প্রসঙ্গঃ সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়

মুহাম্মাদ আমানুল্লাহ
Published : 2 Dec 2012, 05:20 AM
Updated : 2 Dec 2012, 05:20 AM

কয়েকমাস আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষকদের পদ মর্যাদা দ্বিতীয় শ্রেণিতে উন্নীত করার ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি এই ঘোষণা দেয়ার পর পরই সেদিন সন্ধ্যায় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করে। বিষয়টি বেশ ইতিবাচক বলে দেশের সাধারণ মানুষ মনে করেন। জানা যায়, এ নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে। কারণ, তাঁদের কেউ কেউ প্রথম শ্রেণীর পদমর্যাদা প্রত্যাশা করেছিলেন। এমন কি অতিসম্প্রতি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষকদের একটি সংগঠন তাঁদের পদ মর্যাদা প্রথম শ্রেণিতে উন্নীত করা, আলাদা মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর স্থাপন ও শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর বাস্তবায়ন এই তিনটি দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আবার আন্দোলন শুরু করেছে।

শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে কোনো কোনো ক্ষেত্রে পিতা-মাতা ও অভিভাবকের চেয়ে শিক্ষকদের ভূমিকা অনেক বেশি-এ বিষয়ে আমরা সবাই একমত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সেদিন আরো বলেন, 'এ জন্য পড়াশোনার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের নৈতিকতার বিষয়ে শিক্ষা দিতে হবে। তাদের সৃজনশীলতা বিকাশে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক চর্চার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।' সরকার দেশের ক্রমবর্ধমান শিক্ষার্থীর সংখ্যা বিবেচনায় এনে জেলা শহরে অবস্থিত ৮৩টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শিফট চালু করেছে। এসব বিদ্যালয়ে সুষ্ঠু পাঠদান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দ্বিতীয় শিফটের জন্য আলাদাভাবে প্রায় দুই হাজার শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এসব

ইতিবাচক পদক্ষেপের পরও দেশের ৩১৭ টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় বহুমাত্রিক সমস্যায় আক্রান্ত। বছরের শুরুতে এক এক স্কুল এক এক শ্রেণিতে ছাত্র ভর্তির মাধ্যমে এ শিক্ষা কর্মসূচিতে সমন্বয়হীনতা শুরু হয়। এখানে স্কুল ভেদে মাধ্যমিক শ্রেণিগুলোর পাশাপাশি প্রাথমিক পর্যায়ের শ্রেণিগুলোতেও ছাত্রছাত্রী ভর্তি করা হয়। যা কোন ভাবেই কাম্য নয়। স্কুলগুলোতে প্রাথমিক আর মাধ্যমিক শ্রেণিসমূহ এক সঙ্গে থাকায় এক ধরনের বিশৃংখলা তৈরি হয়। আবার ভর্তি পরীক্ষা, ভর্তি নীতিমালার ঘন ঘন পরিবর্তন ও ছাত্রছাত্রী ভর্তিতে অপ্রত্যাশিত হস্তক্ষেপ বিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক কার্যক্রমকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে। প্রধান শিক্ষক ও সহকারি প্রধান শিক্ষকের পদগুলো অবাঞ্চিতভাবে দীর্ঘদিন খালি পড়ে থাকে। এই দুইপদে সরাসরি নিয়োগ বিলম্বিত না হলেও নিয়মিত পদোন্নতির ক্ষেত্রে দীর্ঘ জটিলতা লক্ষনীয়। মাধ্যমিক শিক্ষায় এই দীঘসূত্রিতা এক ধরনের শূন্যতা সৃষ্টি করে –যা প্রশাসনে ও শিক্ষাকার্যক্রমে বিরূপ প্রভাব ফেলে।

আমরা দেশের সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়গুলোর দিকে তাকালে এক দুঃখজনক ছবি দেখি। কিশোর ছাত্র-ছাত্রীদের শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির অনুশীলন ও বিকাশের কোন সুযোগ সেখানে নেই। সরকারি স্কুলগুলোতে কোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নেই, ম্যাগাজিন প্রকাশনা নেই, দেয়ালিকা নেই। প্রভাতফেরিতে কখনো কোন সরকারি স্কুলকে দেখা যায় না। বিজ্ঞান মেলা দূরে থাক-এমনকি কখনো কোন সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় বার্ষিক পিকনিকের আয়োজন করেছে তা-ও শোনা যায় না। কিশোর ছাত্র-ছাত্রীরা সুষ্ঠু বিনোদন, সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের অভাবে মাদকাসক্তিসহ বিভিন্ন অপরাধের জালে জড়িয়ে যাচ্ছে। এরই ফাঁকে কোন কোন বিভাগীয় শহরের মাধ্যমিক পর্যায়ের কিশোর ছাত্ররা লোমহর্ষক অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ছে বলে পত্রপত্রিকায় খবর আসছে। আরো একটু গভীরে তাকালে দেখা যায় তারা অনেকেই সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র। সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করছেন, আধুনিক প্রযুক্তির নেতিবাচক ব্যবহার, পিতামাতার অত্যাধিক ব্যস্ততা, অভিভাবকের দীর্ঘ প্রবাসজীবন, নাগরিক জীবনের জটিলতা,সামাজিক বিচ্ছিন্নতা ও ব্যক্তিজীবনের স্বপ্নহীনতা তাদেরকে অন্ধকারের দিকে টেনে নিচ্ছে।

সারা বছর নানা মাত্রিক কোচিং- ভর্তি কোচিং, জেএসসি কোচিং, এসএসসি কোচিং যেন কখনো থামে না। বিদ্যালয়গুলো অলিখিতভাবে যেন কোচিং সেন্টারে পরিণত হয়েছে। তদারকি দূরের কথা, শ্রেণি কার্যক্রম বলতে কিছু বাকি নেই। অভিভাবকগণ অসহায় অবস্থায় শিক্ষকদের দ্বারে দ্বারে দিনের পর দিন ছাত্রছাত্রী দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। শহরের অলিগলি, ষ্টেশন বা মহল্লার মোড়ে মোড়ে শিক্ষকগণ নাম পদবি ও প্রতিষ্ঠান পরিচিতি দিয়ে 'পড়ানো হয়' সাইন বোর্ড ব্যবহার করেন। একজন সরকারি চাকুরিজীবী তা কীভাবে করেন? প্রধানশিক্ষক,মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের দুর্বল তদারকি তথা পরোক্ষ সমর্থনকে কেউ কেউ এর জন্যে দায়ী বলে মনে করেন। আবার, অনেকে মনে করেন, সিভিল সমাজের অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের সমন্বয়ে শক্তিশালী ব্যবস্থাপনা পর্ষদ গঠন করে এক্ষেত্রে শৃংখলা ফিরিয়ে আনা যেতে পারে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মতো মাধ্যমিক ছাত্র ছাত্রীপর্ষদ গঠন করে তাদের অভাব অভিযোগ উপস্থাপনের সুযোগ দেয়া যেতে পারে। অনেক অভিভাবক প্রতিরক্ষা বিভাগের কর্মকর্তাদের সাময়িক বদলিতে শিক্ষা প্রশাসনে দায়িত্বে দিয়ে শৃংখলা ফিরিয়ে আনার কথাও বলে থাকেন। কারণ, দেশের ক্যাডেট কলেজ, ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজ, ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড স্কুলগুলোর অবস্থা তুলনামূলকভাবে ভালো।

আমাদের বাঙালি জাতি সত্তার অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির সকল প্রসঙ্গ নানাভাবে বর্জনের অজুহাত দেখা যায় কোন কোন সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে । বার্ষিক পরীক্ষার চাপে বিজয় দিবস, এসএসসি পরীক্ষার ফাঁদে মহান একুশে উদযাপন বন্ধ থাকে। একটি অলিখিত ছুটির দিনের আমেজ প্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে পড়ে। কোন কোন স্কুল জাতীয় দিবসে বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালন করেছে মর্মে মিথ্যা বলে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে কাগজ পাঠিয়ে দেয়-এমন অভিযোগও আছে।

শিক্ষকদের কাছে শিক্ষকসুলভ মনোভাব তেমন দেখা যায় না। তাঁরা যেন সরকারি অন্য চাকুরেদের মতো চাকুরি করেন আর মাস শেষে মাইনে পান। তখন তাঁদের কাছে মানুষ গড়ার কাজটি অধরা থেকে যায়। যাঁদের শিক্ষা, যোগ্যতা ও মেধা নিয়ে তেমন কোন প্রশ্ন না থাকলেও সততা, নিষ্ঠা ও দায়িত্ববোধের অভাব মারাত্মকভাবে চোখে পড়ে। শিক্ষকদের বেতনভাতা অবশ্যি সম্মানজনক হতে হবে; মেধাবীদের শিক্ষকতায় ফিরিয়ে আনতে হবে। তবে, শুধু বেতন বাড়ালে যে এই সমস্যার সমাধান হবে তা নয়; এখানে নৈতিকতার জাগরণই প্রধান কথা। একজন শিক্ষক মেধাবী হলে ভালো, সৎ হওয়াটা অপরিহার্য। এ পেশায় সততার ক্ষেত্রে কোন আপোষ নেই। তাঁর দেশপ্রেম হবে নিখাদ – এটাই জাতি চায়। আমাদের জানা উচিত শিক্ষকতা সবার পেশা নয়- আর কোন চাকুরি না পেয়ে শিক্ষকতায় আশ্রয় নেয়ার মতো ঘৃণিত

প্রবণতা থেকে তরুণ সমাজকে বেরিয়ে আসতে হবে। কোন স্বপ্নহীন মানুষ যেন এ পেশায় না আসেন- কারণ স্বপ্ন ফেরি করাটাই একজন শিক্ষকের মূল কাজ। যে স্বপ্নহীন সে কীভাবে স্বপ্ন দেখাবে ? এ বিষয়টা শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণের পূর্বে গভীরভাবে ভেবে দেখা জরুরি। এ দায়িত্ব একা সরকারের নয়- ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র এগিয়ে আসলেই একটি অসাম্প্রদায়িক, আধুনিক ও বিজ্ঞানমনষ্ক প্রজন্ম তৈরির পথ সহজ হবে।