“ট্রানজিশান” এবং “কম্প্রোমাইজ” একটি সমকালীন চিন্তা

শাহ মুর্শিদ
Published : 9 August 2015, 08:18 AM
Updated : 9 August 2015, 08:18 AM

বাংলাদেশের বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপট এবং সাম্প্রতিক নিষ্ঠুরতা নিয়ে আলোচনায় অনেকেই বলছেন যে আমাদের সমাজে এখন একটা "ট্রানজিশান" চলছে, ফলে অনেক কিছুই হচ্ছে যা কাঙ্ক্ষিত নয় অথবা অচিন্তনীয়।অনেকে আবার বলছেন এগুলো আগেও ছিল, এখন মিডিয়ার কারনে তা প্রকাশিত হচ্ছে যা আগে অপ্রকাশিত থেকে যেত।এরকম বিভিন্ন মতামত।অর্থাৎ কিছুটা প্রত্যাশিত আর কিছুটা অনাকাঙ্ঘিত।মনিষীরা বলেন পরিবর্তনটাই হচ্ছে স্থায়ী আর স্থায়ীত্বই হচ্ছে অস্থায়ী।যাহোক, এটা নতুন কোনো কথা নয়।কিন্তু আসল কথা হচ্ছে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের জন্য সুনির্দিস্ট লক্ষ্য স্থির করা এবং মৌলিক মূল্যবোধগুলোর সাথে কম্প্রোমাইজ না করে অনাকাংখিত দিকগুলো যতটা সম্ভব বিবেচনায় এনে পরিবর্তনকে লাগামের মধ্যে রাখা।সেটা না হলে সমাজে নিত্য নুতন ভয়ংকর সব আলামত দেখা দেয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়।যার কিছু নমুনাতো আমরা আমাদের সমাজে ইতিমধ্যেই দেখতে পাচ্ছি।

তবে অনাকাংখিত পরিনতি পুর্ব থেকে আচ করাও অত্তান্ত কঠিন।তাই দরকার দূরদৃষ্টি সম্পন্ন চিন্তাবিদের, দার্শনিকের।যাদের চিন্তার প্রভাব থাকবে সমাজ বিনির্মাণে, নেতৃত্বে।কিন্তু এর অভাব আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।বিদেশের তৈরী কিছু কিছু সিনেমাতে দেখি ভয়ংকর সব পরিনতির কাহিনি।কিভাবে সমাজ ধংস হয়ে সন্ত্রাসীদের হাতে চলে গেছে বা যাচ্ছে, কিভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ পুরো শহর কিংবা পরিবেশ ধংস করে দিয়েছে ইত্যাদি।একেবারে নেতিবাচক হলেও এক ভয়ংকর ভবিষ্যতের ধারনা তাতে পাওয়া যায়।এসব ছবি দেখে মানুষ কিছুটা হলেও অনাকাংখিত পরিনতি সম্পর্কে আঁচ করতে পারে এবং তাদের কাজে এর প্রতিফলন করার চেষ্টা করে।অর্থাৎ সাহিত্য, সংস্কৃতি, ছবি ইত্যাদির প্রভাব সমাজ পরিবর্তনে থাকে।আমাদের এসব নেই, আছে অপসংস্কৃতির প্রভাব, সন্ত্রাস, মারামারির গল্প এবং সিনেমা।এর ফলাফল তো প্রায় প্রতিদিনের বীভৎস আর নৃশংসতায় পরিপুর্ন খবরে ইদানিং আমরা দেখছি।

আমরা কিন্তু সুখের সপ্নে বিভোর, দেশ ডিজিটাল হচ্ছে, মধ্যম আয়ের দেশ হচ্ছি, ইত্যাদি।কিন্তু বৈসম্য যে দিন দিন বেড়ে চলেছে, সত্যিকার শিক্ষার সোপানগুলো ধীরে ধীরে ভেঙ্গে পড়ছে।পরিবার গুলো হয়ে যাছে আত্মকেন্দ্রিক, মেধা চলে যাচ্ছে বিদেশে, দরিদ্র শ্রেণী অন্ধকার থেকে অন্ধকারে নিমজ্জিত হচ্ছে ফলে বাড়ছে তাদের অসহায়তা সেসাথে ক্ষমতাবানদের নির্যাতনও পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে।ক্ষমতা, সম্পদ আর টাকাই যেন বর্তমানে বেচে থাকার মুলমন্ত্র হয়ে দাড়িয়েছে।রাজনীতি হয়েগেছে অসুস্থ।সমাজের উচ্চ পর্যায় থেকে সমাজের নিম্ন মধ্যবিত্ত পর্যন্ত দূর্নীতি, কুশাসন, অত্যাচার, দখল, অনাচার অনৈতিক সব কার্যকলাপের মাধ্যমে এই অবনতি জারি রেখেছে।কারন আমরা কম্প্রমাইজ করছি গনতন্ত্রের সাথে, দূর্নীতির সাথে, কুশাসনের সাথে, শিক্ষার সাথে সর্বপরি নৈতিকতা এবং মূল্যবোধের সাথে, আর তা করছি তথাকথিত উন্নয়নেরই স্বার্থে।

উন্নয়ন যদি বৈসম্য বাড়ায়, উন্নয়ন যদি, অনাকাংখিত পরিনতির ব্যপারে ব্যবস্থা না নেয়, উন্নয়ন যদি সমাজের ঐতিহ্য ভেঙ্গে দেয়, উন্নয়ন যদি সামাজিক মানবিক প্রতিষ্ঠান গুলো দুর্বল করে দেয় উন্নয়ন যদি মানুষকে আত্বকেন্দ্রিক ও বিচ্ছিন্ন করে ফেলে, উন্নয়ন যদি একটি শ্রেনির ভোগবাদিতা, লোভ লালসা বাড়িয়ে দেয়, উন্নয়ন যদি দুর্নীতি ছাড়া না হয়, তখন উন্নয়ন নিজেই এসবের দারা আক্রান্ত হয়।কম্প্রোমাইজ জা্তীয় সংস্কৃতিতে রুপ নেয়।মানুষ তখন বেচে থাকার স্বার্থেই কম্প্রোমাইজ করে।উন্নয়নের সুফল হয় সঙ্কুচিত।ট্রানিজিশান ধাবিত হয় অবক্ষয়ের আর অন্ধকারের দিকে।

সবচে দুর্ভাগ্য হলো আমরাও সবাই কম্প্রোমাইজ করছি।চোখের সামনে অন্যায়কে দেখেও কিছুই করছিনা, কারন ভয়।নিজের নিরাপত্তার র্স্বার্থে।বিচারহীনতা, নিরাপত্তাহীনতা, দুর্ভোগ ইত্যাদির শঙ্কা আমাদের সবাইকে নিস্ক্রিয় করে ফেলেছে।অন্যের বিপদে বা দেশের বিপদে ঝাপিয়ে পড়ার ঐতিহ্য আমাদের আর নেই।ইচ্ছাটাও ক্ষয় হয়ে গেছে।এই পরিবর্তন কি কাম্য ছিল?

সুতরাং যে পরিবর্তনের কথা প্রথমেই শুরু করেছিলাম, আমরা কি কাঙ্ক্ষিত ট্রানিজিশান এর মধ্য দিয়ে যাচ্ছি? ৭১ এ যে ট্রানজিশান হয়েছিল তা ছিল প্রতিটি বাঙ্গালীর অন্তরের আকাঙ্ক্ষা (কিছু রাজাকার ছাড়া)।আমরা কি তখন কোনো কম্প্রোমাইজ করেছিলাম? বোধহয় না।এমনকি ভারত আমাদের এত উপকার করা সত্তেও আমরা তাদের সেনাবাহিনীকে আমাদের ভুখন্ডে প্রয়োজনের বেশী সময় থাকতে দেই নাই।যাহোক, আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র আমাদের মাঝখানে থামিয়ে দিয়েছিল।এখন বোধহয় সময় হয়েছে সবকিছু  পুনর্গঠিত করার।উন্নয়নের (অর্থনৈতিক) কিছু আশা যখন আমরা পেয়েছি আমাদের উচিত সমভাবে সব দিকে নজর দেয়ার।অনিয়ম, অন্যায়, দুর্নীতি, কুশাসন অত্যাচার, অনাচার, অসম শিক্ষা, ইত্যাদি সকল ব্যপারে কম্প্রোমাইজ না করা।বিশ্বায়নের এবং মুক্তবাজারের লোভে মুল্যবোধের সাথে কম্প্রোমাইজ না করা।নতুন প্রজন্মের বিবেক দলীয় স্বার্থে বিসর্জন না দেয়া, সর্বপরি রাস্ট্রের নেতৃত্বের উচিত আম জনতার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাতে তারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাড়াতে পারে।একমাত্র জনতার শক্তি পারে সব অন্যায় দূর করতে।তাই জনতার শক্তিকে বিভেদ সৃষ্টির এবং কম্প্রোমাইজের মাধ্যমে, নিঃশেষ করে দেয়ার আগেই পরিবর্তন দরকার।

পরিশেষে মনে পড়ছে জাপানের টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন এমিরেটাস প্রোফেসরের (নাম মনে নেই)উক্তি।নতুন প্রজন্মকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেছিলেন "প্রবীনরা গত শতাব্দীতে যত উন্নয়ন সাধন করেছে, সাথে সাথে তত জঞ্জালও তৈরী করেছে।তোমরা (নবীনরা) আগামি ৫০ বছর এই জঞ্জাল সমুহ নির্মুল করার কাজেই ব্যাস্ত থাকবে।