না ফেরার দেশে হারিয়ে গেলেন তিনি

মুহাম্মদ দিদারুল আলম
Published : 16 August 2016, 03:20 PM
Updated : 16 August 2016, 03:20 PM

" তুমি থাকো, আমি থাকি
পৃথিবী থাকুক, চাঁদ থাকুক,
তোমার গায়ে চাঁদ উলকি আঁকুক !!
পাখিরা থাকুক ।।
পাখিরা গাইলে গান
হবে সকাল।
গাছেরা থাকনা বেঁচে ,
গাছেরা থাকলে ফুল ফুটবে !!
মেঘ থাক হাওয়া থাক
নদী যাক বয়ে…!! "

মৃত্যুর ৪দিন আগে এভাবে উনি উনার ফেসবুকে লেখে গেছেন। ফুল,পাখি চাঁদ, পৃথিবী সবই ঠিক আছে শুধু তিনি নেই। আমাদের কাঁদিয়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে।

'হ্যালো আমি দিদার বলছিলাম চট্টগ্রাম থেকে… ওহ, তুমি! তোমার লেখা পড়ছিলাম খুব সুন্দর মনের ভাবটা প্রকাশ করলা। আমিও আপনার লেখা পড়ছি, আর এখান থেকে আপনার মোবাইল নম্বরটা পেলাম। হা হা হা…তা আর কি খবর বলো?'

এভাবে তাঁর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো 'সাপ্তাহিক' পত্রিকা। এর পর থেকে বেশী কথা হতো সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে। মা ডাকতে চাইলে তিনি হেসে তাঁর আরো অনেক সন্তানের সাথে আমাকেও বুকে টেনে নিলেন।

যেদিন আমার ছেলেটা জন্ম নিলো সাথে সাথে উনাকে যখন ফোন করলাম তিনি বলে উঠলো- 'দেখো, এবার তোমার জীবনের সব দুঃখ চলে যাবে।' তিনি খুশি হয়ে জানতে চাইলেন 'আমার বৌ-মাটা কেমন আছে, সুস্থ আছেতো?'

মানুষটার সাথে বছর কয়েকের পরিচয়। মনে হতো আমার জন্মের আগের পরিচিতজন। কোথায় যেন বাঁধা। খুব একটা বেশী দিন নয় আমাদের তারপরও… । আমার মত অনেকের মা তিনি। মমতার বাঁধনে তিনি জড়িয়ে নিতেন খুবই সহজে। তাঁর লেখনি শক্তি প্রকট, লেখায় মায়া-মমতা, ভালোবাসা, শিক্ষা কোন কিছুর কমতি থাকতো না। ভালো লাগতো যেমন তাঁর কথা, তেমনি তাঁর লেখাও।

আমার আর তাঁর আবাসের দুরত্ব থাকায় ব্যস্ততা কারণে হয়নি মা ছেলের দেখা। এই আফসোস হয়তো চিরকালের। ঢাকায় যাওয়া হয়নি তেমন তাঁর সাথে পরিচয়ের পর যা একবার গেলাম তখন ছিলাম দৌঁড়ের উপর। সময়কে সময় দিতে না পারায় মাকে দেখা থেকে বঞ্চিত হলাম। আর মা বঞ্চিত করে রেখে গেলেন চিরকালের জন্য। সম্বল হয়ে রইলো ফোনে যা কতটুকু আলাপ, কণ্ঠ বাজে কানে। এখন আমার লেখালেখিটা তেমন না হলেও যদি টুকটাক কোথাও চলে আসে আমার আগে তিনিই দেখতেন। ফোন দিয়ে বলতেন আজ ওখানে তোমার লেখাটা দেখেছো? দেখে নিও।

