যৌতুকের চেয়েও যে প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ

নাহিদুল নীল
Published : 22 Nov 2011, 11:14 AM
Updated : 22 Nov 2011, 11:14 AM

কয়েকদিন ধরেই যৌতুক ও একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে কনের তালাক দেওয়ার ঘটনায় ব্লগ সরগরম। গণমাধ্যমেও বেশ লেখালেখি হলো। এর মধ্যে অনলাইন বার্তা সংস্থা বিডিনিউজে ব্লগার-লেখক আইরিন সুলতানার নিবন্ধ সর্বাগ্রে রাখতে হয়। তিনি ওই দিনটিকে (১১ নভেম্বর) 'যৌতুকবিরোধী দিবস' হিসেবে পালনের পক্ষে মত দিয়েছেন।

যৌতুক নিয়ে আমাদের উৎকণ্ঠার শেষ নেই। সে হিসেবে এ বিষয়ক একটি দিবস পালন অযৌক্তিক নয়। কিন্তু যৌতুক ও বিয়ের অনুষ্ঠানেই তালাক প্রসঙ্গ নিয়ে যখন তোলপাড় চলছে, তখন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সবাই এড়িয়ে গেছেন। তা হলো 'রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ' সাংবাদিকতার নীতিমালা। শামসুর রহমান তার পণ্ডশ্রম কবিতায় মানুষের একটি বাজে প্রবণতার অসাধারণ প্রকাশ ঘটিয়েছেন। সেটি হলো শোনা কথায় কান দিয়ে দৌড়ঝাঁপ করা।

গণমাধ্যম আর ব্লগের কল্যাণে সেই কনে ফারজানা এখন 'হিরো'। যথারীতি 'ভিলেন' বর হীরণ। কে দোষী কে নির্দোষ সেই বিচারের ভার আদালতের। কিন্তু বিচারের আগেই কাউকে 'চরথাপ্পর' মেরে সমাজচ্যুত করা যায় কিনা? সাজা দেওয়া জায়েজ কিনা? ব্লগে-গণমাধ্যমে এখন ফারজানার প্রসঙ্গ তুলে যৌতুকের বিরুদ্ধে যারা কথা বলছেন, তাদের এই মতের সঙ্গে দ্বিমত করার কোনো কারণ নেই। তবে খেয়াল করার বিষয়, তাদের অধিকাংশই নিশ্চিত যে, হীরণ যৌতুক চেয়েছিলেন। অর্থাৎ প-শ্রম কবিতার 'কান নিয়েছে চিলে'র মতো ব্যাপার। ফারজানা বললেন, হীরণ যৌতুক চেয়েছিলেন তাই তিনি বিয়ের অনুষ্ঠানেই তাকে তালাক দিয়েছেন। এখন ফারজানার এই বক্তব্য অন্ধের মতো বিশ্বাস করে অনেকেই ব্লগ-গণমাধ্যম ফাটিয়ে ফেলছেন।

আইরিন সুলতানা এ ক্ষেত্রে সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন বলে মনে হয়, তিনি লিখেছেন, ''যৌতুকের প্রতিবাদে ফারজানা যেদিন হীরনকে তালাক দেয়, সেদিন ছিল ১১১১১১। সংখ্যার বিশেষ বিন্যাসের কারণে এই তারিখটি বিশ্বজুড়ে নানাভাবে পালিত হয়েছে। সবার উৎসাহ ছিল, দিনটিকে কতটা অভিনবভাবে স্মরণীয় করে তোলা যায়। দ্ব্যার্থহীনভাবে বলা যায়, ফারজানার মত এ দিনটিকে এমন বিশেষত্ব দিতে পারেনি আর কেউ। বিশ্ব ১১১১১১'র গল্পকে ধারণ করতে চেয়েছিল আগামির জন্য। সাহসী ফারজানার প্রতিবাদী গল্পটা '১১ নভেম্বর' -এর প্রতীক হয়ে উঠুক, কেবল দেশে নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও। প্রতি বছর '১১ নভেম্বর' পালিত হোক যৌতুকবিরোধী দিবস।''

এই বক্তব্য পড়ে আমরা নিশ্চিতই হচ্ছি যে, আইরিন সুলতনা ওই বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। নয়তো তদন্তের আগেই তিনি কী করে নিশ্চিত হলেন, যৌতুকের কারণেই ফারজানা হীরণকে তালাক দিয়েছেন। একটি পত্রিকার প্রতিবেদনের শিরোনাম হয়েছে, 'চাকরি হারিয়েছেন যৌতুকলোভী হীরণ'। হীরণ যৌতুকলোভী কিনা, তা কি এখনই প্রমাণিত হয়েছে? ভবিষ্যতে যদি প্রমাণিত হয় হীরণ যৌতুক চাননি, ঘটনাটি ছিল অন্যরকম। তাহলে কী হবে? হীরণ কি তার সম্মান ফিরে পাবেন?

