বঙ্গবন্ধু ও একটি সাক্ষাৎকার

মোরশেদ তালুকদার
Published : 4 March 2017, 06:00 AM
Updated : 4 March 2017, 06:00 AM

'আত্মবিশ্বাসী মানুষ হিসাবে তার জন্য অগাধ শ্রদ্ধা', পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বেনজীর ভুট্টো এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব নিয়ে এমন মন্তব্য করেছিলেন।

বাংলাদেশিরা তাদের আবেগের জায়গা থেকে যে পাকিস্তানি জাতির প্রতি মনের কোনায়  ঘৃণা অনুভব করেন সেই পাকিস্তানিদের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেত্রীর মুখে এমন উচ্চারণে আমার গর্ববোধ হয়। বেনজীর ভুট্টোর এ মন্তব্য এমনটায় প্রমাণ করে, তারা তাদের (পাকিস্তানিরা) বিবেকের জায়গা থেকে বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা করতে বাধ্য। কিন্তু দু:খজনক হলেও সত্য আমরা, এই দেশের জনগণরা বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে কেমন কৃপণতা অনুভব করি!

তবে এটাও সত্য, বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের নানা ঘটনা বা কিছু কিছু সিদ্ধান্তের বিষয়ে দ্বিমত থাকতে পারে। তাই বলে সেই দ্বিমতের জায়গা থেকে তার অন্যান্য অবদানকে খাটো করার ষড়যন্ত্র কেন? এটা কতটা সমীচীন মনে করে সেই ষড়যন্ত্রকারীরা তাদের অবস্থান থেকে পিছপা হচ্ছেন না তাও আমার বোধগম্য হয় না। আমি যেটা বিশ্বাস করি সেটা হচ্ছে, বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা জানানোর জায়গায় কোনো রাজনীতি নয়।

১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে বেনজীর ভুট্টোর সেই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন গবেষক মুনতাসীর মামুন, সাংবাদিকতার শিক্ষক মহিউদ্দিন আহমেদ ও আফসান চৌধুরী। পরের বছর এ সাক্ষাৎকার ছাপানো হয়েছিল দৈনিক জনকণ্ঠে। তবে এ সাক্ষাতকারটি আমার পড়ার সুযোগ হয়েছিল গ্রন্থভুক্ত হওয়ার পর।

সাক্ষাৎকারে ১৫ অগাস্ট প্রসঙ্গে বেনজীর ভুট্টো বলেছিলেন,"আমরা সকলেই শেখ মুজিবের জন্য শোক প্রকাশ করলাম। কেননা পাকিস্তানি হিসেবে তাঁর সম্পর্কে আমাদের মিশ্র অনুভূতি থাকলেও তিনি তো এক স্বাধীন দেশ ও জাতির আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

"সর্বোপরি, নীতিবাদী ব্যক্তি হিসাবে তিনি ব্যাপক পর্যায়ে শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন। তিনি এমনকি মুত্যৃরমুখেও তাঁর নিজ নীতিতে অবিচল ছিলেন। তিনি ছিলেন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি, অল্পের জন্য  প্রাণরক্ষা পেয়েছে। তিনি হয়ত ভেবেছিলেন, রেহাই তিনি পাবেন না, তাকে মরতে হবে। আত্মবিশ্বাসী মানুষ হিসাবে তার জন্য ছিল অগাধ শ্রদ্ধা; এমন একজন মানুষের ওপর এ ধরনের ট্র্যাজেডি নেমে আসায় বিষাদ নেমে আসে। তার দেশ ও জাতির জনকের পরিণতি যদি এই হয় তাহলে তেমন পরিস্থিতি আমাদের জন্য খুব শুভ হতে পারে না।"

তিনি বলেছিলেন,  "একটা গভীর বিষাদ নেমে এসেছিল এই ভেবে যে, নিজের লোকেরাই তাদের জাতির পিতাকে এমন বর্বরোচিত নিষ্ঠুরতায় হত্যা করতে পারে।"

বেনজীর ভুট্টো একজন পাকিস্তানি। তবু বঙ্গবন্ধুর প্রতি তার এমন শ্রদ্ধার উচ্চারণে অবাক হওয়াটা স্বাভাবিক হলেও আমি মোটেও অবাক হয়নি। কারণ আমার বিশ্বাস বঙ্গবন্ধুর অসাধারণ ব্যক্তিত্ব এবং নিখুঁত দেশপ্রেমই বঙ্গবন্ধুর নাম শ্রদ্ধার সাথে উচ্চারণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন বেনজীর ভুট্টো। পক্ষান্তরে অবাক হই এই ভেবে আমরা কেন বঙ্গবন্ধুকে যথাযথ সম্মান জানাতে কৃপণ হই?

