ধর্ষণের নেপথ্য কারণ কী?

মুফতি মুহাম্মাদ শোয়াইব
Published : 25 March 2016, 12:46 PM
Updated : 25 March 2016, 12:46 PM

এই লেখা যখন লেখছি, তখন বার বার মনে পড়ছিল পহেলা বৈশাখে আমার অপমানিতা ও নির্যাতিতা বোনদের কথা, যারা শ্লীলতাহানি ও বিবস্ত্রের শিকার হয়েছেন বর্ষের প্রথম দিনে। এই ন্যাক্কারজনক ঘটনায় যারা মানুষরূপী পশুগুলো দ্বারা বর্বরতার শিকার হয়েছেন, তারাই যে শুধু অপমানিত ও লাঞ্চিত হয়েছেন তা কিন্তু নয়; বরং অপমানিত হয়েছে পুরো বাংলাদেশ। ঘটনাস্থলের যারা নীরব দশর্কের ভূমিকা পালন করেছে, জানি না তারা বিবেকের কাছে কিভাবে দায় এড়াচ্ছে? এত মানুষের ভিড়ে যারা এই গর্হিত কাজটি করতে পেরেছে, তারা যে অতীত জীবনে আরও বহু ধর্ষণের অভিজ্ঞতা হাসিল করেছে, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। যেসব পুরুষ এই কলংকময় অধ্যায় রচনা করেছে, তারা সারা দুনিয়ার পুরুষদেরকেও কলংকিত করেছে।

আমাদের দেশে নারীকে অপমানিত ও নিপীড়িত করা নতুন কিছু নয়। বলা যায়, অতীত অপকর্মের ধারায় ঘটেছে পহেলা বৈশাখের অনাকাঙ্খিত ও গর্হিত ঘটনাটি। এই ঘটনায় আমাদের জতীয় চরিত্রের উলঙ্গ চিত্র ফুটে উঠেছে বিশ্ববাসীর সামনে। নারী নির্যাতন, নারী ধর্ষণ, নারীকে অপমান ও লাঞ্চিতকরণ এগুলো এখন সমাজের স্বাভাবিক চিত্র। এসব দেখতে দেখতে, খবরের কাগজে পড়তে পড়তে আমাদের সয়ে গেছে। এসব অনৈতিক কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার মানসিকতা অনেকেই হারিয়ে ফেলেছে।

নারী নির্যাতনের নেপথ্য কারণ কী এই প্রশ্নের জবাবে নারী পুরুষ একে অপরকে দোষারোপ করতে দেখা যায়। পুরুষপক্ষ বলছে, নারীর উগ্র চলাফেরা, নগ্নতা, মিডিয়ায় তাদের কামনাময়ী হয়ে উপস্থাপন পুরুষকে ধর্ষণের দিকে উদ্বুদ্ধ করছে। নারী দিন দিন নারীত্ব সংকটে পড়ছে। নারী তার নারীত্ব বর্জন করে পুরুষের ভূমিকায় আর্বিভূত হতে চাচ্ছে। নারী ঘরনী হলে যেভাবে সে পুরুষের চিত্তাকর্ষক, তেমনি বিমানের পাইলট কিংবা কর্পোরেট হাউজের এক্সিকিউটিভ হলেও সে আপন মহিমায় বিভূষিত। সে নিজেকে আকর্ষণীয় অবয়বে প্রদর্শন করলে বা কোনোভাবে প্রদর্শিত হলে পুরুষ আকর্ষিত হবেই। নারী যদি করা সেন্ট বা সুগন্ধিজাতীয় বস্তু ব্যবহার করে, উগ্র, আপত্তিকর ও যৌন উত্তেজক পোশাক পরিধান করে অসামাজিক ও অস্বাভাবিক ফ্যাশন ও সাজসজ্জায় সেজেগুজে রাস্তা দিয়ে নিতম্ব দুলিয়ে দুলিয়ে হেটে যায়, পুরুষের কামভাব জেগে উঠবেই। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এমন সব দৃশ্য দেখার পরও যদি কারও কামনা জাগ্রত না হয়, তবে তার সুস্থ্যতা নিয়েই প্রশ্ন উঠবে।

আধুনিকতার স্লোগানে নারী আজ চরম মোহগ্রস্ত ও প্রতারিত। হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতোই এক শ্রেণীর প্রতারক পুরুষ নারীকে নিক্ষেপ করছে গভীর অন্ধকূপে। নারী তার মান-ইজ্জত ও সম্ভ্রম হারিয়ে হয়ে পড়েছে চরম নিঃসঙ্গ। নারী আজ দিশে হারিয়ে দিগ্বিদিক ছুটোছুটি করছে। কোথায়ও তার আশ্রয় নেয়ার জায়গা নেই। পথের মোড়ে মোড়ে ঘাপটি মেরে বসে আছে ধোঁকাবাজ লম্পট নরপশুরা। তারা নারীকে কুড়ে কুড়ে খেতে চায়। কামড়ে খামচে তাদের কামনা নিবারণ করতে চায়। তাদেরকে বানাতে চায় কাম ও লালসাসেবী। তাদের হিংস্র ছোবল থেকে নারী নিজেকে রক্ষা করতে পারছে না।

নারীরা আজ পশ্চিমাদের অন্ধ অনুকরণে আকন্ঠ নিমজ্জিত। তাদের মতো স্কার্ট, মিনি স্কার্ট, মাইক্রো স্কার্ট পরে শরীরের আকর্ষণীয় আঙ্গগুলো প্রদর্শন করতে বেশ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। আধুনিক সাজতে গিয়ে নারীরা উগ্র ও যৌন আবেদনময়ী পোশাক পরে পাড়ায় পাড়ায় রাস্তা-ঘাটে ঘুরে বেড়ায়। এসব উদ্ভট সাজ-পোশাকে সে যখন বাইরে বের হয়, পাড়ার বখে যাওয়া উঠতি তরুণরা তাকে দেখে শিশ দেয়, হাততালি দেয়, আশালীন মন্তব্য করে, নোংরা কথা বলে আরও নানাভাবে উত্ত্যক্ত করে। নারীর প্রতি অনৈতিক চিন্তা ও কাজে সরাসরি প্রলুব্ধ হচ্ছে। এতে কর্মক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বা সহকর্মী দ্বারা লাঞ্ছিত হচ্ছে। এমনকি শিক্ষক ও সহপাঠী দ্বারাও হয়রানির শিকার হচ্ছে। ইদানিং 'লেগিংস' নামে মেয়েদের অদ্ভুত এক প্যান্টের আর্বিভাব হয়েছে। এগুলো মেয়েদের পদযুগলের সঙ্গে এতই আঁটসাট হয়ে লেগে থাকে যে, তাদের শরীরের অবয়ব স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। এসব দেখে পুরুষের দৃষ্টি কামার্ত হয়ে ওঠে।

পণ্যের বিজ্ঞাপনে নারী যেভাবে আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে প্রদর্শিত হচ্ছে, তাতে মূলত নারীই প্রধান পণ্যে পরিণত হচ্ছে। এমনকি যেসব পণ্য নারীর জন্য প্রযোজ্য নয়, সেসব পণ্যের বিজ্ঞাপনেও নারী উত্তেজক রূপে হাজির হচ্ছে। সিনেমার নায়িকা থেকে সাইড নায়িকা, নর্তকী থেকে নিয়ে টিভি সিরিয়াল ও নাটকেও নারী যেভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে তাতে নারী ভোগবাদী সমাজপতীদের তাদের ওপর উপগত হওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে। ইন্টারনেট এবং গণমাধ্যমে নারী যৌন আবেদনময়ী ও উপভোগ্য হয়ে উপস্থাপিত হচ্ছে। এসবই ধর্ষণ ও নারীর যৌন হয়রানিকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। মোটকথা ধর্ষণ বৃদ্ধির নেপথ্য কারণ হিসেবে পুরো দোষটা কিন্তু নারীর ঘাড়েই পড়ছে। অর্থাৎ নারীই পুরুষকে তার ওপর উপগত হতে সুযোগ সৃষ্টি করে দিচ্ছে।

