রওশন আরা মুক্তার তিনটি কবিতা

রওশনআরামুক্তা
Published : 17 April 2012, 05:43 AM
Updated : 17 April 2012, 05:43 AM

চাঁদ-চকোরা
চাঁদের হেঁয়ালিতে চাঁদের রহস্যে পেয়েছি যে রতন, চাঁদ জানে
সাক্ষী হয়েছে সে দু'জোড়া কাঁপা কাঁপা চোখের মিলনের, চাঁদ জানে
এভাবে তুমি আমি আপন হতে পারি, আসতে পারি কাছে, চাঁদ জানে
আমার মত আজ নদিয়া ভেসে যায়, আজকে ভিজে যায় পুড়ে যায়
নদিয়া, চাঁদ জানে! চমকে ওঠে প্রাণ ঝলসে যায় এই তির তির
হৃদয় ঝিরি ঝিরি বাতাসে; তুমি জানো জ্যোৎস্না জানে— মাখে তারে কেউ
শরীরে, মাখে তারে— চাঁদের গায়ে— মাখে হৃদয়ে, মাখে যারে সেই চাঁদ
খানিক পরে তুমি স্নিগ্ধ জাদু মাখা জোছনা বর্ষণ অবিরাম।
দেখছ চাঁদ তুমি দেখছি চাঁদ আমি… বার্তা আসে ভেসে আলো হয়ে,
বার্তা ভেসে আসে পাতার ফাঁক গলে— মাতাল চকোরিনী বসন্তে
আমি তো জানি এই মনের কোনো এক আলোকময় কোণে তুমি শুধু
আমার! চাঁদ তুমি আমার আঁধারের শব্দ, তুমি এক দাঁড়িহীন
বাক্য, তুমি কেন লুকিয়ে ছিলে ছায়াপথের চকমকে ধূলিকণা?
লুকিয়ে না তো! তুমি এ নক্ষত্রের শরীরে মিশে ছিলে বাঁধ ভাঙা
আবেগ! তুমি এক ভোরের উদ্ভাস, একটা ঝড় তুমি! এসো তবে
জোছনা পান করো চকোরা তৃষার্ত! হৃদয়ে এসো ওগো চাঁদ-চকোরা!
০৭/০৩/১২

