এমনই তো হওয়ার কথা

বিনয় দত্ত
Published : 22 May 2020, 12:48 PM
Updated : 22 May 2020, 12:48 PM

১.

এমনই তো হওয়ার কথা ছিল। বিশ্বাস করুন। ঠিক এইরকম বা এরচেয়ে আরো খারাপ কিছু হবে এইটা ঠিক বুঝতে পারছিলাম। কারণ আমাদের অভ্যাস, বদভ্যাস, চাল-চলন, ব্যবহার, অস্থিরতা, একরোখা ভাব, উদাসীনতার কারণে আমরা অনেক, অনেক বেশি বিপদে পড়েছি এবং পড়ছি। এই বিপদ আমরা নিজেরা ডেকে এনেছি। এর জন্য দায়ী আমরা নিজেরা।

ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউ'র তথ্যানুযায়ী, ঢাকাতে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ২৩ হাজারেরও বেশি মানুষ বাস করে। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। সেই হিসেবে ঢাকা করোনাভাইরাস সংক্রমণের অন্যতম বড় দূর্গ। রাজধানীর ১০টি এলাকাকে সংক্রমণের হটস্পট হিসেবে উল্লেখ করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এগুলো হলো- রাজারবাগ, কাকরাইল, যাত্রাবাড়ী, মুগদা, মহাখালী, মোহাম্মদপুর, লালবাগ, তেজগাঁও, বাবুবাজার ও মালিবাগ। এইসব হটস্পটসহ মোট ১৭টি এলাকায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেশি। এইসব জানার পরও কি আমাদের আচরণে কোনো পরিবর্তন এসেছে? আসেনি। আমরা স্বাভাবিক জীবনের মতো আচরণ করে যাচ্ছি। করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে সরকার অসংখ্যবার বলে বলে আমাদের বাসায় রাখতে পারেনি।

২০২০ সালের ১৮ মার্চ থেকে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা, ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি এবং যানবাহন চলাচল বন্ধ ঘোষণা, ৬ এপ্রিল মসজিদে না গিয়ে বাসায় নামাজ পড়ার অনুরোধ এবং ৮ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জসহ ঢাকার ৫২ এলাকা লকডাউন ঘোষণার পরও কিন্তু ঢাকায় করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী কমেনি। কারণ আমাদের উদাসীনতা এবং বেশি বোঝার ফল।

মোটাদাগে বলতে গেলে, শুরু থেকে স্বাস্থ্যবিধি না মানা, শারীরিক দূরত্ব না মানা, অপ্রয়োজনে বাসা থেকে বের হওয়া, জিদ করে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়া, পোশাক মালিকদের একরোখা আচরণ, পোশাক শ্রমিকদের দফায় দফায় ঢাকা আনা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জানাজায় অংশ নেওয়া বড় কারণ। এসবের বাইরে যেসব কারণে করোনাভাইরাস পুরো দেশে ছড়িয়েছে তার জন্য প্রশাসনের ওপর সবচেয়ে বেশি দোষ বর্তায়। এবার আসি আত্মঘাতী প্রসঙ্গে।

২০২০ সালের ১৯ মার্চ করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে বাংলাদেশ সরকার ওয়াজ মাহফিল এবং তীর্থযাত্রাসহ সব ধরনে র ধর্মীয়, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জমায়েত বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়। ২৩ এপ্রিল ধর্ম মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে রমজান মাসে মসজিদে এশা ও তারাবির নামাজের জামাতে সর্বোচ্চ ১০ মুসল্লি ও দুই হাফেজসহ মোট ১২ জন অংশ নিতে পারার কথা জানায়। ৫ মে মসজিদ খুলে দেয়ার আহ্বান জানিয়ে বাংলাদেশের আলেমদের অনেকে একটি বিবৃতি প্রকাশ করে। ৭ মে বাংলাদেশে সব ধরনের নামাজের ওপর থেকে বিধিনিষেধ তুলে দিয়ে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ার অনুমতি দিয়ে জরুরি বিবৃতি দেয় ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ।

এটি আসলে এত বড় প্রসঙ্গ যে, অল্প কথায় তা বলে শেষ করা যাবে না। তবে কয়েকটি বিশেষ দিক তুলে ধরলে তা পরিষ্কার হবে। প্রথমত, সরকার একক কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নয় যে, একা কোনো সিদ্ধান্ত নিবেন। সরকারকে পরামর্শ দেওয়ার বিশেষ লোক থাকে তারা সবসময় সরকারকে নির্দেশনা দেন। সেই নির্দেশনা মোতাবেক সরকার সিদ্ধান্ত নেন। তবে সরকার একক সিদ্ধান্তও নেন।

দ্বিতীয়ত, এদেশে সব সরকার ধর্মীয় দলগুলোকে প্রশ্রয় দিয়েছে। তাতে সুবিধা হলো, ভোট বা ক্ষমতা হাতে থাকা। যেমন ১৮ মার্চ থেকে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণার পর কেউই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সাহস করেনি। ৬ এপ্রিল মসজিদে না গিয়ে বাসায় নামাজ আদায়ের অনুরোধ করার পর কি তারা অনুরোধ শুনেছে? আশা করি বিষয়টা পরিষ্কার।

২.

