সিলিকন ভ্যালিতে ভারতের স্বপ্নউড়ান

মৃণাল কান্তি দাস
Published : 1 Oct 2015, 08:42 AM
Updated : 1 Oct 2015, 08:42 AM

চে ন্নাইয়ের মধ্যবিত্ত জীবন থেকে সিলিকন ভ্যালির অন্যতম প্রধান মুখ এখন পিচাই সুন্দররাজন। সুন্দর পিচাই নামেই যিনি পরিচিত। চেন্নাইয়ের অতি সাধারণ দু'কামরার ফ্ল্যাট থেকে যাত্রা শুরু। মাত্র ৪৩ বছরে গুগলের রাশ হাতে এল। অথচ ১২ বছর বয়স হওয়ার আগে টেলিফোনেও হাত দেননি সুন্দর। বাড়িতে ছিলই না। ছিল না টিভি। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার। জন্মের আগে তাঁর মা স্ট্যানোগ্রাফার হিসেবে কাজ করতেন। বাবা রঘুনাথ পিচাই ছিলেন একটি কারখানার বিদ্যুৎমিস্ত্রি। সুন্দরের মেধা প্রশ্নাতীত। খড়গপুর আইআইটি থেকে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, ওয়ার্টন বিজনেস স্কুল, সর্বত্রই তাঁর কৃতিত্বের নজির রয়েছে। গত এগারো বছরে গুগল-এর অন্দরমহলে তাঁর উত্থানও রীতিমত ব্যতিক্রমী। তথ্যপ্রযুক্তির দুনিয়ার অন্যতম প্রধান সংস্থার শীর্ষপদে অধিষ্ঠিত হওয়া সুন্দর পিচাইয়ের নিজস্ব অর্জন।

প্রথমে পরিকল্পনা ছিল, স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই পিএইচডি শেষ করে অধ্যাপক হবেন। তার বদলে এমবিএ করলেন হোয়ার্টন বিজনেস স্কুল থেকে। ২০০৪ সালে গুগলের সদর দফতরে প্রথম পা। চাকরির ইন্টারভিউ চলাকালীন তাঁকে বলা হয়েছিল সে দিনই নাকি জি-মেল বাজারে আনছে সংস্থা। গুগলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ল্যারি পেজের কথায়, ''আমি ভাগ্যবান যে, সুন্দরের মতো মেধাবী, পরিশ্রমী আর গুগলের প্রতি দায়বদ্ধ লোক সংস্থা চালাবেন।'' আর সুন্দর নিজে বলেন, ''আমি চাই প্রযুক্তি হবে ক্রেতার চাহিদার চাকর। যেমন, যদি গুরুত্বপূর্ণ কিছু ভুলতে বসি, তখনই যেন চিৎকার করে আমার ফোন। যাতে তা মিস না হয়।''

আমেরিকায় এসে ৬০ ডলার দিয়ে ব্যাগ কেনার সামর্থ ছিল না সুন্দরের। আজ ৬,৬০০ কোটি ডলারের সংস্থা তাঁর কাঁধে। এই জয় শুধু সুন্দরের নয়। জয় ভারতীয় স্বপ্নের। বহু ভারতীয় বংশোদ্ভূতই এখন কর্পোরেট বিশ্বে কর্ণধারের ভূমিকায়। সুন্দর পিচাই সেই তালিকায় নতুন সংযোজন। তালিকাটি ভারতীয় কৃতিত্বের। আবার, তালিকাটি ভারতের মতো দেশের প্রেক্ষিতে বিশ্বায়নের মাহাত্ম্যের বিজ্ঞাপনও বটে। সুন্দর পিচাইরা ভারতে 'সাফল্য'-এর সংজ্ঞা বদলে দিচ্ছেন। ভারতে 'আন্তর্জাতিক মানের সাফল্য' বলতে এতদিন ভারতবাসী বুঝতেন, পশ্চিমি দুনিয়াকে পরাজিত করা, বিশেষত প্রথম সারির দুনিয়াকে পর্যুদস্ত করা। সুন্দর পিচাইদের সাফল্যের কেন্দ্রে আছে সহযোগিতা। তাঁরা কাউকেও হারিয়ে সফল হননি। তাঁরা আরও অনেকের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সফল। তাঁরা সত্যিই একটি বিশ্বমঞ্চ পেয়েছেন, যেখানে দক্ষতাই একমাত্র বিবেচ্য, জন্মসূত্রে প্রাপ্ত পাসপোর্টের রং নয়।

