কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত এবং একটি সম্ভাবনার অপমৃত্যু

নবকুমার দত্ত
Published : 28 April 2018, 04:26 AM
Updated : 28 April 2018, 04:26 AM

কোথাও পড়েছিলাম, যে দেশের কপালে সাগর জুটেছে, তার অর্থনৈতিক উন্নতির গ্রাফ ঊর্ধ্বমুখী। একথা বাংলাদেশের জন্য একদমই খাটে না। ছোট ছোট সমুদ্রসৈকত নিয়ে কতই না আদিখ্যেতা আর আহ্লাদ করে কিছু কিছু দেশ। পর্যটকের ভিড় লেগেই থাকে সেসব দেশে। অর্থনীতি চাঙ্গা হতে থাকে তাদের। অথচ পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত থাকা সত্ত্বেও আমাদের সাধের কক্সবাজারে বিদেশি পর্যটক দেখা যায় না। এই সৈকতের রূপ আর আতিথেয়তা বেচে আমাদের ধন ভাণ্ডার ফুলে-ফেঁপে উঠতে পারতো। বাংলাদেশ হতে পারতো লাখো বিদেশি পর্যটকের প্রথম পছন্দ। বাংলাদেশের রূপ আর লাবণ্যের প্রেমে মাতোয়ারা হতে পারতো সারা বিশ্ব। অথচ আমরা প্রতিযোগিতা করে সৌন্দর্যের এই ভাণ্ডারকে নিঃশেষ করে দিচ্ছি।

কক্সবাজার এখন একটি 'বিরক্তিকর' জায়গার নাম হয়ে উঠছে দিন দিন। যাদের সুযোগ আছে তারা সাগর আর সৈকত দেখতে ছুটছে বালি, পাতায়া, লাংকাউয়ি, গোয়া। কেউ কেউ হয়তো বলবেন ওদের উড়ানোর মতো টাকা আছে তাই দেশ ছেড়ে বিদেশ যায়। ব্যাপারটা পুরোপুরি সেরকম নয়। বিনোদনের জন্য মানুষ নির্ঝঞ্জাট জায়গা আর পরিবেশ খুঁজে। কিন্তু আমাদের কক্সবাজার পর্যটক আকর্ষণ করার মতো কোনো পরিবেশই নিশ্চিত করতে পারে না।

হিমছড়িতে পাহাড় ও সাগরের মিতালি

আবর্জনা আর ধুলোবালির সাম্রাজ্য: কক্সবাজার অবশ্যই বালির সাম্রাজ্য। সেটা থাকুক সৈকতে। সেখানেই বরং মানায়। কিন্তু পথে-ঘাটে ট্যালকম পাউডারের মতো সূক্ষ্ম ধুলোর উড়াউড়ি মেজাজ খিঁচড়ে দেয়। আর রয়েছে যত্রতত্র  ছড়ানো ময়লা-আবর্জনা। দেখে মনে হয় ইহকালে অত্র এলাকায় ঝাড়পোছ পড়েনি। এই ভাগাড়ে পা পাততে নিশ্চয়ই হাজার ডলার খরচ করে বিদেশ থেকে পর্যটক আসবে না। এদিকটায় কখনোই নজর দেয়নি কর্তৃপক্ষ।

আসলে তাদের সদয় নজর কোথাও কি আছে? অন্তত আমার কাছে মনে হয়েছে, কক্সবাজার কতগুলো অর্থলিপ্সু মানুষের রোজগারের উৎস শুধু। পথের ধারে বাঁদর দেখিয়ে যেমন বাজিকর টুপাইস কামিয়ে নেয়, তেমনি কক্সবাজার দেখিয়ে পুঁজিবাদিরা দু-হাতে কামিয়ে নিচ্ছে নির্লজ্জের মতো। আবর্জনা ব্যবস্থাপনার কোনো আয়োজন চোখে পড়েনি। চিপসের প্যাকেট ফেলার জন্য ডাস্টবিন খুঁজেও পাওয়া যায় না। অবশ্য পুরো এলাকাটাই একটা আস্ত ডাস্টবিন হয়ে আছে। আলাদা করে বিন রাখার কোনো দরকার কেউ মনে করেনি বলে তাদের দোষ দেয়া যায় না।

সেবাদানকারীদের অপেশাদারিত্ব দৌরাত্ম্য: সেবাদানকারী বলতে অটো চালক থেকে শুরু করে ভ্রাম্যমান ফটোগ্রাফার, স্ট্রিট ফুডের দোকানি, সৈকতের গুচ্ছ ব্যবসায়ি সবাইকে বোঝাচ্ছি। উদাহরণ দিয়ে তাদের চরম অপেশাদারীত্বের নমুনা তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

