রোহিঙ্গা সমস্যাঃ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংগঠনের ভূমিকা

নেয়ামুল নাহিদ
Published : 20 Nov 2016, 07:13 PM
Updated : 20 Nov 2016, 07:13 PM

লজ্জা শুধু ব্যক্তির হয় না; লজ্জা হতে পারে একটি প্রতিষ্ঠানের, একটি সংগঠনের, একটি রাষ্ট্রের। আজ মিয়ানমার ইস্যুতে দেশের, বিদেশের এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর লজ্জা পাওয়া উচিত। লজ্জা পাওয়া উচিত মিয়ানমারের, লজ্জা পাওয়া উচিত জাতিসংঘের, লজ্জা পাওয়া উচিত নোবেল কমিটির। যদিও লজ্জা এই গর্হিত বিষয়ের সমাধান নয়, কিন্তু যারা দিনের পর দিন এই সমস্যাকে প্রশয় দিয়ে এসছে – তাদের এই মুহূর্তে অন্তত লজ্জা অনুভব করা দরকার। তারা সত্যিকার কাজের হলে, অনেক আগেই উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতো।

দেশীয় অনেক সংগঠন আছে, রাজনৈতিক দল আছে – যারা নিত্য মিছিল করে, মিটিং করে সামান্য ইস্যু পেলে; সেটা হোক দেশের বা বিদেশের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়, প্রেস ক্লাব এলাকায় এটি নিয়মিত ঘটনা, কিন্তু এখন লক্ষ্য করা যায় – মিয়ানমার ইস্যু নিয়ে কারো কোন মাথাব্যাথা নেই। মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা কি সংখ্যালঘু নয়? নাকি মুসলমানেরা সংখ্যালঘু হতে পারে না কোথাও? আমি 'মুসলমান' টার্মটির উপর জোর দিচ্ছি না, আসল কথা হলো তারা তো মানুষ এবং তারা নির্যাতিত, তাহলে তাদের পক্ষে কেন আন্দোলন হয় না?

মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর নির্যাতন, তাদেরকে হত্যা করা, এমনকি পালাতেও না দেওয়া – এরকম নির্মম পরিস্থিতিতে পৃথিবীর লক্ষণীয় মানবাধিকার সংগঠনগুলোও প্রায় চুপ। জাতিসংঘের কথা বলা যায়, এটি আসলে কাদের পক্ষে?

"রোহিঙ্গা মুসলমানদের পূর্ণ নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য গত সোমবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ মিয়ানমার সরকারের প্রতি যে আহ্বান জানিয়েছে, আমরা তার প্রতি সুদৃঢ় সমর্থন জানাই। রোহিঙ্গাদের প্রতি মিয়ানমার সরকার এবং সংখ্যাগুরু আরাকানি সম্প্রদায়ের আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গি কেবল অমানবিক নয়, সব ধরনের আন্তর্জাতিক আইনেরও পরিপন্থী" – (প্রথম আলো থেকে)

সমগ্র বিশ্বের মানুষের জন্য কাজ করা জাতিসংঘ এবং এর অন্যান্য অঙ্গ সংগঠনগুলোর অন্যতম দায়িত্ব। তারা শুধু সমর্থন জানায়, উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করে – কিন্তু কার্যকর পদক্ষেপ কোথায়? এভাবে শুধু তারা মিয়ানমার ইস্যু নয়, প্রায় বিভিন্ন সমস্যাতেই তারা উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করে, যেখানে কিনা তাদের সামর্থ্য এবং শক্তি আছে সেটার সমাধান করার। তারা তা না করে বরং দু-একটা রাষ্ট্রের ক্রীতদাসে পরিণত হয়েছে। তাহলে কি জাতিসংঘের মত প্রতিষ্ঠানও নিতান্তই বিশ্বের চোখকে ধুলো দেবার জন্য?

মিয়ানমারের 'অং সান সু চি' যিনি কিনা নোবেল পেয়েছেন শান্তিতে। অথচ তার দেশের মানুষের একটি বড় অংশকে সাধারণ নাগরিক হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয় নি, বছরের পর বছর নানাভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। শুধু ধর্মের কারণে তাদেরকে নাগরিক অধিকার দেওয়া হয় নি। এমনকি তাদের জাতিগত পরিচয় মুছে ফেলার পায়তারা হয়েছে। এমন একটি দেশের বর্তমান ক্ষমতাসীন দলে আছেন সু চি, তিনি কি পদক্ষেপ নিয়েছেন তার দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য? যিনি নিজ দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনতে পারেন না, সাধারণ জনগণের অধিকার ফিরিয়ে দিতে পারেন না – তিনিই কিনা সদম্ভে বহন করছেন শান্তিতে নোবেল! তিনি নোবেল পেয়েছেন তো অনেক আগে, কিন্তু তখনো তো রোহিঙ্গা সমস্যা ছিল। অষ্টম শতাব্দী থেকে রোহিঙ্গারা বসবাস করে আসছে, সেদিকে কোন সরকার কোন প্রতিষ্ঠান নজর দেয় নি। একটি কথা বিবেচ্য – সারা বিশ্ব দেখছে মিয়ানমার সরকার যা করছে সেটা অন্যায়, তাহলে বিশ্বের শক্তিশালী রাষ্ট্র আর সংগঠনগুলো কেন নিশ্চুপ থাকে?

আমেরিকা সবসময় মুখিয়ে থাকে, কার ওখানে জঙ্গি পাওয়া গেলো অথবা এমন কোন ইস্যু যেন যুদ্ধ বাধানো যায়। মানবাধিকার রক্ষা তাদের উদ্দেশ্য নয়, আবার তারাই কিনা অনেক বড় বড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান চালায়। ওদের নাক এতো লম্বা যে, নাক গলানো ওদের চিরাচরিত অভ্যাসে পরিণত হয়েছে; কিন্তু তারা কি মিয়ানমার বিষয়ে নাক গলায়? ব্যাপারটা লক্ষণীয়, তারা এমন এমন দেশে মানবাধিকার রক্ষায় কাজ করছে, যেখানে আগেই তারা যুদ্ধ বাঁধিয়ে রেখেছে। পৃথিবীতে মগের মুলুকের অস্তিত্ব সবসময় ছিল, এখনও আছে। মিয়ানমারে এতো বীভৎসভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে, তাতে শুধু আমেরিকা কেন – কোন দেশেরই কোন প্রতিষ্ঠানের উদ্বিগ্নতা লক্ষণীয় নয়। যা একটু আছে, তা প্রায় লোক দেখানো বা মিডিয়া নির্ভর।

সাধারণ মানুষেরা সমর্থন দিতে পারে, এটাই অনেক বড় বিষয় – কিন্তু এগিয়ে আসতে হবে তো কোন রাজনৈতিক বা অন্য কোন সংগঠনের। বিশ্বের নির্যাতিত মানুষের এরকম একটি মুহূর্তে সেইসব সংগঠনগুলো যদি চুপ করে থাকে যারা কিনা দেশ ও বিদেশের নানা ইস্যু নিয়ে সবসময়-ই সোচ্চার, তাহলে তো সাধারণ মানুষের মনে সন্দেহ জাগবেই। আন্দোলন হোক মানুষের জন্য, কোন বিশেষ গোষ্ঠিকে খুশি করার জন্য নয়।