সত্য নাদেল্লার কথাই ধরুন। মাইক্রোসফটের সিইও। হায়দরাবাদের ছেলে। হায়দরাবাদের বেগমপেটে একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়াশুনো শেষ করে মণিপাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেন। তারপর আরও পড়াশুনোর জন্য পাড়ি দেন মার্কিন মুলুকে। সান মাইক্রোসিস্টেমে চাকরি নেন। ১৯৯২ সালে তিনি মাইক্রোসফটে যোগ দিয়েছিলেন। তার পর বাকিটা ইতিহাস। অনেকে বলছেন, রূপকথা না হোক, ইতিহাসই তো তৈরি হল। মাইক্রোসফট আর গুগলের মতো দুই চির যুযুধান দৈত্যের মাথাতেই বসে পড়লেন দুই ভারতীয়। হয়তো সিলমোহরও পড়ল তথ্যপ্রযুক্তির দুনিয়ায় ভারতীয়দের ক্রমবর্ধমান নিয়ন্ত্রণের উপরে।

বিল গেটসের হাতে গড়া সংস্থা মাইক্রোসফটে যোগ দেওয়ার আগে নাদেল্লা কর্মজীবন শুরু করেন সান মাইক্রোসিস্টেমে, যা পরে কিনে নেয় ওরাকল। সেখান থেকে চাকরি বদলে ১৯৯২ সালে মাইক্রোসফটে যোগ দেন নাদেল্লা। মাইক্রোসফটে যোগ দেওয়ার পর একইসাথে এমবিএ ডিগ্রিও সম্পন্ন করেন নাদেল্লা। সেই সময়ে উইন্ডোজ এনটি নিয়ে কাজ করছিল মাইক্রোসফট। এই অপারেটিং সিস্টেমের জন্য কাজ করতেই মূলত নাদেল্লাকে নিয়োগ দেওয়া হয়। একসাথে চাকরি ও পড়ালেখা করতে গিয়ে দারুণ হ্যাপা সামলাতে হলেও শেষ পর্যন্ত দুটোকেই সাফল্যের সাথে মেলাতে সক্ষম হন তিনি। ওই সময়ে সারা সপ্তাহ মাইক্রোসফটে কাজ করে শনিবারের ক্লাস করতে শিকাগো যেতেন তিনি। দীর্ঘ আড়াই বছর এই রুটিন মেনে চলতে হয় তাকে। এমবিএ শেষ করার সাথে সাথে মাইক্রোসফটেও নিজের অবস্থানকে শক্তিশালী করে তুলতে সমর্থ হন তিনি। যে কারণে দীর্ঘ ২২ বছর কাটিয়ে দিয়েছেন এই মাইক্রোসফটের সাথেই। সিইও'র দায়িত্ব গ্রহণের আগে সর্বশেষ নাদেল্লা মাইক্রোসফটের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন ক্লাউড ও এন্টারপ্রাইজ বিজনেসের প্রধান হিসেবে। এ ছাড়াও সার্ভার ও টুলসের প্রেসিডেন্ট, অনলাইন সার্ভিসের রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট, বিজনেস ডিভিশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট, বিজনেস সলিউশন অ্যান্ড সার্চের কর্পোরেট ভাইস প্রেসিডেন্টসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।

মাইক্রোসফট-এর পর নোকিয়ার সিইও পদেও বসেছেন আরও এক অনাবাসী ভারতীয়। মাইক্রোসফটের কাছে নিজেদের মোবাইল তৈরির ব্যবসা বিক্রির পর সংস্থার বাকি ব্যবসাকে ঘুরিয়ে দাঁড় করাতে রাজীব সুরির উপরই আস্থা রেখেছে ফিনল্যান্ডের সংস্থাটি। সম্প্রতি ৭২০ কোটি ডলারে নিজেদের মোবাইল ফোন তৈরির ব্যবসা বিক্রির প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করেছে প্রায় দেড়শো বছরের পুরনো সংস্থা নোকিয়া। তাদের বাকি তিন ব্যাবসা নোকিয়া সলিউশন্স অ্যান্ড নেটওয়ার্কস (এনএসএন), হিয়ার এবং টেকনোলজিসের দায়িত্বভার নিয়েছেন ৪৬ বছরের সুরি।

