আরাগঁ-এলসার সাহিত্য নীড়ে একদিন

মু: গোলাম মোর্শেদ উজ্জ্বল
Published : 18 Oct 2019, 03:45 PM
Updated : 18 Oct 2019, 03:45 PM


প্রতি বছরই গ্রীষ্মের সময়কালে সাহিত্য সংগঠন অক্ষরের আয়োজনে প্যারিসের সাহিত্যপ্রেমী বন্ধুদের নিয়ে কোন ছায়াঢাকা সবুজ পার্কের পড়ন্ত বেলায় আয়োজন চলে কবিতা পাঠের আসর আড্ডার।গ্রীষ্মের উষ্ণতা প্রায় শেষের পথে তাই সাহিত্য অনুরাগী হাসনাত জাহানের উদ্যোগে গত ২৯ অগাস্ট অক্ষরের সদস্য ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের নিয়ে প্যারিসের অদূরে Moulin de Villeneuve -তে অবস্থিত প্রয়াত ফরাসি লেখক দম্পতি লুই আরাগঁ ও এলসা ট্রায়োলেটের আবাস স্থলে আয়োজন করা হয় কবিতা পাঠের আসর।

কবি আরাগঁ'র নাম শুনেছি, কিন্তু তার জীবন ও সৃষ্টি সম্পর্কে আমার তেমন ধারণা ছিল না। তাই কবির সমাধির পাশে দাঁড়ানোর পূর্বে কবির জীবন ও সৃষ্টিকর্ম জানার তাগিদ অনুভব করে কয়েকদিন ইন্টারনেটকে মাধ্যম করে আরাগঁকে খোঁজাখুঁজি করে পেয়ে গেলাম কিছু আরাগঁ সাহিত্যের অনুবাদ এবং তার বৈচিত্র্যময় জীবন বৃত্তান্ত।আরাগঁকে জানার পর আরও দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম কবির বাসগৃহ পরিদর্শনের নির্ধারিত দিনটির জন্য।

দুটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে ২৯ অগাস্ট প্যারিসের  Montparnasse থেকে ট্রেনে একঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে আমরা মিলিত হলাম  Rambouillet রেল ষ্টেশনে। Transdev Express 10 বাসে উঠে আমরা রওনা হলাম Moulin de Villeneuve -তে অবস্থিত আরাগঁ এলসার আবাস গৃহের দিকে।

বাস কিছুক্ষণের মধ্যে প্রবেশ করল বিস্তীর্ণ ফসলী মাঠের মধ্য দিয়ে বয়ে চলা ফরাসি গ্রামীণ পিচঢালা পথে।উঁচুনিচু পথের পাশে কোথাও ঘন জঙ্গল, আবার একটু পথ পেরুলেই তৃণভূমিতে সাদা ধেনু ও ভেড়ার পালের বিচরণের দৃশ্য দেখতে দেখতে আমরা পৌঁছে গেলাম Chaudières বাস স্টেশনে। ছায়াঢাকা গ্রামীণ পরিবেশ, জনমানবের কোলাহল মুক্ত, পাখ-পাখালির কিচির মিচির আওয়াজ ভেসে আসে কানে।এমনই এক নৈসর্গিক প্রকৃতির মধ্যে আরাগঁ-এলসা'র সাহিত্য সৃষ্টির নীড়।


পুরুষের ভবিষ্যৎ হচ্ছে নারী। জনপ্রিয় এই বিখ্যাত উক্তিটি করেছিলেন ফরাসি সাহিত্যিক লুই আরাগঁ। আরাগঁ মূলত তার পারিবারিক নাম নয়, ছদ্মনাম। প্রকৃত নাম গ্রাদেল। ফরক্যালকুয়ার সংঘের সিনেটর লুই অ্যান্ড্রুক্স তার পিতা হলেও কখনো পিতৃস্বীকৃতি তার কপালে জোটেনি। এ নিয়ে কোনো অস্থিরতাও ছিল না আরাগোঁর মধ্যে। বৈচিত্র্যময় জীবনের অধিকারী বিশিষ্ট এই রোমান্টিক কবি, ঔপন্যাসিক, প্রবন্ধকার, সাংবাদিক ও রাজনৈতিকের জন্ম ১৮৯৭ সালের ৩ অক্টোবর ফ্রান্সের প্যারিস শহরে। ছেলেবেলা কেটেছে মা ও নানীর লালন-পালনে। অসম্ভব মেধাবী, জেদি, আত্মবিশ্বাসী আরাগোঁর শৈশব কাটে অনেকটাই কঠোর অধ্যবসায়ের মধ্য দিয়ে। ছাত্র অবস্থাতেই প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের সময় সহকারী চিকিৎসক হিসেবে তিনি যোগ দেন সেনাবাহিনীতে। অসীম সাহসিকতার স্বীকৃতি সম্মানও পান।

মূলত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তিনি বিভিন্ন সাহিত্য আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর সারা পৃথিবীতে যখন মন্দা অবস্থা, সমস্ত ইউরোপ জুড়ে অস্থিরতা তখন রাশিয়ার শ্রমিকরা বিপ্লবের ভেতর দিয়ে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন সমাজতন্ত্র। এই যুগসন্ধি কালে সচেতন কবি-সাহিত্যিকেরা পুরনো ধ্যান-ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে নতুন এক বিস্ময়ের অনুসন্ধানে নিমগ্ন হন। এই অনুসন্ধান ছিল গভীরতম সত্যকে উপলব্ধির। এই সত্য উপলব্ধির অনুপ্রেরণায় তরুণ ফরাসি সাহিত্যিক আরাগঁ অতিক্রম করেছেন দাদাইজম, কিউবিজম, সুররিয়ালিজম, সিমবলিজম, রিয়ালিজম মতো সাহিত্য আন্দোলনের নানা স্তর।

আজন্ম বিদ্রোহী আরাগঁ মার্কসবাদী লেলিনের রুশ বিপ্লব দ্বারা সাম্যবাদের দিকে অনুরক্ত করে। ফলে ১৯২৭ সালে আনুষ্ঠানিক ভাবে কম্যুনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেন।

সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় বিচরণ করা আরাগঁর ছয়-সাত বছর বয়সে গল্প লেখার মধ্য দিয়ে লেখালেখির হাতে খড়ি হয়। অপরিপক্ব বয়সের লেখা হলেও লেখাগুলোর মধ্যে ছিল পরিপক্বতার ছাপ। তিনি কবিতা লিখতে শুরু করেন দশ বছর বয়স থেকে। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ   'ফো দ্যা বোয়া'  প্রকাশিত হয় ১৯২০ সালে। প্রথম উপন্যাস  'আনিসে ঊ ল পানোরামা'  প্রকাশকাল ১৯২১।

সাম্যবাদী আরাগঁর জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় দিনটি হচ্ছে লা কুপেলে রেস্তোরাঁয় ১৯২৮ সালের ৫ নভেম্বর তারিখে এলসার সঙ্গে সাক্ষাতের ক্ষণটি। বিখ্যাত রুশ বিপ্লবী কবি ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কি প্যারিসে আসেন আরাগঁর সাথে পরিচয় হতে। তখন মায়াকোভস্কি তার শালিকা এবং বান্ধবী এলসার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। এলসা ছিলেন মাক্সিম গোর্কি'র স্নেহধন্য রুশ লেখিকা। বয়সে আরাগঁর বছর খানেকের বড়। ১৯২৩ সালে এলসার বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে, এর পূর্বে আরাগঁর তার প্রণয় সঙ্গী নানসি কানার্ডের সঙ্গেও সম্পর্কের ছেদ ঘটে। ফলে প্রথম সাক্ষাতেই একে অপরের প্রতি এক ভালোলাগা এবং ভালোবাসার দৃষ্টি বিনিময় হয়। পরবর্তীতে তাদের প্রণয় এবং পরিণয় ঘটে। এরপর থেকে এলসা আরাগঁর জীবনে সুখে-দুঃখে, আনন্দ-বেদনায়, সংগ্রামে, আবেগ, অনুরাগে গভীর ভালোবাসায় জড়িয়ে ছিলেন।

