বাংলাদেশের হাওড় মনষ্টার

শাহ মুর্শিদ
Published : 23 August 2015, 06:56 PM
Updated : 23 August 2015, 06:56 PM

টিভিতে এনিমেল প্ল্যানেট চ্যানেলে জেরেমী ওয়েডের রিভার মনষ্টার পর্বগুলো আমি বার বার দেখি।  ছোটবেলায় বড়শিতে মাছ ধরার নেশা ছিল বলেই হয়তো এই এক্সট্রিম এংলারের দৃশ্যগুলো এত ভালোলাগে। কিন্ত তার চেয়েও বড় কথা, এই রিভার মনষ্টার পর্বগুলো আমাকে বহু বছর আগের এক রাতের স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। আজ যদি সেই সময় থাকতো তাহলে জেরেমীকে বাংলাদেশের হাওড়ে মনষ্টার খুজতে অনুরোধ করতাম।

অফিসের কাজে হাওড় এলাকায় আমাদের কয়েকটি শাখা অফিসে প্রশিক্ষন দিতে গিয়েছিলাম। মার্কুলি, আনন্দপুর, দাউদপুর, দিরাই ইত্যাদি গ্রামে ছিল আমাদের শাখা বা ক্যাম্পগুলোর অবস্থান। ঢাকা থেকে ভৈরব তারপর লঞ্চে মার্কুলি। সেখান থেকে যেতে হবে সবগুলো শাখায় কিন্ত পাড়ি দিতে হবে সমুদ্রের মত সেই হাওড় তাও কিনা ছোট ছৈয়া নৌকায়। সেই সময় ইঞ্জিনের নৌকার প্রচলন হয় নাই। পুরো একদিন লাগতো এক ক্যাম্প থেকে আরেক ক্যাম্পে যেতে। যাহোক, এসব বৃত্তান্ত লেখা আমার উদ্দেশ্য নয়।

কাজের এক পর্যায়ে পৌছালাম আনন্দপুর। ছোট্ট গ্রাম, চারিদিকে তার অথৈ পানি। ঢেউ আছড়ে পড়ছে দ্বীপের মত সেই গ্রামের চারিদিকে। গ্রামের ঠিক মাঝখানে একটি টিনের ঘরে অফিস, সামনে বারান্দা। সন্ধ্যায় বাবুর্চি একটা হ্যাজাক জালিয়ে দিয়ে গেল উঠানে। গ্রামের পুরুষদের নিয়ে ছিল আমাদের সমিতি যার বেশিরভাগই ছিল মৎসজীবি। একটু পর একজন দুজন করে বেশ কয়েকজন সমিতির সদস্য হাজির হলো সেখানে। আমিও বসলাম তাদের সাথে। অন্ধকার নেমে এসেছে ততক্ষনে, হাওড় আর দেখা না গেলেও ঢেউএর ছলাৎ ছলাৎ শব্দ কানে ভেসে আসছিল অবিরত।

আমার চার পাশে ঘিরে ওরা বসে পড়লো, শুরু হলো আলাপ। মাছের কথা উঠতেই বৃদ্ধ বয়সের একজন বলে উঠলো এখন আর হাওড়ে আগের মতন মাছ নাই। বুঝলাম, একসময় মাছ ধরা ছিল তার পেশা। কিন্ত জেলে বলে সম্বোধন করায় বয়োজেষ্ঠ কয়েকজন একসাথে প্রতিবাদ করে উঠলো। তারা তাদের জেলে বলে মানতে নারাজ। বল্লো, তারা জেলে নয়, মাছ শিকারী। আমি কিন্তু ভেবে পাচ্ছিলামনা কেন তারা এই পার্থক্য করতে চাইছে?
তারপর, এই পার্থক্য বুঝতে গিয়ে তাদের মুখ থেকে সেই রাতে যে কটি কাহিনী আমি শুনেছিলাম তার তুলনা শুধু এনিমেল প্ল্যানেটের রিভার মনষ্টারের পর্ব গুলোর সাথেই মেলে। আর তারা যে যথার্থই মাছশিকারী, আমার তাতে আর কোনো সন্দেহ রইলনা।

আনন্দপুর গ্রামের এমনি এক কাহিনী। এমনি এক বর্ষায় খবর এলো গ্রামের হাঁসগুলো পানিতে নামলে আর ফিরছেনা। পাশের গ্রামের এক ছোট শিশুও নিখোঁজ। খবর গেল এই মাছশিকারীদের কাছে। তারা লম্বা জেলে নৌকা নিয়ে হাজির হলো। সামনের গলুইতে হ্যাজাক বাতি জ্বালানো, পেছনে  হারপুন হাতে শিকারীর তীক্ষ দৃষ্টি। হাওড়ে বড় মাছ ধরার এটাই পদ্ধতি। হ্যাজাকের আলোয় সন্মোহিত হয়ে  মাছ ভেসে ওঠে জলের উপর আর সেই সুযোগে হারপুন ছুড়ে মারে শিকারী। বক্তা নিজেই ছিল সেই শিকারী।

সে বলতে লাগলো যে প্রথম রাতে গ্রামের চারিদিকে নৌকা বেয়ে তারা কিছুই দেখতে পেলোনা। দ্বিতীয় রাতে আবার অভিযান শুরু করলো। সেই রাতেই দেখা মিললো হাঁস খাদকের। বিস্মিত ভাবে দেখল তাদের নৌকার সমান সাইজের প্রকান্ড এক বোয়াল মাছ ভেসে উঠলো পানির উপর।শিকারী তড়িত সিদ্ধান্ত নিল হারপুন ছুড়ে না মারার, কারন হারপুন বিদ্ধ হলে সেই বোয়াল যে দৌড় দিত তার বেগ সামলানো তাদের পক্ষে সম্ভব হতোনা। মৃত্যু ছিল অনিবার্য। দৈত্যাকার সেই বোয়াল তারা ধরতে পারে নাই বটে তবে হাঁস আর শিশু হারানোর রহস্য উদ্ধাঘাটন করতে পেরেছিল ঠিকই।

এই সিদ্ধান্তের যুক্তি সঙ্গত ব্যাখ্যা সে দিয়েছিল আরেকটি কাহিনী বলে, আর সেটা ছিল আঈড় মাছের কাহিনী। এমনি ভাবে তার দল প্রকান্ড এক আঈড় মাছকে হারপুন দিয়ে গেঁথেছিল। কিন্ত মাছটি দমার পাত্র ছিলনা। হারপুন গাথা অবস্থায় দিয়েছিল দৌড়। দুর্ভাগ্যবশত, তাদেরই একজন শিকারীর পায়ে দড়িটি ছিল আটকে। টানের চোটে নৌকা থেকে সে ছিটকে পানিতে গিয়ে পরেছিল। তাকে আর জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।

মাছের দ্বারা মানুষের মৃত্যুর আরেকটি কাহিনী তারা আমাকে বলেছিল। তখন হাওড়ে অনেক বড় বড় পাঙ্গাস মাছ পাওয়া যেত। জেলেরা পাঙ্গাসের ঝাঁককে প্রথমে জাল দিয়ে ঘিরে রাখতো। তারপর প্রতিদিন কিছুকিছু মাছ ধরে বাজারজাত করতো। এমনি একটি ঘেরে জেলেরা লক্ষ্য করলো মাছ যা থাকার কথা, তা যেন কমে যাচ্ছে। সিদ্ধান্ত নিল ব্যাপারটি পরীক্ষা করার। নামালো ডুবুরীকে। কিন্ত সে আর ভেসে উঠছেনা। পরে দেখা গিয়েছিল যে জালের এক জায়গা ছিদ্র করে পাঙ্গাস গুলো বেড়িয়ে যাচ্ছিলো। ডুবুরী বুঝতে পেরে তা বন্ধ করার চেষ্টা নিয়েছিল কিন্ত সেই দৈত্যাকার পাঙ্গাসের ঝাঁক তাকে এমন ভাবে চেপে ধরেছিল যে তাদের কাছ থেকে সে আর মুক্তি পায়নি।

সত্যি, ভয়ংকর তাদের সেই অভিজ্ঞতার কাহিনী শুনতে শুনতে রাত দুটো বেজে গিয়েছিল। হাওড়ের সেই ভয়ংকর মনষ্টারদের গল্পগুলো আজ ও আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল। এনিমেল প্ল্যানেটের রিভার মনষ্টারের কাহিনী গুলোর সাথে আমি যেন তার সাদৃশ্য খুজে পাই। বাংলাদেশে সেই সব হাওড় মনষ্টারদের কাহিনী এখন আর শোনা যাবেনা। সেই শিকারীরাও হয়তো আর বেঁচে নেই।