'তিনি তো এক স্বাধীন দেশ ও জাতির আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন' এবং 'নীতিবাদী ব্যক্তি হিসাবে তিনি ব্যাপক পর্যায়ে শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন'- বেনজীর ভুট্টোর এমন উচ্চারণের পরেও কেন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এত দ্বিধাবিভক্তি?

এখানে বলে রাখা দরকার, বেনজীর ভুট্টোর বক্তব্যকে এই কারণেই গুরুত্ব দেওয়া যে, ওদের কাছ থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনায় ওদেরই তো বেশি বঙ্গবন্ধুর সমালোচনা করার কথা। কিন্তু তারাই বঙ্গবন্ধুকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হলেন।

এই পর্যায়ে এসে আমার আবদুল করিম ওরফে এ কে খন্দকারের লেখা '১৯৭১ ভেতরে বাইরে' বইটির কথা মনে পড়ল। বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গে নানা মন্তব্য এই গ্রন্থ এবং গ্রন্থ লেখক আলোচনা-সমালোচনায় এসেছিলেন। তবে এটাও বলেও রাখি, পড়া শুরু করেছিলামও বইটি। এতদিনেও বইটি পড়ে শেষ করতে পারি নি। দীর্ঘদিনেও গ্রন্থটি শেষ করতে না পারা আমার ব্যর্থতা নাকি পাঠককে ধরে রাখতে লেখক ব্যর্থ হয়েছেন?

বইটি যখন পুরোটা পড়া হয়নি তাই আপাতত ওই বইটা নিয়ে কোনো মন্তব্য করবো না। তবে একটা হতাশা কাজ করছে এই ভেবে, আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি এবং অগ্রজদের কাছ থেকে শুনতে শুনতে এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে লেখা রচনা পড়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানার চেষ্টা করি তারা মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস জানতে পারছি না। বারবার আমরা বিভ্রান্ত হচ্ছি।

কারণ, একেকজন একেকভাবে ব্যাখ্যা করছেন। আবার প্রতিটি ব্যাখ্যাকে পাল্টা যুক্তির মধ্য দিয়ে খণ্ডন করা হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে  '২০৭১ সালে' ওই সময়ের তরুণরা মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধু নিয়ে কী জানতে পারবে তা ভেবে শিহরিত হচ্ছি!

কারণ মাঝখানের সময়টায় যে আরো অনেক গ্রন্থ  লেখা হবে এবং ওইসব গ্রন্থে যে এ.কে খন্দকারের লেখা বই থেকে উদ্ধৃতি থাকবে। যেমনটি এ.কে খন্দকার তার গ্রন্থেও অন্যের উদ্ধৃতি ব্যবহার করে নিজের বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছেন।

আমার সীমিত জ্ঞান থেকে যে উপলব্ধি তাতে এমটাই মনে হয়, বঙ্গবন্ধুকে যতদিন পর্যন্ত রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ নিজের সম্পদ মনে না করে পুরো বাংলাদেশির সম্পদ হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা না করবেন ততদিন পর্যন্ত এই বিভ্রান্তি দূর হবে না। বাঙালি এবং বাংলাদেশিদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর যে অকৃত্রিম প্রেম এবং বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য বঙ্গবন্ধুর যে ত্যাগ তার জন্য বঙ্গবন্ধুকে পুরো জাতিরই সম্মান করতে হবে।

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রাজনীতি করা যাবে না। রাজনীতির ঊর্ধ্বে রেখে বঙ্গবন্ধুর প্রতি সকলের শ্রদ্ধা থাকা উচিত। কিন্তু যখনি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রাজনীতি করা হয় তখনি বিপক্ষের রাজনীতিবিদরা বঙ্গবন্ধুর অবদানকে খাটো করার চেষ্টা করেন।