আক্রান্ত গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ…

মৃণাল কান্তি দাস
Published : 7 August 2015, 02:25 AM
Updated : 7 August 2015, 02:25 AM

উত্তরপ্রদেশের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের এক মন্ত্রীর প্রত্যক্ষ মদতে গুন্ডাবাহিনী ও পুলিশকর্মীরা প্রকাশ্যে এক সাংবাদিককে জ্যান্ত পুড়িয়ে খুন করেছেন, যা নিঃসন্দেহে ভারতের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে বড় প্রশ্ন তুলে দিয়েছে।

শাহজানপুরের বাসিন্দা যোগেন্দ্র সিং অবৈধ খনন, ভয় দেখিয়ে জমি দখলের মতো একাধিক বেআইনি কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে মূর্তির বিরুদ্ধে সংবাদপত্রে অকুতোভয়ে একাধিক রিপোর্ট লিখেছিলেন। সেইসঙ্গে ফেসবুকেও পোস্ট করেছিলেন তাঁর প্রতিক্রিয়া।যা স্থানীয় একটি সংবাদপত্র প্রকাশ করেছিল। তার পরেই তাকে খুন করা হয়।যোগেন্দ্র সিং হত্যা মামলায় কেন্দ্র, রাজ্য ও প্রেস কাউন্সিল অব ইন্ডিয়ার কাছে নোটিস পাঠিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে কেন্দ্র ও অখিলেশ সরকারকে এই বিষয়ে জবাবদিহি করতে বলা হয়েছে।যোগেন্দ্র খুনের ঘটনায় সিবিআই তদন্তের আবেদন জানিয়ে দায়ের করা জনস্বার্থ মামলার শুনানির সময় এই নির্দেশ দেয় শীর্ষ আদালত।সাংবাদিক-হত্যার জন্য আঙুল ওঠার পর রাজ্যের মন্ত্রী রামমূর্তি বর্মা উধাও।‌ অভিযোগ, রামমূর্তির চাপেই পুলিশ যোগেন্দ্রকে বাড়ি থেকে জিজ্ঞাসাবাদের নামে তুলে নিয়ে গিয়ে পুড়িয়ে মারে।‌ ১ জুন শাহজানপুরে যোগেন্দ্রর গায়ে আগুন লাগানো হয়, ৮ তারিখ তাঁর মৃত্যু হয়।‌ পুলিস বলছে, এখনও পর্যন্ত মন্ত্রীকে প্রশ্ন করার নাকি প্রয়োজন পড়েনি! সমাজবাদী পার্টিরই আরও এক মন্ত্রী প্রশান্ত যাদব‌ বলেই ফেলেছেন, 'প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে এবং ভাগ্যের পরিহাসে কিছু ঘটনা ঘটে যায়।‌ প্রকৃতির বিরুদ্ধে আপনি লড়াই করতে পারবেন না।‌'

যোগেন্দ্রর বড় ছেলে বলেছেন, বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে চিঠি লিখবেন তিনি। তাঁর অভিযোগ, বিষয়টি মিটিয়ে নেওয়ার জন্য অভিযুক্তের ঘনিষ্ঠরা তাঁকে ঘুষ আর সরকারি চাকরির টোপ দিচ্ছে। দলীয় সূত্রের খবর, রাম মূর্তিকে বহিষ্কারের প্রশ্নে এখন দু'ভাগে বিভক্ত সমাজবাদী পার্টি। সরকারের মান বাঁচাতে এক দিকে অখিলেশপন্থীরা চাইছেন রামমূর্তিকে সরিয়ে দিতে। অন্য দিকে কুর্মি ভোটব্যাঙ্কের কথা ভেবে রামমূর্তিকে ক্ষমতাচ্যুত করতে চাইছেন না দলীয় প্রধান মুলায়ম সিংহ যাদব আর অন্যতম শীর্ষ নেতা রামগোপাল যাদব। বেআইনি জমি দখল নিয়ে খবর লেখার 'শাস্তি' হিসেবে সেই উত্তরপ্রদেশেই গত ১৫ জুন এক সাংবাদিককে বেদম মারধরের পর বাইকের পিছনে বেঁধে প্রায় ১০০ মিটার ছেঁচড়ে নিয়ে যায় দুষ্কৃতীরা।

