আইজুদ্দীনের ছোট মুখে বড়-বড় কথা ও অঙ্গারসম প্রশ্ন!

মুক্ত যাযাবর
Published : 18 April 2012, 10:45 AM
Updated : 18 April 2012, 10:45 AM

প্রায় দেড় কিংবা দুই দশক আগের কথা, আমি তখন কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, দেয়ালে দেয়ালে লেখা উঠেছিলো, "কষ্টে আছি আইজুদ্দীন!" মানুষের মনে মনে তখন এই কথা। তাই দেয়াল লিখন হওয়ার পরে বেশ কিছু দিন মুখে মুখে ফিরেছে। তারপর থেকে আইজুদ্দীন দের এই কষ্ট তো লাঘব হয়নি বরং তার সাথে যোগ হয়েছে, প্রতারণা, আশ্বাস ভংগের প্রতিযোগিতা, পালাবদলের শাষন নামক শোষন, নাগরিক নিরাপত্তাহীনতা ও সর্বোপরি জলজ্যান্ত মানুষ যাদুর ফুয়ে বাতাসে মিলিয়ে যাওয়া ইত্যাদি বিবিধ ঝামেলায় থেকে কষ্টের সাথে যোগ হয়েছে "চাপা ক্ষোভ, ঘুরে দাঁড়ানোর মরিয়া মনোভাব"। তাই ১৬ কোটি আইজুদ্দিন আজ দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ফেটে পড়ার অপেক্ষায়, তাই আজকাল কিছু হলেই আইজুদ্দিনরা "ছোট মুখে বড়-বড় কথা ও অঙ্গারসম প্রশ্ন" তোলে!

১) কোনটি বেশী জরুরী, পদত্যাগ না কি স্বচ্ছ তদন্ত/ঘটনানুসন্ধান?
আপনাদের একটি শিশুতোষ পর্যালোচনা দেব। ধরুন আপনি বাজার থেকে ফিরছেন, আপনার বাজারের ব্যাগটি আছে সাইকেলের সামনের হ্যান্ডেলে, আপনার ছেলে(যাদের ছেলে নেই ধরুন ভাই, ভাইগ্না) বসেছে সাইকেলের পিছনের ক্যারিয়ারে। রাস্তায় নিয়ন্ত্রন হারিয়ে আপনার ছেলে পরলো ডান দিকে, সাইকেল সহ আপনি ছোট-খাটো কাটা ছেড়া হলেও বলা চলে অক্ষত, বাজারের ব্যাগটি পরলো আপনার বামপার্শে। দু-দিক থেকেই গাড়ি আসছে, আপনার কাছে মনে হচ্ছে আপনি শুধু হয় ছেলেকে বা বাজারের ব্যাগটিকে বাচাঁতে পারবেন। এখন আমি আপনাকে, "বলুন তো কাকে বাঁচাবেন"? এ জাতীয় প্রশ্ন করে রামবোকা উপাধি নিতে চাই না। শুরুতেই বলেছি শিশুতোষ পর্যালোচনা, তাই একজন শিশুও বলতে পারবে ছেলেটিকে বাচাঁনো উচিত। গত কয়েক বছরের বা মাসে দেশের স্বার্থ ও দেশের রাজনীতির সঙ্গে বিগত কয়েক দিনের দেশের স্বার্থ ও দেশের রাজনীতির তুলনা করে আমার কেনো যেন মনে হচ্ছে আমারা সমগ্র দেশবাসী কি এতই বুদ্ধিহীন, একটা ছোট অগ্রাধিকার মূলক হিসাব আমরা করতে পারলাম না!

প্রয়োজনের অগ্রাধিকার বুঝাতে আর একটু ক্যাচ ক্যাচ করি। এটা একটু খটকাময় উদাহরন। সুতরাং পাঠক নিজগুনে সেন্সর করে পড়বেন। তবে ছোটবেলার ঘটনা বলে লিখতে পারছি। কারন ছোট বেলায় অনেক কিছু বলা বা করার ছাড়পত্র থাকে যা বড় হলে করা যায় না। কিছুদিন আগেই ব্লগে একটা কৌতুক পড়েছিলাম, " ১৮ বছরের ছেলে ১৮ বছরের মেয়েকে – আমি তোমাকে ভালোবাসি বলে "অসভ্য" পদাধিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু সেই মেয়েকেই সেই দিন সন্ধ্যায় ২ বছরের একটা ছেলে আধো-বোলে একই কথা বলায় মেয়েটি বলেছে – Oh! So cute!" তাই ছোট বেলার ঘটনা বলে সাহস করে বলা যায়। তখন আমাদের বয়স ৭ বা ৮। আমরা সবাই এক সঙ্গে খেলছিলাম, আসরের আযান দিলো, আমরা দেখলাম আমাদের এক বান্ধবী তার প্যান্টটি ঝটপট খুলে মাথায় দিচ্ছে। বলা বাহুল্য প্রচন্ড গরমের জন্য আমাদের পরনে প্যান্ট ছাড়া অন্য কোন পরিধেয় ছিলো না। আমারা কারন জিজ্ঞাসা করা মাত্র সে বললো, " আম্মু আমাকে আযানের সময় মাথায় কাপড় দিতে বলেছে!" আমাদের যখন ১৩/১৪ বছর কি আগ্রহেই না আমারা আযানের সময় আমাদের উক্ত বান্ধবীর দিকে তাকাতাম। 😛 । কিন্তু আমাদের সেই বান্ধবী কি আর বোকা আছে, কিছুদিনের মাঝেই সে শিখে গেছে কর্ম/গুরুত্বের অগ্রাধিকার। সে যে আর শিশুটি নেই! দুঃখ লাগে আমাদের দেশটিও আর শিশুটি নেই, ৭১ জন্ম, হাটতে যেয়ে ৭৫ হোচট খেলো, তারপর কতো বছর, ৯১ এ গনতন্ত্রে গ্রাজুয়েট করলো, আজ দেশটি ৪১ বছরে মাঝবয়সী। এখনো আমাদের অগ্রাধিকার নির্ণয়ে শিশুর মতো কর্মকাণ্ড কি মানায়!

ব্যাখ্যা করতে চাচ্ছি না, আইজুদ্দিনরা ব্যাখ্যায় কাচাঁ, শুধু কয়েকটি "অঙ্গারসম প্রশ্ন" দিতে চাই।

২০১০ এ শেয়ার বাজারে যে পরিমান(হাজার হাজার কোটি) টাকা কারসাজি করা হয়েছে তার থেকে ৭০ লক্ষ টাকা কি বড়? পদ্মা সেতুতে, কুইক রেন্টালে যে কারসাজি হয়েছে সেটাই বা কেমন অঙ্কের আমার মতো আইজুদ্দিনের মাথা অতবড় হিসাব করতে পারে না। দুদক কেনোই বা অন্য সকল লাইসেন্স আবেদনকারী বা লাইসেন্স প্রাপ্ত দের বাদ দিয়ে একজনের অর্থের হিসাবের পিছনে ছুটলো? আমার এসব কথার অর্থ এই নয় যে আমি চলতি এসব ৭০ লক্ষ/নিয়োগ বানিজ্য/সে…… টেলিকমের অর্থের উৎসের তদন্ত বিরোধী, এই তদন্ত হচ্ছে, আমি সাধুবাদ জানাই। কিন্তু ব্যাপারটা কেনো যেন আমাকে ছেলেবেলার আযান ঘটনায় নিয়ে যাচ্ছে। বড় বড় মাছগুলোকে কি আমরা দুই টাকার শাক দিয়ে ঢেকে ফেললাম না! একবারের জন্য সরকারী দল কি বলার সুযোগ পেলো না, " আমরা দূর্নীতি বিরোধী, আমারা দূর্নীতির প্রমাণ পেলে যথেষ্ট তদন্ত করি, তদন্তের প্রয়োজনে পদত্যাগ ইত্যাদি ইত্যাদি"। তাই আমার আহব্বান থাকবে "আইজুদ্দিন ভাইরা ছোট ছোট শাকপাতার আড়ালে বড় বড় রুই-কাতলা মাছ হারিয়ে ফেলেন না! এগুলোর পাশাপাশি পুকুরচুরি গুলোও হাইলাইট করতে থাকুন। মানবতা বিরোধী(ড্রাইভার আজম খান কই?), নাগরিক নিরাপত্তা(সাগর-রুনি, সৌদি কূটনৈতিক) প্রসঙ্গগুলো নিয়ে প্রবাহমান লেখা লিখতে থাকুন। পদত্যাগের আড়ালে যেনো সকল অনৈতিক কাজের সত্যানুসন্ধান চাপা না পড়ে যায় সেটা খেয়াল রাখতে হবে।

অবশ্য বিরোধীদলের এই লেখা দেখে খুশী হওয়ার করন নেই। আইজুদ্দিনেরা আপনাদের দুঃশাসন ও ভোলে নাই। আপনাদের ফিরিস্তি দিতে গেলে পাঁচ পাতায়ও আঁটবে কিনা সন্দেহ।

২) আইজুদ্দিনদের জন্য কি বাতি হাতে নেই কনো ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল?
আজকের পত্রিকা খুলুন। দেখতে পাবেন একজন সংসদ সদস্য স্বেচ্ছায় শুধু মন্ত্রীত্বই ছাড়েন নি, পাশাপাশি সকল বেতন-ভাতা পদত্যাগের পরদিন থেকে ফিরিয়ে নেয়ার আবেদন করেছেন। কয়েক মাস আগে দেখেছিলাম পৃথিবীর ১২ জন উদ্যোক্তা ব্যাক্তির মধ্যে ১০ জন যুক্তরাষ্ট্রের, ১ জন ভারতের আর বাকিজন বাংলাদেশের। যিনি কিনা বলেছিলেন "আমি দারিদ্র বিমোচনের যে লক্ষ নিয়ে কাজ করছি তাতেই থাকতে চাই, বিশ্ব-ব্যাঙ্কের সর্বাধিনায়ক হওয়ার কনো ইচ্ছা আমার নেই!" আজ জনগনের টাকা নয়-ছয় কারী অসৎ রাজনৈতিক আমলে, গরীবের দেশে শুল্ক হীন বিলাসবহুল গাড়ী আমদানী ও ব্যাবহারের আমলে টাকা ফিরিয়ে দেবার এই নমুনা কি আমাদের কাছে বাতি হাতে এগিয়ে আসার ইঙ্গিত দেয় না!

প্রজন্ম অনুসারে যে বাঙ্গালী চরিত্রগত ভাবে ভালো হচ্ছে তা আমি ব্যাক্তিগত ভাবে দেখতে পারছি। কিছুদিন আগে একজন নবীন লেখকের কাছে কোন এক রাজনৈতিক দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে পত্রিকাতে তার ব্লগের লেখা আহবান করা হয়েছিলো। ভাগ্যক্রমে আমার সেই তরুন লেখকের জবাব জানতে পারার সৌভাগ্য হয়েছিলো। আমার খুব ভালো লেগেছে তার এই উত্তর। তাই উদ্ধৃত করছি, "ধন্যবাদ আপনাদের আগ্রহ প্রকাশের জন্য। আমি বাংলাদেশের বর্তমান চলমান রাজনীতি, রাজনৈতিক দলগুলির নৈতিকতা নামক ভণ্ডতা, দলগুলির নেতা-নেত্রীর নির্লজ্জ আচরন ও কর্মকাণ্ড ইত্যাদির সঙ্গে প্রচণ্ডভাবে মতপার্থক্য অনুভব করি। "…………"(একটি রাজনৈতিক দলের নাম) এই প্রধান রাজনৈতিক দলগুলির ই একটির সাথী।তাই আমি বিনয়ের সাথে আপনাদের এই প্রকাশে আমার লেখা ছাপাতে অপারগতা প্রকাশ করছি। যদি বাংলাদেশে কনো দিন এমন কনো দল আসে,এমন কনো নেতা আসে যিনি দেশের জন্য চিন্তা করবেন, দেশের স্বার্থে যিনি নির্দ্বিধায় দলীয় স্বার্থকে ছুঁড়ে ফেলতে পারবেন, তিনি ডাক দিলে ছুটে যাব, এই লেখাগুলো দলীয় চিন্তাধারার পত্রিকাতে প্রকাশিত না হয়ে দেশের জন্য উন্নয়নের জন্য প্রকাশিত কোনো পত্রিকাতে প্রকাশের আহবান করে, আমি সানন্দে সেই পত্রিকাতে প্রকাশের জন্য শুধু অনুমতিই নয়, দৌড়ঝাঁপ করে অংশগ্রহন করবো। আমি সেই দিনের অপেক্ষায় আছি। ধন্যবাদ"। আহ্ আমি এই নবীন লেখককে সালাম জানাই, দেশের ভালোর জন্য যারা ব্যাক্তিগত সুখ/খ্যাতি কে নির্মোহ অবহেলায় দূরে ঠেলে দিতে পারে!

চাকুরীগত কারনে আমাকে দেশে দেশে ঘুরতে হয়। সৌদি-আরবে দেখেছিলাম একজন ছেলেকে, পেশায় ইলেকট্রিশিয়ান। নিজের ক্ষুদ্র উপার্জনের মাঝে সে পন করে প্রতিমাসে জমাচ্ছে রিয়াল। তার হিসাব আল্লাহ তাকে আর ২০ বছর কাজ করার তৌফিক দিলে, যে টাকা জমবে তা দিয়ে উত্তরাঞ্চলে তার দেশের বাড়ীতে ইলেক্ট্রিক সামগ্রীর একটা কারখানা দিবে। তাতে সে আরো ১০ জন বেকার ছেলের কর্মসংস্থান করতে পারবে। পালাবদলে মালয়শিয়া ও ইংল্যান্ডে টাকা পাচারের এই যুগে এই স্বপ্ন ধারন করা ও তার দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাওয়াকে আপনি কি "ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল" হিসাবে চিনতে পারছেন না!

অস্ট্রেলিয়াতে দেখেছিলাম, ঢাকা বিশ্ব-বিদ্যালয়ের এক প্রাক্তন শিক্ষক(অণুজীববিজ্ঞান, উচ্চতর গবেষণারত)। গবেষণার পাশাপাশি টাকা জমানো, চিন্তা দেশে ফিরে করবেন প্রথমে ল্যাব, পরবর্তীতে ফার্মাসিটিক্যাল ল্যাব ইত্যাদি ইত্যাদি। তার কথা, তার স্বপ্ন এখনো আমার কানে বাজে। "ভাই এই দেশে এসে আমার জ্ঞান, শ্রম দিতে গিয়ে আমার মনে মাঝে মাঝে আত্ম-ধিক্কার অনুভব করি। কিন্তু মনকে অটো-সাজেসান দিই। আমি এখানে এসেছি শুধু গবেষনা করতে আর অর্থ সংগ্রহ করতে। তারপর ই তো দেশে ফিরে যাবো, ঝাঁপিয়ে পরবো আমার এই ক্ষুদ্র সম্পত্তি নিয়ে দেশের উন্নতিতে যতটুকু আমার দ্বারা সম্ভব"।

আমার আহবান থাকবে সবার প্রতি শুধু আইজুদ্দিন হয়ে ক্ষোভ নিয়ে থাকলে হবে না, খুজতে থাকুন এই সব বাতি হাতে পথ প্রদর্শককে, যারা আমাদের দেশকে দেখাতে পারবে আলো।তাদের নির্বাচনের জন্য অর্থের দরকার পরবে না, পোস্টারিং এর দরকার পরবে না, যেমন দরকার পরেনি নারায়ণগঞ্জ বা নরসিংদির নির্বাচনে।মানুষ এখন ভন্ড-প্রতারক রাজনৈতিক কে চেনে! মানুষ এখন বলছে, " আর নয় মার্কা দেখে ভোট, ভোট দেও মানুষ দেখে!"

লেখকের বক্তব্যঃ বানান শুদ্ধিকরণ পাঠকের উপর বর্তাবে! 😛 .