শঙ্খ-লাগা প্রলয়

পড়ার টেবিলে এই চার পাঁচ সপ্তাহ পুরাতন বাজারের ব্যাগ
উদ্ধার করা হল, নজরের সামনেই ছিল, তবু কেউ দেখেনি।
সে ব্যাগ থেকে বের হল এক সাপ, আমাদের টানা বারান্দা
ঘর ভর্তি মানুষ, পাকঘর,ঝেড়ে দৌড় দিল। সে সাপ কেমন
কির কির একটা শব্দ তুলে… সাপেরা কথা বলে? ছোটকালে
দাদিকে প্রশ্ন করেছিলাম, সাপেরা ডিম দেয় কী করে? গূঢ়
অর্থ, সঙ্গমটা হয় কী করে? সাপটা বারান্দা পার হতে হতে
আস্ত এক ছাগল হয়ে গেল, চোখগুলো শুধু অচেনা প্রাণীর,
খুব ক্রূর। সাপটা, মানে ছাগলটা, ঘাস খেতে শুরু করল, আমি
জানালা দিয়ে তাই দেখলাম বার বার, আমার পুরাতন অসুখ
জেগে উঠল। এরই মাঝে ফেশিয়াল প্যরালিসিস, ঘরবাড়ির
মানুষ ভাই বেরাদার সবাইকে ডাকা হল, মধুর শয্যা ছেড়ে
কেউ কেউ করুণা করল। দূর থেকে একজন দাঁত কেলিয়ে
মেসাওয়াক করল, পিচ করে থুথু ফেলল। আজ আমরা বেড়াতে
যাব কোথায় যেন সাহিত্য উৎসব, তবে তার আগেই এক জঙ্গলে,
বাগানে সাপের সঙ্গম কেমন তা আমরা জানব আমি জেনেছিলাম,
কারা যেন একের পর এক নারকেল গাছ কেটে ফেলছে, বাগানটা
অনাবৃত হয়ে পড়ছে, কিন্তু আমরা তো এখনও সাপ, তুমি কিছু
নারকেল পাতা আনলে, আব্রু ঢাকি যেন,কিছু কালো কালো লোক
আমাদের বকতে থাকে, এই কর্মের আর জায়গা পেল না!ওহ
তাড়াতাড়ি তাড়াতাড়ি সাহিত্য উৎসবে যেতে হবে, নারকেল পাতার
নিচে ঘাসের উপর শুয়ে আমি ফিতা বাঁধি, এক ছোকরা আবার
কবিতা চায়, ছাপবে। ওরাও, ওই ছেলেটার দলটাও, অদ্ভুত হাসে
এই কর্মের আর জায়গা পেল না!আমরা পৌঁছে গেছি আমার
সন্তান নাকি কোতাবাতুর এক কুটিরে, ভালোই আছে, আমি প্রায়
একশ ফুট উঁচুতে ট্রেনে তোমার হাত ধরে যেন টাইটানিক জাহাজ।
আজ এখানে অনেক মানুষ এসেছে, এটাকে কি সাহিত্য উৎসব
বলে? মেয়েরা শাড়ি গয়না পরে ঘুরছে আর ছেলেরা পকেটে যত্ন
করে কেনা কনডম নিয়ে। ওদিকে আকাশ দেখে বিস্ময় আমার
কাটে না, আমার বিস্ময়ে তোমার গালে ঝিলিক লাগে, সঙ্গমের
পূর্ণতা আমার বিস্ময়ে খুঁজে পাও বোধহয়, আমিও চোখ ভরে
দেখি তোমার পুলক, কিন্তু আজ তো মহাপ্রলয়। বলাবলি করছে
কৃষ্ণগহ্বর সব নাকি টেনে নেবে মেঘগুলো একের পর এক,
অমানুষিক যন্ত্রণা নিয়ে একদিকে কীসের টানে যেন ভেঙে
ভেঙে যেতে থাকে। আমি তোমার ট্রেন থেকে নেমে আকাশ
দেখছিলাম, আমি হাত বাড়ালাম আমাকে ধরো,ধরো আমাকে
আমাদের নিচে সমুদ্র, আমরা আজ মরবই, তবু হাতটা ধরো
এক সঙ্গে মরি, ধরো, আমি চিৎকার করে কেঁদে উঠি তুমি হাত
দিয়েছ আমি ধরতে পারছি না, না না আমি একা মরব না কিছুতেই
না,আমি পানিতে পরে যাই, কিছুক্ষণ পর তুমিও পরবে, তোমার
হাজার বগির ট্রেনের ভাঙন আমি নিচ থেকেই শুনতে পাই, একবগির
আধখানা ভাঙে, তুমি ভাঙা ট্রেনে করে নামছ, আমি সাঁতরে সরে যাই,
যদি বেঁচে যাও? একসাথে বাঁচতে আমি তোমাকে জায়গা দিলাম যদি
বেঁচে যাও!সন্তানের কথা মনে পড়ে, এত মানুষ শাড়ি গয়না মেয়ে
কনডম পুরুষ সবাই বাঁচতে চায়। এক মেয়ে খুব কাঁদছে তার সন্তান
ট্রেনে আটকা পড়েছে, এত ভিড়ে কাছে যেতে পারছে না, এই তার
কান্না, আমার পিছন ফেরার সময় নেই, আমি তোমায় খুঁজি না, এক
ছোটো কুটিরে আমার সন্তান, আমি দৌড়াই, তোমার কি মৃত্যু হচ্ছে?
আমার কিচ্ছু মনে থাকে না আমি সন্তানের তরে দৌড়াই, তাকে
জড়িয়ে ধরি, কে যেন কানে কানে বলে তুমি নেই,তুমি নেই?
ক্ষণস্থায়ী প্রলয় তোমায় নিয়ে গেছে, সব আগের মতই, শুধু
তোমার চিরশিশু সন্তান কী করে যেন বড় হয়ে গেছে, তার
কোলে ছোট্ট বালক সর্পরাজ তুমি আঠারো বছর স্তন দিয়েছ,
সেও দেবে, এই আমাদের সন্তানও যে এক চিরশিশু। জানো,
এখনও আকাশে তোমায় জ্বলতে দেখি, ছুঁতে পারি না, এখনও
ঘুম ভাঙলে দেখি মাথায় কোন বোধ নাই, বুকটা শুধু ব্যথা।
২১/১১/১১

চিত্রার্পিত ভ্রূণ


চোখ খুললে যা থাকে, মুদলে তা কেন থাকে না! সূর্যের নিচে সব বোধ গলে যায়। কালো হয়ে আসে রোদের কণারা। ব্ল্যাকআউট।
দপদপ করে জ্বলে উঠেই যে-নক্ষত্র নিভে যায়, উজ্জ্বল এক আগুন মুহূর্ত বুকে ছুরি চালিয়ে, যে-পাপের বা যে-পুণ্যের লালফিতা কাটে,
সেই সুপারনোভার ধূলি-কুহেলিকায় কী হারায়? কোন ভ্রূণ আত্মহত্যার কথা ভাবে,— বিকলাঙ্গ জন্ম চায় না। কোন জরায়ু জরাগ্রস্থ হয়,
জেনিথের নিচে?


