ধানমন্ডি লেকের কড়চা

সালমা কবীর
Published : 28 Dec 2012, 06:13 AM
Updated : 28 Dec 2012, 06:13 AM

'মন যতদুর চাইছে যেতে ঠিক ততদূর আমার দেশ' লুপা মুদ্রার গানের কলিটি শুনতে শুনতে জনাকীর্ণ এই ঢাকা শহরে অতি সহজেই যদি একটি প্রাণকেন্দ্র পাওয়া যায় বা খুঁজে নেয়া যায় মন্দ কি! আর আজ যেন সেটিই আবশ্যক। কেননা আজকাল গবেষকদের গবেষণায় শতায়ু, সুস্বাস্থ্য, সুষম খাদ্য, ঘুম, পেশা, আধ্যাত্মিক কর্ম ইত্যাদি যাবতীয় বিষয় উঠে আসে।ফলশ্রুতিতে মানুষ নিজেকে উপলদ্ধি করে। এযেন বেঁচে থাকার দায়। আর বেঁচে থাকার দায় আছে বলেই সুস্থ জীবনকে উপলদ্ধি করার প্রয়োজনীয়তা। প্রয়োজেনেই যেন দায়ের প্রশ্নটি্‌ এসে যায়। অনুভূত হয় বয়সভেদে একের পাশে অন্যের, স্বজন আর আত্মীয় বন্ধু-বান্ধবের। উপলদ্ধি হয় লোকালয়ের। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে অনুভূতি আদান প্রদানের; মন বা চিত্তের সহজাত আকর্ষণ-সুস্বাস্থের আদলে বাঁধা একটু নিত্যদিনকার চিত্তবিনোদন।

ব্যস্ততম এই ঢাকা শহরের ২৭ নম্বর রোডের পাশ ঘেঁষে যে লেকের শুরু তার শেষ ধানমন্ডি রাইফেলস স্কয়ার। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এটার আয়তন ৯৮ একর। এ লেকের প্রধান আকর্ষণ ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধু মুজিবের বাড়ী তথা মিউজিয়াম, ৮নম্বর এর রবীন্দ্র সরণী এবং সবশেষে 'জাহাজ বাড়ী' ।

আপনমনে লেকের একপাশ ধরে হাঁটতে হাঁটতে গাছগাছালির সবুজাভ শোভা, লেকের মৃদৃমন্দ হাওয়ার পরশ পাওয়ার পাশাপাশি পাঁখির কিঁচির মিঁচির এতটা না থাকলেও মটর-বুট-চিরা-চাউল ভাজা,বাদাম, মুড়ি মুরকী,টক-ঝাল ফুচকা-চটপটি, পোঁড়া ভুট্টা,পাঁপড়, হটপেটিস হাতে হকারদের হাকডাকে যেন মুখরিত বিকেলেবেলাটি। বাচ্চা-বুড়োর বোট চালানোতে আছে চিত্ত-বিনোদনের শোভা। পরিবার বন্ধুবান্ধবের সাথে সিজনাল খেলা, রঙিন বেলুনে নিজের কনফিডেন্স পরীক্ষা-বিনোদনের এমন তালিকা অপর্যাপ্ত হলেও উপভোগ্য। কতৃপক্ষের ২৪ কোটি টাকা ব্যয় বরাদ্দে পরিবেশের শোভা বাড়ানোর এবং পাবলিক সুবিধাদির প্রশংসনীয় উদ্দ্যোগ প্রায় বছরখানেক ধরে চলছে। সেফটি সিকিউরিটির জন্য ভেতরে বহাল সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা প্রহরী, পার্ক-সংলগ্ন বসতি বাড়ীর সীমানা ঘেঁষে ছোট আকারের লোহার নেট বাউন্ডারী, সুপ্রসস্ত লেক ঘেঁষা ঘুরানো পেঁচানো লাল ইটের ডবল হাঁটার রাস্তা, পাবলিক টয়লেট, ফোঁয়ারা, সিঁড়ি বেয়ে লেকের পানি পর্যন্ত নামা প্লাটফর্ম ইত্যাদি নানা সুবিধাদি এরই মধ্যে উপভোগ্য হয়ে উঠতে শুরু করেছে । এক সময়ের জনবিরল এলাকাটি এখন হয়ে উঠেছে প্রাণবন্ত ব্যস্ত সরণীতে। বিশেষ করে জাতীয় ছুটির দিনগুলিতে লেকের পারে হাঁটার যায়গা পাওয়া যায় না । লেকের পাড়ে রয়েছে সৌখিন মৎস শিকারীরও একাগ্রতা ।

রবীন্দ্র সরণীর সুবিন্যস্ত ইট বাঁধানো স্বল্প পরিসরে স্থায়ী অস্থায়ী রেস্তোরাগুলিতে বসে মচমচে পিঠা, লুচি-কাবাব, পাকোরা ভোজন বিলাসীদের এতটা আকর্ষন করলে বা না করলেও রৃচিমত চা-কফিতে চুমুক দিয়ে আড্ডায় পার করে দেয়া যায় বেলা ।

আমাদের জেনারেশন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা পাবলিক লাইব্রেরী চত্বরে আড্ডা দিত। সে সব আড্ডায় অন্যান্য বিষয়ের সাথে থাকতো কাফকা-কামু-সার্ত্রে বা কমল মজুমদারের আলোচনা । এখন বেশীরভাগ ইউনিভার্সিটি ধানমন্ডি এলাকার হওয়ায় লেকের পাড়ে থাকে তরুণ-তরুণীদের ভীড় । তাদের হতে থাকে জি মেট বা আই এল এটসের বই কাফকা-কামু-সার্ত্রে ক্লাসের পাঠ্য তালিকায় থাকলেও কমলকুমার তাদের কাছে অচেনা ।আমার কোন আফসোস নেই, বিশ্ব জয় বা চাকুরী জয়ে কমল কুমারের দরকারই বা কি !

চাকুরী-অর্থসংকট, যানজট আর জনবহুল জনপদের তীব্র ছোবল থাকা সত্বেও রবিঠাকুরের 'সীমার মাঝে অসীম তুমি' প্রাণে ধারণ করে আজকাল সচেতন ঢাকাবাসীর অনেকেই সময়ের সীমারেখা আর সংগতি-সামর্থ্যের সাথে তাল মিলিয়ে প্রাণের পরশ পেতে চায় । ক্লান্তিহীনতার আশ্বাসে একটি পরিবেশ নিয়মমাফিক নিত্যদিনই বাইরে যেতে আকর্ষন করে, যেখানে দেখা যায় নবীনের উচ্ছ্বাস আর প্রবীনের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার অভিলাষ ।

সাধারণত তরুণরা আসে বিকেলে, আমার মত মধ্যবয়সীরা আসে সকালে । হাঁটার পাশাপাশি লাইনে দাঁড়িয়ে ব্যায়াম করে, পরে কেউবা জন্মদিন পালন করে-কেক কাটে; কেউবা ব্লাড সুগার মাপে, এ লেকের পাড়ে। পৃথিবীর সর্বোচ্চ কোলাহলময় এই শহরে একটি মুক্তশ্বাস নেয়ার জন্য হলেও যেন আপনাকে একবার এখানে আসতেই হবে । প্রায়শ:ই রবীন্দ্রসরণীতে থাকে সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার সাজ সাজ রব । দেখা যায় নবীন প্রবীনের সমাগম। বিশালকায় সাউন্ড বক্সে গম গম করে বেজে উঠে 'তীর হারা এক ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেব, আমরা ক'জন নবীন মাঝি হাল ধরেছি ..' এ যেন প্রবীনের মাঝে নবীনের প্রাণস্পন্দন, প্রাণবার্তা ।