একটি শহীদ মিনার নির্মাণের আদ্যোপান্ত!

মুক্তার ইবনে রফিক
Published : 22 Feb 2016, 07:27 PM
Updated : 22 Feb 2016, 07:27 PM

ভাষার মাস এলেই আমরা পুরোদস্তুর বাঙালি হয়ে যাই যেন! বাংলা ভাষার ব্যবহারে যত্নবান হই, ঠিকভাবে বাংলার উচ্চারণ নিয়ে সোচ্চার হই। একুশের প্রথম প্রহর থেকে লাউডস্পিকারে গান বাজাই, 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি…'

কিন্তু ফেব্রুয়ারি মাসটা পেরোলেই সব ভুলে যাই আমরা, সব! খারাপ শোনালেও এটাই তো আমাদের গড়পড়তা প্রবণতা!

এমন সময় আমরা ভাবলাম, কী এমন করা যায় যাতে বছরজুড়ে একুশের এই আবেগ-চেতনা সমুন্নত থাকে। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, এমন কোনো স্কুলে শহীদ মিনার বানাব যেখানে আশেপাশে কোনো শহীদ মিনার নেই, যে স্কুলের বাচ্চাদের প্রভাতফেরীতে যাওয়ার সুযোগ মেলে না। এতে করে যেটা হবে, বছরজুড়ে স্কুলের ছেলেমেয়েদের সামনে শহীদ মিনার থাকবে, কখনোই স্মৃতির আড়াল হবে না!

এই পর্যায়ে নিজেদের পরিচয় দেওয়া যাক। আমরা 'লাইটার ইয়ুথ ফাউন্ডেশন' নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। মূলত ফেসবুক থেকে যাত্রা শুরু হলেও আজ আমাদের কর্মপরিধির পরিধি ব্যাপক পরিমাণে বিস্তৃত। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন হয়ে একটি সরকারী স্কুলে শহীদ মিনারে বানানোর সিদ্ধান্ত- নিশ্চিতভাবেই খানিকটা চমকপ্রদ! আমরা যখন গত ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার অদূরে কেরাণীগঞ্জের আব্দুল্লাহপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে দেখা করে শহীদ মিনার বানানোর প্রাথমিক প্রস্তাব দিই, তাঁরা কিছুটা অবাকই হলেন। সঙ্গে কিছুটা দ্বিধান্বিতও। আসলেই কি এই ছেলেপেলেরা শহীদ মিনার বানাবে! দ্বিধা এক পাশে রেখে প্রাথমিক সায় দেওয়ার পর প্রবল বিস্ময় নিয়ে তাঁরা লক্ষ্য করলেন, সেদিন বিকেলেই আমরা কাজ শুরু করে দিয়েছি!

আমরা জানতাম, পুরো কাজটি শেষ করতে বেশ বড় অংকের টাকা লাগবে। তাই প্রবল সাহস বুকে নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও মনে খানিকটা সংশয় ছিলই। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে টাকা তুলতে পারব তো! তারপর শুরু হলো অনলাইনে-অফলাইনে ক্যাম্পেইন। অভিনব একটি উদ্যোগ নেওয়া হলো। নিজেদের সংগ্রহে থাকা পুরনো বইগুলোই বিক্রির সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা! বইগুলো নতুন ঝকঝকে নয়, মলাটের কোণা হয়তো ছেঁড়া, বইয়ের ভেতর হয়তো নানান আঁকিবুকি। তাই কিছুটা দুরুদুরু বুকেই নেওয়া এই উদ্যোগ। বইমেলার মাসে সবাই কেনে নতুন বই, আমাদের পুরনো বই কে কিনবে! কিন্তু যাবতীয় সংশয় ফুড়ুৎ করেই উড়ে গেল যখন দেখলাম, আমাদের পুরনো বইগুলো মানুষ কিনছে, বেশ আগ্রহ নিয়েই কিনছে!

এদিকে বক্স নিয়ে আমরা চষে বেড়াতে লাগলাম ঢাকার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত। কত জায়গায় যে পুলিশের ধামকি, কত ফরমালিটির ঝক্কি! ভালো কাজে গোলযোগ বেশি হয়- এই আপ্তবাক্যটি আমরা জানি। তবু শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য ফাণ্ড সংগ্রহ করতেকোনো সমস্যা হতে পারে, সেটি মানতে কিছুটা কষ্টই হয়েছে বৈকি।

ভ্যালেন্টাইনস ডে'তে তো ভিন্নধর্মী আরেকটি উদ্যোগ নিলাম। ভালোবাসার চিহ্নের মতো করে ককশিটে ডিজাইন করে সেটি নিয়ে ঘুরলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। যুগলদের অনুরোধ জানালাম ভালোবাসার মানুষকে পাশে নিয়ে ওই ভালোবাসার প্রতীকী চিহ্ন হাতে ছবি তুলতে। সেই ছবি ওই রাতেই ই-মেইল মারফত পাঠানো হবে। শুধু একটাই অনুরোধ। শহীদ মিনারের জন্য কিছু টাকা দিলেই হবে!

এত সব পাগলামো আর কঠিন পরিশ্রম বিফলে গেল না। ঠিক সময়েই শেষ হলো শহীদ মিনারের নির্মাণকাজ। এবং গতকাল ২১ ফেব্রুয়ারি, নবসাজে সজ্জিত শহীদ মিনার দেখতে পুরো এলাকায় মানুষের ঢল। সবার মুখে হাসি, অনাবিল শান্তি। স্কুলের বাচ্চাদের চোখেমুখে কী আনন্দের ঝিলিক!

স্কুলের বাচ্চাদের নিয়ে একটি সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজনও করেছিলাম আমরা। ছিল কবিতা আবৃত্তি, দেশাত্মবোধক গান, চিত্রাংকন প্রতিযোগিতার আয়োজন। বিজয়ীদের পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হয়েছে একটি মাটির ব্যাংক, একটি কলমদানী এবং মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছোটদের উপযোগী করে লেখা একটি বই। পুরস্কার পেয়ে বাচ্চাদের সে কী আনন্দ! যারা পুরস্কার পায়নি, তারাও বাদ যায়নি। হরেক রকমের কলম, চকলেট পেয়ে মন খারাপ হয়নি কারো এতটুকুও!

গতবছর চট্টগ্রামের এম কে রহমানিয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার বানিয়েছিলাম। এবার বানানো হলো কেরাণীগঞ্জের আব্দুল্লাহপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সাধ্যমত আমরা অসহায় মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে দাঁড়াচ্ছি। বন্যার্তদের জন্য ত্রাণ নিয়ে ছুটে যাচ্ছি, শীতার্তদের জন্য কম্বল হাতে উষ্ণতার পরশ বোলাতে। এসবই করছি দেশের প্রতি, সমাজের প্রতি নিজেদের দায়বদ্ধতা থেকে। কতটুকু আমরা পারব, কতদূর যেতে পারব, এসব না হয় সময়ের হাতে তোলা রইলো। তবে আমরা বিশ্বাস করি, যদি এভাবে সবসময় পাশে থাকেন, তবে অন্ধকারের আগল ভেঙে জাগবে প্রভাত। আলো আসবেই। আসতেই হবে।

লাইটার ইয়ুথ ফাউন্ডেশনের ফেসবুক পেজ- www.facebook.com/lighterfoundationbd

ফটো ক্রেডিট: পার্থMilton Kar