দুটো মানুষের হৃদয়-নিংড়ানো আর্তনাদ গুলে যায় ব্রহ্মপুত্রের টলটলে জলে। তীরের গোড়ালি-সমান জলে চিকচিকে বালুর প্রতিটি
কণায় কার প্রতিবিম্ব ফুটে থাকে? মৃদু ঢেউয়ে জল সরে যায়, নতুন জল আসে, কার ছবি ভাসে সেই জলে? রোদের ছায়া পড়ে মুখে,
চুলে বাতাস লাগে, ব্রহ্মপুত্রে আবার জল ভাসে, আরো জল ভাসে, ভ্রূণের হাসি মুছে যায়, আশঙ্কায় দুরুদুরু বুকে ভ্রূণ স্বপ্নে আসে, মা
ডাকে, কাঁদে। আমাকে মেরো না!


ভ্রূণ তোমাকে আর ডাকব না, ভ্রূণ, আমার নাভি থেকে খুলে নাও তোমার নল; আমার রক্তস্বল্পতা। তোমাকে শরীরে রাখব না আর।
গর্ভে, ওমে, প্রেমে রাখব না। ভ্রূণের নল খুলে যায় নাভি হতে। লাল হয়ে যায়, লাল হয়ে যায়, ব্রহ্মপুত্র লাল হয়ে যায়! জলে
ভেজানো পায়ে আলতা-পরা হয়ে যায়, ব্রহ্মপুত্র আমার লাল হয়ে যায়— গর্ভপাতের রক্তে। পারমাণবিক বিস্ফোরণের অক্সিজেনহীনতা
গ্রাস করে নারী শরীরকে। চিৎকার চাপে দাঁতে ঠোঁট চেপে।


মহাজাগতিক পোকারা লালফিতা খায়, লাল লাল, লাল লাল, লাল ফিতা। মাকড়সার মতো জাল বুনে লালসুতা দ্বারা— লালসালু।
ভ্রূণের সমাধি ঢাকে লালসালু। দুপুরবেলার ব্রহ্মপুত্র লাল হয়ে যায়, লাল হয়ে যায়। রক্তজমা বুকে সাদা দুধ জমে না, ব্রহ্মপুত্র লাল
হয়ে যায়! ব্রহ্মপুত্র হিমশীতল বরফের আস্তরণে ঢাকা পড়ে। রক্তলাল— লাল লাল— বরফে ঢাকা পড়ে যায়। বরফ-চরে লালসালুতে
ঢাকা ভ্রূণের সমাধিতে স্বরগ্রাম রেওয়াজ করে, অরোরা আলোর নিচে। বেহালা বাজে, রাতের আঁধারে ফোটে সুন্দর সব ফুল।


শেষ বিন্দুটুকু মুছে ফেলে, জরায়ু ব্যবচ্ছেদ শেষ করে। লাশকাটা পোকারা দাঁত ঘষে, ক্রূর হাসি হাসতে গিয়ে মিইয়ে যায়। ভ্রূণ হত্যা
মহাপাপ। লাশকাটা পোকারা ভ্রূণকে আগলে রাখে। কীটেরা জানে, ভ্রূণহত্যা মহাপাপ। সামাজিক জরায়ু জানে না— ভ্রূণহত্যা মহাপাপ।


তোমাকে পথ দেখাবার কালে, একজোড়া ফিরোজারঙা ফড়িং আমাকে জানিয়েছিল, ভ্রূণহত্যা মহাপাপ। ওরা মিলিত হতে হতে
উড়ছিল, জোড়া-লাগা দুই শরীরকে এক শরীর বলে ভ্রম হয়। ফিরোজারঙা ফড়িং আমি আগে দেখি নাই, সঙ্গমরত ফড়িং আমি আগে
দেখি নাই। তারা উড়ে এসে কেন তোমার হাতে বসল! কেন আমি দেখলাম? মিলনে একাকার ঘাসফড়িং; আমি কেন দেখলাম?

০৩/০৪/১২