শ্রমিকের লাশ, মালিকের আইন আর রাষ্ট্রের অর্থনীতি

সঙ্গীতা ইমামসঙ্গীতা ইমাম
Published : 13 Feb 2012, 07:02 PM
Updated : 11 July 2021, 03:51 PM

আমাদের শিল্প শ্রমিকরা কাজে যান নিজের প্রাণটি নিয়ে ফিরবেন কিনা- এই অনিশ্চয়তা নিয়ে। তারা তো রক্তকরবীর  খনি শ্রমিকের মতো একেকটি সংখ্যা মাত্র! কে তাদের পরিবারের খবর রাখে, কেইবা তাদের স্বজনদের বুকফাটা আহাজারিতে কান দেয়, কতদিনইবা শ্রমিকের মৃত্যু আমাদের মনে থাকে? দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে শ্রমিক হলো মহামারীকালে সরকারি প্রণোদনা পাবার জন্য মালিকপক্ষের একটি অজুহাত। কঠোর বা কোমল যে কোনো লকডাউনে কারখানা খোলা রাখার জন্য মালিকপক্ষের সবচেয়ে বড়ো প্রদর্শনযোগ্য হাতিয়ারটি হলো 'শ্রমিকের স্বার্থ'। কিন্তু প্রতিটি ঈদের সময়ই ন্যায্য বেতন-বোনাসের দাবিতে আমাদের শ্রমিক ভাইবোনদের রাস্তায় নামতে হয়। এ দৃশ্য তো কেবল গত দু বছরের না, সব সময়ই এমনটি দেখে আসছি আমরা। গত বছর অতিমারীর সময়ে পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের বেতন-ভাতার জন্য সরকারি প্রণোদনা দেয়া হলো, কিন্তু তারপরও শ্রমিকদের রাস্তায় নামতে হয়নি? তাহলে সরকারের প্রণোদনার টাকা গেলো কোথায়- এমন প্রশ্নের সদুত্তর আজও ওই শিল্পের মালিকরা আমাদের দেননি। প্রতিবার সরকার লকডাউনের ঘোষণা দিলেই কারখানার মালিকরা একটি মুখস্থ বুলি আওড়ান 'স্বাস্থ্যবিধি মেনে'। শ্রমিকের স্বাস্থ্যবিধি! হায় রে তামাশা! যেখানে শ্রমিকের জীবনেরই কোনো মূল্য নেই, পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া শ্রমিকের লাশ যেখানে একটি সংখ্যা মাত্র, সেখানে শ্রমিকের আবার স্বাস্থ্যবিধি!

শ্রমিকের অসহায় মৃত্যু এখন আমাদের দেশে আর আঁতকে ওঠার মতো ঘটনাও নয়। কারখানার অবকাঠামোগত ত্রুটি, মালিকপক্ষের নির্মমতা আর গাফিলতি, আইনের অন্ধত্ব আর ক্ষমতার দম্ভের আগুনে দগ্ধ নিহত শ্রমিকদের কথা এখন আমাদের একবেলার আলোচনার বিষয়বস্তু। বিদেশের মাটিতে ফুটবলের উন্মাদনা, দেশীয় ক্রিকেট ম্যাচ বা অন্য আরও নানা ঘটনা-দুর্ঘটনার খবরে ক্রমেই চাপা পড়ে যায় সব কান্না। কেবল যারা স্বজন হারিয়েছেন, স্বজনের একটি ছবি নিয়ে হাসপাতালের মর্গের দ্বারে বসে রয়েছেন, যাদের পরিবারের সবকিছু শেষ হয়ে গেছে, তারাই, কেবল তারাই ভুলতে পারছেন না ওই আগুনের লেলিহান শিখা। প্রতিবার কাফনে মোড়ানো ওই কয়লা হয়ে যাওয়া লাশগুলো আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, কতটা মূল্যহীন শ্রমিকের প্রাণ। 'আইনের শাসন' কথাটি তখন উপহাসের মতো ঠেকে আমাদের কানে।