এখানেই শেষ নয়! যোগেন্দ্র সিং হত্যা নিয়ে যখন উত্তরপ্রদেশের রাজ্য রাজনীতি উত্তপ্ত, তখন মধ্যপ্রদেশে অপহরণ করে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করা হয় সন্দীপ কোঠারি নামে আরও এক সাংবাদিককে।যে তিন জনের দিকে অভিযোগের আঙুল উঠছে, তারা প্রত্যেকেই বেআইনি খননকাজের সঙ্গে জড়িত। পুলিশের অনুমান, তাদের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নিতে রাজি না-হওয়াতেই সন্দীপকে খুন করা হয়েছে।জবলপুরের কিছু হিন্দি কাগজের সংবাদদাতা হিসেবে মধ্যপ্রদেশের বালাঘাট জেলার কাটাঙ্গি তহশিলে কাজ করতেন সন্দীপ। গত ১৯ জুন রাতে এক বন্ধুকে নিজের বাইকে চাপিয়ে স্থানীয় উমরি গ্রামের দিকে যাচ্ছিলেন তিনি। তখনই একটি চার চাকার গাড়ি এসে তাঁর বাইকে ধাক্কা মারে। গাড়ি থেকে লোকজন বেরিয়ে সন্দীপকে জোর জবরদস্তি করে সেটিতে তুলে দেয় তারা, জানিয়েছেন সন্দীপের সেই বন্ধু, রাহাঁদলে। তাঁকে মারধর করে দুষ্কৃতীরা। মহারাষ্ট্রের নাগপুরের বুটিবোরি এলাকা থেকে উদ্ধার হয় সন্দীপের পুড়ে যাওয়া দেহ।

কথায় বলে গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ হল গণমাধ্যম। এক কথায় তা গণতন্ত্রের পাহারাদারও বটে। আমলা স্তরের দুর্নীতি বা ক্ষমতাবান মানুষের ক্ষমতার অপব্যবহার ও বিভিন্ন দুর্নীতিতে মদত দেওয়ার মতো প্রায় নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনার সঙ্গে অনেক দিন ধরেই ভারতীয়রা অভ্যস্ত। কিন্ত্ত পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়েছে যেখানে সংবাদমাধ্যমে সেই ধরনের কেলেঙ্কারি ফাঁস করাও খুব নিরাপদ ঠেকছে না। সংশ্লিষ্ট সংবাদমাধ্যম বা সাংবাদিকের ক্ষমতাসীনের কোপে পড়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।কায়েমি স্বার্থধারীদের গায়ে সামান্যতম আঁচ লাগলেই সাংবাদিকদের উপরে নেমে আসছে চরম আক্রমণ। সারা দেশ জুড়েই মাথা চাড়া দিচ্ছে এই ভয়ঙ্কর প্রবণতা।কথা বলবেন শুধু নেতারাই। অন্য সবাইকে চুপ করে থাকতে হবে। কেউ কোনও শব্দ উচ্চারণ করতে পারবে না। গ্রামের মানুষ তাদের মনের কথা বলতে পারবেন না। শহরের মানুষ তাদের ক্ষোভের কথা জানাতে পারবেন না। ছাত্রছাত্রী কেউ কোনও প্রশ্ন করতে পারবেন না। শিক্ষক তাঁর মতামত প্রকাশ করতে পারবেন না। সাংবাদিকরা নেতার অপছন্দের প্রশ্ন করতে পারবেন না। কারোর একটি শব্দ যদি সরকারের পক্ষে অস্বস্তিকর হয় তাহলেই তাকে চুপ করিয়ে দেওয়া হবে। এ ঘটনা ঘটেছে পশ্চিমবঙ্গেও!