হাঙ্গরের মোড় (লাবনী পয়েন্টে প্রবেশের মুখে) থেকে সুগন্ধা বিচে প্রবেশ মুখে হেঁটে যেতে পাঁচ থেকে সাত মিনিট সময় লাগবে। অতটুকুন পথের জন্য অটোওয়ালারা ৮০ টাকা ভাড়া আদায় করেছে! কেউই এর কমে জেতে রাজি নয়। একজোট হয়ে পর্যটকদের উপর জুলুম চালিয়ে যাচ্ছে। দেখার কেউ নেই।

সৈকতে গিয়ে আরামে একটু দাঁড়াতে পারবেন না। একের পর এক 'সেবাওয়ালারা' বিরক্তির সীমানা ছাড়িয়ে দিয়ে আসবে। বালিয়াড়িতে পা রাখার আগেই বাইকওয়ালা, ওয়াটার স্কুটারওয়ালারা আপনাকে পুনঃপুন আহ্বান করতেই থাকবে। দলে দলে ভ্রাম্যমাণ ফটোগ্রাফার আপনার ছবি তুলে দেয়ার জন্য জোঁকের মতো লেগে থাকবে। কেউ কেউ তাদের দিয়ে ছবি তুলিয়ে নিচ্ছে। ছবি তোলা শেষে ওদের চালাকিপূর্ণ (আসলে প্রতারণা) আচরণে পর্যটকদের চেহারার মানচিত্র পরিবর্তনও হয়ে যাচ্ছে।

সৈকতে পাতা সারি সারি বিচ চেয়ারে বসার সাথে সাথেই রিসিপ্ট ধরিয়ে ৩০ টাকা আদায় করে নিবে। তবে সবুজ রং করা কিছু সরকারি চেয়ার আছে যেগুলোতে ফ্রি বসতে পারার কথা। কিন্তু কেউই এই খবরটি জানে না বিধায় তাদেরকেও টাকা দিতে হয়। আমি খুঁজে খুঁজে একটি সরকারি চেয়ারে বসার পর যথারীতি টাকা চাইতে আসলো একটা ছেলে। আমি জানালাম এটা সরকারি চেয়ার, তোমাকে কেনো টাকা দেবো। সে গলার স্বর একটু উঁচু করে যা বললো তার অর্থ হলো, "সরকার কি চেয়ার থেকে বালু মুছে দেয়? জোয়ার-ভাটার সময় চেয়ার টেনে সরায়?" কথা সত্য। সরকার চেয়ার দিয়েছে কিন্তু চেয়ার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কাউকে দিয়েছে কিনা জানা নেই। যাই হোক, সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেটকে ফোন করে জানাবো বলাতে সেই ছেলে আর টাকার জন্য ঘ্যানঘ্যান করেনি।

একটু আরাম করে বসে চোখ বন্ধ করে সমুদ্রের শব্দ শুনবেন বা হারিয়ে যেতে চাইবেন কল্পনার দূর দ্বীপে? কোন চান্স নেই। ক্ষণে ক্ষণে ছোট ছোট বাচ্চা ছেলেরা এসে বলবে, 'ম্যাচেচ'। এর অর্থ ম্যাসেজ। এরা ঘন্টা চুক্তিতে মাথা ও হাত-পা ম্যাসেজ করে দেয়। একটা বাচ্চা ছেলের পিড়াপীড়িতে মাথা ম্যাসেজ করাতে রাজি হলাম। ছোট ছোট হাতে ম্যাসেজের নামে কি করলো বুঝলাম না। ওর হাত থেকে মাছের আঁশটে গন্ধ আসছিলো। এটাই মনে হয় স্বাভাবিক। আমি সাগরের পারের মানুষদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় এই আঁশটে গন্ধটা পাই। তবে থাইল্যান্ড-ব্যাংককের মতো কক্সবাজার সৈকতেও ম্যাসেজের রমরমা ব্যবসা হতে পারে যদি এই আনাড়ি সেবাদানকারীরা উত্তম প্রশিক্ষণ পায়।

