমরা গেলাম প্লাস দো কাতালোনিয়া। এখানে দেখা মিললো শত শত কবুতর আর পর্যটকের এক অন্য রকম মিলন মেলা।পর্যটকদের সাথে এখানকার কবুতরগুলোর দারুন এক বন্ধুত্বের সম্পর্ক।কিছু গমের দানা হাতে নিয়ে ওদের আহব্বান জানানোর সঙ্গে সঙ্গে কাছে চলে আসে,হাতের উপর ঘাড়ের উপর বসে।কবুতরগুলোকে আতিথেয়তার জন্য এখান থেকেই এক ইউরোর বিনিময়ে ছোট প্যাকেটের গমের দানা কিনতে পাওয়া যায়। আমরাও কিছু গমের দানা সংগ্রহ করে কবুতরগুলোর সাথে সবাই কিছু সুন্দর সময় উপভোগ করলাম।

এই প্লাস দো কাতালোনিয়া মুলত বার্সেলোনা শহরের কেন্দ্রস্থল।পর্যটকদের পাশাপাশী স্থানীয় কাতালান স্পানিশদেন দারুন এক আড্ডা স্থলও বটে।স্পেনের কাতালান অঙ্গরাজ্যের নাম অনুসারে এই বিখ্যাত চত্বরটির নামকরন প্লাস দো কাতালনিয়া।আর কাতালোনিয়া হচ্ছে স্পেনের একটি স্বায়ত্বশাসিত অঙ্গরাজ্য। এটি চারটি প্রদেশ বার্সেলোনা, গিরোনা, লেইদা এবং তারাগোনা নিয়ে গঠিত । এই অঙ্গরাজ্যের রাজধানী এবং সর্ববৃহত শহর হচ্ছে বার্সেলোনা, যা মাদ্রিদের পর স্পেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। কাতালোনিয়ার আয়তন ৩২,১১৪ বর্গ কিলোমিটার এবং এর জনসংখ্যা ৭,৫৩৫,২৫১।রাজ্যটির জনগন বর্তমান স্পেন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্নে আন্দোলনরত রয়েছে।

প্লাসা দো কাতালোনিয়ার পর আমরা এর আশেপাশের এলাকাগুলো হেঁটে দেখতে লাগলাম।পুরান ঢাকার সাঁখারি বাজারের সাথে বেশ মিল খুজে পেলাম।সাঁখারি বাজারে যেমন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পূঁজা অর্চনার নানাবিধ সরঞ্জাম বিক্রয়ের দোকান রয়েছে, তেমনি এখানে দেখা মিললো সেরকম কয়েকটি দোকান, তবে সেখানে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পূঁজা অর্চনার কোন কিছু বিক্রয় হয়না ,বিক্রয় হয় খ্রীষ্ট ধর্মাবলম্বীদের নবী যীশু খ্রীষ্ট ও মাতা মারিয়ুম এর মূর্তি,বাইবেল এবং খ্রীষ্ট ধর্ম সংক্রান্ত বই ইত্যাদি।
হাসনাত আপা কিছু সুভেনির কেনার ইচ্ছে পোষন করলেন, তাই উ্জ্জ্বল ভাই আমাদের নিয়ে গেলেন আশেপাশের একটি পরিচিত বাঙ্গালী মালিকের সুভেনিরের দোকানে।দোকানটি অনেক বড় এবং সাজানো গোছানো ।বার্সেলোনা শহরে এত সুন্দর একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক একজন বাংলাদেশী ভেবে গর্ববোধ হলো।উজ্জ্বল ভাই সবাইকে দোকানের স্বত্বাধিকারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন।ভদ্র লোকের নাম উত্তম কুমার, বাংলাদেশের ফেনি জেলায় তার পৈতিক নিবাস।নব্বই দশকে ফ্রান্সের প্যারিসে পারি জমালেও পরবর্তিতে স্পেনের এই বার্সেলোনা শহরে থিতু হয়েছেন।অত্যন্ত বিনয়ী স্বভাবের সাংস্কৃতিক মনা মানুষটি স্বপরিবারের এখানে বসবাস করছেন।আমরা যে বাংলাদেশ সমিতির আয়োজনে বৈশাখী মেলা উপলক্ষ্যে এখানে এসেছি, উত্তম কুমার সেই বাংলাদেশ সমিতি বার্সেলোনার সাধারণ সম্পাদক।হাসনাত আপা ওনার দোকান থেকে ক্রয় করার জন্য যে সুভেনিরগুলো সংগ্রহ করলেন কিন্তু মূল্য দিতে গিয়ে শত চেষ্টা করেও তা সম্ভব হলোনা।আমাদের অন্যাদেরকেও একটি করে সুভেনির উপহার দিলেন।হঠাৎ দোকানের দেয়ালের এক পাশে ছেঁটে দেয়া একটি পোষ্টারে নজর পড়লো।২৯ মে অনুষ্ঠিতব্য বৈশাখী মেলার পোষ্টার ,পোষ্টারটি চারজন গুনি অতিথি শিল্পী ফকির শাহাবুদ্দিন,তপন চৌধুরী,পবন দাস বাউল ও আমাদের কাব্য কামরুলের ছবি সম্বলিত। ভালোলাগলো পোষ্টারে কাব্য কামরুলের ছবি দেখে।

