মজুদদার নিকৃষ্টতম ব্যক্তি

মুফতি মুহাম্মাদ শোয়াইব
Published : 29 June 2016, 03:51 PM
Updated : 29 June 2016, 03:51 PM

রমজান মাস আসার আগেই আমাদের দেশের একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী অবৈধভাবে খাদ্যদ্রব্যের কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে মূল্য বাড়িয়ে দেয়। এ ক্ষেত্রে না তারা অর্থনীতির নিয়মনীতির তোয়াক্কা করে, না তারা নীতিনৈতিকতার ধার ধারে। বিশেষ করে রমজান মাস কেন্দ্র করে এ ধরনের অসাধু কাজ বেশি হয়। রমজানে ফলমূল, শাকসবজি, মাছ-গোশতসহ যেসব খাদ্যপণ্যের চাহিদা বেশি থাকে, সেসব খাদ্যপণ্যের দাম শাঁ শাঁ করে বেড়ে যায়। খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি বিত্তবানদের জীবনমানে কোনো ধরনের প্রভাব না ফেললেও এর অসহায় শিকার হয় নিরীহ গরিব-দুঃখী ও ধর্মপ্রাণ মানুষ। যাদের কাছে অনৈতিক বিত্তের প্রাচুর্য মজুদদার নিকৃষ্টতম ব্যক্তিনেই। সব কিছু দিন এনে দিন খাওয়া অসহায় গরিব লোকদের হাতের নাগালে চলে যায়। এতে তাদের জীবন গভীর সঙ্কটে পড়ে। সংসার চালাতে তারা রীতিমতো হিমশিম খায়।
এমনিতেই আমাদের দেশে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা বর্তমান দামেই সংসার চালাতে হিমশিম খায়, তার ওপর আবার রমজান উপলক্ষে নতুন করে দ্রব্যমূল্য বাড়লে তাদের জীবনমানের কী অবস্থা হয় তা সহজেই অনুমেয়। তা ছাড়া রমজান মাসে একজন রোজাদার সারা দিন রোজা রেখে, হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে যে টাকা আয় করেন, সে টাকা দিয়ে তিনি পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্যদ্রব্য কিনতে পারে না। এতে সেই রোজাদার সারা দিন অভুক্ত রোজা রাখে। রোজাদারের এই অভুক্ত থাকার পেছনে কি অতিরিক্ত মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা দায়ী নয়? এই শ্রেণীর ব্যবসায়ীদের একটু মানবিক দিক থেকে ভাবা উচিত যে, তার সন্তান বা বাবা-মা যদি এরকম অভুক্ত থাকার যন্ত্রণায় ছটফট করত তাহলে সে কি শান্তি পেত? তা হলে অন্যদের স্বেচ্ছায় কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে বিশেষত আল্লাহ তায়ালার মেহমান ও প্রিয় বান্দাদের কষ্ট দেয়ায় তাদের কতটুকু লাভ হয়?
সারা দিনের অভুক্ত রোজাদারকে যদি ইফতার ও সাহরিতে একটু তৃপ্তি দিয়ে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি হাসিল করা যায়, তাহলে তো তা আখেরাতের অনেক বড় প্রাপ্তি। কেয়ামতের দিন, যে দিন আমলের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হবে, সে দিন এই ছোট ছোট আমলই বেশি কাজে লাগবে।
তাই ছোট নেক কাজকে ছোট বলে অবজ্ঞা করা উচিত নয়। ছোট ছোট নেক আমলের প্রতি মনোযোগ না দেয়ার কারণে বা সেগুলোকে তুচ্ছ জ্ঞান করার কারণে অনেক বড় প্রাপ্তি থেকে আমরা বঞ্চিত হয়ে যাই। কুরআন কারিমে বলা হয়েছে, 'সে দিন মানুষ বিভিন্ন দলে প্রকাশ পাবে, যাতে তাদের কৃতকর্ম দেখানো যায়। এরপর কেউ অণুপরিমাণ সৎ কর্ম করলে তা দেখতে পাবে এবং কেউ অণুপরিমাণ অসৎ কর্ম করলে তাও দেখতে পাবে'। (সূরা যিলজাল : ৬-৮) হাদিস শরিফে রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেন, 'কোনো সৎ কাজকে কখনোই তুচ্ছ জ্ঞান করো না। যদিও তা হয় তোমার ভাইয়ের সাথে হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় সাক্ষাৎ করা।' (সহিহ মুসলিম ২/৩২৯)
রমজান মাস মূলত আল্লাহ তায়ালার অবারিত রহমত ও করুণার মাস। এ মাসে আল্লাহ তায়ালা নিজেই দুর্বৃত্ত শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে তার প্রিয় বান্দার ইবাদত-বন্দেগির সুযোগ করে দেন। সেখানে আমরা বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে সেই সুযোগ থেকে রোজাদারদের বঞ্চিত করি। এটা এক দিকে যেমন রোজাদারের জন্য অশনি সঙ্কেত অন্য দিকে মহান আল্লাহ তায়ালার সাথে ধৃষ্টতা প্রদর্শনের শামিল।
অবশ্য এটা ঠিক যে, ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করবেন, কারণ ব্যবসাই তাদের জীবিকা নির্বাহের একমাত্র মাধ্যম। কিন্তু তাদের সাথে সাথে এটাও স্মরণ রাখতে হবে যে, রমজানে আল্লাহ তায়ালার বান্দারা ইবাদত বন্দেগি করে। তার ইবাদত বন্দেগিতে কোনোভাবে বাধা দেয়া অনেক বড় অন্যায়। এই মুহূর্তে তাদের সঙ্কটে ফেলে দেয়ার অর্থ হলো সরাসরি আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণ করা। আর আল্লাহ তায়ালার বিরুদ্ধাচরণ করলে কী করুণ পরিণতি বরণ করতে হবে তা সবারই জানা।
খাদ্যদ্রব্য মজুদ রেখে দাম বাড়ানো ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ নাজায়েজ। ইসলাম মজুদদারি কালোবাজারির ব্যাপারে কঠোর শাস্তির ঘোষণা দেয়। রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেন, 'কেউ যদি মূল্যবৃদ্ধির লক্ষ্যে মুসলমানদের থেকে নিজেদের খাদ্যশস্য আটকে রাখে (মজুদদারি করে), তবে আল্লাহ তার ওপর মহামারী ও অভাব চাপিয়ে দেন।' (ইবনে মাজা ও বাইহাকি, সূত্র : মিশকাত পৃ: ২৫১) অন্য হাদিসে আছে, 'যে ব্যক্তি মূল্য বাড়ানোর উদ্দেশ্যে ৪০ দিন পর্যন্ত খাদ্যশস্য মজুদ রাখে, সে আল্লাহ তায়ালার দায়িত্ব থেকে মুক্ত এবং আল্লাহ তায়ালা তার প্রতি অসন্তুষ্ট।' (মিশকাত পৃ: ২৫১) রাসূলুল্লাহ সা: আরো ইরশাদ করেন, 'মজুদদার ব্যক্তি খুবই নিকৃষ্টতম ব্যক্তি। যদি জিনিসপত্রের দাম হ্রাস পায়, তবে তারা চিন্তিত হয়ে পড়ে। আর যদি দাম বেড়ে যায়, তবে আনন্দিত হয়।' (বাইহাকি, সূত্র : মিশকাত পৃ: ২৫১)
আরেক শ্রেণীর ব্যবসায়ী ভাইয়েরা খাদ্যে ভেজাল সৃষ্টি করে। বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করে তারা অধিক মুনাফা হাতিয়ে নেয়। আর রোজাদারেরা সেসব বিষাক্ত খাদ্য খেয়ে নানা অসুখ-বিসুখে আক্রান্ত হন। অনেকে ব্যস্ততার কারণে রাস্তাঘাটে হোটেল রেস্তোরাঁয় ইফতার করে থাকেন, এই নিম্নমানের বিষাক্ত খাবার খেয়ে রোজাদারেরা দীর্ঘস্থায়ী রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হন। অনেক সময় এর প্রভাব রোজাদারের রোজায় পড়ে। তাই ব্যবসায়ী ভাইয়েরা এই মানবিক দিকটির দিকে একটু লক্ষ্য করলে অন্তত রমজান মাসে রোজাদার নিরাপদ খাবার লাভ করতে পারে।
এ প্রসঙ্গে হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সা: একবার এক বাজারের খাদ্যদ্রব্যের স্তূপের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর হাত খাদ্যদ্রব্যের ভেতর ঢুকিয়ে দেন। ফলে হাতে কিছুটা আর্দ্রতা অনুভূত হয়। তিনি খাদ্য বিক্রেতাকে জিজ্ঞেস করেন, এই আর্দ্রতা কিভাবে এলো? বিক্রেতা বলে, এই খাদ্যস্তূপের ওপর বৃষ্টি পড়েছিল। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, তুমি ভেজা খাদ্যদ্রব্যকে ওপরে রাখলে না কেন? যাতে ক্রেতারা তা দেখতে পায়। জেনে রেখো! যে ব্যক্তি মানুষকে ধোঁকা দেয় সে আমার উম্মত নয়। (মুসলিম শরিফ)
ব্যবসায়ী ভাইদের আরো একটি বিষয় খেয়াল রাখা উচিত, এই দুনিয়ার ব্যবসাই সব কিছু নয়। আমাদেরও এক দিন হাজিরা দিতে হবে মহান আল্লাহর দরবারে। সে দিন তিনি যদি আমাদের সঙ্কটে ফেলে দেন তাহলে আমাদের কী উপায় হবে? এসব কথা চিন্তায় রেখে ভোক্তাসাধারণের প্রতি কিছুটা সংযমী হন, রোজাদারদের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করুন।
সম্পাদক, মাসিক আরবি ম্যাগাজিন 'আলহেরা'