সুগন্ধা পয়েন্টে যেতে সামুদ্রিক মাছ, স্কুইড, অক্টোপাস, কাঁকড়া ইত্যাদি সাজানো দোকান রয়েছে কিছু। ইচ্ছে করবে চেখে দেখতে। দরদাম করে খেতে পারেন সি ফুড। কিন্তু স্বাদের ক্ষেত্রে গ্যারান্টি দিতে পারছি না। আমি স্কুইড খেতে বসে  'কী' খেলাম জানি না। একটা টুনা মাছ ফ্রাই করে দিতে বললাম। আমি শতভাগ নিশ্চিত ছিলাম, যেই টুনা মাছটি আমি পছন্দ করে দিয়েছিলাম, দোকানের ভিতরে রান্না ঘরে গিয়ে সেটি পরিবর্তন হয়ে গেছে। টুনা মাছের কটকটি বানিয়ে এনে দিলো। বিস্বাদ খেতে। কিছুটা নষ্ট গন্ধও পেয়েছিলাম। কয় স্লাইস খেয়ে আর রুচি হয়নি।

হোটেলওয়ালাদের অপেশাদারিত্ব:  বিভিন্ন দেশে এমনকি দেশের ভিতর মফস্বলের হোটেলেও যে ধরনের সার্ভিস পাওয়া যায়, তার অর্ধেকও পাবেন না কক্সবাজারের একটা ভালো মানের হোটেলে। আমি মান বোঝাতে অবশ্যই গাঁটের টাকা খরচকে বিবেচনায় নিয়েছি। প্রতিরাত ২০০০ টাকায় যে হোটেলে ছিলাম সেখানেও রুম সার্ভিস বলতে যে একটা ব্যাপার আছে তার দেখা পাইনি। বার বার বলার পরেও এরা প্রতিদিন রুম ক্লিন করে না, বেড কভার পাল্টায় না, পানি দেয় না; ব্রাশ পেস্ট চিরুনি এসবের কথা বাদই দিলাম। কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্টের কথা এরা শুনেওনি মনে হলো। জানি না অন্যান্য হোটেল গুলোয় কেমন অবস্থা। আমি ছিলাম ম্যাসকট হলিডে রিসোর্ট নামক একটা হোটেলে।

অপরিকল্পিত অবকাঠামো: ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠা হোটেল-মোটেল-রিসোর্ট দেখলে যে কেউ বুঝতে পারবে এগুলোর পেছনে কোনো সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার বালাই নেই। নেই পথঘাট। ফুটপাত জিনিসটা তো নেই-ই। যে যেভাবে পারছে দালান-কোঠা তুলে ব্যাবসা ফেঁদে বসেছে শুধু। সৈকতের উপরেও অবকাঠামো আছে। ভূমি গিলে খাওয়ার প্রচেষ্টা স্পষ্ট। প্রকৃতিকে বিকৃত করে গড়ে উঠছে (নাকি ভেঙে পড়ছে!) কক্সবাজার।

হিমছড়ির কবর রচিত হয়েছে: কক্সবাজারে গিয়ে একবার হিমছড়িতে ঘুরে আসে না এমন পর্যটক কমই আছে। আমি বিশেষত যাই ওখানের একটা রেস্তোরাঁয় খেতে। সান ড্যান্সার নামক রেস্তোরাঁয় বসে সাগর দেখতে দেখতে ওদের স্পেশাল থালি দিয়ে লাঞ্চ করা আমার সামান্য শখ। গত মার্চে হিমছড়ি গিয়ে খুব খারাপ লেগেছে। প্রতিযোগিতা করে প্রকৃতিকে নষ্ট করতে আমরা এতই করিৎকর্মা যে হিমছড়ির বর্তমান চেহারা তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। সৌন্দর্য বর্ধনের নামে সৌন্দর্য বর্জন করা হয়েছে। পাহাড়চূড়া থেকে অসীম সমুদ্রের উদোম চেহারা দেখতে দেখতে চরম নিরস মানুষটাও কবি হয়ে উঠার কথা। সেই নির্জন সবুজ পাহাড়চূড়া এখন স্থাপনায় ঢেকে গেছে। দোকানপাট বসে মেলা হয়ে গেছে। ওখানে কিছু দেখার নাই আর। তার পাশেই একটা ঝর্ণা আছে। কোনমতে এখনো রোগীর গায়ে দেয়া স্যালাইনের মতো টিপটিপ করে ঝরছে জল। এই ঝর্ণাকে ঢেকে ফেলেছে কর্পোরেট রাক্ষসেরা। নোংরা আবর্জনা রোধ করেছে বয়ে চলা সামান্য জলের ধারার পথ। কিছুই আর দেখার নেই ওখানে। খুব কষ্ট হয়েছে এসব দেখে।

হিমছড়ির পাহাড়ের শির থেকে দেখা দিগন্ত জোড়া সমুদ্র

পাহাড়ের চূড়োয় দোকানপাটের জঞ্জাল

ঝরনা দেখবেন নাকি বিজ্ঞাপন?

সাবধান বাণী নাকি বিজ্ঞাপন?

