চোখের ক্ষুধার সাতকাহনঃ কাঠ খায় কয়লা হাগে

সোহেইল মুশফিক
Published : 5 Oct 2011, 02:12 AM
Updated : 5 Oct 2011, 02:12 AM

ছেলেবেলায় পেট ভরে একবার খেয়ে উঠেই সবাই যখন খেতে বসতো , সবার দেখাদেখি আমিও তখন আবার খেতে চাইতাম। স্পষ্ট মনে আছে , আমার এই দ্বিতীয়বার খেতে চাওয়ার বিষয়টিকে আম্মা ''চোখের ক্ষুধা'' বলতেন । পেটে ক্ষুধা না থাকা সত্তেও স্রেফ চোখের ক্ষুধার বশবর্তী হয়ে দ্বিতীয়বার খেতে বসতে বারণ করতেন খাবারটা নির্ঘাত নষ্ট করবো বলে ।

আমি কি আর আম্মার কথা শুনতাম ! দ্বিতীয়বার খেতে বসতাম এবং নির্ঘাত খাবারটা নষ্ট করে আম্মার হাতের মার খেতাম। মায়ের হাতের মার খাওয়াকে চোখের ক্ষুধার একটা কারণ মনে করার বয়সটা পেড়িয়ে আসার পর এখন বুঝি, চোখের ক্ষুধা কেবল মার খাওয়ার বিষয় নয়, মার দেয়ারও বিষয়। চোখের ক্ষুধা হচ্ছে সেই ক্ষুধা; সার্বজনীন সামগ্রিকতাকে নির্দ্বিধায় উপেক্ষা করে একার নিজের নিরন্তর ভোগের প্রতি মানুষের মাত্রাতিরিক্ত লালসার তাৎক্ষণিকতা – যা ব্যক্তিকে একবার পরিপূর্ণ করার আগে অন্য দশজনকে দশবার ধ্বংস করে আসে। ব্যক্তি সমাজ সভ্যতা মানবিকতা সবকিছুকে নিঃশেষ করে দেয়। কাঠ খেয়ে কয়লা হাগে । কয়লা খেয়ে হাগে ছাই। ছাইয়ের গাঁদায় মানিক খোঁজা গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে ফের কাষ্ঠ সংগ্রহে নামে। আমরা বুঝতেও পারিনা , টের পাওয়ার আগেই নানা-রূপে ,নানা-বর্ণে, নানা-গন্ধে, নানা-ছন্দে শিকারীর চোখের ক্ষুধার নিরন্তর শিকার হয়ে যেতে থাকি আমরা যাপিত বাস্তবতার প্রতিটি পলে পলে ।

মানুষের পেটে ক্ষুধা থাকলে পেটের ক্ষুধা মেটানো যায়। চোখের ক্ষুধা মেটানো যায় না। অথচ মানবিকতা হারানো রাষ্ট্র, স্বচ্ছতা হারানো বিচার ব্যবস্থা, নৈতিকতা হারানো রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সাংবাদিক, শিল্পী বুদ্ধিজীবিসহ এমন কোনো একটা সেক্টর নেই , প্রতিনিয়ত যাদের চোখের ক্ষুধা মেটানোর নিরন্তর যোগান দিয়ে যাচ্ছে না বাংলাদেশের জনগণ । তারপরও ক্ষুধা মিটছে না কারো । চাল, ডাল, তেল, নুন, পেয়াজ, রসুন, আদা, জিরা, জ্বর, সর্দি, শেয়ার বাজার, স্কুল, কলেজ, বই খাতা , মশারী, কয়েল, কাপড়া, মাকান ,জ্বালানী,কনভেন্স, কনডম, ডিশএন্টেনা, সেল নেটওয়ার্ক , মামলা মোকাদ্দমা, ঘুষ, দূর্নীতি, স্ট্যাম্প, রেভিনিউ, পদ্মার ইলিশ , মাদক, ওয়াসা, বিদ্যূৎ, ড্রাইভিং লাইসেন্স , ব্রা, পেন্টি, আন্ডারওয়্যার, ওয়াশিং পাউডার, ব্যাংক, বীমা, শেয়ার বাজার, অপসংস্কৃতি , স্বপ্ন ও আশা – সবকিছু থেকে লুটে নিচ্ছে যাচ্ছে মানুষের টাকা । লুটে নিয়ে হজমও করে ফেলছে রাষ্ট্রের বুকে হেগে দিয়ে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দূর্বৃত্তায়ন, স্বেচ্ছাচারিতা, অনৈতিকতা , ম্যানেজ কালচার , ব্যক্তিগত ও সামাজিক অস্থিরতার পাকাপোক্ত প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি। রাষ্ট্রও কিছু বলছে না, বরং কখনো প্রত্যক্ষ মদত দিচ্ছে, কখনো বা পরোক্ষ । দীর্ঘদিন থেকে এসব দেখে দেখে এবং প্রতিনিয়ত এসবের ভেতর দিয়ে লালিত পালিত ও শাসিত শোষিত হতে হতে জনগণও বুঝে ফেলেছে – কোথাও যেহেতু কোনো প্রতিকার নেই , বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্পিরিট খামাখা আর বুকে ধরে রেখে, কিসের আশায় তবে আর শুধু অন্যের কাবারের হাড্ডি হয়ে থাকা ,নিজেই স্বয়ং কাবাব খাওয়া শুরু করা ভালো ! বাঘ যদি হরিণ খাবেই , হরিণও খাবে ঘাস । উজাড়ই যদি হবে জঙ্গল , কেউ উপোস থেকে আর লাভ কি , সকলে খেয়ে দেয়েই উজাড় হোক।

আগের লাঙ্গল যেভাবে হাঁটে , পেছনের লাঙ্গলও সেভাবে হাঁটে । শুরু হলো আরেক নতুন অধ্যায়। সন্মিলিতভাবে সকল আমজনতার নষ্ট হওয়া। কেউ কারো কথা শোনেনা । কারো প্রতি কারো কোনো দায়িত্ববোধ নেই, শ্রদ্ধাবোধ নেই্। কাউকেই তোয়াক্কা করেনা কেউ। সুবচন নির্বাসনে গিয়ে কথা বলা শুরু করলো পয়সা । পথ নিয়ে আর মাথা ঘামানোর অবকাশ রইলো না কারো। যে কোনো মূল্যে জেতাটাই আরাধ্য হয়ে উঠলো সবার। যে মধ্যবিত্তিয় মূল্যবোধ বাংলাদেশ জাতি রাষ্ট্রের ভিত্তি-তা আর কল্কে পেলোনা সংখ্যাগরিষ্ঠ হাতে । শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনীতিকে মননশীলতায় ঋদ্ধ না করে উৎপাদনশীলতায় দগ্ধ করে তোলা শুরু হলো এক কালো রাতে ছোবলে ।
বোঝতে চাইল না কেউ,

'লক্ষীর নিরঙ্কুশ লোভে কচলালে সমকাল
চিরকাল পস্তায় সরস্বতি
লেপের ওমে সাপের ঠান্ডা শরীর
ভিজিয়ে দেবে ঘুম পৌষের মাঝরাতে।'
( আমার ঋত্বিক বেঘোরে উন্মাতাল ষাড় কবিতা থেকে)

সামাজিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করার কাজগুলি নির্দ্বিধায় সংঘটিত করে ফেলছি আমরা । স্ত্রীর সাথে নিজের যৌনসঙ্গমের দৃশ্য ভিডিও করে বাজারজাত করে দিচ্ছে কেউ কেউ। ছাত্রীকে বেশী নম্বর পাইয়ে দেয়ার লোভ দেখিয়ে অনবরত যৌন হয়রানি, ধর্ষণ করে যাচ্ছে শিক্ষক । প্রেমিকার নিরাভরণ শরীর দৃশ্যবন্দি করে ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করে যাচ্ছে প্রেমিক । কখনো কখনো ধর্ষণ করে মেরে ফেলছে। প্রবাসী স্বামীর কষ্টার্জিত অর্থ মেরে দিয়ে অন্য লোকের সাথে ভেগে যাচ্ছে স্ত্রীরা। সন্তানের মায়াও করছেনা । ক এর পাছায় ঠিকমতো ব দিতে না জানা লোকটি স্রেফ কয়টি টাকার জোরে হয়ে যাচ্ছে স্কুল কমিটির সভাপতি। ঘুষ দূর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি পেয়ে যাচ্ছে পরিবার ও সমাজে। লোকে মেয়ে বিয়ে দিচ্ছে ছেলের বাড়ি গাড়ী ইনকাম সোর্স দেখে। শিক্ষা ও মেধা গুরুত্ব পাচ্ছেনা সে অর্থে । নতুন কোনো চিন্তা নাই।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে গবেষণা নাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকায় উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশ গিয়ে দেশে ফিরছে না শিক্ষকেরা । টাকাও শোধ করছে না কেউ কেউ। পাঁচ হাজার টাকার নীচে সাধারণ একটা জ্বরের চিকিৎসা হয় না দেশে । পাঁচ মিনিটে পাঁচশো টাকা ফি নিয়ে ডাক্তাররা আরো পাঁচ হাজার টাকা খরচের ফর্দ ধরিয়ে দিচ্ছে হাতে। একই পরীক্ষার একেক ফলাফল ধরিয়ে দিচ্ছে ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলি। বইয়ের ভারে ন্যূজ হয়ে যাচ্ছে কোমলমতি শিশুরা। জ্ঞানের ধারে আলোকিত হচ্ছে না । সন্তানের শৈশব , কৈশোর এবং সামর্থ্যকে গলাটিপে হত্যা করছে অভিভাবকেরা অসুস্থ প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়ে অলীক স্বপ্ন বাস্তবায়নের আশায়। অ্যান্টি ড্রাগ ডিপার্টমেন্ট ও র্যা ব পুলিশের কমতি নাই দেশে । অথচ মাদকের করাল গ্রাসে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে তরুন সমাজ । রিয়েল হিপোক্র্যাট, দূর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী ও নতুন পুরাতন আমলা কামলার আড্ডাস্থল হয়ে গেছে রাজনীতি । নামে সংসদীয় গণতন্ত্র অথচ ক্ষমতায় যেতে না পারলে সংসদে থাকে না কেউ । রাজনৈতিক বিবেচনায় পদ ও পদবী নির্ধারিত হওয়ার কারনে পড়াশোনার ধার ধারছে না কেউ । রাজনীতিতে নাম লেখাচ্ছে সদলবলে। ফলে মেধাহীনতায় ছেয়ে যাচ্ছে দেশ। ক্রমে ক্রমে আমরা এক গভীর অমানিশার দিকে ধাবিত হচ্ছি।

শেখ হাসিনার মাছে ভাতে বাঙ্গালী ও খালেদা জিয়ার ডালে ভাতে বাংলাদেশী তত্ত্বের মুগুর ভাঁজতে ভাঁজতে আমরা এমন এক পরস্পর বিরোধী অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছি যে , এক দল যদি বলে দুধ ; অন্যদল নিমিষেই সেটাকে কুত্তার মুত বলে প্রত্যাখান করতে দ্বিধা করছে না ।

ফলে বাংলাদেশ রাষ্ট্র এখন অথৈ সমুদ্রে দিক হারিয়ে ফেলা জাহাজের মতো উদভ্রান্ত ঘুরছে ।
গণতন্ত্রের চতুর্থস্তম্ভ বলে খ্যাত প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াও পাত দেখে সাহিদারি করছে ।
মাত্রাতিরিক্ত চক্ষুজাত ক্ষুধাক্রান্ত হয়ে পড়া বাঙ্গালী জাতিকে তীরে টেনে তুলবে কে ?
তারুণ্য , তুমি ।
তোমার প্রণোদনা- তোমার আছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, হাজার বছরের ঐতিহ্যমন্ডিত বাঙ্গালী সংস্কৃতি ।
আর ?
আপাতঃ দিক হারিয়ে ফেলা মানুষ চৌদ্দকোটি ।
আর তোমার অবস্থান হবে – আমার এক প্রিয় বন্ধুর ভাষায় – অবশ্যই নিরপেক্ষতা নয় , ন্যায্যপক্ষতায় ।
তাহলে শুরু হয়ে যাক..নতুন পথ চলা ।