ব্লগার গুন চৌধুরী তার সহকর্মীর বরাত দিয়ে সেই বিয়ের অনুষ্ঠানে যা ঘটেছিল তার একটি বর্ণনা দিয়েছেন। মূলত ফারজানার বক্তব্যের পক্ষে সমর্থন জানিয়ে লেখা আরেক লেখকের পোস্টের মতামত অংশে গুন লিখেছেন, ''আমার সহকর্মীর গ্রামের বাড়ি বরগুনার আমতলী, যেখানে এই ঘটনাটি ঘটেছে। এবং কাকতালীয় ভাবেই, এই বিয়েতে তিনি নিমন্ত্রিত ছিলেন। ঈদের ছুটি শেষ করে আজই তিনি কাজে যোগ দিলেন, তার কাছ থেকে ঘটনাটি বিস্তারিত শুনলাম। মিডিয়ায় যেভাবে এসেছে, মূল ঘটনা তার চেয়ে কিছুটা আলাদা। এটা যেহেতু সংবাদপত্র নয়, বরং ব্লগসাইট, আমি ভেবেছিলাম, এই পোস্টের লেখকও বুঝি তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকেই ঘটনাটি লিখেছেন। কিন্তু ঘুরেফিরে সেই পত্রিকার ভাষ্যটিই আবারো পড়ে হতাশ হলাম। যাহোক, প্রত্যক্ষদর্শী প্রদত্ত বিবরণটি জানাই।

বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা দুপুরের পরে পরেই সারা হয়ে গেলেও বরপক্ষ কনের জন্য নিয়ে আসা গহনা, শাড়ি, প্রসাধনী ইত্যাদিতে সাজানো স্যুটকেসটি হস্তান্তর করে সন্ধ্যার মুখে। তাদের অযুহাত, যে গাড়িতে স্যুটকেস ছিল, সেটি নাকি কোনো কারণে পৌঁছুতে দেরি করেছে। যা হোক, বধূ বিদায়ের আগে আগে স্যুটকেস খুলে কনে-কে গহনা পরাতে গিয়েই বাধে বিপত্তি। দেখা যায়, সব গহনাই সিটি গোল্ডের, তাতে সোনার লেশমাত্রও নেই! এই ঘটনায় যখন তোলপাড় শুরু হয়, তখন বরের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজনসহ আগত বরযাত্রী উচ্চস্বরে বলতে শুরু করেন, আপনারাও তো বরকে খালিহাতেই বিদায় দিচ্ছেন, আপনারা কি ফ্রিজ-টিভি কিছু দিয়েছেন? নিজেরা কিছু দিবেন না, আবার পাওয়ার আশা করবেন- এইটা কেমন কথা! এই কথায় বেঁকে বসেন কনে ফারজানা এবং 'যৌতুকলোভী ও প্রতারক' বরকে স্বামী হিসেবে মানতে অস্বীকার করেন। তারপরের ঘটনা, যেমনটা মিডিয়ায় এসেছে, তার অনুরূপ। লক্ষ্যণীয়, এই বিবরণের পুরোটাই প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণের আলোকে লিখলাম, এখানে আমার নিজস্ব কোনো বক্তব্য নেই। দয়া করে আমাকে আবার বরপক্ষ বা কনেপক্ষ কোনো দলে না ফেললে খুশী হবো।''

আইরিন আরও লিখেছেন, ''রুমানা মঞ্জুরের ঘটনায় কেউ কেউ নিরপেক্ষতার ভেক ধরে বলেছিলেন উভয় পক্ষের (সাঈদেরও) বক্তব্য শোনা প্রয়োজন। এদের মূল সুড়সুড়ি হলো, নিশ্চয়ই নারীটির কোন 'ঘটনা' আছে এবারও একইভাবে অনেকে ছুটে এসেছেন নারীর চরিত্র হননে।''

গুনের ওই বর্ণনা কিভাবে বিশ্লেষন করবে গণমাধ্যম কিংবা আইরিন? হীরণ-ফারজানার ওই ঘটনায় আরও অনেক ঘটনার মতোই সাংবাদিকতার নীতিমালা সম্পূর্ণভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে। কারো বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত তাকে চোর বলা সঙ্গত নয়। সাভারে গণপিটুনিতে ছয় ছাত্র নিহত হওয়ার পর কোনো অনুসন্ধান ছাড়াই গণমাধ্যম পুলিশের ভাষ্য প্রচার করল। বলল তারা ডাকাত। পরদিন জানা গেল তারা ছাত্র। কি বিস্ময়কর ঘটনা! বরের বিরুদ্ধে কনের অভিযোগ অনুসন্ধান ছাড়াই বলছি, 'যৌতুকলোভী বর'। দোষী সাব্যস্ত করেই ক্ষান্ত দেওয় হচ্ছেনা। গণমাধ্যমে ফারজানার বক্তব্য যেভাবে প্রচার করা হয়েছে, হীরণকে তেমন সুযোগ দেওয়া হয়নি? তার কি অধিকার ছিল না আত্মপক্ষ সমর্থণের? এমনকি সংবাদ সম্মেলনে তার বক্তব্যও গণমাধ্যম যৌক্তিকভাবে উপস্থাপন করা হয়নি।

শোনা কথায় কান দিয়ে গণমাধ্যম কোন দিকে চলেছে? নীতিমালাহীন এই সাংবাদিকতার ভয়াবহতার বিষয়টি যৌতুকের চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ?