মুক্তিযুদ্ধে সংগীতের ভাবদর্শন গবেষণা

এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার
Published : 26 March 2021, 06:00 AM
Updated : 26 March 2021, 06:00 AM

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল গণমানুষের যুদ্ধ। শোষণ-বঞ্চনার শেকল ছেঁড়ার নয় মাসের যুদ্ধজীবনে প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল হাজার বছরে গড়ে ওঠা বাঙালির সংস্কৃতি সঞ্জাত এবং একই ভিত্তির উপরে পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে সৃষ্টি দেশপ্রেমমূলক কালজয়ী কিছু গান। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করতে গেলে দেখা যাবে, সংগীতের ভূমিকা এক অসামান্য ও উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে। একটি জাতির সংস্কৃতি গড়ে ওঠে তার অর্থনৈতিক জীবনের প্রেক্ষাপটে এবং  রাজনৈতিক কালপর্বের প্রভাবও তাকে নানামুখী গতি দেয়। সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও রাজনীতি এ তিনের সংমিশ্রণে সম্মেলনে জাতীয় জীবনের গতিপথ প্রভাবিত হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট পর্যালোচনায় অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বঞ্চনার প্রশ্নটি যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি তার সাংস্কৃতিক বঞ্চনার প্রেক্ষাপটও- এ বিশ্লেষণ এর আওতায় বিবেচিত।

বাঙালি জাতীয়তাবাদ মুক্তিযুদ্ধের মূল দর্শন। এর ভিত্তি রচিত হয়েছিল ১৯৭১ এর বহু পূর্বেই। কিন্তু আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার কার্যকর ও বাস্তব সংগ্রাম ১৯৭১ এ চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে। ফলে ১৯৭১ শুধুই প্রস্ফুটনের এক উপযুক্ত কাল বললে অত্যুক্তি হয় না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাথে যখন সংগীতের সম্পর্ক আলোচনায় আসে তখন কেবল মাত্র ১৯৭১-কে ভিত্তি হিসেবে বিবেচনায় ধরলে এর পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ হয় না। এ কারণেই দেখা যায় মুক্তিযুদ্ধের গান বলতে আমরা যে গানগুলি চিহ্নিত করছি তার কোনো কোনোটির রচনাকাল মুক্তিযুদ্ধের বহুকাল পূর্বে।

এ বিষয়টিও বর্তমানে গবেষণার অন্যতম দিক। নানা প্রকার সংগীত বিশেষত লোকসংগীত এর তাত্ত্বিক প্রেক্ষাপট আলোচনার পাশাপাশি এসবের মূলভাব দর্শনের সাথে মুক্তিযুদ্ধের দর্শনের তুলনামূলক বিশ্লেষণ প্রয়োজন।

বাংলাদেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত স্বপ্নের স্ফুরণ ছড়িয়েছে মাটি ও মানুষের সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন ধরনের সংগীত। মানুষ তার মনের আকুতি জানাতে একটু স্বস্তির পরশ নিতে গান শুনতে ভালোবাসে, তেমনি এ গান পরিস্থিতির বিচারে তার অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবেও কাজ করে। বিশেষ করে ভাটিয়ালি সুর যেমন মাঝিকে, মরমী গানের সুর যেমন বাউলকে অনুপ্রাণিত করে- তেমনি একজন মুক্তিযোদ্ধা স্বাধীনতা সংগ্রামে অনুপ্রাণিত হয়েছিল দেশ, মাটি ও বিজয়ের গানে। আমাদের বাঁচা-মরার লড়াই মুক্তিযুদ্ধে তাই অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল দেশাত্মবোধ জাগানিয়া সংগীতগুলো। এগুলোর টানে মানুষ একাত্ম হয়েছিল, জীবন বাজি রেখে লড়াই করেছিল ঐশ্বরিক শুভেচ্ছাদূত বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে দেশ, মা মাটি ও মানুষের জন্য। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে দীর্ঘ সংগ্রাম করে ছিনিয়ে এনেছিল আমাদের স্বাধীনতা।

