স্বাধীন নির্বাচন কমিশনঃ স্বপ্ন ও বাস্তবতা

আলী সিদ্দিকী
Published : 27 Nov 2015, 05:15 AM
Updated : 27 Nov 2015, 05:15 AM

মুশকিল হলো, যে কোন রকম গঠনমূলক আলোচনাকেও আমরা রাজনীতির পক্ষে-বিপক্ষে নিয়ে যাই এবং অন্যায্যভাবে নিজস্বার্থে ব্যবহার করে লাভবান হবার মতলব করি। আমরা যে যেই অবস্থানে থাকি না কেন, নিজের অবস্থানকে শক্ত করার মানসে আমরা যে কোন মতামতের ব্যাখ্যা নিজেরদের মতো করে নিই। ফায়দা লোটার এই মনোবৃত্তি আমাদের পুরো সংস্কৃতিকে কলুষিত করে দিচ্ছে। আমাদের সমাজের সুস্থ বিকাশের পথকে রুদ্ধ করে দিচ্ছে। এটি আমাদের মানসকিতার দৈন্যতা।  যেমন ধরুন, এই মুহূর্তে আমার পৌরসভা নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ প্রশ্নে ইসি'র সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তটি নিয়ে আমার কিছু বলতে ইচ্ছে হচ্ছে যা কোন রাজনৈতিক দলের দৃষ্টিভঙ্গীতে নয় বরং একজন সচেতন মানুষ হিসেবে গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার স্বার্থে কথাগুলো বলতে চাই। কিন্তু আমি নিশ্চিত যে, সরকারী দলের বেতনভূক্ত অথবা সুবিধাভোগী  লোকজন একে যেমন সরকারের সমালোচনা বলে গালি দেবেন তেমনি সরকারবিরোধীরা সরকারকে একহাত নেয়ার জন্য ব্যবহার করবে। আমাদের অতিরাজনৈতিক বিভাজিত জনসমাজের সহিংস অবস্থানের কথা স্মরণে রেখেই সমাজের স্বার্থেই তারপরও কথাগুলো বলছি।
গত ২৫শে নভেম্বর নির্বাচন কমিশন ২৩৪টি পৌরসভায় নির্বাচনের জন্য রিটার্নিং অফিসার ও সহকারী রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ করে পরিপত্র জারি করেছেন। তাতে জেলা সদরের ৪২টিতে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক), ৫৯টিতে ইসির নিজস্ব কর্মকর্তা এবং ১৩৩টিতে নিয়োগ দিয়েছেন ইউএনওদের। অবশ্য প্রায় সব ক'টি পৌরসভায় সহকারী রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তাদের। এই নিয়োগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সরাসরি পুরো নির্বাচনকে সরকারী প্রশাসনের অধীনে স্থাপন করা হয়েছে যা নির্বাচন কমিশনকে একটি স্বাধীন সংস্থা হিসেবে গড়ে ওঠার পুরো আয়োজনকে ভন্ডুল করে দেবার জন্য যথেষ্ট। একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের জন্য বাংলাদেশের মানুষ দীর্ঘ ধরে সোচ্চার। কারণ একটি স্বাধীন নির্বাচন ছাড়া বাংলাদেশের গণতন্ত্র কোনভাবেই শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পারবে না। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হলে এবং বিভাজিত সমাজের পারস্পরিক দ্বন্ধ-সন্দেহে জর্জরিত জনসমাজের কাছে গ্রহনযোগ্য নির্বাচন সম্পন্ন করতে হলে স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের কোন বিকল্প নেই। বর্তমান সরকার গণতন্ত্রকে বিকশিত করার উদ্যোগের কথা বললেও কাজে কিন্তু সম্পূর্ণ বিপরীত আচরণটি করলেন এবং নির্বাচন কমিশন সচিব যুক্তি দেখিয়েছেন এই বলে যে, পর্যাপ্ত জনবল থাকলেও এখনো সে সময় আসেনি (দায়িত্ব অর্পনের)। বর্তমানে মাঠ পর্যায়ে সাত শতাধিক কর্মকর্তা থাকলেও সরকার নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় নির্বাচন কমিশন স্বাধীন ভুমিকা পালন করতে পারছে না। তার পরিষ্কার অর্থই হলো সরকার নির্বাচনকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়। কেন চায় সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
এর মধ্যেই বিএনপি বলে ফেলেছে, সরকার ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করার পাঁয়তারা করছে। অথচ বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিলো তখনো বাংলাদেশের মানুষ নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন সংস্থায় পরিণত করার জন্য দাবী তুলেছিলো এবং তখন সরকার বিরোধী আওয়ামী লীগও আজকের বিএনপির মতো সরকারের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার ষড়যন্ত্রের কথা বলে নির্বাচন কমিশনকে ক্ষমতা প্রদানের দাবী জানিয়েছিলো। আমরা খুব ভালো ভাবেই জানি যে, বিএনপি তাতে কর্ণপাত করেনি।
এই যে বাঙালি জাতি পারস্পরিক দোষারোপের "তোড় বড়ি খাড়া খাড়া বড়ি তোড়" খেলায় মেতে দেশ ও জাতির সর্বনাশ করছে এবং যে গণতন্ত্রের জন্য বাংলাদেশের মানুষ রক্ত দিয়েছে যুগের পর যুগ রাজনৈতিক দলগুলো শুধু ক্ষমতায় যাওয়া ও টিকে থাকার জন্য "গণতন্ত্রের" জন্য মায়াকান্না করছে তা প্রকৃতপক্ষে প্রতারণা। দল, গোষ্ঠী ও ব্যক্তিবিশেষের স্বার্থসিদ্ধির জন্য গণতন্ত্রকে ব্যবহার করা হচ্ছে বারবার। সেটা শুধু আওয়ামী লীগ করছে বলে আওয়ামী লীগকে গালাগাল দেবো আর বিএনপি এখন ক্ষমতায় নেই বলে তার সাথে সুর মেলাবো-এই প্রবণতার বাইরে এসে আজ শুধু একটি স্বাধীন স্বশাসিত নির্বাচন কমিশনের জন্য আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার। আমি জানি এতে বিএনপি সমর্থকরা উৎফুল্ল হবে আর আওয়ামী লীগ সমর্থকরা একথা শুনে গালি দেবে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন করতে হলে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হলে স্বাধীন নির্বাচন ছাড়া অন্য কোন বিকল্প নেই। আসুন, ক্ষমতা নয় শুধু দেশের সমৃদ্ধির স্বার্থে গণতন্ত্রকে শক্ত বুনিয়াদের ওপর দাঁড়াতে আমরা স্বচ্ছ নির্বাচন ব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেই।

নভেম্বর ২৫, পেনসেলভেনিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।