ম্যানেজমেন্ট বা অন্য কোনও বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি তাঁর নেই। কিন্তু ধুঁকতে থাকা সংস্থাকে ঘুরিয়ে দাঁড় করানোর দক্ষ কারিগর হিসেবে তথ্যপ্রযুক্তির দুনিয়া তাঁকে এক ডাকে চেনে। অনেকেই মনে করছেন, সেই দক্ষতাকে কাজে লাগাতেই সুরিকে শীর্ষ পদে বসানোর এই সিদ্ধান্ত। ১৯৬৭ সালে জন্মানো সুরির বেশির ভাগ সময়টাই কেটেছে বিদেশে। নাদেল্লার মতো তিনিও ইলেকট্রনিক্স অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশন্স ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছেন মণিপাল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে। পড়া শেষে সুরি কাজ করেছেন দেশ-বিদেশের একাধিক সংস্থায়। নোকিয়ায় যোগ দেন ১৯৯৫ সালে। দীর্ঘ দিন সংস্থাটির বিভিন্ন ব্যবসা সামলানোর পর, ভারতে তাদের টেলিকম প্রযুক্তির ব্যবসা নোকিয়া-সিমেন্সের দায়িত্ব নেন তিনি। এর পর ২০০৯-এ তাঁকেই ওই সংস্থার সিইও নিযুক্ত করে নোকিয়া। তাঁর হাত ধরেই এক সময়ে ধুঁকতে থাকা নোকিয়া-সিমেন্স ঘুরে দাঁড়ায়। পরিণত হয় নোকিয়ার সবচেয়ে মোটা ও লাভজনক ব্যবসায়। এ জন্য অবশ্য বিপুল সংখ্যায় কর্মী ছাঁটাইয়েও পিছপা হননি তিনি। সিমেন্সের সঙ্গে জোট ভাঙার পর এই ব্যবসারই নাম হয় নোকিয়া সলিউশন্স অ্যান্ড নেটওয়ার্ক। আর এই সব কারণেই নোকিয়ার শীর্ষ পদে সুরির নিয়োগ কিছুটা প্রত্যাশিতই ছিল।

আমরা যে ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করি, তা হয় ভিসা অথবা মাস্টার কার্ড। আর এই মাস্টার কার্ডের সিইও পদে রয়েছেন একজন ভারতীয়। অজয় বাঙ্গা। পাঞ্জাবের ছেলে অজয় বাঙ্গার পড়াশুনো দিল্লির সেন্ট স্টিফেন্স কলেজে। শুধু পানিপুরী মানে ফুচকার টানে আজও ছুটে আসেন দেশে! অ্যাডোব ফটোশপ, অ্যাডোব রিডার, অ্যাডোব পেজমেকার ইত্যাদি নামগুলির সঙ্গে আমরা খুবই পরিচিত। সেই অ্যাডোব কোম্পানির মাথায়ও রয়েছেন ভারতের ছেলে। শান্তনু নারায়ণ। অন্ধ্রপ্রদেশের মানুষ তিনি। হায়দরাবাদের ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনো। মেমরি কার্ড, সিডি ইত্যাদি প্রস্তুতকারী সংস্থা সান ডিস্কের সিইও পদেও একজন ভারতীয়। তিনি হলেন সঞ্জয় মেহরোত্রা। আর এক বিদেশি সংস্থা ইগন জেনডারের সিইও পদে রয়েছেন রাজীব বাসুদেব। মূলত ভারতীয়দের মেধা ও নিষ্ঠাই তাঁদের এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে অন্যান্য দেশের চেয়ে। অন্তত কর্পোরেট দুনিয়ার এটাই মত। এই ১২ জনের সব্বার বেতনই চোখ ছানাবড়া করে দেবে আপনার। যেমন মাইক্রোসফটের সিইও সত্য নাদেল্ল এখন বছরে ১১২ কোটি টাকা বেতন পাচ্ছেন! অন্যান্য ভাতা, বাংলো ইত্যাদি না হয় বাদই দেওয়া গেল!

শুনলে অবাক হবেন, তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে বিশ্বের বিত্তশালীদের তালিকায় প্রথম কুড়িতে দুজন ভারতীয়। উইপ্রোর চেয়ারম্যান আজিম প্রেমজি এবং এইচসিলের প্রতিষ্ঠাতা শিব নাদার রয়েছেন ১৩ এবং ১৪ তম স্থানে। বরাবরের মতো তালিকায় সবথেকে উপরে রয়েছেন মাইক্রোসফটের সহ-প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস। তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ধনীদের নিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে ফোর্বস তালিকা। সেখানেই প্রথম কুড়ির দু'জন ভারতীয়। তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে ১০০ জন বড়লোকের তালিকায় রয়েছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত রমেশ আদানি ও ভারত দেসাই। ৭০ বছর বয়স্ক আজিম প্রেমজি এশিয়ার সবথেকে বড় তথ্যপ্রযুক্তি টাইকুন হয়েছেন। তাঁর মোট সম্পত্তির পরিমাণ ১৭.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অন্যদিকে শিব নাদারের ঝোলাতে রয়েছে ১৪.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই উচ্চতায় তুলে এনেছে তাঁদের প্রখর স্মৃতিশক্তি, বরফ শীতল স্নায়ু এবং সম্পর্কের উষ্ণতা বজায় রেখেও চূড়ান্ত দর কষাকষির ক্ষমতা।