স্বাধীনতার এ লড়াই অতটা সহজ ছিল না, কিন্তু এর জীবনধর্মীতা খুব সহজেই লড়াইটাকে একান্ত আমাদের করে দিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে সংগীতের ভাবদর্শনেই নিহিত ছিল যুদ্ধজয়ের অনুপ্রেরণা। এসব সংগীত আমাদের হৃদয়ে এমন অনুরণন তৈরি করেছিল যেখানে শত্রুপক্ষের যুদ্ধের হাতিয়ার তুচ্ছ বলে গণ্য হয়েছিল। তাই শক্তিশালী পাক হানাদার ও তাদের সহায়তাকারী ঘাতক-দালালদের ষড়যন্ত্র মুক্তিকামী মানুষের উদ্দীপনার সামনে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছিল।

প্রাচীনকাল থেকে এদেশের সংগীত ঐকিক ধারাকে অবলম্বন করে চলছে যাকে বলা হয় মেলোডি প্রধান (একরৈখিক)। তাছাড়া মার্গ ও দেশী- এই উভয় পদ্ধতির গ্রাম সভ্যতা থেকে উৎসারিত। মার্গসংগীত সুরকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে, আর দেশীয় সংগীত কথা ও সুরকে সমান প্রাধান্য দিয়ে থাকে। বাংলা সংগীত মাত্রই এই দেশি সংগীতের আদর্শে পরিচালিত। লোকসংগীত এর ব্যতিক্রম নয়। রবীন্দ্রনাথও লোকসংগীত বলতে দেশি সংগীতই বুঝিয়েছেন। শ্রীশান্তিদেব ঘোষ তার রবীন্দ্র সংগীত গ্রন্থে Folk Music এর প্রতিশব্দ রূপে 'দেশি সংগীত'কে যথোপযুক্ত বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন।  আধুনিক সংগীত বিকাশ লাভ করেছে ঊনিশ শতকে এবং বর্তমানকাল এক বিশিষ্ট আসন করে নিয়েছে। ফলে গ্রাম সভ্যতাজাত সংগীত 'লোকসংগীত' হিসেবে চিহ্নিত করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। কিন্তু এই আধুনিক যুগের সৃষ্ট সংগীত ও প্রাচীত ধারাশ্রয়ী গ্রামজাত সংগীতের মধ্যে মৌলিক কোনো পরিবর্তন বয়ে আনেনি। আধুনিক সংগীত এবং লোকসংগীত উভয় ধারাই ঐকিকধারাকে (মেলোডি)অবলম্বন করে বর্তমান অবধি প্রবাহমান। সেজন্য ইউরোপীয় সংগীত ধারায় Folk Music যেভাবে যুক্তিযুক্ত বাংলা সংগীতে তা প্রযোজ্য নয়। বরঞ্চ, দেশি সংগীতই যথোপযুক্ত। বর্তমান আলোচনায় 'লোকসংগীত' শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে এটি বিশেষভাবে প্রচলিত ও প্রচারিত হয়েছে অন্য অর্থে নয়। দেশি সংগীতেরই সমার্থক হিসেবে লোকসংগীতকে গ্রহণ করা হয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে আরও একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, অনেক ফোক মিউজিক এর অনুবাদরূপে লোকগীতি, পল্লীগীতি এবং লোকসংগীত ব্যবহার করেন। লোকসংগীতকে যদিও অনেকটা এর সমার্থক রূপে গ্রহণ করা যায় কিন্তু লোকগীতি বা পল্লীগীতি তা নয়। ফোক সং এর অনুবাদ হিসেবে লোকগীতি বলা যায়। আর পল্লীগীতির জন্ম আধুনিক নগর সভ্যতার কোলে। অনেকটা আধুনিক গানের মতো আধুনিক লোকগীতি পল্লীগীতি হিসেবে তাকে আখ্যায়িত করা যায়।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমাজতাত্ত্বিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণে বিভিন্ন গবেষণা হলেও এর সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণের পদক্ষেপ তেমন গভীরভাবে দেখা যায় না। বিশেষত সংগীতের ভূমিকা বিশ্লেষণী গবেষণা নেহাতই কম। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণে অর্থনৈতিক শোষণ বঞ্চনার চিত্র পরিস্ফুটিত হলেও সাংস্কৃতিক বঞ্চনা ও দ্বন্দ্ব-সংঘাতের বিষয়টি জনমনে যে গভীর ছাপ নিয়ে বিদ্যমান ও উদ্দীপনা জাগ্রত করণে সংগীতের ভূমিকা বিশ্লেষণ অতি জরুরী। আলোচ্য প্রবন্ধে মুক্তিযুদ্ধের সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটের একটি বিশেষ দিক হিসেবে সংগীতের প্রভাব এর উপর আলোকপাত করা হয়েছে; যে দিকটি এতদিন উপেক্ষিতই রয়েছে বলা চলে। ক্ষেত্র  গবেষণার ফলে প্রবন্ধটি মুক্তিযুদ্ধে সাংস্কৃতিক উপাদানের বিশেষ করে সংগীতের ভূমিকা বিষয়ক গুরুত্ব অনুধাবন করা সহজ হবে।

বাঙালি সাংস্কৃতিকভাবে ঋদ্ধ একটি জাতি। বাঙালির রয়েছে হাজার বছরের উন্নত সাহিত্যের গৌরবময় ধারাবাহিকতা। এটি অত্যন্ত বিস্ময়ের ব্যাপার যে, নৃ- তাত্ত্বিকভাবে সমগোত্রীয় একটি জাতি একটি সুনির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমারেখায় নিজ ঐতিহ্যের ধারা নিয়ে গৌরবের সাথে সুদীর্ঘকাল বসবাস করে আসলেও তার নিজের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা বিশেষত 'জাতিরাষ্ট্র (Nation State) গঠনে অপেক্ষা করতে হয়েছে হাজার বছর। কিন্তু বাঙালির চেতনা বিদ্যমান ছিল না এ কথা বলার সুযোগ নাই। জাতি চেতনা বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও জাতিরাষ্ট্র কেন সৃষ্টি হয়নি সেটি হয়তো ভিন্ন গবেষণার বিষয় হতে পারে। কিন্তু আমরা এই গবেষণায় দেখবো যে, বাঙালি জাতিচেতনা বর্তমান বাংলাদেশ সৃষ্টির পেছনে কতটা গভীরভাবে রেখাপাত করতে সক্ষম হয়েছিল। আর এই 'জাতি চেতনার' বিষয়টি বিশ্লেষণ করা হবে বাঙালি জাতির নিজস্ব সাংস্কৃতির চেতনার আলোকে যা সে সুদীর্ঘকাল ধরে সযত্নে লালন করে এসেছে। মূলধারার নানান রাজনৈতিক কালপর্বে সামাজিক জীবনে বিভিন্ন পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগলেও বাঙালি জাতিসত্ত্বার বিলোপ কখনই হয় নাই বরং বহতা নদীর সজীবতা নিয়ে সে বর্তমানে পৌঁছেছে। বাঙালি জাতির এই সজীব  সাংস্কৃতিক চেতনাই তার 'জাতীয়তাবোধ' এর শক্ত ভিত্তিভূমি রচনা করেছিল, যা উপযুক্ত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট কে ধারণ করতে সক্ষম হয়েছিল এবং দুই-এর সম্মিলনে এক অপ্রতিরোধ্য ও দুর্বার আন্দোলন হিসাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয় এবং বাংলাদেশের জন্ম হয়।

আমরা যখন মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক দর্শন খুঁজতে যাই তখন অবিসংবাদিতভাবে একথা প্রতিষ্ঠিত হয় যে, বাঙালি জাতীয়তাবাদই ছিল মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক দর্শন। একইভাবে আর একটু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে এ যুক্তিও প্রতিষ্ঠিত হয় যে,  বাঙালি জাতীয়তাবাদের অন্যতম ভিত্তি হলো তার সুদীর্ঘকালের ঋদ্ধ সংস্কৃতির ধারা ও ঐক্য। এ কারণেই আমরা যুক্তি দিতে চাই যে 'বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ যতটা রাজনৈতিক, যতটা অর্থনৈতিক ভিত্তিভূমির উপর প্রতিষ্ঠিত ঠিক ততটাই সাংস্কৃতিক ভিত্তিভূমির উপর প্রতিষ্ঠিত।' নৃ- তাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিকভাবে সমগোত্রীয় বাঙালি জাতিকে রাজনৈতিক ইতিহাসের বিভিন্ন বাঁকে বাঁকে প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবেলা করতে হয়েছে। পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পর রাজনৈতিক উপেক্ষা ও অর্থনৈতিক বঞ্চনা যখন চরমে পৌঁছেছে তখন সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্বের বিষয়টিও সমভাবে প্রতিভাত হয়। পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টির পূর্বে সম্ভবত জাতীয়তাবোধের প্রশ্নে বাঙালিকে এমনভাবে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের সাথে সাথে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন মোকাবেলার মুখোমুখি হতে হয়নি। বরং রাজনৈতিক পরিবেশ যাই থাকুক না কেন বাঙালির সাংস্কৃতিক ধারা তার আপন গতিতেই প্রবাহিত হয়েছে কিন্তু দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্র যখন ইসলামীকিকরণের নামে বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতির উপর একটি আঘাত হানে অর্থাৎ পাকিস্তানের State Discourse যখন বাঙালির সংস্কৃতির প্রতি একটি অভিঘাত হিসেবে আবির্ভূত হয় তখনই বোঝা যায় বাঙালি জাতিসত্ত্বার প্রাণভোমরা আসলে তার সুদীর্ঘ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, যার উপর আঘাত বাঙালি জাতি সহ্য করতে পারেনি আর এ কারণেই রাতারাতি দ্বি-জাতি তত্ত্বের দর্শন ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়।.

একটি জাতি হিসেবে বিকশিত হবার সুদীর্ঘ পথ পরিক্রমায় বাংলার আর্থসামাজিক রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে সৃষ্ট সাংস্কৃতিক ধারা তেমনিভাবে একটি বাঙালি আত্মা/ মন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল। আর এই হৃদ্ধ ও পূর্ণবিকশিত আত্মা যখন অস্তিত্বের সংকটে  নিপতিত হয় তখনই তা হয়ে ওঠে বিপ্লবী এবং প্রতিবাদী এ কারণেই আমরা দেখিনি যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়কালীন গানগুলো ধর্ম বা অন্য কিছু নয়, বরং বাঙালি শব্দটিকেই তার চেতনা ও প্রেরণার কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। মুক্তিযুদ্ধের গানগুলো বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখি যে, 'বাংলা' বা 'বাঙালি' শব্দটিই প্রেরণার কেন্দ্র।

প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সুধীজনেরা লোকসংগীতকে সামগ্রিক সৃষ্টি বলে মনে করে থাকেন। তবে বাংলার লোকসংগীত শুধু সমষ্টির সৃষ্টি নয় অনেকাংশে ব্যাষ্টিক রচনা হিসেবেও পরিগণিত হওয়ার দাবি রাখে।এর দৃষ্টান্ত প্রাচীন চর্যাপদ এর গীতিকা থেকে শুরু করে সাম্প্রতিককালের অসংখ্য রীতি দিয়ে বোঝানো সম্ভব। যেমন, বাউল- মরমিয়া- দেহতত্ত্ব গানের রচয়িতার নাম ভণিতায় এর সাক্ষ্য মেলে। উৎস ভূমি সমাজ সংস্কৃতি আর প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও ব্যক্তি থেকে সমষ্টিতে পরিণত হয়েছে এ ধারা। বলতে গেলে এই দৃষ্টান্তই ঢেউ তুলেছে বাংলা লোকসংগীতে। বাউল গান যেমন একক সৃষ্টি হলেও তৎকালীন সমাজের শুধু নয়, সর্বকালীন মানবহৃদয়ের চিরন্তন আকুতি প্রকাশ পায় জগৎ জীবন সম্পর্কে; তার প্রকাশ সমগ্র মানব সমাজের সৃষ্টিরূপে গণ্য হতে পারে। প্রথমে ব্যক্তি এবং পরে তা মুখে মুখে সুরে সুরে প্রচারিত হয়ে সমষ্টি চেতনায় উত্তীর্ণ হয়। চাওয়া-পাওয়ার পথেই সমাজ এসেছে এবং সমাজ ব্যক্তিকেই অনুবর্তন করেছে। যেমন ভাটিয়ালি গান। ব্যক্তি চেতনার গান পুরোপুরি একক কণ্ঠের গান। ক্রমে তা লোকমুখে প্রচারিত হয়ে সমাজ মানসে উত্তীর্ণ হয়। সুতরাং বাংলাদেশে সেই সংস্কৃতির সূচনালগ্ন থেকেই  মাটি ও মানুষের সাথে সম্পর্কিত লোকসংগীত বেশ জনপ্রিয় একটি মাধ্যম। বিশেষ করে ভাটিয়ালি, জারি- সারি, ভাওয়াইয়া এবং অন্যান্য বাউল গানের কথা বলা যেতে পারে। যেমন, পল্লীগীতি বা গ্রামীণ সংগীত সবসময়ই গ্রাম বাংলার অত্যন্ত জনপ্রিয়। ভাওয়াইয়া ও পল্লীগীতির অন্যতম পুরোধা ছিলেন আব্বাস উদ্দীন আহমেদ। বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এ দেশের সংগীতের বিকাশে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন।

তার গানের মধ্যে রয়েছে- ক্লাসিক্যাল বা ধ্রুপদী সংগীত, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, বাঊল, জারি- সারি, গজল, কাওয়ালি, ভৈরবী, কীর্তন ও শ্যামা সংগীত। নজরুল বহু ইসলামী গানও রচনা করেন। আব্বাস উদ্দীন ও কাজী নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের মুসলমানদের নিকট সংগীতের  গুরু হিসেবে বিশেষ সম্মানের অধিকারী। বিশেষত এসব সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে তারা মানুষের মধ্যে জাগরণ সৃষ্টি করেন যার ধারাবাহিকতা মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সঙ্গীতগুলো নতুন ব্যঞ্জনা নিয়ে মানুষকে উদ্দীপ্ত করেছিল। তাদের সংগীত এদেশের মানুষকে জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছে। ফলে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছিল। সংগীত বিনোদনমূলক সমাবেশের অন্যতম উপাদান হিসেবে উপভোগ্য হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধের সময় তার জীবনী শক্তি হিসেবে কাজ করেছিল। ভাটিয়ালি-জারি-সারি ভাওয়াইয়া খুবই সুশ্রাব্য এবং জনপ্রিয় সংগীত। আর সময়ের সাথে পাকিস্তান বিরোধী চেতনা যুক্ত হওয়ায় খুব সহজে তা মানুষের দৃষ্টি ও মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। এ শ্রেণির গানের আবেদন খুব জোরালো উদ্দীপক হওয়ায় তা যুদ্ধক্ষেত্রে সংগীতের শক্তিমত্তার অসীমতাকেই প্রকাশ করেছে। যেখানে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক শক্তি বিপরীতধর্মী কিংবা শত্রুশক্তি হিসেবে ক্রিয়াশীল থাকে সেখানেও সংগীতের শক্তি চূড়ান্ত সত্যের পক্ষে, মানবতার পক্ষে  সমবেদনা ও সহমর্মিতা দেখাতে সক্ষম হয়।

জর্জ হ্যারিসন ও পণ্ডিত রবিশঙ্কর কর্তৃক মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে খোদ আমেরিকায় কনসার্ট করে শরণার্থীদের জন্য অর্থ ও মানবিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে বিশ্ববাসীর দরবারে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অবস্থান তুলে ধরার প্রচেষ্টা সংগীতে বিশ্ব শক্তিমত্তার এক অনন্য স্বাক্ষর। যুদ্ধ যখন অনিবার্যভাবে কোন জাতির মুক্তির একমাত্র বিকল্প হয়ে দাঁড়ায়, তার অস্তিত্বের সংগ্রামে ও আত্মপরিচয় বিনির্মাণের অবিকল্প পটভূমি- আর সেই জাতি যদি হয় মেধা-মননে হৃষ্ট, ভাষা-ঐতিহ্যের দীর্ঘ ইতিহাসের গৌরবান্বিত তাহলে তার বাসনা পূরণের মাধ্যম হিসেবে সংগীত কেবল প্রেরণার উৎস হিসেবে সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং তা হয়ে ওঠে অস্ত্রের সমকক্ষ কখনো বা তার চেয়েও অনেক বেশি শক্তিশালী। কেননা যেখানে একটি বুলেট মাত্র একজন শত্রুকে পরাভূত করতে পারে সেখানে একটি গান সমগ্র জাতিকে উজ্জীবিত করতে পারে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে।