অপরদিকে নারী পক্ষ বলছে, নারী যেভাবেই চেলাফেরা করুক সেটা তারা করতেই পারে। পুরুষের মানসিকতা ঠিক করলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। কারণ ৪-৫ বছরের যে নিষ্পাপ শিশুটি ধর্ষিতা হয়, তার তো শারীরিক নগ্নতা প্রদর্শনের কিছু নেই। সেও কিন্তু ধর্ষিতা হচ্ছে। বুঝা গেল নারীর অবাধ নগ্নতা প্রদর্শনই ধর্ষণ বৃদ্ধির আখেরি কথা নয়। পুরুষ নারীর প্রতি আকর্ষিত হওয়ার কারণে যদি ধর্ষণ হয়, তাহলে সমাজের সব পুরুষই ধর্ষণে উদ্বুদ্ধ হত। তা তো হচ্ছে না। সবাইতো নারীকে কামনা করে জোর করে ভোগ করার প্রচেষ্টা চালায় না; বরং অতি অল্প কিছু বিকারগ্রস্ত মানুষ এই জঘন্য কর্মে লিপ্ত হয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা, পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ও পুরুষরা বলবান হওয়ার কারণে পুরুষরা নারীকে লালসা মেটানোর সবচেয়ে নমনীয় শিকার হিসেবে ভাবে। তাছাড়া ধর্ষকদের উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত না হওয়ার কারণেও পুরুষ ধর্ষনকর্মে সাহস পেয়ে যায়।

নারীকে নিয়ে বাণিজ্যিকীকরণ, বিজ্ঞাপন ও ইভেন্টে নারীকে ক্রমাগত দেহসর্বস্ব যৌন লালসার ভোগ্যপণ্য হিসেবে উপস্থাপন পুরুষকে ধর্ষণের দিকে উদ্বুদ্ধ করে। মোবাইল কোম্পানির সিম বিক্রি থেকে নিয়ে জুস, আচার, কোল্ড ড্রিঙ্কস, দাঁত মাজার পেস্ট, গায়ে মাখার সাবান, বাড়ি তৈরির সিমেন্ট, গাড়ি, বাড়ি সব বিজ্ঞাপনে নারীকে উপস্থাপন করা হয় আবেদনময়ী করে। আবার পত্রিকার কাটটি বাড়াবার জন্য নগ্ন দেহের সুন্দরী মডেলের ছবি প্রচারিত হয়। তাছাড়া মোবাইল ইন্টারনেটে পুরুষরা যে পর্নো ভিডিও ছড়িয়ে দিচ্ছে, উঠতি তরুণ থেকে শুরু করে অনেক যুবকরাও এসবের প্রতি আসক্ত। তারা এগুলো দেখে দেখে শরীরে যে উত্তাপ অনুভব করে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে ধর্ষণের মাধ্যমে। প্রশ্ন হচ্ছে এ কাজগুলো করছে কারা? এ কাজগুলো করছে পুরুষরা। আরও খুলে বললে বলতে হয়, আমাদের দেশের কর্পোরেট ব্যবসায়ী ও সমাজের সবচে উঁচুশ্রেণীর শিক্ষিত লোকজন ও কথিত সুশীল সমাজ। সুতরাং ধর্ষণের পেছনের সব দায় নিতে হবে পুরুষদের।

কেউ আবার দোষাদুষি বাদ দিয়ে অন্যভাবে ভাবছেন। তাদের ধারণা, সামাজিক অজ্ঞতা ও কুসংস্কার পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা ও নানা কুসংস্কারকে দায়ী করেন। কেউ কেউ আবার এর সঙ্গে ধর্মকে টেনে আনার জোর প্রচেষ্টা চালান। তারা নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা ও নারী স্বাধীনতায়ও ধর্মকেই বড় প্রতিবন্ধক হিসেবে দেখানোর চেষ্টা চালান। এমনকি সামাজিক কুসংস্কারের মতো ধর্মীয় কুসংস্কার নামেও একটি ধারণাকে সামাজ-হৃদয়ে বদ্ধমূল করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।

কিন্তু আফসোসের বিষয় হলো, সমাজের যারা ধর্মকে নারী উন্নতি ও প্রগতির অন্তরায় মনে করেন, তারা কিন্তু সিনেমার পোস্টার, বিলবোর্ড, পত্র-পত্রিকার বিনোদন পাতায় নারীর নগ্ন ছবি প্রদর্শন, অশ্লীল নৃত্য, বিয়ে বর্হিভূত অবৈধ প্রেম ও শারীরিক সম্পর্ক ও অবাধ যৌনতার বিরোধিতা কখনো করেন না বা করতে দেখা যায় না। বরং এগুলোকেই প্রগতি ও আধুনিকতা সাব্যস্ত করে এর বিরোধিতাকারীদের পশ্চাতপদ ও প্রগতিবিরোধী কিংবা মৌলবাদী বলে বিষোদগার করতে দেখা যায়।