যে স্থাপত্য নির্দেশনায় শপিং মল বা মার্কেটগুলো নির্মিত হওয়ার কথা ছিল তা হয়নি। এই তথ্য স্থাপত্যবিদদের। এখন প্রশ্ন হলো, যে নির্দেশনা মেনে শপিং মলগুলো খুলতে বলা হয়েছে, তা কি মানা হচ্ছে? বা আদৌ মানা সম্ভব? তার আগে জানা প্রয়োজন, কেন সরকার শপিং মলগুলো খুলতে বাধ্য হলো।

পৃথিবীর কোনো সরকারই ব্যবসায়ীদের ক্ষতি করে কোনো সিদ্ধান্ত নেন না। বাংলাদেশও এই নিয়মের বাইরে নয়। বৈশাখের অর্থনীতিটা বেশ বড়। কয়েক হাজার কোটি টাকা লেনদেন হয় এক বৈশাখে। এই বিশাল অর্থনৈতিক লোকসানটা এবার ব্যবসায়ীরা দিয়েছে।

সাধারণত পহেলা বৈশাখ থেকে ঈদের নির্দিষ্ট দূরত্ব থাকে। এবার সেই দূরত্বটা ছিল না। এপ্রিলে পহেলা বৈশাখ আর মে মাসে ঈদ। প্রথমবার ব্যবসায়ীরা অর্থনৈতিক লোকসান দিয়েছে, আবার লোকসান? এটা তারা মেনে নিয়ে পারছে না। ফলে তারা শপিং মল বা দোকান খোলার জন্য সরকারকে অনুরোধ করা শুরু করেছে। যখন ২০২০ সালের ২৫ এপ্রিল থেকে ধাপে ধাপে পোশাক কারখানাগুলো খুলে দেয়া হচ্ছে তখন দোকান মালিক সমিতিও সাহস পায়।

৬ মে সংবাদমাধ্যমে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিনের সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। তিনি জানা, দোকানপাট খোলার সিদ্ধান্তে ব্যবসায়ীরা কিছুটা হলেও অর্থের মুখ দেখবে। পরে সরকার একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। তাতে জানানো হয়, ১০ মে থেকে সারাদেশে সীমিত পরিসরে দোকানপাট ও শপিং-মল খোলা রাখা যাবে। এতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেয়া স্বাস্থ্য বিষয়ক নির্দেশনা মেনে শপিং মল ও দোকানপাট সকাল ১০টা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত খোলা রাখা যাবে।

এইখানে দুটি বিষয় লক্ষ্যণীয়। প্রথমত, দোকান মালিক সমিতির সাথে ব্যবসায়ীদের সমন্বয়হীনতা। দ্বিতীয়ত, স্বাস্থ্যবিধি মেনে শপিং মল বা দোকান চালু রাখা।

হেলাল উদ্দীনের বক্তব্যর পরপরই দেশের বৃহত্তম দুই শপিং কমপ্লেক্স যমুনা-বসুন্ধরা তাদের শপিং মল না খোলার সিদ্ধান্ত দেয়। জেলা শহরগুলোও তাদের শপিং মল বা মার্কেট না খোলার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়। একইদিনে সংবাদমাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত হয় মূল সমন্বয়হীনতার গল্প।

দোকান চালু নিয়ে দ্বিধায় মালিকরাই, দোকান খোলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা-মার্কেটে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিতের সক্ষমতা নেই। এই শিরোনাম দেখেই বোঝা যাচ্ছে আসলে দোকান মালিক সমিতি কারো সাথে আলোচনা না করেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

৭ মে হেলাল উদ্দিন এক সাক্ষাৎকারে জানান, দোকান খোলার বাধ্যবাধকতা নেই। একদিনের ব্যবধানে হেলাল উদ্দিনের বক্তব্য নমনীয় হয়ে যায়। ৬ মে যে লোক অর্থনৈতিকভাবে ব্যবসায়ীদের বাঁচানোর জন্য বক্তব্য দিল ৭ মে তার বক্তব্য ভিন্নদিকে ধাবিত হয়ে গেল! একইদিনে জাতীয় দৈনিকগুলোর সংবাদ দেখলে তা আরো স্পষ্ট হয়ে যায়। খোলার সিদ্ধান্ত জানত না জাতীয় কমিটি; আজ-কালের মধ্যেই সুপারিশ, করোনাভাইরাস: দোকান এবং শপিং মল খোলা রাখা নিয়ে মালিকদের সিদ্ধান্তহীনতা।