দুই

২০১০ সালের নিমতলী ট্র্যাজেডি, ২০১২ সালের তাজরিন ফ্যাশনের আগুনে শ্রমিক হত্যাকাণ্ড, ২০১৩ সালের রানা প্লাজার ধ্বংসযজ্ঞ কিংবা ২০১৯ সালের চকবাজারের রাসায়নিক পদার্থের গুদামের অগ্নিকাণ্ড… এসব হতাহতের ঘটনা থেকে কোন শিক্ষাই নিতে পারিনি আমরা। গত ৭ জুলাই রাতেও পুরান ঢাকার নবাবপুরের এস কে মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি বলে সংবাদটি আমাদের চোখেও তেমন পড়েনি। কিন্তু গত এক দশকের হিসেবে কারখানায় বা রাসায়নিক গুদামে বৈদ্যুতিক ও দাহ্য পদার্থের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় শত শত মানুষের প্রাণহানি ঘটছে। লাশের সংখ্যার ভিত্তিতে ক্ষয়-ক্ষতির নিরিখে কারখানা বা গুদামের মালিক বীমার টাকায় পকেট ভরেছে। সেই টাকা আর ক্ষমতার অপব্যবহার করে আইনের হাত থেকে ছাড়াও পেয়ে যাচ্ছে অপরাধীরা। আর সময়ের সাথে চাপা পড়ে যাচ্ছে কারখানার ভবনের নির্মাণ ত্রুটি, অবৈধ গুদামে দাহ্য পদার্থ রাখার অপরাধ। আইনের কিছু গালভরা নির্দেশনা আমরা সংবাদপত্রে দেখি, কিন্তু সেগুলোর কোনো প্রয়োগ দেখি না। আর ওই মৃত সংখ্যার স্বজনের চোখের জল, আহাজারি আর একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটিকে হারিয়ে ক্ষুধার্ত পেটের টিকে থাকার সংগ্রাম একদিন আমাদের আইন-প্রশাসন-বিবেক-বিচারব্যবস্থা সবকিছু থেকে হারিয়ে যায়।

২০১৭ সালে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) এক গবেষণায় দেখা গেছে, পুরান ঢাকায় রয়েছে ২৫ হাজার কেমিক্যাল গোডাউন বা রাসায়নিক দাহ্য বস্তুর গুদাম। এসবের মধ্যে ১৫ হাজার আছে খোদ বাসা-বাড়িতেই। মাত্র আড়াই হাজার গুদামকে ট্রেড লাইসেন্স দিয়েছে সিটি করপোরেশন। বাকি ২২ হাজারের বেশি গুদামই অবৈধ। ২০০ ধরনের ক্ষতিকর ও ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিকের ব্যবসা চলে এখানে। ২০১০ সালের জুন মাসে নিমতলী ট্র্যাজেডির পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই এলাকা থেকে অবৈধ রাসায়নিক কারখানা ও গুদাম কামরাঙ্গীরচর ও কেরানীগঞ্জে সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো এখনো সরেনি একটি কারখানাও। ২০১৯ সালে আবার আগুন লাগে চুরিহাট্টা এলাকায়। ঝরে পড়ে ৭১টি তাজা প্রাণ। কারখানা সরাতে আবারও গঠিত হয় কমিটি। এরপরেও সরেনি গুদাম। আজও ওই বিষ্ফোরকের ওপরই জীবনধারণ করছেন লাখ-লাখ মানুষ।