উত্তম দা'র কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা রওনা হলাম সাগর পারের উদ্দেশ্যে।প্লাসা দো কাতালোনিয়া থেকে সহজ পথ লা রামলা দিয়ে আমরা সাগরের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম।পর্যটকদের শ্রোতে লা রামলা'র প্রশস্থ পথটি যেন একটি দীর্ঘ মৌন মিছিলের রূপ নিয়েছে।উজ্জ্বল ভাই প্রথমেই লা রামলার পাশেই অবস্থিত বার্সেলোনার একটি ঐতিহ্যবাহী বাজার 'মার্কা সেন্ট যোসেফ লা বুকারিয়া' (Mercat St. Josef La Boqueria)তে নিয়ে গেলেন।কয়েক শত বছরের প্রাচীন এই বাজারটিতে যতটানা ক্রেতার ভীড় রয়েছে তার চেয়ে দ্বিগুন রয়েছে দর্শনার্থীদের হুড়োহুড়ি।বাজারটির ধরণ আমাদের দেশের কাওরান বাজারের মত কিন্তু অত বড় নয়।এই ছোট্ট বাজারটিতে মাছ,মাংশ,ফলমূল,শাক সবজি,রেস্তোরার খাবার সবই পাওয়া যায়।আমাদের দেশের বাজারগুলো থেকে পার্থক্য এই যে,বাজারটি চকচকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এবং প্রতিটি দোকানের পন্য সামগ্রী এমন বৈচিত্র ও শৈল্পিকভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে প্রদর্শিত যা যে কোন মানুষকেই আকৃষ্ট করবে।শৌখিন আলোকচিত্রিরাও তাই এই ব্যতিক্রমধর্মী দোকানগুলোর ছবি তুলতে সদা ব্যস্ত।

লা বুকারিয়া থেকে বেরিয়ে আমরা আবার মিরাদোর দো কলম(Mirador de colom)দিকে হাঁটতে লাগলাম।


লা রামলার ব্যস্ত লোকারণ্য পথটির দুই ধার দিয়ে সুসজ্জিত সুভেনিরের দোকান, চিত্র শিল্পীদের চিত্রকর্মে ব্যস্ততা,পথ শিল্পীদের নাবিক কলম্বাস,বিখ্যাত স্থপতি গাউদির মূর্তি সেজে পর্যটকদের আকৃষ্ট করার দৃশ্যগুলো যেন জায়গাটিকে এক ভিন্নতর সৌন্দর্য দিয়েছে। এই সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে কাব্য ভাই কয়েকবার আমাদের মাঝ থেকে পর্যটকদের ভিড়ে হারিয়ে গেলেন। আমিও ছবি তুলতে গিয়ে গ্রুপ থেকে মাঝে মাঝে বিচ্ছিন্ন হতে লাগলাম।

প্রচন্ড রোদ আর রাতভর দীর্ঘ যাত্রার ক্লান্তি সবার মধ্যে ভর করে বসলো , তাই মিরাদোর দো কলম এ আসার পর কেউ আর সামনে এগুতে ইচ্ছে পোষন করলো না।সবাই এই বন্দরের গাছের নিচে জল খাবার নিয়ে বসে পড়লাম।আমাদের ক্ষুদে ভ্রমণার্থী আঞ্জু আর ফিরোজাও এখানে দুপুরের খাওয়া সেরে নিলো।গল্প গুজবের ফাঁকে আমাদের পুঁথি শিল্পী কাব্য ভাই বার্সেলোনা শহর নিয়ে একটি পুঁথিও রচনা করে ফেললেন। তাৎক্ষনিক রচিত সেই পুঁথি আবার পোর্ট ভেল বন্দর পাড়ে উজ্জ্বল ভাইয়ের নির্দেশনায় মোবাইল ক্যামেরায় শ্যুট করা হলো।ব্যতিক্রম সুরের এই পরিবেশনা দেখে কিছু সাদা চামড়ার মানুষ উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন।সঙ্গে সঙ্গে এই বন্দর পাড় থেকে বার্সেলোনা বন্দনার এই পুঁথি'র ভিডিওটি ফেজবুকে আপলোড করে বার্সেলোনা প্রবাসি বাঙালিদের জানিয়ে দেওয়া হলো পুঁথি শিল্পী কাব্য কামরুলের আগমন বার্তা।

মিরাদোর কলম ,এখানে রয়েছে নাবিক কলম্বাসের স্মৃতিসম্বলিত যাদুঘর কলম মুজে মারিতিম(COLOM MUSEU MARITIM)।
চলমান…………..