সরল প্রশ্ন করে ধমক খেতে হয়েছিল প্রেসিডেন্সির ছাত্রী তানিয়া ভরদ্বাজকে। সারের দামের কথা বলে মাওবাদী হতে হয়েছিল বেলপাহাড়ির শিলাদিত্য চৌধুরীকে। মুখ্যমন্ত্রী নিজে নির্দেশ দিয়ে তাকে জেলে পাঠিয়েছিলেন। মন্ত্রী এবং নেত্রীকে নিয়ে একটি সাধারণ ব্যঙ্গচিত্র ই-মেল করায় জেল খাটতে হয়ে‍‌ছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্রকে। পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণকে সাজানো বলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু কলকাতা পুলিসের গোয়েন্দা প্রধান তদন্ত করে জানিয়ে দিয়েছিলেন, ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। অপরাধীরাও চিহ্নিত হয়েছে। প্রকৃত তথ্য বের করার অপরাধে মুখ্যমন্ত্রী বদলি করে দিয়েছিলেন গোয়েন্দা প্রধানকে। সাংবাদিকরা সরকারের পক্ষে অসুবিধাজনক কোন প্রশ্ন করলেই মুখ্যমন্ত্রী ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দেন সাংবাদিককে।

মনে পড়ে সাংবাদিক জ্যোতির্ময় দে-র কথা? মুম্বই শহরতলীর পাওয়াইয়ের এক‍‌টি শপিং মলের কাছে অজ্ঞাতপরিচয় আততায়ীদের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছিলেন সাংবাদিক জ্যোতির্ময় দে। তিনি মুম্বইয়ের '‍মিড ডে' পত্রিকার তদন্তমূলক খবরের বিভাগীয় সম্পাদক ছিলেন। স্বভাবতই এক সাহসী সাংবাদিকের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গোটা দেশে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে এবং সাংবাদিক মহল তাঁদের নিরাপত্তার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হয়ে প‍‌ড়েছিল।কারণ জ্যোতির্ময় দে হত্যাকাণ্ড কোনও বিচ্ছিন্ন বা বিরল ঘটনা নয়। দেশের বিভিন্ন জায়গায় সাংবাদিকরা আক্রান্ত হচ্ছেন। এই ভয়ঙ্কর ধারা গণতন্ত্রের পক্ষে নিশ্চয় প্রতিকূল। বাক্‌-স্বাধীনতা কেড়ে নিতে সাংবাদিক হত্যা আসলে গণতন্ত্রেরই কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা। অপরাধজগতের কুকর্ম ফাঁস করে দিয়ে সমাজজীবনকে অসুস্থতার ও বিকৃতির হাত থেকে রক্ষা করার পণ নিয়েই বহু সাংবা‍‌দিক দেশের বিভিন্ন জায়গায় অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। কিন্তু যে দেশের রাজনীতিকরা নিজেরাই দুর্নীতিবাজ ও অপরাধীদের আড়াল করতে ব্যস্ত সেই দেশের অন্ধকারজগত যে তাতে আরও উৎসাহিত হবে তা বলাই বাহুল্য। সে কারণেই তারা জ্যোতির্ময় দে'কে প্রকাশ্য দিবালোকে গুলির পর গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেওয়ার মতো পৈশাচিক কাণ্ড ঘটাতে পারে। তারা জানে সরকার প্রথম কয়েকদিন খুব তৎপরতা দেখাবে, তারপরে সরকার নি‍‌ষ্ক্রিয়তার শীতঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়বে। শুধু তাই নয়, আমাদের দেশে সাংবাদিকদের উপ‍‌রে আক্রমণের ঘটনাগুলিকে পুলিস ও প্রশাসন হালকা চোখে দেখে বলে ঐ সব মামলা বছরের পর বছর ধরে ঝুলে থাকে। দোষীরা শাস্তি পায় না। তা সত্ত্বেও সমাজের স্বার্থে এবং সাংবাদিকতার মহান আদর্শকে অমলিন রাখার জন্য সাংবাদিকেরা অসমসাহসিকতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। দেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে যখন জনমত ক্রমশ দানা বাঁধছে, তখন লক্ষ্য করা যাচ্ছে দুর্নীতিবাজ ও অপরাধজগতের হাত অনেক লম্বা। তাদের অর্থশক্তি ও পেশিশক্তি অনেক বেশি। তারা যে কোনওভাবে হোক প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে।