তোরা যুদ্ধ করে করবি কী তা বল?

মৃণাল কান্তি দাস
Published : 29 Oct 2016, 00:40 AM
Updated : 29 Oct 2016, 00:40 AM

ফরাসি ভবিষ্যকথক নস্ত্রাদামুস তাঁর ভবিষ্যদ্বাণীর আনাচে-কানাচে নাকি বলে গিয়েছিলেন ভারত-পাক সংঘর্ষের কথা। নস্ত্রাদামুসের রচনার একাংশে বলে হয়েছে— 'পঞ্চনদের দেশে 'সাইরেন সেলিন'-এর প্রসার ঘটবে। তার মাধ্যমেই বাতাসে আগুনের বৃষ্টি হবে।' সেই সাংকেতিক কহনে নাকি 'পঞ্চনদের দেশ' বলতে পাকিস্তানকেই বোঝানো হয়েছে। তাহলে ১৫৫৫ সালে নস্ত্রাদামুস কি 'সাইরেন সেলিন' টার্মটির আড়ালে আসলে পারমাণবিক শক্তির কথা বলেছিলেন? আর 'অগ্নিবৃষ্টি'-র অর্থ নিউক্লিয়ার রেন?

নস্ত্রাদামুসের ভবিষ্যদ্বাণী নিয়ে চর্চার মধ্যেই সেই 'অগ্নিবৃষ্টি'-র ভয় দেখানো শুরু করেছে পাকিস্তান। গোটা বিশ্ব এবং উপমহাদেশে কোণঠাসা হয়ে গিয়ে পরমাণু যুদ্ধের হুংকার ছাড়ছে ইসলামাবাদ। জানিয়ে দিয়েছে, ভারতের উপরে পরমাণু বোমা ফেলতে দু'বার ভাববে না পাকিস্তান। হুমকি দিয়েছেন পাকিস্তানের পরমাণু বিজ্ঞানী আবদুল কাদির খান থেকে শুরু করে খোদ প্রতিরক্ষামন্ত্রী খোয়াজা মহম্মদ আসিফ। প্রত্যুত্তর দিয়েছিলেন ভারতীয় প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরাও। একটি সর্বভারতীয় দৈনিককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ভারতের প্রাক্তন সেনাপ্রধান নির্মলচন্দ্র ভিজ বলেছেন, ভারত শুধু পাকিস্তানের রাজধানীই নয়, সমগ্র পাকিস্তানকেই টার্গেট বানাতে সক্ষম। পাঁচ মিনিটে পাকিস্তানকে মুছে দিতে পারে ভারতও।

শুধু বাজার গরম করা বাক্য বিনিময় নয়, সম্প্রতি মার্কিন কংগ্রেসে পেশ করা এক চাঞ্চল্যকর রিপোর্ট বলছে, ইসলামাবাদ ভারতের দিকে তাক করে রেখেছে তাদের সবকটি পরমাণু অস্ত্র। পাক সেনার এমন ভয়ংকর সমরসজ্জার তথ্য গোপন থাকেনি। মার্কিন কংগ্রেসের স্বশাসিত শাখা 'কংগ্রেসনাল রিসার্চ সার্ভিস' (সিআরএস) মাস কয়েক আগেই মার্কিন সংসদে তাদের ২৮ পাতার এই রিপোর্ট জমা দিয়েছে। ওই রিপোর্টেই বলা হয়, পাক অস্ত্রাগারে থাকা ১১০ থেকে ১৩০টি পরমাণু বোমা— সবক'টিই যে কোনও মুহূর্তে ব্যবহারের জন্য তৈরি। পাকিস্তান যে সব সময়েই পরমাণু যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত, সেটাই প্রমাণ করে এই প্রস্তুতি।

ভারত ও পাকিস্তানের মতো পরমাণু অস্ত্রে রীতিমতো শক্তিশালী দু'টি দেশের মধ্যে যদি যুদ্ধটা হয়, তা হলে এই ভারতীয় উপমহাদেশের পক্ষে তা কতটা বিপজ্জনক হয়ে উঠবে, তা জানেন যুদ্ধ-গবেষকরা। তাঁরা বলছেন, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে পুরোদস্তুর যুদ্ধ বাধলে প্রতিবেশী দু'টি দেশেরই অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে চৌচির হয়ে যাবে। যার ফলে দু'টি দেশই পিছিয়ে যাবে অন্তত বেশ কয়েকটি দশক। দুই পরমাণু শক্তিধর প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মধ্যে পুরোদস্তুর যুদ্ধ হলে তা শুধু এই উপমহাদেশের পক্ষেই নয়, গোটা এশিয়ার পক্ষেই অত্যন্ত ক্ষতিকারক হবে। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে পুরোদস্তুর যুদ্ধ বাধলে এই উপমহাদেশে দু'কোটি ১০ লক্ষেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারাবেন। গুরুতর জখম বা সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যাবেন কম করে আরও ৫০ লক্ষ মানুষ।

৪৮ বছর আগে, ১৯৬৯-এর ৮ মে সেই ধ্বংসপর্বের অমোঘ বার্তাই দিয়ে গিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। তাঁর অমর সৃষ্টি 'গুপী গাইন বাঘা বাইন'-এ। হিংসায় উন্মত্ত এই দুনিয়ায় গুপী-বাঘা শুনিয়েছিল সেই ম্যাজিক-বাণী: 'মিথ্যে অস্ত্রশস্ত্র ধরে…।'‌ ক্ষমতার রাজনীতিতে ভুঁড়িওয়ালা মন্ত্রীমশাইয়ের 'ভুরুকুটি'-তে তারা যুদ্ধবাজ নায়কের তম্বি আর প্রতাপ বুঝে ফেলেছিল! এবং দম্ভ আর প্রতাপের সেই জয়ঢাক কীভাবে ফাঁসিয়ে দেওয়া যায়, তার তড়িকা বের করতেও তাদের সময় বেশি লাগেনি।‌ কারণ উন্মত্ত ধ্বংসলীলাকে একমাত্র হারাতে পারে যে মানবতার ম্যাজিক, সে তো তাদের গলার সুরে। গানের ভাষায়।‌ নিরন্ন সেনাবাহিনীর সাম্রাজ্য জয়ের অভিযানকে তারা এক পলকে ভুখা মিছিল বানিয়ে দিয়েছিল। 'হাজারে হাজারে হাতিয়ার'-উট-কাটাকাটি- জখম-হত্যা-রক্ত-বীরত্ব সব ফিকে করে দিয়েছিল খাবারের সামনে। সেদিন গুপী পৃথিবীর সর্বকালের, সবচেয়ে সরল, অমোঘ যুদ্ধবিরোধী বাণীটা গেয়ে গিয়েছিল: 'তোরা যুদ্ধ করে করবি কী তা বল?'

পাকিস্তানের হাসান নিসারদের কথায় তো এখন সেই সুর। ভারতকে শত্রু বানিয়ে নিজের দেশেই প্রশ্নের মুখে পড়েছেন নওয়াজ শরিফ। প্রখ্যাত সাংবাদিক তথা রাজনৈতিক বিশ্লেষক হাসান নিসার বলেছেন, পরমাণু হামলার হুমকি পাকিস্তানের আত্মহত্যার সামিল। ভারতের সঙ্গে পরমাণু যুদ্ধের জিগির তুললে পাকিস্তান পৃথিবীর মানচিত্র থেকে চিরতরে মুছে যাবে। নিসারের কথায়, 'পাকিস্তানে এক দল অশিক্ষিত লোক রয়েছেন। তাঁরা জানেনই না যে, পরমাণু বোমা মানে কী। যারা নিজেদের ধ্বংসের কথা ভেবে উল্লসিত হয়।' সেই উল্লাস দেখে আতঙ্কিত যুদ্ধ-গবেষকরাও। তাঁরা সতর্ক করে বলেছেন, এই উপমহাদেশে দুই পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রের যুদ্ধ হলে, মহাজাগতিক রশ্মি ও অতিবেগুনি রশ্মির মতো অত্যন্ত ক্ষতিকারক রশ্মিগুলির হাত থেকে আমাদের প্রতি মুহূর্তে বাঁচিয়ে রাখে পৃথিবীর ওপর চাদরের মতো বিছিয়ে থাকা যে ওজোন স্তর, তার অর্ধেকটাই ধুয়ে-মুছে সাফ হয়ে যাবে। সেই যুদ্ধের ফলে ভয়াল ভূমিকম্প, বন্যা, দাবানল ও অগ্ন্যুৎপাতের মতো সর্বগ্রাসী প্রাকৃতিক মহা-দুর্যোগের ঘটনাগুলি তো বেড়ে যাবেই, গোটা উপমহাদেশে অচিরেই নেমে আসবে পারমাণবিক শৈত্য। ধ্বংস হয়ে যাবে লক্ষ লক্ষ বর্গ কিলোমিটারের ক্ষেতের ফসল।

যুদ্ধ মানে কী?

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথাই ধরুন। ১৯৩৯-১৯৪৫ সাল পর্যন্ত টানা যুদ্ধে মৃতের সংখ্যা ৭ কোটিরও বেশি। সেই ভয়ংকর যুদ্ধের দীর্ঘতম ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে হিরোশিমা-নাগাসাকি! শুধু তাই-ই নয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চার বছর পর ইউরোপের অর্থনীতিতে নেমে এসেছিল অত্যন্ত করুণ পরিণতি। ইউরোপের পুরো অর্থনীতি দ্রুত মার্কিন ঋণের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। আর, তাই আমেরিকার স্টক মার্কেট ভেঙে পড়ায় গোটা দুনিয়ার অর্থ-ব্যবস্থাই পড়ল বেদম বেকায়দায়। বিশ্বব্যাপী মন্দা এই প্রথম। ১৯২৯ থেকে ১৯৩৯ পর্যন্ত চলল এই মন্দা। এখনও ইতিহাসে দীর্ঘতম।

আর এই মুহূর্তে আরব দুনিয়ায় বিরামহীন যুদ্ধের সাক্ষী গোটা দুনিয়া। অন্তহীন ধ্বংসের পথে সিরিয়া। ইরাক, আফগানিস্তান, লেবানন তো ধ্বংস হয়েছে কবেই। দশকের পর দশক প্যালেস্তাইনের যে বিষাক্ত ক্ষত এখন প্রত্যহ রক্তপাত ঘটিয়ে চলেছে, তার কার্যকারণ লুকিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মধ্যেই। যুদ্ধের ভিতরে যুদ্ধ। বিশ্বশক্তির নানা স্বার্থ। চোখের সামনে সিরিয়া যুদ্ধে ইতিমধ্যে কয়েক লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। তার মধ্যে এক লক্ষই শিশু। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ যে শেষ পর্যন্ত এই অবস্থায় পৌঁছবে তা সুদূর কল্পনাতেও ছিল না। আকাশধোয়া বৃষ্টি নয়। বোমা-গুলি-বারুদের বৃষ্টি। বাড়িতে একফোঁটা জল নেই। দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ বিদ্যুৎ। বন্ধ স্কুল। বন্ধ খেলা। স্তব্ধ জীবন। শৈশবও।

পাঁচ বছরের টানা গৃহযুদ্ধে দেশটা অনেক দিন আগেই ধ্বংসস্তূপ। আলেপ্পোর মতো ঐতিহাসিক শহর আজ ধ্বংসস্তূপ। আর সেই স্তূপের ভিতরে বন্দি শত শত শিশু আর তাদের পরিবার। ভবিষ্যৎ নিকষ অন্ধকার। ভিয়েনার ভিয়ানে শুধু আশ্বাসবাণী আর রাষ্ট্রশক্তির স্বার্থ জারিত হচ্ছে। রাষ্ট্রসংঘ-সহ নানা আন্তর্জাতিক সংগঠন, হাজারো মানবাধিকার সংগঠনের আর্তিরও উত্তর মিলছে না। আকাশ থেকে অবিরাম বোমাবর্ষণ, কুর্দদের সাহসী লড়াই, ইরাকি সেনার মনোবল ফিরে পাওয়ায় আজ আইএস কোণঠাসা। কিন্তু বোমা তো শুধু জঙ্গি মারে না! এই বিপুল 'কোল্যাটরাল ড্যামেজ'-এর দায়িত্ব কার। উত্তর মেলে না। গুলি-বোমা-বন্দুক-রক্ত দেখে দেখে ক্লান্ত সিরিয়ার শৈশব। লতা-পাতা দিয়ে তৈরি ঝোল খেয়ে সিরিয়ার বেঁচেবর্তে রয়েছে শৈশবহারানো শিশু, হাড় জিরজিরে বৃদ্ধ। মৃতের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন মৃত্যুমিছিলকেও তা হার মানাতে পারে। এটাই ২০১৬-র সিরিয়া। এই যুদ্ধের ক্ষত বয়ে বেড়াতে হবে দশকের পর দশক।

তবু যুদ্ধের হুংকার!

সত্যি সত্যিই যুদ্ধ লাগবে নাকি? প্রশ্নটা প্রায় রাতারাতি কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা ছড়িয়ে পড়েছে। যুদ্ধ যুদ্ধ জিগির উঠেছে চারদিক জুড়ে। কেন যুদ্ধে গিয়ে পাকিস্তানে গুঁড়িয়ে দিয়ে আসা হচ্ছে না, এমন প্রশ্ন তুলছেন অনেকেই। সবাই নন, হয়ত বেশির ভাগও নন, কিন্তু পাকিস্তানকে যুদ্ধে হারিয়ে জ্বালা জুড়োতে চাওয়া ভারতবাসীর সংখ্যাটা নেহাত কম নয়।

১৯৪৭-এর মধ্যেরাতে জন্ম নেওয়া সেকুলার ভারত আর ধর্মের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা পাকিস্তানের মধ্যেকার চাপান-উতোরকে খুঁজতে গেলে পৌঁছতে হতে পারে ব্রিটিশ শাসনের কাল। দ্বিজাতি তত্ত্ব, সাম্প্রদায়িক বাটোয়ারা, রক্তস্নাত দাঙ্গা এবং অনন্ত উদ্বাস্তু-স্রোত পেরিয়ে এই সম্পর্ক ক্রমশ আকার নিয়েছে প্রত্যক্ষ সংঘাতের। বারবার। সেই সঙ্গে নিরবচ্ছিন্নভাবে চলছে স্নায়ুযুদ্ধও। পাঠানকোট হয়ে উরি— সেই ইতিহাসের ধারাবাহিক পুনরাবৃত্তি। সেই পথ ধরেই যুদ্ধের হুংকার! যুদ্ধের হুমকি পাকিস্তানের। ভারতের রক্ত ঝরাতে চান পাক সেনাপ্রধান রাহিল শরিফ। ওপারে উত্তরের আকাশসীমায় উড়ান নিষিদ্ধ। বন্ধ পাক অধিকৃত কাশ্মীরের হাইওয়ে। ইসলামাবাদের আকাশে চক্কর কাটছে যুদ্ধবিমান। মাঝে মধ্যেই সীমান্তের ওপার থেকে ধেয়ে আসছে গুলি, মর্টার, শেল। এপারে পালটা জবাব। নিয়ন্ত্রণ রেখা পেরিয়ে ভারতের সার্জিকাল স্ট্রাইক। ঘন ঘন ওয়ার রুমে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। দশেরা উৎসবে 'অসুর' নিধনের ডাক প্রধানমন্ত্রীর। জঙ্গি হানার আশঙ্কায় জলে নৌসেনা, ডাঙায় চিরুনি তল্লাশি আর আকাশে সেনা হেলিকপ্টার। সন্ত্রাসবাদকে মানবতার শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে পরোক্ষে পাকিস্তানকে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। লখনউতে দশেরার অনুষ্ঠান থেকেই তাঁর বার্তা, 'এক এক সময় পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে যুদ্ধটাই অবধারিত হয়ে যায়। যে দেশগুলি সন্ত্রাসবাদীদের প্রশয় দিচ্ছে, তারাও শাস্তি পাবে।' সবই যুদ্ধের পটভূমি।

গোটা দুনিয়া তাকিয়ে ভারত-পাক সীমান্তে যুদ্ধের আবহের দিকে। চারদিকে হাজার হাজার কোটি টাকার অস্ত্র ব্যবসার গন্ধ! পাকিস্তানের দরজায়ও টোকা মারছে চীন। ইতিমধ্যে চীনের পক্ষ থেকে পাকিস্তানকে ২৫০টি জেএফ– ১৭ যুদ্ধ বিমান দেওয়ার চুক্তি হয়েছে। এই ধরনের একেকটি বিমানের দাম প্রায় এক কোটি পঞ্চাশ লক্ষ ডলার। সামরিক সহায়তা নেওয়ার ক্ষেত্রে পাকিস্তান তার দীর্ঘদিনের 'আর্মস পার্টনার' মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ক্রমেই সরে গিয়ে চীনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। তাঁদের মতে, পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম ক্ষেপণাস্ত্র-ব্যবস্থা উন্নত করার বিষয়ে এরই মধ্যেই বেজিংয়ের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে ইসলামাবাদ। ভারত-আমেরিকার পালটা শক্তি হিসাবে চীনকে নিয়ে শক্তিশালী শক্তি গড়ার চেষ্টায় পাকিস্তান।

অন্যদিকে, এই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার মাঝেই রাশিয়ার সঙ্গে ৩৯ হাজার কোটি টাকার প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত চুক্তি সই করে ফেলেছে ভারত। এই চুক্তির ফলে ভবিষ্যতে পাঁচটি এস-৪০০ 'ট্রায়াম্ফ' অ্যান্টি মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম হাতে পাবে ভারত। এছাড়াও ২০০টি কামোভ ২২৬টি হেলিকপ্টারও ভারতের হাতে আসবে। ইতিমধ্যে ফ্রান্সের সঙ্গে স্বাক্ষরিত বহুপ্রতীক্ষিত রাফাল চুক্তি। শুধু যুদ্ধবিমান নয়, ভারতের হাতের মুঠোয় মিটিওর ক্ষেপণাস্ত্রও। চুক্তি অনুযায়ী, ৩৬টি বিমানের ক্রয়মূল্য প্রায় ৫৮ হাজার কোটি। সীমান্তে যুদ্ধের আবহের মধ্যেই অস্ত্র আমদানিতে এখন দুনিয়ার প্রথম সারিতে ভারত। আর তাই ভারতকে ঘিরেই এখন বিশ্ব অস্ত্র বাজারে তীব্র প্রতিযোগিতা। মোদি সরকারের দোরগোড়ায় লাইন পড়ে গিয়েছে ফ্রান্স, আমেরিকা, ব্রিটেনের মতো দেশগুলির। লক্ষ্য একটাই: ভারতের অস্ত্র বাজার।

অত‌্যাধুনিক সমরাস্ত্র হাতে চলে এলে পাকিস্তানের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ভারতই এগিয়ে যাবে কয়েক যোজন। দেশবাসীর জন্য এইটুকু বার্তাই যথেষ্ট। দারিদ্র, বেকারত্ব, অভাবের জ্বালা যতই থাক, পাকিস্তানের কাছে তো মাথা নোয়ানো যায় না! তাই বিপুল অঙ্কের অর্থ ব্যয় করে রাফাল চুক্তি নিয়ে চারদিকে উত্তেজনা। গর্বও বটে। দেশবাসী যেন চাইছে, প্রতিশোধের জোয়ারে ভেসে যাক সন্ত্রাসবাদের আঁতুড়ঘর 'পাক' ভূমি। রক্ত ঝরবে। ঝরুক। সহ্যেরও তো ক্ষমতা থাকা চাই। কিন্তু আখেরে লাভটা কার হবে? না এপারের, না ওপারের। নাকি অস্ত্র কারবারিদের? সেই ভাবনা চুলোয় যাক। কে না জানে, অস্ত্র যখন 'পণ্য' হয়, যুদ্ধ তখন তো 'বিজ্ঞাপন' হয়!

যেমন হয়েছে ইরাকে, আফগানিস্তানে, প‌্যালেস্তাইনে…সম্প্রতি সিরিয়ায়। এক সিরিয়াকে কেন্দ্র করে রাশিয়া আবার অস্ত্র বাজারে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। ইরান থেকে শুরু করে আরব দুনিয়ার বহু দেশ এখন রাশিয়ার সুখোই-৩০ যুদ্ধবিমান কিনতে মরিয়া। তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো তথ্য হল, এই মুহূর্তে বিশ্বে পাঁচ দিনের অস্ত্র কেনার পিছনে যে খরচ হয়, তা বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার ২০ বছরের গুটিবসন্ত উচ্ছেদ কর্মসূচির খরচের সমান। বিশ্বে প্রতি এক লক্ষ মানুষের বিপরীতে রয়েছে ৫৫৬ জন সেনা। কিন্তু এই এক লক্ষ মানুষের জন্য ডাক্তার রয়েছে ৮৫ জন। প্রতিটি সেনার জন্য বছরে গড়ে খরচ ২০ হাজার ডলার। অথচ বিশ্বের প্রতিটি স্কুলবয়সী শিশুর পিছনে আমরা খরচ করি মাত্র ৩৮০ ডলার। বিশ্বে তিন সপ্তাহে যে সামরিক খরচ হয়, তা দিয়ে গোটা বিশ্বের মানুষের সারা বছরের খাবার জল জোগান দেওয়া যেত। আর এর ফলে গোটা মানবসমাজের রোগ অর্ধেক কমে যেত। গোটা দুনিয়ায় বছরে রোগ ও ক্ষুধায় মারা যায় এক কোটি শিশু। অথচ, আমরা ১ মিনিটে অস্ত্রের পিছনে খরচ করছি ৬৫ লক্ষ ডলার। বাস্তব তথ্য হল, মানুষ আজ যে পরিমাণ অর্থ খরচ করছে উন্নয়ন খাতে, সেই তুলনায় ২০ গুণ বেশি খরচ করছে যুদ্ধের পিছনে। তবুও গোটা দুনিয়াজুড়ে যুদ্ধের আতঙ্ক। অস্ত্র কেনাবেচার হিড়িক। অস্ত্রের কারবারীরা বলেন, আপনি যুদ্ধ করুন, আপনার পাশে আমি আছি। যা লাগে আমি দেব।

'প্রতিটি বন্দুক তৈরি, প্রতিটি রণতরী জলে ভাসানো, প্রতিটি রকেটে আগুন ধরানোর অর্থ শেষ পর্যন্ত হল— যাঁরা ক্ষুধার্ত, যাঁদের খাবার নেই, যাঁরা শীতে কুঁকড়ে রয়েছেন, যাঁদের শীতবস্ত্র নেই, আসলে তাঁদের থেকে চুরি করা।' একথা বলেছিলেন মার্কিন রাষ্ট্রপতি আইজেনহাওয়ার।

ইতিহাস জানে, সাম্রাজ্য তার আধিপত্য অটুট রাখতে বরাবরই ভরসা রেখেছে সামরিক শক্তির ওপর। এরজন্য অস্ত্র চাই। মানব সভ্যতার ইতিহাসে এটাই দস্তুর। রোম সাম্রাজ্যের ক্ষেত্রে তা যেমন সত্য, তেমনই সত্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে। এমনকী তা সত্য এই একুশ শতকের মার্কিন, চীন, রুশ, ফরাসি সাম্রাজ্যেও।

অস্ত্রের কারবারীরা চায় দেশে দেশে যুদ্ধ। চায় পৃথিবীর প্রত্যেক কিলোমিটার জমিতে থাকবে তাদের যুদ্ধ বিমান-মিসাইল, প্রতি ইঞ্চি জমি থাকবে তাদের বিক্রি করা ক্ষেপণাস্ত্র পাল্লার মধ্যে। তারজন্য চাই দুনিয়াজুড়ে যুদ্ধের বিজ্ঞাপন!

অথচ এই বিশ্বই দেখেছে হিরোসিমা-নাগাসাকির অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ! দেখেছে ইরাক-আফগানিস্তানে অগণন প্রাণের বলি! কী আসে-যায় বোমা-বিস্ফোরণে যদি ভূমিকম্পে চিড় ধরে মাটির পৃথিবীর! যদি দূষণে মরে যায় পরিবেশ! যদি উন্নত তেজস্ক্রিয়তায় প্রজন্মের পর প্রজন্ম বিকলাঙ্গ হওয়াই ভবিতব্য হয়ে দাঁড়ায়!

তবু আমরা জানি, গুপী-বাঘা এই দুনিয়ার আম-জনতার ভিড়েই কোথাও আছে। যে-কোনও যুদ্ধ থামানোর, যে-কোনও বদ ষড়যন্ত্রের দফারফা করার ম্যাজিক নিয়েই আছে। ক্ষমতা যদি কোথাও অহঙ্কারী প্রচারের বেলুন ফুলিয়ে বাড়াবাড়ি করে, নিজেকে মানুষের শক্তির চেয়েও বড় ভাবতে থাকে, তাহলে সে ইসলামাবাদেই হোক কিংবা দিল্লিতে, ওই বেলুনের হাওয়াটুকু বের করে দিতে গুপী-বাঘা ঠিক সেখানে পৌঁছে যাবে। হ্যাঁ, ৪৮ বছর পরেও শোনা যাবে: 'তোরা যুদ্ধ করে করবি কী তা বল?'