গরমের ছুটিতে কানাপভিল গ্রাম পেরিয়ে দোভিল সমুদ্র সৈকতে

মু: গোলাম মোর্শেদ উজ্জ্বল
Published : 24 Sept 2018, 12:53 PM
Updated : 24 Sept 2018, 12:53 PM

মিশেল গরমের ছুটিতে তার মায়ের সঙ্গে বাংলাদেশে। টিভি রিমোটের কন্ট্রোল পুরোপুরিই আমার হাতে। কাজ শেষ করে বাসায় এসে সিনেমা দেখা, বারান্দায় গাছের টবগুলোতে পানি দেয়া, তিনদিনে একদিন রান্না করা আর ঘর গোছানোর কাজ এখন সপ্তাহে একদিন করলেই চলে।

দিন শেষে নিস্তব্ধ নীরবতা নেমে আসা ফ্ল্যাটে নিজের মতো করে একটু ভাবনার সুযোগ; এরপর পরবর্তী দিনের শক্তি সঞ্চারের জন্য ঘুমের প্রস্তুতি। এভাবেই কেটে যাচ্ছিলো সাময়িক একাকি জীবন।

গত ৯ আগস্ট থেকে শুরু হলো নয় দিনের ছোট্ট গরমের ছুটি। ভাবনায় ছিল কয়েক দিনের জন্য সবুজের চাদরে মোড়া কোনো পাহাড়ের নির্জন কোনে সময় কাটাবো। কিন্তু দীর্ঘ দিনের কাজের ক্লান্তির আলস্য এমনভাবে শরীর আর মনকে চেপে বসেছিল যে ছুটির দিনগুলো হেলায় কেটে যাচ্ছিল।

সিদ্ধান্ত নিলাম একদিনের জন্য কোথাও ঘুরে আসবো। ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি করে আঁলিয়াস ভয়াসের একদিনের একটি ভ্রমণের রেজিস্ট্রেশন করলাম, স্থান দোভিল।

এটি নরমাণ্ডি রেজিওর কালভাদোজ দোপার্টতোমোর একটি সমুদ্র উপকূলীয় শহর। সমুদ্র সৈকতের জন্য মূলত এই শহর অধিক পরিচিত। প্যারিস থেকে বাসে মাত্র তিন ঘণ্টার যাত্রা পথ। আজ থেকে পাঁচ বছর পূর্বে প্যারিসে বাংলাদেশের একটি আঞ্চলিক সমিতির আনন্দ ভ্রমণের সঙ্গী হয়ে ইতোপূর্বে এই শহরের সৈকতের নোনা জলে আমার শরীর ভেজানোর সুযোগ হয়েছে। কিন্তু এবারের ভ্রমণটা একটু ভিন্ন রকম।

ভ্রমণ এজেন্সি দিনের প্রথম পর্বে আমাদের নিয়ে যাবে কানাপভিল নামে একটি গ্রামের মদ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের ফ্যাক্টরি পরিদর্শনে এবং আমি একমাত্র এই ভ্রমণে সঙ্গীহীন পান্থ।

১৬ অগাস্ট প্যারিসের দফের রসু  থেকে আমাদের ভ্রমণ বাস যাত্রা শুরু করলো। ভ্রমণ সঙ্গীদের অধিকাংশই জীবনের পাতাঝরা শীতকালে অবস্থান করছে। দলে বসন্তের সায়াহ্নে অবস্থানকারী মানুষ আমিই শুধু। আমাদের ভ্রমণ নির্দেশনাকারীও সত্তরোর্ধ্ব প্রাণোচ্ছল মহিলা।

শহর পেরিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে ভ্রমণ বাস প্রবেশ করলো ধু ধু বিস্তীর্ণ মাঠের মধ্য দিয়ে বয়ে চলা মহাসড়কে। আমি সব সময় প্যারিসের বাইরে গেলে চলার আনন্দটা দারুণভাবে উপভোগ করি। ফ্রান্সের কৃষিভূমি এবং গ্রাম ছবির মতই সুন্দর।

তিন ঘণ্টার যাত্রা অতিক্রম করে আমরা প্রবেশ করলাম কানাপভিল গ্রামে। পাহাড়, সমভূমি এবং সবুজ অরণ্যে বেষ্টিত সুন্দর গ্রামের মধ্যে অবস্থিত সাতু দু ব্রুই। এটি এক সময়ের রাজবাড়ি হলেও এখন মূলত একটি মদ উৎপাদন কারখানা।

বৃক্ষ আর ফুলে শোভিত ছায়া শীতল সাজানো গোছানো একটি বাগানবাড়ি। প্রথম দেখাতে বোঝার উপায় নেই এটি একটি মদ উৎপাদনকারী কারখানা।

বাস থেকে নেমেই সবাই প্রবেশ করল সাতু দু ব্রুই উৎপাদিত মদের প্রদর্শনী কেন্দ্রে। এখানে নানা আকৃতির বোতলে মোড়কিকরণ করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে তাদের পণ্য সামগ্রী।

বিক্রয় কর্মীরা দর্শনার্থীদের জন্য উৎপাদিত ওয়াইনের স্বাদ গ্রহণের জন্য আপ্যায়নের ব্যবস্থা রেখেছেন। দর্শনার্থীদের অনেকেই প্রদর্শনী কেন্দ্র ঘুরে পছন্দের স্বাদের ওয়াইন কিনলেন। এর স্বাদের সঙ্গে এখন পর্যন্ত যেহেতু আমি পরিচত নই তাই নতুন করে স্বাদ গ্রহণ আর হলো না। আমি চারপাশ ঘুরে ছবি তুলতে ব্যস্ত থাকি।

এরমধ্যে আমাদের ভ্রমণ নির্দেশনাকারীর ডাক পড়লো। সকল ভ্রমণারথী একত্রিত হওয়ার পর আমাদের ভ্রমণ দলকে সাতুর একজন কর্মকর্তা নিয়ে গেলেন মদ উৎপাদনের প্রক্রিয়াকরণ একটি ইউনিতে।

এখানে আমাদের দেখানো হল আপেল থেকে রস তৈরির পর কীভাবে জ্বালানোর মাধ্যমে মদে রূপান্তর করা হয়। ভালোভাবে বোঝার জন্য কর্মকর্তা একটি ভিডিও প্রজেকশনের মাধ্যমে পুরো উৎপাদন প্রক্রিয়া আমাদের সামনে তুলে ধরলেন।

এরপর আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো যেখানে আপেল থেকে উৎপাদিত ওয়াইন সংরক্ষণ করা হয়। সংরক্ষণাগারটির বাহিরের চেহারা অনেকটাই আমাদের দেশের কৃষকদের ধান-গম সংরক্ষণের গুদাম ঘরের মতোই। ভেতরের দৃশ্য অনেকটাই আমাদের দেশের স্থানীয় ভোজ্যতেল উৎপাদনকারী মিলের মতো।

কাঠের নির্মিত সংরক্ষণাগারে ওয়াইনে ভরপুর সুবিশাল কাঠের গোলাকৃতির কনটেইনার দুই সারিতে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। প্রতিটি কনটেইনারে সংরক্ষণ সংক্রান্ত লেবেল লাগানো।

আমাদের সবাই খুব আগ্রহ নিয়েই মদের এই সংরক্ষণাগারটি ঘুরে দেখতে লাগলেন। এই ওয়াইন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের প্রধান কাঁচামাল আপেল।

আপেল গাছে ফুল ফোটা থেকে শুরু করে বাগান থেকে আপেল সংগ্রহ এবং সংগৃহিত আপেলের রস মদে রূপান্তর করে মজুদ ও বাজারজাতকরণের প্রতিটি স্তরের একটি ভিডিও চিত্র কয়েকটি কনটেইনার উপর প্রোজেক্টরের মাধ্যমে দেখানো হলো সবাইকে।

ফরাসি খাবার তালিকায় মদ  ঐতিহ্যবাহী পানীয়। সমস্ত ফরাসি ভূখণ্ডে নামী ব্র্যান্ডের মদ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কারখানার পাশাপাশি রয়েছে অসংখ্য অপরিচিত ছোট ছোট কারখানা। এমনকি ফরাসি গ্রামাঞ্চলে অনেক কৃষি পরিবারে পারিবারিক ভাবেও তৈরি হয় মদ; যেমনটি আমাদের দেশে কাঁচা আমের সময় গ্রামের অনেক পরিবার কাসুন্দি তৈরি করে।

এখানে আঙুর এবং আপেল অন্যতম কৃষি পণ্য, যা বিশেষত মদ উৎপাদনের প্রধান কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ফরাসি রপ্তানিজাত পণ্যের মধ্যে মদ অন্যতম। আমাদের দেশের বিভিন্ন মেলায় যেমন স্থান পায় আমাদের দেশজ উৎপাদিত প্রধান পণ্যসামগ্রী আর এখানকার শহর কিংবা গ্রামে কোনো মেলার আয়োজন হলে সেখান প্রধানত স্থান পায় মদ ও পনির।

আমরা যখন সাতু দু ব্রুই থেকে বিদায় নিয়ে গ্রামীণ জনপদের ভেতর দিয়ে দোভিললের উদ্দেশ্যে রওনা করলাম তখন চোখে পড়ল অসংখ্য আপেল বাগান।


দোভিল রেল স্টেশনে পৌঁছানোর পর আমাদের ভ্রমণ নির্দেশনাকারী ঘোষণা করলেন সন্ধ্যা ছয়টার সময় ভ্রমণ বাস প্যারিসের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করবে। সুতরাং সবাইকে ছয়টা বাজার পনেরো মিনিট পূর্বে বাসে অবস্থান নিতে হবে।

আমি  ক্যামেরাকে সঙ্গী করে রওনা হলাম সৈকতের উদ্দেশ্যে। পরিচিত শহরটা এবার নিজের কাছে নতুন করে আবিষ্কৃত হল। বিগত সময় এভাবে দোভিল শহরের সৌন্দর্য আমার দৃষ্টিকে ছুঁয়ে যায়নি। শহরের ভেতর দিয়ে সৈকতে যাওয়ার সময় চোখে পড়ল পাহাড়ের পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে গড়ে ওঠা স্থানীয়দের বসতবাড়ি, অন্যদিকে সমভূমিতে গড়ে ওঠা ভিন্ন মাত্রার স্থাপত্য শৈলীর দালান, যার অধিকাংশই হোটেল, কেসিনো, অফিস-আদালত। দেখে মনে হলো, দালানগুলোর সামনের অংশের নকশার সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলতে কাঠের ব্যবহার করা হয়েছে।

আমি নরমান্ডির আরও কয়েকটি শহরে আগে ভ্রমণ করলেও এবার দোভিল শহরের সৌন্দর্য যেন অন্য শহরগুলো থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে ধরা দিল।

দোভিলের সমুদ্র সৈকতে চল্লিশ মিনিট একপাশ ধরে হেঁটে অন্যপাশে যাওয়া যায়। আমার সমুদ্রের গর্জন শুনতে ভালোলাগে। তীরের বুকে ঢেউয়ের আঁছড়ে পরার দৃশ্য মুগ্ধ করে, কিন্তু নোনা জলে শরীর ভেজাতে অনীহা রয়েছে।

গতবার এই সৈকতে এলোমেলোভাবে হেঁটে বেড়িয়েছি। পুরো সৈকত ঘুরে দেখা হইনি। বেশ দূরত্বে সুমদ্রের কোল ঘেঁষে বেড়ে ওঠা সবুজে ঘেরা একটি টিলার মাঝে ছোট্ট একটি বাড়ি নৈসর্গিক সৌন্দর্য বিলাচ্ছে। সেই সৌন্দর্য  দারুণভাবে টানলো। সিদ্ধান্ত নিলাম সৈকতের তীর ধরে হেঁটে ঐ বাড়িটার কাছে পৌঁছুবো।

আমি হাঁটছি আর সৈকতের চার পাশের মানুষের কর্মকাণ্ড দেখছি। ছোট শিশুরা বাবা-মায়ের সঙ্গে সমুদ্রে জলকেলিতে মেতে উঠেছে। সৈকতের বেলাভূমির স্বেদ চামড়ার নানা বয়সের মানুষ স্বল্প বসনে শরীরকে প্রকৃতির কাছে সমর্পণ করে নিশ্চিন্ত মনে সূর্যের তাপ গ্রহণ করছে।

বছরের অধিকাংশ সময় ঠাণ্ডা আবাহাওয়ার কারণে ইউরোপের মানুষের শরীর মোটা কাপড়ে ঢাকা থাকে তার উপর মেঘাচ্ছন্ন আকাশ সূর্যকে ঢেকে রাখে ফলে সূর্যের তাপ থেকে তাদের শরীর হয় বঞ্চিত। তাই মাস তিনেকের রোদ্রোজ্জল উষ্ণ সময় কালে অধিকাংশ ইউরোপিয়ান সমুদ্রমুখী হয় শরীরের সাদা রঙটাকে রোদে পুড়িয়ে একটু তামাটে করার প্রচেষ্টায়।

সমুদ্রের তীর দিয়ে দীর্ঘ সময় হেঁটে আমার গন্তব্যে পৌঁছুলাম। এখানে কিছু সময় বিশ্রাম নেবার পর ফেরার পথে দেহ-মনে দারুণ এক ক্লান্তি চেপে বসতে সমুদ্রের বিশালতাকে সামনে রেখে নিজেকে এই বিস্তীর্ণ বালিয়াড়ির উপর সমর্পণ করলাম।

আমাদের ইট-পাথরে আচ্ছাদিত নিয়ম-কানুনের জীবন-যাপনে মাটির স্পর্শ নেবার সুযোগ খুবই কম। সমুদ্রের গর্জন, বয়ে যাওয়া বাতাসের শোঁ শোঁ আওয়াজ এমন প্রকৃতির মাঝে বালুর উপর দেহটাকে এলিয়ে দিয়ে পৃথিবীর সমস্ত চিন্তার জাল ছিন্ন করে চলে গেলাম ঘুমের ঘোরে।  বিধি-নিষেধের সভ্যতার বাইরে দু'ঘণ্টার জন্য আদিমতর জীবনের নির্ভেজাল স্বাদ গ্রহণ করলাম।

এদিকে ঘড়ির কাঁটা বুঝিয়ে দিলো সাগর পাড়ের কিছুক্ষণের উন্মত্ত জীবনের সময় প্রায় শেষ হয়ে আসছে। শরীরের উপর জমে থাকা বালুর স্তর ঝেড়ে ফেলে আবার সভ্য সমাজের জন্য তৈরি হয়ে নিলাম।

পড়ন্ত বিকেলের উত্তাপহীন সৈকতে হাঁটাহাঁটি করে চলে এলাম সারি সারি জাহাজের নোঙর করা এলাকায়। এখানে শান্ত জলাধারার মধ্যে গড়ে তোলা হয়েছে নান্দনিক কিছু অবকাশ যাপনের দালান। খালের ওপর পাশে সমুদ্রের কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা সবুজে ঘেরা পাহাড়ি জনবসতি আর পর্যটকদের পদচারণা মুখর সৈকত দোভিল শহরকে এক ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে গিয়েছে।

সাগরের পার থেকে বিদায় নিয়ে নির্ধারিত সময়ের প্রায় এক ঘণ্টা আগেই চলে এলাম আমাদের দোভিল রেল স্টেশনে। উদ্বৃত্ত সময় শহরের ভেতর দিয়ে বয়ে চলা নদীর পারে বসা বৈকালিক মেলা, আকাশে পাখিদের দলবেঁধে উড়ে বেড়ানো,নদীর শান্ত স্রোতে বয়ে চলার দৃশ্য দেখে কেটে গেলো।

বাসে ঢুকতেই আমাদের ভ্রমণ পরিচালক মহিলা আমাকে দেখে মনে হয় একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। তার হয়তো আশংকা ছিল ভ্রমণ দলের একমাত্র সঙ্গীহীন এবং এশিয়ান কালো এই মানুষটি অচেনা শহরে পথ হারাবে।

আলোকচিত্র: মু: গোলাম মোর্শেদ উজ্জ্বল