হেলাল উদ্দিনের বক্তব্য আরো ভিন্নদিকে ধাবিত হয় শপিং মল খোলার পর। ১১ মে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় হেলাল উদ্দিন জানায়, স্বাস্থ্যবিধি না মানলে প্রতিষ্ঠান বন্ধের হুঁশিয়ারি দোকান মালিক সমিতির।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শপিং মল বা মার্কেটগুলো কিভাবে নির্মিত হয়েছে তা অন্তত হেলাল উদ্দিনের জানার কথা। তারচেয়েও বড় কথা হলো, করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শপিং মল বা মার্কেট চালানো অসম্ভব বলা চলে। শপিং মল বা মার্কেট চালু হলে ক্রেতারা সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়বেন, সেটা সামলানোর সক্ষমতাও বেশিরভাগ মার্কেটের নেই। সেই জায়গায় এসব বিবেচনায় না রেখে, কোনো ধরনের সমন্বয় এবং আলোচনা ছাড়া দোকান মালিক সমিতি শপিং মল বা দোকান খোলার অনুরোধ জানায় সরকারকে। তাদের অনুরোধে সরকার প্রভাবিত হয়ে শপিং মল বা দোকান খোলার নির্দেশ দেয়। এতে পরিস্থিতি আরো বাজে হয়। সাধারণ মানুষ শপিং মল বা দোকান খুলতেই তাতে ভিড় জমায়।

এমনিতেই করোনাভাইরাস পরিস্থিতি প্রশাসনের হাতের নাগালে, শপিং মল বা দোকান খোলার পর তা একেবারেই হাত থেকে বের হয়ে যায়।

এবার আসি স্বাস্থ্যবিধি মানার সক্ষমতা প্রসঙ্গে। কয়েকটি জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদন তুলে ধরলেই তা পরিষ্কার হয়ে যাবে।

নিয়ম না মানায় বঙ্গবাজার ও দুই ফ্যাশন 'আউটলেট' বন্ধ, রংপুরে শপিংমলে ভিড়, সংক্রমণ 'বৃদ্ধির শঙ্কা', পুরান ঢাকায় সেই পুরান চেহারা, রাজধানীর ইসলামপুর নবাববাড়ি মার্কেটে মানা হচ্ছে না সামাজিক দূরত্ব, জেলায় জেলায় মার্কেটে ক্রেতাদের ভিড়, মানা হচ্ছে না স্বাস্থ্যবিধি, ঠাকুরগাঁওয়ে খুলেছে শপিংমল, স্বাস্থ্যবিধির বালাই নেই, স্বাস্থ্য বিধি না মানায় 'সানরাইজ প্লাজা' বন্ধ, করোনা ঝুঁকিতে নারায়ণগঞ্জের গাউছিয়া মার্কেট বন্ধ ঘোষণা, মুন্সীগঞ্জে ভিড় সামলাতে না পেরে মার্কেট বন্ধের সিদ্ধান্ত দোকানিদের, স্বাস্থ্যবিধি অমান্য, টাঙ্গাইলে মার্কেট বন্ধ ঘোষণা, স্বাস্থ্য বিধি না মানায় বগুড়ায় নিউ মার্কেট বন্ধ, সামাজিক দূরত্ব না মানায় মানিকগঞ্জে মার্কেট-বিপণিবিতান বন্ধ, নবাবগঞ্জ উপজেলায় স্বাস্থ্যবিধি না মেনে বিভিন্ন মার্কেটে চলছে কেনাকাটা।

কয়েকদিনেই এই অবস্থা দাঁড়িয়েছে। বাকি দিনগুলোতে কি হবে তা সহজেই অনুমেয়।

৩.

বাংলাদেশ সৃষ্টির পর এই ধরনের পরিস্থিতিতে কখনো পড়েনি। এই অভিজ্ঞতা দেশের জন্য যেমন নতুন, তেমনি সরকার বা প্রশাসনের জন্যও নতুন। অভিজ্ঞতা দিয়ে তা সামলে নেওয়া যায়। করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে অন্যান্য দেশের গতিবিধি লক্ষ্য করা এবং তাদের ভুল থেকে শুধরে নিয়েও এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করা যায়। প্রয়োজন সদিচ্ছার। এখন সিদ্ধান্ত আমাদের হাতে, আমরা কি আরো আত্মঘাতী দিকে যাব? নাকি করোনাভাইরাস দমনে কঠিন সিদ্ধান্ত নেব?