আবার কারও ধারণা, ছেলেবন্ধু আর মেয়েবন্ধু নামে যে নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশার সংস্কৃতি তৈরী হয়েছে, তাও পুরুষকে ধর্ষণে উদ্বুদ্ধ করে। কারণ প্রতিটি পুরুষ যৌন তাড়নায় কাতর। প্রতিটি পুরুষের ভেতরই বাস করে একজন কুৎসিত ধর্ষনকামী মানুষ। যখনই সে সুযোগ পায় সে তার মোক্ষম সুযোগটি কাজে লাগায় এবং তার আসল রূপে আর্বিভূত হয়। সে শুধু একটি মোক্ষম সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। নারীর কাছ থেকে তার লালসা মেটানোর জন্যই সে শুধু ছেলেবন্ধুর ভান করে।

মোটকথা নারী ধর্ষণ দিন দিন বেড়েই চলছে। বিবাহিত নারীদের প্রতি চারজনের একজন স্বামীর নির্যাতনের শিকার। বিশেষত নারীকে পণ্য করে বাজারে তোলার যে সংস্কৃতি চালু হয়েছে তা ধর্ষণ-নির্যাতনের অন্যতম কারণ। ধর্ষণ একটি রিপাতাড়িত লিপ্সা। মানুষ যখন বিপরিত লিঙ্গের প্রতি প্রবল আকর্ষিত হয় তখন সে ধর্ষণে উদ্বুদ্ধ হয়। তবে প্রশ্ন হচ্ছে ধর্ষকরা কি জন্মগতভাবেই ধর্ষণকর্মে অভ্যস্ত হয়? ধর্ষক চাই পুরুষ হোক বা নারী, জন্মগতভাবেই কেউই বোধ হয় ধর্ষণকর্মে উদ্বুদ্ধ হয়ে জন্মগ্রহণ করে না। মূলত পরিবেশ-পরিস্থিতি পারিবারিক অবস্থান, কর্মক্ষেত্রসহ অনেক কিছুর সমন্নয়ে মানুষ ধষর্ণে প্রলুব্ধ হয়ে ওঠে। ধর্ষণ মানুষের সাধারণ কোনো আচরণ নয়। এটি হচ্ছে অস্বাভাবিক আচরণ ও বিকারগ্রস্ততার বহিঃপ্রকাশ। বিকারগ্রস্ত মানুষের পক্ষেই কেবল ধর্ষণের মতো অসামাজিক ও কুরুচিপূর্ণ আচরণ করা সম্ভব।

অনেক প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী মনে করছেন, এসব সামাজিক ব্যাধি ছড়িয়ে পড়ার পেছনে কারণ হলো অশিক্ষা ও দারিদ্র্য। অনেকে আবার এসব সমস্যার মূলে আইনের কঠোর প্রয়োগ না থাকাকেই দায়ী করেন। চলুন দেখা যাক আসল রহস্যটা কোথায় ?

অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, ধর্ষণকর্মে সাধারণত পুরুষরাই লিপ্ত হয়। নারীরা সাধারণত ধর্ষকের ভূমিকায় থাকে না। তবে তাদের দ্বারা যেটা হয়, সেটা হলো ধর্ষণকর্মে মৌন সমর্থণ বা পুরুষকে উপগত হতে খানিকটা সুযোগ করে দেয়া। তবে নারী সৃষ্টিগত লজ্জা, সামাজিক অবস্থান, পারিবারিক বিধি-নিষেধ ইত্যাদি কারণে সরাসরি বিপরিত লিঙ্গের সঙ্গে উপগত হতে বাধাপ্রাপ্ত হয় বা নিবৃত থাকে। তবে পুরুষ কিছুটা বলবান, সামাজি অবস্থান দৃঢ়, সমাজ পুরুষ শাসিত, সৃষ্টিগতভাবে পুরুষ কিছুটা রুক্ষ স্বাভাবের ইত্যাদি কারণ বিবেচনায় পুরুষকেই ধর্ষকের ভূমিকায় দেখা যায়। ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়। তবে তার মাত্রা একেবারেই কম। দু'একটি যা হয় তাও অনভিপ্রেত ও অপ্রত্যাশিত। সুতরাং বলা যায়, পুরুষরাই ধর্ষণকর্ম করে থাকে। প্রশ্ন হচ্ছে পুরুষরা তো আর জন্মগতভাবে ধর্ষক হয়ে জন্মগ্রহণ করেন না। তাহলে কেন তারা ধর্ষণের প্রতি আর্কষিত হয়ে পড়েন ?

নারীকে মহান আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টিগতভাবেই সুন্দর দেহ-সৌষ্ঠব দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। তার চাল-চলন, কথা-বার্তা, হাসি-ঠাট্টা ও চাহনি সব কিছুতেই একটা আকর্ষণভাব থাকে। সুতরাং নারী যখন তার আকর্ষণীয় বিষয়গুলো প্রদর্শণ করে তখন পুরুষরা আকর্ষিত হবে এটা স্বাভাবিক ব্যাপার।

নারীকে পণ্য করে উপস্থাপনের যে প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে তার জন্য দায়ী কারা? মসজিদের ইমাম সাহেব নাকি টিভি টকশোতে নিয়মিত যারা প্রগ্রাম করে জাতির উন্নত বিবেক সাজেন, সেই ভদ্র নামের কথিত অভদ্র লোকগুলো। একটি মোবাইল কোম্পানি তাদের বিলবোর্ড টানাবে সেখানেও তিন তিনটি মেয়েকে উগ্রবাচনভঙ্গিতে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়েছে। নৌকায় দেয়ার জন্য আলকাতরা কিনলেও সেখানে একটি নারী যৌনআবেদনময়ী ভঙ্গিতে দাঁড়িতে থাকতে দেখা যায়। আধিনিকতা আমাদের সমাজমানসে এমনভাবে ঢুকেছে যে, এখন সভ্যতা ভব্যতা বলতে কিছু নেই। পশ্চিমারা যাই পাঠাচ্ছে, আমাদের ছেলেমেয়েরা ও যুবক-যুবতীরা সেগুলোকেই দেদারছে গিলছে। যৌনআবেদনময়ী ও আঁটসাট পোশাক পরে, নগ্ন, অর্ধনগ্ন হয়ে ঘুরে বেড়ানোর সংস্কৃতি আমাদের ছেলে-মেয়েরা যেভাবে রপ্ত করেছে, তাতে বিপরিত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষিত হওয়ার বহু কারণ রয়েছে। নারীর প্রদর্শণীয় অঙ্গগুলোকে প্রদশর্ণ করলে পুরুষের ভেতর অবশ্যই কামভাব জাগবে। মোবাইল ইন্টারনেটের এই যুগে পর্নো ভিডিও খুবই সস্তা একটি অনুষঙ্গ। ইন্টারনেটের কল্যাণে এসব চরিত্র বিধ্বঃসী ভিডিও হাতের নাগালে পেয়ে যুবকরা সেগুলো দেখে দেখে শরীরের ভেতর যে উত্তাপ অনুভব করে তা প্রশমনের জন্য বেঁছে নেয় ধর্ষণের মতো কুকর্ম। সুতরাং ভেতরে চিকিৎসা না করে ওপরে যতই মলম লাগানো হোক, ধর্ষণ তাতে কিছুতেই বন্ধ হবে না।

একটি চরম সত্য কথা হলো, আমাদের বুদ্ধিজীবীরা টিভি-টকশোতে যে যত পদ্ধতি আবিস্কার করেন, কোনো কিছুতেই ধর্ষণ নামক সামাজিক ব্যাধি বন্ধ হবে না। হওয়ারও নয়। যার প্রমাণের জন্য কারও চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়ার প্রয়োজন বোধ করি না। সত্য কথা হলো, তরুণ সমাজে যতদিন ইসলাম চর্চিত না হবে, ততদিন এই ধরনের অপরাধগুলো বন্ধ হবে না। ইসলামই হচ্ছে আসল মুক্তির সনদ। অপসংস্কৃতির প্রভাব যে হারে বাংলাদেশের আকাশ-বাতাসকে গ্রাস করে চলেছে, তা এক কথায় ভয়াবহ। সাথে সাথে মানুষের দৈনন্দিন জীবন থেকে পাল্লা দিয়ে অপসৃত হচ্ছে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও নৈতিক আদর্শ। সে শূন্যস্থান পূরণ করছে মানুষের জৈবিক ও পাশবিক চিন্তাধারা। মানুষের সবকিছুতে জৈবিক চিন্তাধারা ঢুকে যাওয়ার কারণে নৈতিক অবক্ষয় ও অধঃপতন এমনভাবে তরান্বিত হচ্ছে, যার কারণে মানুষের মনুষত্বশক্তি লোপ পেয়ে সেখানে আসন গেড়ে বসেছে পাশবিকশক্তি। ফলশ্রুতিতে আজ নারী ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, নারী অপহরণ ও নারীকে লাঞ্চিত ও অপমানিতকরণ ইত্যাদি অপরাধগুলো সমাজকে কুরে কুরে খাচ্ছে।

ধর্ষণ এমন এক প্রবণতা যা ধর্মীয়, সামাজিক, ও আদর্শিক সব মাপকাঠিতেই জঘন্যতম অপরাধ। শুধু ইসলামই নয়; বরং সব ধর্ম ও মানুষের কাছে এটি সবার্ধিক ঘৃণিত বিষয় বলেই বিবেচিত হয়ে আসছে। আমাদের সমাজে এ ধরনের নৈতিক অপরাধ-প্রবণতা দিন দিন বেড়েই চলছে। অপরাধ দমনের জন্য বহু আইন তৈরি করা হচ্ছে; কিন্তু তা অপরাধ দমনে কার্যকর ও ফলপ্রসূ ভূমিকা পালন করতে পারছে না। ইসলামের দৃষ্টিতে অপরাধ দমনের প্রধান ও ফলপ্রসূ ব্যবস্থা হলো তাকওয়া বা আল্লাহর ভয় মানুষের অন্তরে জাগিয়ে তোলা। ইসলাম ব্যক্তির মনমানসিকতায় আল্লাহর ভয় ও পরকালের জবাবদিহিতার প্রত্যয় সৃষ্টি করার প্রতিই বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। মানুষকে পরিস্কারভাবে একথা বোঝানোর চেষ্টা করেছে যে, যত সংগোপনেই সে অপরাধ করুক না কেন, আল্লাহ তায়ালা তা দেখেন। পরকালে আল্লাহর কাছে এ জন্য তাকে জবাবদিহি করতে হবে। পরকালে ভালো-মন্দ বিচারের মাপকাঠি হবে তাকওয়া বা আল্লাহর ভয়। যার ভেতর আল্লাহর ভয় যত বেশি থাকবে সে তত বেশি আল্লাহর নৈকট্য ও ভালোবাসা লাভ করবে। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'তোমাদের মাঝে সে ব্যক্তিই আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয় ও সম্মানিত যে তোমাদের মাঝে অধিক মুত্তাকী।' (সুরা হুজরাত : ১৩)

মানব জীবনে তাকওয়ার গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে মহান আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন, 'আর যে ব্যক্তি তার রবের সামনে উপস্থিত হওয়ার ভয় রাখে এবং নিজেকে কু-প্রবৃত্তি থেকে ফিরিয়ে রাখে নিশ্চয়ই জান্নাত হবে তার আবাসস্থল।' (সুরা নাযি'আত: আয়াত ৪০-৪১।

অন্য আয়াতে আছে, 'তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। আর মনে রেখ, নিশ্চয় তিনি মুত্তাকিদের সঙ্গে আছেন।' (সুরা বাকারা: আয়াত ১৯৪)।

বস্তুত মানুষের মাঝে যদি এই ভয় উপস্থিত থাকে যে, কারও ইজ্জত লুণ্ঠন করলে, কাউকে ধর্ষণ করলে, কাউকে উত্তক্ত করলে আল্লাহ তায়ালার কাছে একদিন এর জবাব দিতে হবে এবং কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে, তবেই সে যাবতীয় অন্যায়-অনাচার থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হবে। পাবন্দির সঙ্গে আল্লাহ তায়ালার হুকুম মানা তার জন্য সম্ভব হবে। তাই ইসলাম সব ধরনের অপরাধ-প্রবণতা দমনের জন্য মানুষের মনে তাকওয়ার বীজ বপন করার মনোভাব পোষণ করে। কারণ অপরাধ দমনে এটিই কার্যকর ও ফলপ্রসূ ব্যবস্থা।

হযরত ওমর (রা.) এক রাতে মানুষের খোঁজখবর নেয়ার জন্য মদিনার অলিগলিতে টহল দিচ্ছিলেন। হঠাৎ তিনি একটি ঘর থেকে কথাবার্তার শব্দ শুনতে পেলেন। কথাবার্তার ধরন শুনে তার কৌতূহল হল। তিনি ঘরের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ালেন এবং শুনতে পেলেন, এক বৃদ্ধা তার মেয়েকে বলছে, 'বেটি ! আজ তো উটের দুধ কম হয়েছে। দুধের সঙ্গে একটু পানি মিশিয়ে দাও।' মেয়ে উত্তরে বলল, 'মা ! আমিরুল মুমিনীন তো দুধের সঙ্গে পানি মেশাতে নিষেধ করেছেন।' বৃদ্ধা বলল, 'আমিরুল মুমিনীন কি আমাদের দেখছেন? তিনি হয়ত নিজ ঘরে ঘুমিয়ে আছেন। তুমি নিশ্চিন্তে পানি মেশাতে পার।' এবার মেয়ে বলল, 'মা! আমিরুল মুমিনীন এখানে নেই এবং তার কোনো লোকও নেই। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তো আছেন। তিনি তো দেখছেন। তার কাছে কী জবাব দেব? এই ঘটনায় আমরা দেখতে পাই যে, একটি সাধারণ মেয়ের অন্তরে মহান আল্লাহ তায়ালার ভয় থাকার কারণে রাতের অন্ধকারেও সে অন্যায় থেকে বিরত থেকেছে।

মোটকথা, মানুষের অন্তরে যদি সর্বক্ষণ এই চিন্তা জাগরুক থাকে যে, মহান আল্লাহ তায়ালা আমাকে দেখছেন, তাহলেই সে নিজেকে যাবতীয় অন্যায়-অনাচার ও পাপ-পঙ্কিলতা থেকে পূত-পবিত্র রাখতে পারে। এই অনুভূতির নামই তাকওয়া। তাই প্রথমত, সামাজিক অপরাধ দমনের জন্য সমাজের সর্ব স্তরে তাকওয়া-পরহেযগারী প্রতিষ্ঠা করার প্রতি আমাদের সবাইকেই সচেষ্ট হতে হবে। দ্বিতীয়ত, ধর্ষণ, ব্যভিচার ইত্যাদি নৈতিক অপরাধের ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে মানব জাতিকে রক্ষা করার জন্য ইসলাম এর কঠিন শাস্তির বিধান দিয়েছে। কাজটি যেমন জঘন্য, শাস্তিও তেমন কঠিন। উদ্দেশ্য হলো এই পাপের উৎসমূল চির রুব্ধ করে দেওয়া। ব্যভিচারীর অবস্থাভেদে ব্যভিচারের শাস্তিও একটু ভিন্ন। ব্যভিচারী নারী-পুরুষকে একশ'টি বেত্রাঘাত অবস্থাভেদে পাথর মেরে প্রাণনাশের বিধান দেয়া হয়েছে। যিনাকারী যদি বিবাহিত হয় তাহলে তাদেরকে প্রস্তাঘাতে মৃত্যুদন্ড দেয়া হবে। আর ব্যভিচারী যদি অবিবাহিত হয়, তাহলে তাদেরকে প্রকাশ্যে একশত বেত্রাঘাত করা হবে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, 'ব্যভিচারী নারী, ব্যভিচারী পুুরুষ, তাদের প্রত্যেককে একশ' করে বেত্রাঘাত কর। আল্লাহর বিধান কার্যকরকরণে তাদের প্রতি তোমাদের মনে যেন দয়ার উদ্রেক না হয়। যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি ও পরকালের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে থাক। (সুরা নুর : ২)। হাদীস শরীফে আছে, অবিবাহিত পুরুষ-নারীর ক্ষেত্রে শাস্তি একশ বেত্রাঘাত এবং এক বছরের জন্য দেশান্তর। আর বিবাহিত পুরুষ-নারীর ক্ষেত্রে একশত বেত্রাঘাত ও রজম (পাথর মেরে মৃত্যুদন্ড)- (সহীহ মুসলিম)।

ধর্ষণকারী অবিবাহিত হলে অন্য মাজহাবের ফকিহদের মতে তার শাস্তি হলো দুটি। ১. একশ' বেত্রাঘাত। ২. এক বছরের জন্য দেশান্তর। অবশ্য হানাফী মাজহাব মতে ধর্ষণকারী যদি অবিবাহিত হয়, তবে তার হদ বা শরিয়ত নির্ধারিত শাস্তি হলো, একশ' বেত্রাঘাত। আর দেশান্তরের বিষয়টি বিচারকের বিবেচানাধীন। তিনি ব্যক্তি বিশেষে তা প্রয়োগ করতে পারেন। অবশ্য ধর্ষণের মাঝে যেহেতু ধর্ষক অপরাধী হয় আর ধর্ষিতা নির্যাতিত হয়, তাই ধর্ষণের ভেতর শুধু ধর্ষকের শাস্তি হবে। ধর্ষক এখানে দুই ধরনের শাস্তি পাবে। যেহেতু তিনি একদিকে যিনা করে থাকে, অন্য দিকে আবার বলপ্রয়োগ বা ভীতি প্রদর্শন করে থাকে, তাই তিনি দুই ধরনের শাস্তি পাবেন। যিনার শাস্তি পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। আর ভীতিপ্রদর্শনের জন্য মুহারাবা তথা ভীতি প্রদর্শন করে ডাকাতি করার শাস্তি পাবে। মুহারাবার শাস্তির ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, 'যারা আল্লাহ ও তার রাসুলের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে এবং দেশে হাঙ্গামা সৃষ্টি করতে সচেষ্ট হয়, তাদেও শাস্তি হচ্ছে এই যে, তাদের হত্যা করা হবে অথবা তাদেরকে শূলীতে চড়ানো হবে। অথবা তাদের হস্তদ্বয় বিপরীত দিক থেকে কেটে দেয়া হবে অথবা দেশ থেকে বহিস্কার করা হবে। এটি হলো তাদের জন্য পার্থিব লাঞ্ছনা আর পরকালে তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি। (সুরা মায়িদা : ৩৩)

মোটকথা ইসলাম ধর্ষণ বন্ধ করার জন্য কঠিন শাস্তির বিধান দিয়েছে। সুতরাং কেউ অপরাধী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যদি ইসলাম নির্দেশিত শাস্তি প্রয়োগ করা হয়, তবে মানুষ ভয়ে হোক আর যেভাবেই হোক এ ধরনের অনৈতিক কাজ থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হবে।

সমাজে দুর্নীতিই এখন নীতি, অশ্লীলতাই এখন শ্লীলতা, অসভ্যতা-বর্বরতাই সভ্যতা হিসাবে পরিগণিত হচ্ছে। আর ন্যায়বিচারের বাণী তো সমাজের সবচেয়ে নিচু তলার বাসিন্দা। সুতরাং এটা সুস্পষ্ট যে, সংস্কৃতির যে শ্লোগান ক্ষণে ক্ষণে উচ্চারিত হচ্ছে সেমিনার-মিডিয়ায় সর্বত্র তা অর্থহীন ফাঁপা কিছু বুলি মাত্র। যার বাস্তবতা নেশা ধরানো রং-তামাশা, আনন্দ-উন্মাদনা উপভোগের মত অমৌল বিষয়কে ঘিরেই পরিবৃত্ত, রিপুচর্চাই যার মূখ্য উদ্দেশ্য। মৌলিক যে সংস্কৃতি মানবের মন ও মননের বিকাশ ঘটায়, চেতনারাজ্যকে রুচিবোধ, আত্মমর্যাদা, সৃজনশীলতার আলোচনায় উদ্ভাসিত করে, সর্বোপরি মানুষকে মানুষ হিসেবে, গড়ে ওঠার প্রেরণায় উজ্জীবিত করে তা দেওয়ার ক্ষমতা প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় নেই।

সম্পাদক, মাসিক আরবি ম্যাগাজিন 'আলহেরা'