সেদিন তাঁর সিঁড়ি থেকে পড়ে পা ভাঙ্গার কথা শুনে খুবই কষ্ট হয়েছিলো। রহিমা ম্যাডাম বললো আপনি কি শুনেছেন- সুফিয়া আপা যে অসুস্থ! তিনি যে পা ভেঙ্গে পেলেছেন। তারপর মায়ের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম তাঁর কিভাবে পা ভাঙ্গলো। একজন স্কুল শিক্ষিকা জীবনের শেষ বয়স পর্যন্ত লিখে গেছেন। দিয়ে গেছেন পাঠকদের মনের খোরাকের জোগান। অবসরপ্রাপ্ত একজন স্কুল শিক্ষিকা। তাঁকে নিয়ে লিখতে গেলে অনেক কথাই আসে। কবি, গল্পকার এই মানুষটি কারো কাছে সুফিয়া ম্যাডাম, কারো সুফিয়া আপা, পাঠকের কাছে সুফিয়া জামান, আমার কাছে তিনি একজন মা।

৭ আগস্ট রাতে তাঁর চলে যাওয়ার কথাটি পরের দিন সকালে শুনলাম রহিমা আক্তার মৌ ম্যাডামের ফোনে। এত সকালে ফোনটা পেয়েই ধরার আগেই অনুমান করে নিয়েছি। কথা বলার পর বুঝলাম অনুমান সঠিক। বুকের ভেতর কেমন যেন লাগলো, চোখে জল টলমল। ইস আর বুঝি দেখতে পেলাম না। আর বুঝি কখনো কথা হবে না। কখনো বলতে পারবো না 'বই মেলা আসলে আপনার বইটি আমি কিনে নিবো, আপনি আমাকে দেয়া লাগবেনা।' কথাটি শুনে তিনি আর হাসবে না। বলবেন না পাগল ছেলে আমার।

''খুব হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে।
তাই যাচ্ছি !!
আমায় ডেকোনা ফেরানো যাবেনা,
ফেরারি পাখিরা নীড়ে তো ফেরেনা !!!''

২৮ জুলাই সকাল ৯.৩৮মি: তিনি তাঁর ফেসবুকে হারিয়ে যাওয়ার কথা লিখে গেছেন তিনি। তারপর যে এত অল্প সময়ে তিনি এভাবে আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে যাবেন তা আমাদের কল্পনাই ছিলো না।

আমাদের অনেকের প্রিয় এই মানুষটি ১৯৫৫ সালে নরসিংদী জেলার মনোহর্দী উপজেলার একদুয়ারি ইউনিয়নের সৈয়দপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। দীর্ঘ ৩৯ বছর শিক্ষকতা পেশায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। কর্মজীবনে নিষ্ঠার সাথে জাতির শিক্ষার বীজ বুনে ছিলেন সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাধ্যমে। শেষ কর্মজীবন কাটান রাজধানীর মহাখালী হামিদ আলী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।

জাতীয় দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিকসহ বিভিন্ন ম্যাগাজিনে তাঁর প্রকাশিত লেখার সংখ্যা অনেক। ২০১০ সালে প্রকাশিত হয় গল্পগ্রন্থ "হিমেল অনল"। ২০১৪ সালে প্রকাশিত হয় বই "হারিয়ে যেতেও সঙ্গী লাগে", এটা চিঠির বই। ২০১৫ সালে প্রকাশিত হয় উপন্যাস "সব হারিয়ে তোমায় পেলাম"

অবসর সময় বলতে তাঁর খুব কমই ছিলো। একজন মা, একজন অভিভাবক এর দায়িত্ব পালন করে যে টুকু সময় পেতেন তিনি বই পড়তেন। নিঃসঙ্গ এই মানুষটির সঙ্গী ছিলো বই, কাগজ আর কলম। আমরা যে একজন ভালো মানুষ, ভালো মা, ভালো লেখিকাকে হারিয়েছি এ ক্ষতি অপূরণীয়। বিধাতার নিকট প্রার্থনা জীবনে যদি কোন ভালো কাজ করে থাকি তার ফলটুকু আমার মায়ের জন্য যেন তিনি দেন।