তিন

গত ৮ জুলাই বিকেল আনুমানিক সাড়ে পাঁচটায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কর্ণগোপ এলাকায় সজীব গ্রুপের হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ কারখানায়। জুস, ক্যান্ডি, বিস্কুট, লাচ্ছা সেমাইসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য তৈরি হতো হাসেম ফুডস লিমিটেডের কারখানায়। কর্মরত শ্রমিকের সংখ্যা ছিল প্রায় পাঁচ হাজার। গত দু মাস ধরেই তাদের বেতন ও অন্যান্য পারিশ্রমিক পরিশোধ করছিল না মালিকপক্ষ। এর প্রতিবাদে গত ১ জুলাই শিশু-কিশোরসহ শ্রমিকরা প্রতিবাদও করেছেন। কিন্তু এবার তাঁদের প্রতিবাদ করার ভাষাটিও নেই।  উদ্ধারকর্মীদের বয়ান অনুযায়ী চেহারা তো দূরের কথা, লাশ দেখে নারী পুরুষও শনাক্ত করা যাচ্ছে না। স্বজনদের ডিএনএ ম্যাচিং ছাড়া বুঝবার কোন উপায় নেই, কোনটি মিতুর লাশ আর কোনটিই বা জয়নালের।

এ ধরনের প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের পরই কিছু সত্য আমাদের চোখের সামনে উঠে আসে। যেমন হাসেম ফুডস লিমিটেডের কারখানায় চলছিল শিশুশ্রম। গত দেড়বছর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনেক শিশু লেখাপড়া ছেড়ে কারখানায় ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যোগ দিয়েছিল। কারখানা বা শিল্প প্রতিষ্ঠানের কাজে শিশুদের নিয়োজিত করা দেশের প্রচলিত শ্রম আইন পরিপন্থী, কিন্তু আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অহরহ চলছে কম মজুরিতে শিশু শ্রমিক নিয়োগ। দ্বিতীয়ত, এত বড়ো কারখানা কমপ্লেক্স কিন্তু সেখানে যাবার রাস্তা এমনই দুর্গম যে ফায়ার ব্রিগেডের গাড়িও সঠিক সময়ে পৌঁছাতে পারেনি। এটা সুস্পষ্টভাবে দেশের প্রচলিত ইমারত নির্মাণ বিধিমালা পরিপন্থী। এই বিধান মতে, ভবনের সামনে ৩০ ফুট চওড়া রাস্তা থাকা উচিত। ভবনের নির্মাণ নকশা, অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা, দাহ্য পদার্থ কোথায় রাখা হবে ইত্যাদি নানা বিষয় সরজমিনে পরিদর্শন করে ছাড়পত্র দেবার কথা ছিল, শুধু তাই নয়, প্রতিবছর কারখানা ভবন পরিদর্শনেরও বিধা আছে আইনে। কিন্তু তার কিছুই যে মানা হয়নি, সে তো ৫২টি প্রাণের বিনিময়ে আমরা দেখেছি।

কিন্তু এবারই তো প্রথম নয়। তাজরীন ফ্যাশন হাউজ, রানা প্লাজা কি হা–মীম অথবা নরসিংদীর তোয়ালে কারখানা কিংবা গাজীপুরের চান্দনার সোয়েটার কারখানা প্রতিবারই কি একই ধরনের ত্রুটিগুলো সামনে উঠে আসেছ না? সেই ভবনের অনুমোদনহীন নকশা, অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা না থাকা, যত্রতত্র দাহ্য ও বিপজ্জনক রাসায়নিক পদার্থ গুদামজাত করা… কিন্তু এগুলোর কোনো সমাধান হচ্ছে না। এত সীমাবদ্ধতা নিয়ে এসব কারখানার লাইসেন্স নবায়ন হয় কী করে? এই উত্তরটি আমরা জানি। সর্বস্তরে সরকারি প্রতিষ্ঠান ও আমলাদের দুর্নীতির যে ভয়াবহ চিত্র আমরা দেখছি, তারই ঘাড়ে চড়ে পার পেয়ে যায় এইসব কারখানার হত্যাকারী মালিকেরা। আর তাদের তৈরি করা এই মৃত্যুফাঁদে প্রাণ যায় অসহায় শ্রমিকের।

বেঁচে থাকতে যে শ্রমিক তাঁর ন্যায্য বেতন-ভাতা পায়নি নিয়মিত, মরে গিয়ে তার কয়লা শরীর নিজের পরিচয়টাও প্রকাশ করতে পারে না।