যাহোক বাঙালি জাতীয়তাবাদই ছিল মুক্তিযুদ্ধের মূল রাজনৈতিক দর্শন আর বাঙালি জাতীয়তাবাদের মূল উপজীব্য হাজার বছরের বাঙালির 'সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য'। এ কারণে সাময়িক  রাজনৈতিক ভ্রান্তির দেয়াল খান খান হয়ে যায় বাঙালির সুদীর্ঘ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের দৃঢ়তায়। রাজনৈতিক বাস্তবতায় প্রথমবারের মতো বাঙালি তারা আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে শামিল হয় নিজ 'জাতিরাষ্ট্র' গঠনের যোদ্ধা হিসেবে বাঙালি উজ্জীবিত হয় পরাধীনতার শিকল ভাঙ্গার জীবন-মরণ পণে। বাঙালি জাতির ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা গৌরবময় এই কালপর্ব বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এখানে সৃষ্টির বীজ আগেই গ্রোথিত ছিল। ভিতরে ভিতরে তা শুধু বিকশিত হবার বাসনায় সুপ্ত ছিল। প্রস্তুত হয়েছিল স্বপ্নদ্রষ্টার ডাকে সাড়া দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশের অপেক্ষায়।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের সেই অনবদ্য কাব্যিক আহ্বান-  "এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম" যেন হাজার বছরের বাঙালির প্রাণের গণসাংগীতিক উচ্চারণ। আনুষ্ঠানিক এ ডাক সাংস্কৃতিকভাবে প্রস্তুত বাঙালি জাতিকে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করল তার আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার যুদ্ধে। বাংলা ও বাঙালির জয়গানই ছিল সে যুদ্ধের মূল মন্ত্র। গীতিকার মাজহারুল আনোয়ার রচনা করলেন- কালজয়ী গান "জয় বাংলা বাংলার জয়/হবে হবে নিশ্চয়/ কোটি প্রাণ একসাথে জেগেছে অন্ধরাতে/ নতুন সূর্য ওঠার এই তো সময়।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন গানগুলোকে চেতনাগতভাবে প্রধানত দুইটি ধারায় ভাগ করা যায়। এক. যুদ্ধপূর্ব কালে বাঙালি সংস্কৃতির অসাম্প্রদায়িক জাতিসত্তা জাতিপ্রেম, দেশপ্রেম ও রাজনৈতিক সংগ্রাম ভিত্তিক গান, দুই. যুদ্ধকালীন সংগ্রামী ও প্রেরণাদায়ক সংগীত যেখানে রয়েছে দেশ-জাতিকে রক্ষায় আত্মবলিদানে নিজেকে উৎসর্গের আহ্বান।

রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্ত, ডিএল রায় প্রমুখ এর রচিত কবিতা ও গান গুলো মুক্তিযুদ্ধের গান হিসেবে গাওয়া হয়েছে। 'চল চল চল', 'কারার ঐ লৌহ কপাট' কিংবা 'বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি'… আবার 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি' কিংবা 'ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা'… ইত্যাদি মুক্তিযুদ্ধের গানগুলো কেবল যুদ্ধকালীন সময়ে রচিত তা নয়। বরং আবহমান বাঙালি জাতিসত্তার মূল চেতনাকে ধারণ করে সংগীতের যে ধারাটি বহমান ছিল তা এক নতুন ব্যঞ্জনায় সময়ের প্রেক্ষাপটে নতুন উপযোগিতা নিয়ে প্রতিভাত হয়। একই সাথে 'যুদ্ধকালীন সময়ের প্রেক্ষাপট' সৃষ্টির নতুন প্রণোদনা হিসেবে কাজ করে। নানা সময় বাঙালির গানে, কাব্যে, বিভিন্ন ধর্মের ছোঁয়া লাগলেও ধর্মীয় গোঁড়ামি বিভেদ বৈষম্য কখনো তার সংস্কৃতিতে  প্রকটরূপ ধারণ করে নাই বরং সহাবস্থান, সহমর্মিতার এক অনুপম সম্মিলন দেখা যায় বাঙালির সাহিত্যে। শেষদিকে নানা রাজনৈতিক মারপ্যাঁচে 'দ্বি-জাতি তত্ত্বের' মত সাম্প্রদায়িক মতবাদের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হলেও তা যে বাঙালি জাতির মনন ও মানসপটের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ছিলনা তা উভয় খণ্ডের সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব ও রূপ ভিন্নতার মধ্যেই প্রতিভাত হয়। সঙ্গত কারণেই অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে মাত্র ২৪ বছরের মাথায় 'বাংলাদেশ' রাষ্ট্রের জন্ম হয়। আর স্বভাবতই সেখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল বিভিন্ন ধরনের সংগীতের ধারা যা যুদ্ধ জয়ে বিজয়ী করেছে। আর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও অন্যান্য বঞ্চনার বিপরীতে বাঙালির মননে যে স্বাধীনতার মানসপট তৈরি হয়েছিল তা সংগীতের ব্যঞ্জনায় যোদ্ধাদের গতিশীল করেছে এবং যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেশ-বিদেশে তার আলো ছড়িয়ে মাত্র নয় মাসে এনে দিয়েছে আমাদের স্বাধীনতা। তাই পুনশ্চ বলতে চাই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ যতটা রাজনৈতিক, যতটা অর্থনৈতিক ঠিক ততটাই সাংস্কৃতিক ভিত্তিভূমির উপর প্রতিষ্ঠিত।