প্যারিস প্রবাসী চিত্রশিল্পী মুহিতের অকালপ্রয়াণ

মু: গোলাম মোর্শেদ উজ্জ্বল
Published : 11 Oct 2017, 06:17 PM
Updated : 11 Oct 2017, 06:17 PM


তিন দিন আগে ফেসবুক স্ট্যাটাসের মাধ্যমে জেনেছিলাম মুহিত ভাই (মুহিত আহমেদ জ্যোতি) গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে অচেতন প্রহর পার করছেন। ৯ অক্টোবর কাজ শেষ করে কর্মস্থল ত্যাগ করেই হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা হলাম। যাওয়ার সময় পথে সংগীতশিল্পী আরিফ রানা ভাইয়ের ফেসবুক স্ট্যাটাস দেখে একটু থমকে গেলাম।

তিনি লিখেছেন—আজকে হাসপাতালে গিয়ে জানতে পেরেছি বন্ধু মুহিতের শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। ডাক্তারেরা আশা ছেড়ে দিয়েছেন। একজন সেবিকা জানালেন তোমাদের যা কিছু করণীয় শুরু করতে পার…কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না…একটি অলৌকিক কিছুর অপেক্ষায় আছি… কেন এখনই চলে যাওয়ার তাড়া, অনেক কাজ আছে বাকি, শেষ করতে হবে অসমাপ্ত সব ছবি, ঝগড়া, অভিমান এখনো যে বাকি…।

স্ট্যাটাসটা পড়ে বুকের মধ্যে একটা কাঁপন অনুভব করলাম। মেট্রো থেকে নেমেই এক পথচারীকে জিজ্ঞেস করে হাসপাতালের দিকে দ্রুত ছুটে গেলাম। হাসপাতালের নিজতলায় সংস্কৃতিকর্মী অলকা দিদিসহ প্যারিসের আরও কয়েকজন মুহিত ভাইকে দেখার জন্য অপেক্ষা করছেন। দ্বিতীয়তলায় কেবিনের সামনে বসা কয়েকজন সমমনা বন্ধুর বিমর্ষ মুখচ্ছবি বলে দিচ্ছে সত্যি কোনো খারাপ সময়ের অপেক্ষায় আছি। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে মুহিত ভাইয়ের কেবিনের আমরা কয়েকজন এগোতে লাগলাম। কেবিনের বিছানায় নিথর পড়ে আছে দেহ, দুই চোখে প্রশান্তির ঘুম। মুখের সঙ্গে লাগানো যন্ত্রের সাহায্যে চলছে শ্বাসপ্রশ্বাস।

আমি কেবিনে দাঁড়িয়ে বুকের স্পন্দন দেখছি আর আশায় বুক বাঁধছি—মুহিত ভাই জেগে উঠবেন, সৃষ্টিকর্তা দয়া করে আবার আমাদের মাঝে ফিরিয়ে দেবেন তাঁকে। কিছুক্ষণ পর করিডরে অবস্থান নিলাম। ২০ মিনিট পর ঘড়িতে রাত ৮টা ৪৫ মিনিট। অলকাদি কান্নাভেজা চোখে করিডরে এসে জানালেন, শ্বাসপ্রশ্বাস যন্ত্র খুলে ফেলা হয়েছে। বুঝতে দেরি হলো না, আশাভঙ্গ হয়েছে, মুহিত ভাই দেহত্যাগ করে ওপারে রওনা হয়েছেন। অর্থাৎ কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেছেন। সদা হাস্যোজ্জ্বল যে মানুষটি আমাদের মাঝে ঘুরে বেড়াতেন, তিনি এভাবে অতীত হয়ে যাবেন ভাবতে কষ্ট হচ্ছিল। আবার ভেতরে প্রবেশ করলাম, এবার যন্ত্রপাতি ছাড়া বিছানায় শুধুই মুহিত ভাইয়ের নিথর দেহ। তাঁর সাত-আট বছরের কন্যাসন্তানটি কিছুক্ষণ আগে আশপাশে স্বাভাবিকভাবে ঘুর ঘুর করছিল বাবার সুস্থতার অপেক্ষায়। তাকে এবার দেখলাম অপেক্ষমাণ কক্ষে বাবা হারানোর বেদনায় কান্নাভেজা চোখে। এমন দৃশ্য দেখা সত্যি কঠিন।