ঝর্ণার জলে পর্যটকদের ছুঁড়ে ফেলা ময়লা

মহেশখালীতে সাবধান: মহেশখালির মিষ্টি পান খেতে হোক আর আদিনাথ মন্দিরে প্রণতি জানাতেই হোক কিংবা বৌদ্ধ দেবের মন্দিরে বিনত হতেই হোক পর্যটকগণ মহেশখালিতে ঢু মারতে যায় কেউ কেউ। কক্সবাজার থেকে অটোতে করে ছয় নম্বর ঘাট যেতে হবে। ওখান থেকে ৭৫ টাকা করে মাথাপিছু ভাড়া দিয়ে স্পিডবোটে করে মহেশখালি ঘাট। ঘাটে নামার পরই শুরু হবে সার্কাস। রিকশাচালক ও অটোচালকেরা আপনাকে মহেশখালি ঘোরাতে নিয়ে যাওয়ার অফার দিবে। তারপরই শুরু হবে ছলাকলা। আগামাথা ছাড়া ভাড়া হাঁকাবে আর কি কি দেখাবে তার ফিরিস্তি দিবে।

অনেক দরদাম করে ৩০০ টাকায় একজন রিকশাচালককে নিয়ে রওনা হলাম। প্রথমে একটা বৌদ্ধ মন্দিরে নিয়ে গেল। তারপর তার অনিচ্ছায় পাশের আরেকটা বৌদ্ধ মন্দিরে নিয়ে গেলাম। ওখান থেকে আদিনাথ মদিরে যাওয়ার পথে ছোট্ট একটা ব্রিজ পেরিয়ে বামে তাকালে গুটিকয় লবন ক্ষেত আর ডানে বাঁশের বাজার। রিকশাচালক আমাদের বোঝালো এই ব্রিজ, লবনক্ষেত আর বাঁশ মহাল তার লিস্টে থাকা স্পটের অন্যতম। এই স্পটের ফিরিস্তি সে গাল ভরে দিচ্ছিলো রিকশা ভাড়া করার আগে। এরপর আদিনাথ মন্দিরে পৌঁছে রিক্সাচালক থেকে ৩০ মিনিট সময় নিয়ে পাহাড়ের উপরের শিব মন্দিরে গেলাম।

মন্দিরে তখন চলছিলো নিত্য পূজোর প্রস্তুতি। মন্দিরের শুনসান চত্বরে কিছু সময় কাটিয়ে আরো একটু উপরের দিকে চলে গেলাম। ওখানে প্রাচীন একটি স্থাপত্য রয়েছে। নিচে নেমে এসে বাম দিকের প্রথম দোকানটি থেকে মাত্র ২০ টাকায় ডাব খেলাম। দোকানটি একজন বয়স্ক নারীর। মহেশখালি গেলেই আমি উনার দোকানে বসে গল্প করি আর ডাব খাই।

যা হোক, ৩০ মিনিটের স্থলে ৪০ মিনিট লেগে গিয়েছিলো। ফিরে এলাম ঘাটে। রিকশাচালক গাইগুই করা শুরু করলো। আমরা ১০ মিনিট বেশি ব্যয় করেছি এবং একটি বৌদ্ধ মন্দির বেশি দেখেছি। তাই বাধ্য হয়ে আরো ৫০ টাকা বেশি দিতে হলো।

মহেশখালীর বৌদ্ধ মন্দির

এমন অভিজ্ঞতার পর প্রশ্ন তৈরি হয়, এভাবে কি পর্যটক আকর্ষণ করা যায়? আমার আরো দুয়েকবার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ছিলো বলেই ওদের ছলাকলা বেশি কার্যকর হয়নি। কিন্তু নতুন কেউ বা বিদেশি পর্যটক পেলে নির্ঘাত কুড়াল দিয়ে পকেট কেটে ছেড়ে দেবে।

বৌদ্ধ মন্দিরের সামনের অংশ

সৈকতের এমন চেহারা অম্লান থাকুক।

তারপরও আশাবাদী হয়ে ভাবতে চাই, সর্বত্র বিশৃঙ্খলা আর জঞ্জালের স্তুপ ঠেলে একদিন কক্সবাজার হয়ে উঠবে পর্যটনের শ্রেষ্ঠ শহর। আশাবাদী মানুষ হিসেবে এতটুকু আশা করা নিশ্চয়ই সমীচীন। কেউ একজন অবশ্যই দেশকে ভালোবেসে মমতার পরশ বুলিয়ে বাংলার এই অপার সৌন্দর্যের বালিয়াড়িকে রক্ষা করবে।