তিনটি ভাঙা ব্রিজ, প্রধানমন্ত্রীর দুঃখ পাওয়া এবং চট্টগ্রামবাসীর প্রত্যাশা

মোরশেদ তালুকদার
Published : 14 March 2017, 01:28 AM
Updated : 14 March 2017, 01:28 AM

'চট্টগ্রামের উন্নয়নের দায়িত্ব আমি নিজ হাতে তুলে নিলাম।' বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক লালদীঘি মাঠে নির্বাচনী জনসভায় এ কথা বলেছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং আজকের বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এটা ২০০৮ সালের ২৭ ডিসেম্বরের কথা।

২০০৯ সালে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। অতঃপর প্রত্যাশা বেড়ে যায় চট্টগ্রামবাসীর। তাদের মনে পড়ে গেল- 'চট্টগ্রামের উন্নয়নের দায়িত্ব আমি নিজ হাতে তুলে নিলাম', প্রধানমন্ত্রীর এই প্রতিশ্রুতি। অবশ্যই পরবর্তীতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের পক্ষে বিভিন্ন সময়ে সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ করার দাবি করা হয়েছিল এবং এখনো করা হচ্ছে।

বিশেষ করে চট্টগ্রামকে ঘিরে সরকারের নেয়া বড় বড় প্রকল্পগুলোর (যেমন- উড়ালসেতু, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ, আনোয়ারা ও মিরসরাই উপজেলায় পৃথক দুটি ইকোনমিক জোন) উদাহরণ দেয়া হচ্ছে এই ক্ষেত্রে। উন্নয়ন প্রকল্পকে ঘিরে দৃশ্যমান কর্মকাণ্ড এবং গণমাধ্যমের প্রচারের কল্যাণে চট্টগ্রামবাসীও ধীরে ধীরে বিশ্বাস করতে থাকেন চট্টগ্রামের প্রতি আলাদা ভালোবাসা রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর।

সর্বশেষ গত ১২ মার্চ (২০১৭) চট্টগ্রামের তিনটি ভাঙা ব্রিজকে ঘিরে প্রধানমন্ত্রী 'দুঃখ পেয়েছেন' মন্তব্য করার পর এ অঞ্চলের মানুষের মনে নতুন আশা দেখা দিয়েছে। তারা এখন মনে-প্রাণে মেনে নিয়েছেন, 'প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রামের জন্য সত্যিকার অর্থেই ভাবেন।'

প্রসঙ্গত, ১২ মার্চ প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রাম সফর করেন দুটো কারণে। প্রথমত বাংলাদেশ নৌ-বাহিনির বহরে যুক্ত হওয়া দুটো সাবমেরিনের কমিশনিং। দ্বিতীয়ত ছিল দৈনিক ১৪ দশমিক ৩০ কোটি লিটার উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন 'শেখ হাসিনা পানি শোধনাগার' এর উদ্বোধন। পানি শোধনাগার প্রকল্পটির উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ছিল পতেঙ্গাস্থ বোট ক্লাবে। মূলত, পানি শোধনাগার প্রকল্পের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখার সময়ই চট্টগ্রামের তিনটি ভাঙা ব্রিজ নিয়ে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন- 'আজকে নেভাল হেডকোয়ার্টার থেকে যে রাস্তা দিয়ে এসেছি তার অবস্থা দেখে আমি সত্যি খুব দুঃখ পেলাম। আমি ঠিক জানি না এই রাস্তার এমন দূরবস্থা কেন? এখানে নির্মাণাধীন ব্রিজগুলোর পাশে বড় বড় গর্ত খুড়ে করে রাখা হয়েছে। কিন্তু ব্রিজগুলোর কাজ সম্পন্ন হয় নি। এর আগে একবার এমন অবস্থা আমি দেখেছিলাম। তখন আমি আমার মিলিটারি সেক্রেটারি আবেদিনকে বলেছিলাম, 'তুমি চট্টগ্রামের মানুষ। চট্টগ্রামের এই অবস্থা কেন, আমার এখান থেকে একটু দেখ? তখন সে খবরও নিয়েছিল। বলেছিল ব্রিজগুলোর কাজ শেষ হতে বেশিদিন লাগবে না।'

প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, '২০১৫ তে সেক্রেটারি পাঠায়, আর আজকে ২০১৭। এখন পর্যন্ত সেই ব্রিজগুলো হয় নি। মেয়রকে জিজ্ঞাসা করলাম, 'কেন এই অবস্থা'। এটাতো এলজিইডি এবং সিটি কর্পোরেশনের করার কথা। তারাই দায়িত্ব নিয়েছে এবং জাইকা সহযোগিতা করছে। জাইকা কোন কাজে এত দেরি করে তা আমার জানা নাই। কিন্তু এই দেরীটা কেন হচ্ছে সেটা অবশ্যই খুঁজে বের করতে হবে। আমরা চাই না চট্টগ্রামের মত এত গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় রাস্তার এই দুরবস্থা থাক। এটা কার গাফিলতি সেটা আমি জানতে চাই। আমি জানতে চাই। নিশ্চয়ই কোন কন্ট্রাক্টর নিয়েছে কাজটি করতে। যদি সে কাজ করতে না পারে তাহলে এভাবে খুঁড়ে রাখবে কেন। কি সমস্যা আছে সেখানে। সমস্যা থাকলে তার সমাধান হবে না কেন। সমস্যা থাকলে সমাধান হতে হবে। কাজেই এই সমস্যা নিরসনে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। আমি আগামীবার এসে যেন রাস্তার এই দুরবস্থা না দেখি।'

এবার আসা যাক চট্টগ্রামবাসীর ভাবনায়। চলার পথে তিনটি ভাঙা ব্রিজ দেখে প্রধানমন্ত্রীর যে কষ্ট পাওয়া তা বাস্তবিক অর্থেই চট্টগ্রামবাসীকে অনেক বেশি আবেগতাড়িত করেছে। চট্টগ্রামবাসী আরো বেশি আনন্দিত হয়েছেন এটা জেনে যে, সেই ২০১৫ সালেও একই সমস্যা নিয়ে ভেবেছিলেন প্রধানমন্ত্রী।

বলাবাহুল্য, চট্টগ্রামের অত্যন্ত্য গুরুত্বপূর্ণ বিমানবন্দর সড়কে অবস্থিত ব্রিজ তিনটি। ২০১৫ সালের আগস্ট মাসে দুটি এবং ডিসেম্বর মাসে আরেকটি ব্রিজের কার্যাদেশ দেয়া হয়েছিল। গত ফেব্রয়ারি মাস পর্যন্ত ব্রিজ তিনটির কাজের গড় অগ্রগতি ছিল ২১ শতাংশ। এ তথ্য ব্রিজ নির্মাণে অর্থ সহায়তাকারী জাপানি সংস্থা জাইকার কাজের অগ্রগতি প্রতিবেদন থেকে পাওয়া।

যাই হোক, ব্রিজ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর এই ভাবনায় চট্টগ্রামবাসীর প্রত্যাশাও বেড়ে গেছে বহুগুন। চট্টগ্রামকে বলা হয়, বাণিজ্যিক রাজধানী। কিন্তু সত্যিকার বাণিজ্যিক রাজধানীর অনেক কিছুরই এখানে অভাব রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে চট্টগ্রামের সুধিমহলের বক্তব্যে এসব বিষয় উঠে এসেছে।

চট্টগ্রামের সচেতন মহলের বক্তব্য হচ্ছে- 'বাণিজ্যিক রাজধানীর যেসব বৈশিষ্ট্য থাকা দরকার সেগুলো চট্টগ্রামে নেই। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সদর দপ্তর নেই চট্টগ্রামে। যেমন সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংক ও ইন্স্যুরেন্সের সদর দপ্তর। বাণিজ্যিক রাজধানীর জন্য এসব খুব গুরুত্বপূর্ণ। চট্টগ্রাম নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ইতিবাচক ভাবনা দেখে চট্টগ্রামবাসী বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন, চট্টগ্রামকে সত্যিকার অর্থেই বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে গড়ে তুলবেন প্রধানমন্ত্রী।

এবার আসা যাক চট্টগ্রামবাসীর দ্বিতীয় প্রত্যাশায়। প্রধানমন্ত্রী যেদিন চট্টগ্রাম সফরে আসেন সেদিন চট্টগ্রামের স্থানীয় একটি পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, "শহর চট্টগ্রামের ৪১টি ওয়ার্ডের জলাবদ্ধতা নিরসনহ অবকাঠামোগত উন্নয়নের সিংহভাগ কাজ সম্পন্ন করার দায়িত্ব স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সংস্থা চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের। তবে উদ্যোগ এবং পরিকল্পনা সত্ত্বেও বার বার হোঁচট খেতে হয় সংস্থাটিকে। এর কারণ আর্থিক সীমাবদ্ধতা। নিজস্ব আয়ের বড় কোন উৎস না থাকায় মন্ত্রণালয়ই শেষ ভরসা অর্থ সংস্থানে। কিন্তু বিগত সময়গুলোতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ মিলে নি। ফলে কাঙ্খিত উন্নয়নে বরাবরই পিছিয়ে থাকতে হয়েছে সিটি কর্পোরেশনকে। এতে হতাশ নগরবাসী।"

ওই প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, সিটি কর্পোরেশন চলতি অর্থ বছরে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এসব প্রকল্প অনুমোদন এবং অর্থ ছাড়েও যেন প্রধানমন্ত্রীর সু-দৃষ্টি থাকে সেটাই প্রত্যাশা চট্টগ্রামবাসীর।।

অর্থাৎ এখন চট্টগ্রামের তিনটি ব্রিজ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ভাবনা দেখে চট্টগ্রামবাসী নতুন করে স্বপ্ন দেখা শুরু করেছেন, সিটি কর্পোরেশনের মাধ্যমেও চট্টগ্রামের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করবেন প্রধানমন্ত্রী।