মুহিত ভাই ছিলেন প্রতিভার অধিকারী। কিন্তু প্রতিভার অহংকারমুক্ত একজন সংস্কৃতি শ্রমিক। দূর পরবাসে বাংলা সংস্কৃতির চর্চা ও বিকাশের জন্য যে মানুষগুলো নিঃস্বার্থ ও নিবেদিতপ্রাণ, মুহিত ভাই প্যারিসের বাংলা কমিউনিটির সংস্কৃতি অঙ্গনে তেমনি এক শিল্প ভাবনার এক সাধক মানুষ। তার সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপ-আলোচনা বা আড্ডার সুযোগ আমার খুব কম হয়েছে। যতটুকু কথা, যোগাযোগ ও আন্তরিকতার সৃষ্টি হয়েছিল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ভেতর দিয়ে। আমার জানা মতে তিনি কোনো তারকা শিল্পী ছিলেন না। কিন্তু শিল্প ও সংস্কৃতি চর্চার মধ্য দিয়ে যে ধরনের আদর্শিক ও চারিত্রিক গুনের মানুষ হওয়া যায়, সেই গুণাবলি তার চলনবলন, কথা ও মানুষের সঙ্গে মেশার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেত। প্যারিসের কোনো সাংস্কৃতিক সংগঠনের অনুষ্ঠান তার রং-তুলির আঁচড় কিংবা তার উপস্থাপনা ছাড়া যেন একটু অসম্পূর্ণ থেকে যেত। নিজে নানা গুনের অধিকারী হলেও, সামান্য গুনের মানুষকেও অন্যের কাছে বড় করে উপস্থাপন করতেন। বন্ধু মনে করে কখনো ঠাট্টার ছলে কাউকে কিছু বললে, তা কেউ গ্রহণ করতে না পারলে তা আবার ঠাট্টা মধ্য দিয়ে মুহূর্তেই পরিবেশ আনন্দঘন করার এক সম্মোহনী গুনের অধিকারী ছিলেন।

প্যারিসে অক্ষর নামে কবিতাভিত্তিক একটি সংগঠনের সঙ্গে আমি জড়িত। ডিজিটাল যুগে সব অনুষ্ঠানে ডিজিটাল প্রিন্টিং ব্যানার ব্যবহার হলেও আমাদের কবিতার অনুষ্ঠানগুলোর ব্যানার হতো মোহিত ভাইয়ের শৈল্পিক হাতের রং তুলির তৈরি ব্যানার দিয়ে। শুধু ব্যানারের কারণেই অনুষ্ঠানের ষাট ভাগ সৌন্দর্য বেড়ে যেত। অনুষ্ঠানের দিন কখনো ব্যানারটি আমাদের হাতে বুঝিয়ে দিয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকতেন না। নিজের থেকেই মঞ্চসজ্জা থেকে শুরু করে অনুষ্ঠানের শেষ পর্যন্ত সার্বিক সহযোগিতায় পাশে থাকতেন। এত কিছু করার পর আবার মঞ্চে গিয়ে কবিতা পাঠের মধ্য দিয়ে দর্শকদের মুগ্ধ করতে কোনো বিচ্যুতি ধরা পড়ত না।

একজন শিল্পীর শৈল্পিক সেবার পাশাপাশি যে সামাজিক দায়বদ্ধতা থাকে, সেই কর্তব্যের জায়গায় তিনি ছিলেন যথেষ্ট সচেতন। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সংকটে প্রবাসের যে প্রতিবাদ, মানববন্ধন হয়, সেই সব জাতীয় ও আপামর মানুষের স্বার্থের কর্মসূচিগুলোতে মুহিত ভাইয়ের সরব উপস্থিতি লক্ষ্য করা যেত।

প্যারিসের বৃহৎ বাংলা কমিউনিটির মধ্যে বাঙালি সংস্কৃতির তারকা ব্যক্তিত্ব অনেকই রয়েছে। কিন্তু মুহিত ভাইয়ের মতো সেবক বা শ্রমিকমনা সংস্কৃতি কর্মীর সংখ্যা খুব কম। তাঁর এমন প্রস্থান কমিউনিটির সাংস্কৃতিক অঙ্গনে যে শূন্যতা তৈরি করল তা পূরণ হওয়ার নয়। যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন। আপনার কর্ম ও রেখে যাওয়া সৃষ্টির মাধ্যমে আপনি আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন।