এই সুযোগে গ্রামীণ অর্থনীতি নিয়ে ভাবুন

মোস্তফা শিবলী
Published : 11 Jan 2012, 06:57 PM
Updated : 9 April 2020, 09:56 AM

চলমান লকড ডাউন এর কারণে এখন দেশ ও দেশের অর্থনীতি প্রায় স্থবির হয়ে গেছে। শহরাঞ্চলের সব শিল্প কলকারখানা, ব্যবসা বাণিজ্য এখন বন্ধ। বছরব্যাপী শহরে কাজ করা শ্রমিকেরা বাধ্য হয়ে গ্রামে ফিরে এসেছে। জনবিরল পানছড়ি উপজেলায়ও হঠাৎ করে গ্রামে গ্রামে অনেক নতুন মুখ দেখা যাচ্ছে। এরা কারা? খোঁজ নিয়ে জানা গেল, শহরে শিল্প কলকারখানায় কাজ করা শ্রমিক। এখন কাজ নেই। কেউ গার্মেন্টস, কেউ জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পে, কেউ কেমিক্যাল কারখানায় কাজ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম বা অন্য কোথাও। সেখানে এখন কাজ বন্ধ। থাকা-খাওয়ায় কষ্ট। তাই বাধ্য হয়ে গ্রামে ফিরে এসেছে। যতদিন লকড ডাউন চলবে, অনেকে এখানেই অপেক্ষা করবে।

আমার খামারে কেউ কেউ অলস বিকেলে বেড়াতে আসে। নিরাপদ দুরত্ব বজায় রেখে ঘুরে ঘুরে আমাদের কাজ দেখে। দেশি হাঁস, রাজহাঁস, টার্কি, কবুতরের লালন পালন দেখে। শাকসবজির চাষাবাদ দেখে। বাঁশ, কাঠের গাছসহ বিভিন্ন গাছের ও সবজির চারা উৎপাদনের নার্সারিতে বসে বসে সময় কাটায়। গ্রামের অন্যান্য কিছু লোক, যারা আগে থেকেই এখানে কাজ করেন তাদের সাথে কথা বলে। সুযোগ থাকলে কেউ কেউ দিনমজুর হিসেবে আমাদের সাথে কাজে নেমে পড়ে। জিজ্ঞেস করি, গ্রামে থেকে এসব কাজ করতে পারো না? শহরে গিয়ে কাজ করতে ভাল লাগে? জবাব আসে, গ্রামে তো কাজ নাই। আপনের মত আমিও হাঁস পালতে চাই, কিন্তু বাচ্চা পাওয়া যায় না। সবজির আবাদ করতে চাই। কিন্তু সামান্য যে পুঁজি, সেও মেলে না। কেন, এনজিও? আমি বলি। দূর… পাশ থেকে এক পুরোনো কর্মী ঠোট উল্টিয়ে বলে, তারা শুধু সমিতির মাধ্যমে সামান্য লোন দিয়াই খালাস! এই টাকা দিয়া কাজ করে, না ওষুধ কেনে, না আগের লোন শোধ করে, সেই খবর তারা রাখে না। সপ্তাহের কিস্তি পাইলেই তারা খুশি।

শহরের সেই শ্রমিক বলে, বৌ-বাচ্চা রাইখা দূরে কাজে কোনো বরকত আছে? আনন্দ আছে? রাইখা গেলেও কষ্ট, নিয়া গেলে আরো বেশি কষ্ট!

কেন? জানতে চাই। শহরে পরিবার নিয়া গেলে যে বেতন, তাতে বস্তিতে থাকা লাগে। তার চেয়ে এইখানে পরিবার রাখা অনেক ভাল। আর সবচেয়ে বেশি ভাল গ্রামেই কোনো কাজ কারবার করা, লোকটা বলতে থাকে। গ্রামে কাজ নাই, ইয়োং পোলাপানগুলা সারাদিন ক্যারম খেলে, তাস পিটায়, মদ-গাজা খায়, গুণ্ডামি করে। কাজ নাই, তাই বেকার। লাস্টে সবাইর তাড়া খাইয়া শহরে গিয়া ওঠে। সেইখানে কারখানায় কাম লয়।

ওদের এসব কথা আমি জানি। গত কুড়ি বছর যাবত গ্রামে কাজ করে এসব কথা অনেক বার শুনেছি। কুয়াকাটায়, পানছড়িতে, রাংগামাটিতে। যেখানে কাজ করতে গেছি, সেখানেই শুনেছি গ্রামের মানুষের এই কষ্টের কথা। মাঝে মাঝে সরকারের-বিদেশীদের বড় বড় রুরাল লাইভলিহুড এর প্রজেক্টের খবর শুনে, শত কোটি টাকার অনুদানের সংবাদ পেপারে পড়ে আশায় বুক বেধেছি। যাক, এইবার কিছু একটা হবে। গ্রামের ঘরে ঘরে কৃষিভিত্তিক কাজ জমে উঠবে! সরকারের যুব মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও পশুপালন মন্ত্রণালয়ের শত-হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ এর কথা শুনে চোখ বুজে স্বপ্ন দেখেছি গ্রামে আসন্ন সমৃদ্ধির, আশু স্বচ্ছলতার। কিন্তু হায়! আহামরি তেমন কিছুই হয়নি।

সরকার নিজে যখন সরাসরি কোনো কাজ করে, কোনো প্রকল্প একলা বাস্তবায়ন করে, দেখেছি তখন ব্যর্থতা অনিবার্য! কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে প্রকল্প পরিচালক বানিয়ে, সেখানে যতই উপদেষ্টা বা বাইরের কর্মী নেয়া হোক, তদারকিতে যখন সরকার আর তার সতত ঘুর্ণায়মান, পরিবর্তনশীল কর্মকর্তাগণ; তখন যতই মনিটরিং, আইএমইডি থাকুক, কাজীর গরু খাতায় থাকলেও গোয়ালে আর খুঁজে পাওয়া যায় না! এসব কথা কোনো চেয়ারে আসীন কর্তাকে বললে তেলে-বেগুনে চটে যাবেন। মিয়া আমার খাওন নষ্ট করতে আইছেন? কিন্তু তিনিই অবসরে যাওয়ার পর মসজিদের গেটে দেখা হলে তসবিহ-জায়নামাজ হাতে নিয়ে আফসোস করেন। বলেন, আর বইলেন না, আমলারাই সব টাকা খাইয়া শেষ কইরা ফেলল! আমরা প্রকল্পের গাড়ি কিন্না যা কামাইসি, এখন তারা পর্দার কাপড় কিন্নাই সেই টাকা কামায়। সিস্টেমটাই খারাপ, বুঝলেন!

দাতা সংস্থাদের চাপে বছর পনের-কুড়ি আগে থেকে গরীবের আয় বৃদ্ধিমূলক প্রকল্পগুলোতে এক নতুন ধারা দেখতে পেলাম। বাস্তবায়ন সহযোগী বা পার্টনার হিসেবে দেশের বড় বড় এনজিওগুলোকে সম্পৃক্ত করা হলো। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাকে পার্টনার বানিয়ে দায়িত্ব দেয়া হলো স্থানীয় দরিদ্র জনগণকে আইডেন্টিফাই করা, সমিতিতে দলবদ্ধ করার কাজে। নিঃসন্দেহে এ কাজে তারা পটু। পরে উদ্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকে প্রশিক্ষণ, তাদের মাঝে ঋণ-অ্যাসেট বিতরণ ইত্যাদি কাজেও বেশ ভালো পারদর্শিতা দেখাল। তিন বা পাঁচ বছরমেয়াদী আয় বর্ধনমূলক প্রকল্পগুলোতে বাস্তবায়ন পর্যায়ে বেশ গতি এলো। কিন্তু সাসটেইনেবিলিটি? প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরের অবস্থা? যেই লাউ, সেই কদু! প্রকল্প শেষ, প্রকল্পের সাথে সম্পৃক্ত কর্তাব্যক্তিরাও বিদায়। অফিস গুটিয়ে, সব গাড়ি সরকারি পুলে জমা দিয়ে খোদা হাফেজ! সেই সাথে এনজিওগুলোও পাততাড়ি গুটিয়ে অন্য এলাকায়, নতুন কোনো প্রকল্প বাস্তবায়নে চলে গেল। সেই সোশ্যাল মবিলাইজেশনের কর্মী, সেই প্রশিক্ষক, সেই মনিটরিং-এর কর্তা কেউ আর এলাকায় নেই, কাউকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না। তাহলে সেই কাজের ধারাবাহিকতা হবে কীভাবে? কে দেখবে ফেলে যাওয়া কাজগুলো?

গলদা হ্যাচারির চিংড়ির পোনা বিতরণ ও স্বাদু পানির চিংড়ি চাষ সম্প্রসারণের এক প্রকল্পে এরকম এক এনজিও'র সম্পৃক্ততা নিয়ে বহু বছর আগে মন্ত্রণালয়ের সচিব মহোদয় এবং সংশ্লিষ্ট দেশের অ্যাম্বাসেডরকে প্রশ্ন তুলেছিলাম এক ককটেল পার্টিতে। দুজনেই মন দিয়ে শুনলেন আমার কথাগুলো। শেষে জানতে চাইলেন, তাহলে উপায়টা কী? আমি বললাম, প্রাইভেট সেক্টরের সম্পৃক্ততা। এনজিও তো প্রাইভেট সেক্টরই, তারা জানালেন। আমি বললাম, না, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা নয় সংশ্লিষ্ট সেক্টরের কোনো বেসরকারী ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, প্রাইভেট বিজনেস কোম্পানি! যাদের ভেস্টেড ইন্টারেস্ট আছে কাজটায়। যারা নিজ স্বার্থেই এই কাজের সাস্টেইনেবিলিটি চাইবে, কাজের ধারাবাহিকতা ধরে রাখার জন্যে প্রাণপনে লড়ে যাবে, এলাকায় থেকে যাবে, কারণ কাজটা চলতে থাকলে তার ব্যবসাও রানিং থাকবে। গলদার চাষের প্রকল্পে যদি হ্যাচারীগুলোকে পার্টনার বানান, তাহলে তারা নিজ স্বার্থেই কাজটা করবে। সোলার প্যানেল বিতরণে এনজিও নয়, যদি সোলার প্যানেল বিক্রয় প্রতিষ্ঠান বা ব্যাটারি সরবরাহের কোম্পানিকে পার্টনার বানান, তাহলে প্রকল্প শেষ হলেও সোলার-এর ব্যবহার থামবে না। এমনি ভাবে জৈব সার কোম্পানি, মাছ-পশু খাদ্যের কোম্পানি, চারা উৎপাদনকারী কোম্পানি, ফুড প্রসেসিং কোম্পানি এদেরকে নিয়ে প্রকল্প করেন, দেখবেন সব কাজ ঠিক মতো হচ্ছে।

দুজনেই বড় করে সিপ নিলেন গেলাসে। সচিব মহোদয় কার্ড দিয়ে বললেন মন্ত্রণালয়ে দেখা করতে। আর হিজ হাইনেস তো ক'দিন পরে আবেগের ঠেলায় ভিজিটেই চলে এলেন কুয়াকাটায় আমার হ্যাচারিতে বিশাল লট বহর নিয়ে। কোন কাজ হয়নি। সচিব মহোদয় পরের মাসেই বদলী টু এনাদার মিনিস্ট্রি। হিজ হাইনেস অবশ্য আমাকে কিছুদিন পরে তার দেশে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) এর ওপর এক লম্বা ট্রেনিং-এ পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু কিছুই করতে পারিনি। রুরাল ইকোনমির জন্য যে সকল সরকারি বা বিদেশী অনুদান নির্ভর প্রকল্প নেয়া হয় সেগুলো শুরু হয় ঢাক ঢোল পিটিয়ে, বাস্তবায়ন হয় সাইক্লোনের গতিতে আর শেষ হয় মোমবাতির মত। লাস্টে কিচ্ছু খুজে পাওয়া যায় না। কারণ প্রকল্পের কোনো বিজনেস পার্টনার নেই। বাস্তবায়ন করে আমলা, বুদ্ধি দেয় অ্যাকাডেমিকসরা, চার দেয়ালে বন্দি গবেষকরা, মনিটরিংও করে আমলারা। অথচ সমাজে সবচেয়ে স্মার্ট যে গ্রুপ, ফাইট করে টিকে থাকা যে গ্রুপ, কম খরচে কাজ আদায় করতে, সমাধা করতে পারঙ্গম যে গ্রুপ, তারাই উপেক্ষিত। তারাই এই আয় বর্ধনমূলক গ্রামীণ অর্থনীতি বিষয়ক প্রকল্পের কাজগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন! যারা নিজ স্বার্থে হাঁসের পালন বাড়াতে চাইবে, মাছের চাষ বাড়াতে চাইবে, নিজের ব্যবসার স্বার্থে কৃষি অর্থনীতির শক্তিশালীকরণ চাইবে, তাদের বাদ দিয়েই সরকার একা একা সব করতে চায়। রেজাল্ট? গ্রামে হাজারো বেকারত্ব, মাদকাসক্তি, বাল্যবিবাহ, মারামারি, খুন-খারাবি।

এত সব হতাশার কথা বলার পরে অন্তত একটা আলোর পথ দেখাই। একটা সমাধানের দিক নির্দেশনা দিয়ে যাই। আমার কাছে আইডিয়ার অভাব নেই কিন্তু একটা স্পেসিফিক আইডিয়া নিতে পারেন। বাংলাদেশ ব্যাংক-এর ইইএফ (ইকুইটি এন্ট্রোপ্রনিওরস ফান্ড) এর নাম শুনেছেন না? এখন নাম দিয়েছে ইএসএফ (এন্ট্রোপ্রনিওর শিপ সাপোর্ট ফান্ড)। এদেরকে বলেন, সারা দেশে ইউনিয়ন পর্যায়ে অ্যাগ্রো প্রজেক্টে ফাইন্যান্স করতে। মেক শিওর করতে যেন প্রতিটি ইউনিয়নে একটি করে অ্যাগ্রো বিজনেস ফার্ম গড়ে ওঠে। এটা করতে হবে আইসিবির মতো শহুরে কোনো প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে নয় বরং কৃষি ব্যাংকের মত গ্রাম পর্যায়ে ছড়িয়ে থাকা প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে। এই উদ্যোক্তাদেরকে শুধু হ্যাচারি ও নার্সারি পর্যায়ে ব্যবসা করতে হবে। ফার্মিং-এ নয়। এগুলো হবে "মাদার ফার্ম" যাদের কাছ থেকে ক্ষুদ্র চাষিরা হাঁসের বাচ্চা পাবে, মুরগীর ছানা পাবে, ছাগল, ভেড়ার স্টক পাবে, গাছের নার্সারি, মাছের পোনা, ফিড ইত্যাদি পাবে। কোনো মাদার ফার্ম একটা আইটেম নিয়ে কাজ করবে, আবার কেউ একাধিক আইটেম যেমন পোনা, ছানা, চারা ইত্যাদি উৎপাদন এবং সরবরাহ করবে। ২% সার্ভিস চার্জে এসব মাদার ফার্মে ঋণ সরবরাহ করেন। অন্যান্য সেক্টরে প্রণোদনা দিতে গিয়ে যে অর্থ ব্যয় হয় (সেগুলোরও দরকার আছে বৈকি!), তার চেয়েও কম টাকাতেই দেশে অ্যাগ্রো সেক্টরে সত্যিকারের বিপ্লব ঘটিয়ে দেয়া সম্ভব। এই মাদার ফার্মগুলোর ফরোয়ার্ড লিংক হিসেবে তৈরি হবে স্থানীয় পর্যায়ে শত শত ক্ষুদ্র ফার্ম যেখানে হাঁস, রাজহাঁস, কবুতর, মাছ, গরু, ছাগল, ভেড়া, সবজি, কৃষির আরো অন্যান্য আইটেম এর চাষাবাদ হবে, লালন পালন হবে। যে ক্ষুদ্র ফার্মগুলোতে কোটি কোটি বেকারের কর্মসংস্থান করা সম্ভব। স্থানীয় পর্যায়ে এরপর আসবে ফুড প্রসেসর, ভ্যালু এডিশন এবং মার্কেটিংয়ের কোম্পানি। স্থানীয় ছেলেমেয়েরা শহরে না গিয়ে সেখানেই কাজ করবে।

আহা! ভাবতে পারেন? আপনার গ্রামের ভাতিজা বা ভাস্তি এখন আর আপনার কাছে একটা চাকরির জন্য আসে না বরং মাঝে মাঝে উপহার হিসেবে আপনাকে তার গ্রামে উৎপাদিত বা প্রক্রিয়াজাতকৃত কোনো খাদ্যপণ্য পাঠায়? ভাবতে পারেন তারা সবাই কাজে ব্যস্ত, উৎপাদন বা বিপননে ব্যস্ত! বাংলাদেশ কি ভীষণ মজবুত গ্রামীণ  অর্থনীতির পিলারে দাঁড়িয়ে যাবে!!

গ্রামীণ অর্থনীতি নিয়ে এই বিষন্ন সময়ে, এই মহামারীর থাবার নিচে বসে একবার সিরিয়াসলি ভাববেন?