আরাগঁ আবেগ-ভালোবাসার উপলব্ধির বহিঃপ্রকাশে বলতো, এলসা পাশে থাকা মানে কোন যুদ্ধাভিযানের অর্ধেক আগেই জয় করা। এলসা রুশ লেখিকা হলেও আরাগঁর সাথে ফ্রান্সে স্থিতি হবার পর পরবর্তীতে ফরাসি সাহিত্যেও নিজেকে একজন অগ্রণী লেখিকা হিসেবে আত্মপ্রতিষ্ঠা করেন।

১৯৩০ সালে রাশিয়ার মস্কোতে অনুষ্ঠিত হয় বিপ্লবী লেখক সম্মেলন। সেই সম্মেলনে চির বিদ্রোহী আরাগঁ আমন্ত্রিত হয়ে প্রিয়তমা এলসা এবং বন্ধু ঝর্ঝ সাদুলকে সঙ্গী করে যোগ দেন। রাশিয়া দর্শন করে ফিরে এসে আরাগোঁ একটি কবিতা লেখেন যেটি ১৯৩১ সালের অক্টোবর মাসে প্রকাশিত পেরসেক্যুতে পেরসক্যতর কাব্যগ্রন্থে স্থান পায়। সংকলনটি প্রকাশ হওয়ার পর ১৯৩২ সালে জানুয়ারি মাসে রাষ্ট্রীয় গভীর ষড়যন্ত্রের অভিযোগে ফরাসি সরকার গ্রেপ্তার করে পাঁচ বছরের কারাদণ্ডাদেশ প্রদান করেন। কিন্তু পৃথিবীর বড় বড় লেখক, রাজনৈতিক মনীষীদের প্রতিবাদ ও চাপ প্রয়োগের কারণে সরকার সেই দণ্ডাদেশ তুলে নিতে বাধ্য হন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আরাগঁ লেখা সাহিত্য কর্মকে বলা হয় আরাগঁ সাহিত্যের তৃতীয় স্তর। ইউরোপের ছোট ছোট সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো যখন নিজেদের দেশ পুনর্গঠনে ব্যস্ত তখন পৃথিবীর বড় দেশগুলো পরমাণু অস্ত্রের প্রতিযোগিতায় বিশ্বকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে রেখেছে । আরাগঁ মনে করেন দেশ স্বাধীন হলেও প্রকৃত শান্তির পরিবেশ ও স্থিতিশীলতা এখনো ফিরে আসেনি। এজন্য এই যোদ্ধা কবিকে বিশ্ব শান্তির জন্য অক্লান্ত কাজ করতে হয়েছে। অন্যদিকে স্নায়ুযুদ্ধের অস্থিরতা, নৈরাশ্য, হতাশা, বেদনা, অতীতের স্মৃতি আরাগোঁর হৃদয় পটে গভীর ভাবে রেখাপাত করে।এরই প্রেক্ষাপটে আরাগঁ সৃষ্টির উত্তরণ। এ পর্যায়ে লুই আরাগোঁ সাহিত্যের বিকাশ ঘটে বিস্ময়কর ধরনের বিষয় বৈচিত্র্যে।

১৯৫৪ সালে লুই আরাগঁ ফরাসি কম্যুনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় সদস্য নির্বাচিত হন এবং একই বছরে লেলিন শান্তি পুরষ্কারে ভূষিত হন। এ পর্যায়ে রাজনীতির পাশাপাশি তিনি সৃষ্টি করেন অসংখ্য সাহিত্যকর্ম। এসময়ের লেখা কাব্যগ্রন্থের মধ্যে লেজিয়ো এ লা মেমোয়া, ল রমা ইনাশভে, এলসা, লে পোয়েৎ, পোয়েজী, লো ফু দেলসা, লো ভয়েজ এন হুলাদ, লে শবির, এলেকি আ পাবলো নেরুদা এবং উপন্যাসের মধ্যে লা সোমেন সাৎ, লা মীজ আ মর, ব্লাশ উ লুবলি, লিসতোরার পারালেল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

১৯৭০ সালে এলসা ট্রিওলের আকস্মিক মৃত্যু এই সংগ্রামী কবিকে শোকে বিহ্বল করে দেয়। তার রক্তধারায় এই নারীর অস্তিত্ব এতটাই বহমান ছিল যে এলসা'র বিদায় বেদনার শোক কাটিয়ে নিঃসঙ্গ আরাগোঁ আর কখনোই ছন্দময় স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেনি। এলসা প্রতি আরাগঁ র ভালোবাসার নিদর্শন মেলে আরাগোঁর সাহিত্যে এলসার বিজয়গাথা বন্দনার মধ্যদিয়ে।

এলসার প্রস্থানের পর আরাগঁ'র কলমে সৃষ্টি হয়নি তেমন কোনো সৃষ্টিশীল সাহিত্য কর্ম । ১৯৭৫ সালে ফরাসি কবি সাঁ-কন পেরসে'র নোবেল বিজয়ের পর তাকে নিয়ে লেখা একটি ছোট্ট প্রবন্ধই সম্ভবতই আরাগঁ'র জীবনের শেষ লেখা।

এলসার মৃত্যুর পর অনেকটাই ভভঘুরে জীবন নিয়ে বেঁচে ছিলেন বিশ্বের এই শ্রেষ্ঠ বিদগ্ধ কবি ও সাহিত্যিক।১৯৮২ সালের ২৮ ডিসেম্বর এই পৃথিবীর মানুষের জন্য তার সৃষ্টি ও কর্মময় জীবন রেখে দেহ ত্যাগের মাধ্যমে প্রাণবায়ু নিয়ে অসীম শূন্যের দিকে যাত্রা করেন।

আরাগঁ সম্পর্কে পড়ে মনে হয়েছিলো তিনি যতটা প্রেমিক কবি তার চাইতে দ্বিগুণ দৃঢ় প্রতিবাদী এবং জীবন যাপনে অগোছালো প্রকৃতির মানুষ ছিলেন।কিন্তু ২৯ আগস্ট কবি দ্বয়ের বাড়ীর প্রবেশ দ্বারে পৌঁছুনোর পর থেকেই আমার ধারণা পরিবর্তন হতে শুরু হল। মনে হল আরাগঁ যতটা প্রতিবাদী মানুষ ছিলেন ঠিক তটটাই শৌখিন,শিল্প অনুরাগী,প্রকৃতি প্রেমিক, নারীর ভালোবাসার কাঙাল প্রকৃতির মানুষ ছিলেন তিনি।

পুরনো বাড়ীর লোহার গেটে টাঙানো একটি পোস্টারে লেখা এলসা ট্রিওলে আরাগঁ'র বাড়িতে আপনাকে স্বাগতম।চারিদিকে প্রাচীরে ঘেরা গাছ পালা বেষ্টিত সবুজের মাঝে অবস্থিত বাসগৃহটি এখন এলসা আরাগঁ স্মৃতি সংগ্রহশালা যাদুঘর।আমরা বাড়ীটিতে প্রবেশ করেই স্মৃতি যাদুঘর পরিদর্শনের জন্য প্রত্যেকে ১০ ইউরো মূল্যে টিকেট সংগ্রহ করলাম, শুধু ছড়াকার লোকমান আপন ভাই সাংবাদিক পরিচয়ে শুভেচ্ছা মূল্যে টিকেট পেলো। বিকেল চারটায় একজন গাইডের নেতৃত্বে আমাদের স্মৃতি যাদুঘর পরিদর্শন। আমাদের হাতে একঘণ্টা সময় তাই দুপুরের মধ্যাহ্ন ভোজের পর্ব সেরে নিলাম দর্শনার্থীদের বিশ্রামের জন্য টেবিল বেঞ্চ সম্বলিত আমাদের দেশের কাচারি ঘর প্রকৃতির একটি ছাউনি ঘরে।বাচিক শিল্পী সাইফুল ইসলামের রন্ধন শৈলীর স্বাদ আস্বাদনে ক্ষুধা নিবারণের পর আমরা কবি দম্পতির বাগান বাড়ীটি ঘুরে দেখতে বেড়িয়ে পড়লাম।বাড়ীর উঠোনের সামনে সুতোর মতো ছোট্ট ক্যানালে মাছের সাঁতার কাটার দৃশ্য পল্লী গ্রামের কোন খাল বা বিলের পাড়ে দাঁড়ানোর শিহরণ এনে দিলো।ক্যানালের উপর কাঠের পাটাতনের ব্রিজ পার হয়ে একটু হাঁটলেই ঘন গাছপালা বেষ্টিত এক জংলা প্রকৃতির উঁচুভূমি।এরমধ্যে স্থাপিত সাউন্ড সিস্টেম থেকে ভেসে আসছে বেহালা ও বাঁশীর সংমিশ্রিত মৃদু সুর।বড় বড় বৃক্ষের নিচে লতা গুল্ম ঢাকা জংলার পাশে একটি শান বাধা কবর।এই একটি কবরের মধ্যে দুই প্রেমিক প্রেমিকার ( আরাগঁ এলসার) সমাহিত দেহ। চারিদিকে শুনশান নীরবতা। সাজানো বিশাল বাগান বাড়ীর চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এই লেখক যুগলের স্মৃতি চিহ্ন ও রুচির বহিঃপ্রকাশ।চারপাশ ভালোভাবে একটু পর্যবেক্ষণ করলে মনে হবে এ যেন আরাগঁ এলসা স্বর্গোদ্যান।আমি অবাক হচ্ছিলাম শুধু লেখার অনুভূতি জাগাবার জন্য একজন কবি এমন সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ তৈরি করতে পারে।চারপাশের পরিবেশ থেকেই থেকেই অনুমান করা যায় আরাগঁ এলসা'র মনের সৌন্দর্যের গভীরতা।

বিকেল চারটায় এখানকার যাদুঘর কর্তৃপক্ষের একজন আমাদেরকে আরাগঁ এলসার বাসগৃহটি পরিদর্শনের জন্য পুনরায় স্মরণ করিয়ে দিলেন।আমাদের চৌদ্দ সদস্যের দলের সঙ্গে একজন তরুণ গাইড যুক্ত হলেন যিনি লেখক যুগলের বাসগৃহের স্মৃতি সংগ্রহশালাটি ঘুরে দেখাবেন।রান্না ঘর থেকে শুরু করে দ্বিতল বাড়ীটির প্রতিটি কামরায় স্মৃতি আর শিল্পের সমারোহ।আমাদের গাইড তরুণটি যখন প্রতিটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সুভেনির হাতে নিয়ে এগুলোর আদি বৃত্তান্ত ব্যাখ্যা করছিল তখন আরাগঁ এলসার উপস্থিতি মনের পটে ছবির মত ভেসে উঠছিল।ঘরের দেয়ালের তাকে সাজানো ৩০ হাজার বইয়ের সারির মাঝে ব্যবহার্য নানা আসবাস পত্র সুশৃঙ্খলভাবে সাজানো গোছানো।প্রতিটি স্মৃতি চিহ্নের সাথে এক একটি গল্প জড়িয়ে রয়েছে, সেই গল্পেরই পুনরাবৃত্তি করে যাচ্ছে আমাদের গাইড।দেয়ালে টাঙানো জগত বিখ্যাত চিত্রশিল্পী পিকাসো'র শুভেচ্ছা স্বারক ছবি, খাবার টেবিল ও দেয়ালে ভিনসেন্ট ভ্যানগগের হাতের সৃষ্টি সিরামিক কর্ম, ভ্রমণ প্রিয় আরাগঁ'র বিভিন্ন দেশ থেকে সংগৃহীত সুভেনীরের সমাহারে সমস্ত ঘর যেন এক শিল্পের সমাহারে পরিণত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যখন তার বাড়ীর পাশ দিয়ে ফরাসি সৈনিকদের দল যেতো তখন আরাগঁ তাদের তামাক বিতরণ করত, সেই তামাকের ক্ষুদ্রাকৃতির কয়েকটি খণ্ডও সংগ্রহ রয়েছে এই স্মৃতি সংগ্রহশালায় ।মানুষের চিন্তার প্রকাশ হচ্ছে লেখা।সেই চিন্তার রস সৃষ্টি হয় পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি থেকে। আরাগঁ এলসার বাসগৃহ ও বাগান দেখে মনে হবে, চেয়ার টেবিল থেকে শুরু করে শোবার ঘর কিংবা উঠানের প্রতিটি ঘাসকে শৃঙ্খলায় আবদ্ধ করা হয়েছে চিন্তার রস বা আবেশ সৃষ্টির কথা চিন্তা করে।খাবার ঘরের পাশেই আরাগঁ'র লেখার ঘর।দেয়ালের চার পাশের তাকে সুসজ্জিত বইয়ের বেষ্টনীর মাঝে আরাগঁ'র লেখার চেয়ার টেবিল, রুমটি দেখতে কোন আইনজীবীর চেম্বার সদৃশ। লেখার টেবিলের সামনে কাঠের তৈরি প্রবেশ দরজা, দরজার মাঝে স্থাপিত স্বচ্ছ কাঁচ দিয়ে বাইরের প্রকৃতির দৃশ্য দেখা যায়, যা সত্যি মনোহর।অতিথিদের বৈঠকখানার ঘরটির মধ্যে রয়েছে কৃত্রিম ঝর্না, এই ঝর্নার জলের আঁচড়ে পরার শব্দে কিছু সময় প্রকৃতির সংস্পর্শের অনুভূতিতে বুদ হয়ে থাকা যায়।বাড়ীর দ্বিতলে ছিমছাম গোছানো এলসার লেখার ঘর, সামনের জানালা খোলা, বিকেলের মিষ্টি রোদের আলো ছিটকে পড়ছে ঘরের মধ্যে, জানালার ফাঁক দিয়ে বাগানের সুউচ্চ সেঞ্চুরি গাছের বাতাসে দুলে যাওয়ার দৃশ্য।মনে হচ্ছিলো আমরা চলে যাওয়ার পরই হয়তো এলসা এসে তার চেয়ারে বসে এই নির্জন প্রকৃতিকে সামনে রেখে লিখবে কোন রোমান্টিক কবিতার পংক্তিমালা।

আরাগঁ এলসার বাসগৃহ পরিদর্শন কালে স্মরণ হয়েছে আমাদের রবীন্দ্র নজরুলের কথা ।আরাগঁ'র মধ্যে খুঁজে পেয়েছি রবীন্দ্র নজরুলের সমন্বিত এক সত্তার সন্ধান । আরাগঁ লেখায় ও কর্মে আমাদের বিদ্রোহী নজরুলের স্বভাবের হলেও রুচি ও জীবনাচারণ মনে হয়েছে রবীন্দ্রনাথের মতো।

নিয়ম অনুযায়ী বিকেল ছয়টায় বন্ধ হবে আরাগঁ এলসার স্মৃতি বাসগৃহের দরজা, তাই একটু তাড়াহুড়া করেই প্রশস্থ আঙিনার ছায়া শীতল ছোট্ট লেকের ধারের কোণ ঘেঁসে বসলো কবিতা অনুরাগী ও রেডিওর সোনালি দিনের অনুষ্ঠান ঘোষক মুনির কাদিরের সঞ্চালনায় আমাদের কবিতা পাঠের আসর।আরাগঁ এলসার সম্মানে আগত কবি ও আবৃত্তিকাররা পড়লো তাদের পছন্দের কবিতা। আরাগঁ'র লেখা একটি  কবিতা আমার কণ্ঠে পাঠের মধ্যে দিয়ে শেষ হল এক স্মৃতিময় বিকেল ও একটি সোনালী সুন্দর দিনের।

তথ্যসূত্রঃ আরাগোঁ'র জীবন ও সাহিত্যকর্মের তথ্য অনুসন্ধান করতে অসিত সরকারের লেখা প্রবন্ধ এবং উইকিপিডিয়ার সাহায্য নেওয়া হয়েছে।