আমার মায়ের অপহরণ ও মৃত্যুযন্ত্রনা

সুমন জাহিদ
Published : 15 Dec 2012, 03:38 PM
Updated : 15 Dec 2012, 03:38 PM

চৌধুরী মঈন উদ্দিনের নেতৃত্বে আল বদর বাহিনী আমার মাসহ ঢাকার অন্যান্য বুদ্ধিজীবীদের অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছিল। আমার মাকে চৌধুরী মঈনউদ্দিন চিনতো, তার গ্রামের বাড়ী ও আমাদের বাড়ী একই জেলায়-ফেনীতে। ঢাকায় যখন মা তার লেখা (প্রবন্ধ, গল্প, কবিতা) ছাপানোর জন্য দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায় যেতেন, তখন সে মার সাথে নানা বিষয় নিয়ে কথা বলতো। কোন এক সময় কৌশলে সে মার ঠিকানা সংগ্রহ করেছিল । পাকিস্তানী মিলিটারীদের পক্ষে এত মানুষের ঠিকানা সংগ্রহ করা সহজ ছিল না যদি না চৌধুরী মঈনউদ্দিনের মত লোকেরা প্রত্যক্ষভাবে এই হত্যাযজ্ঞের সহায়তা না করত। সুতরাং চৌধুরী মঈন উদ্দিনই আমার মার হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত বলে আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি।

স্বাধীনতার আরো পরে ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বর মাসে এসে প্রজন্ম' ৭১ এর এক আনুষ্ঠানে ১৯৭১ সালে রায়েরবাজার থেকে জীবন নিয়ে বেঁচে আসা একমাত্র মুক্তিযোদ্ধার (জনাব দেলোয়ার হোসেন- পরে আনেক পত্রিকায় ও টিভিতে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন) কাছে, আমার মায়ের মৃত্যুর পূর্বে যে যন্ত্রণার সম্মুখিন হয়েছিলেন তা জানতে পারি।

১৩/১২/১৯৭১ দুপুরে তাঁকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার পর, মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারের প্রায় ৩০ জনকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত একটি ঘরে বন্দী করে রেখেছিল ঘাতকেরা। সেখানে ছিল না কোন আলো-বাতাস, ছিল না কোন পানি কিংবা খাদ্য, এমন কি বাথরুম সুবিধার কোন ব্যবস্থা ছিল না। অনেকজন পুরুষের মাঝে তিনি ছিলেন একমাত্র মহিলা, সেখানে সবারই হাত এবং চোখ বাধা ছিল কেবল মুখ দিয়ে একে অন্যের পরিচয় জানছিলেন। অনুমান করা যায় একজন মহিলার পক্ষে এই সময়টা কতটা কষ্টের কতটা যন্ত্রণার। এই ভাবেই দেলোয়ার হোসেন জেনেছিলেন তার পাশের বন্দীর নাম মোফাজ্জল হায়দার চৌধরী, তিনি ছিলেন তার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তাদের সকলের পিছনে ছিলেন একজন মহিলা, তিনি কাঁদছিলেন। নাম জিজ্ঞেস করে জানতে পেরেছিলেন, তাঁর নাম সেলিনা পারভীন। (দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পত্রিকার মাধ্যমে জেনেছিলেন তিনিই শিলালিপি পত্রিকার সম্পাদিকা – শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন) যখন তাদেরকে রায়েরবাজার বধ্যভুমিতে নিয়ে যাওয়া হয় তখন আমার মাসহ সকলেই পরবর্তী পরিণতি সর্ম্পকে একটা ধারণা পেয়ে গিয়েছিলেন। আর তাই মা তখন অনুনয় বিনয় করে বলেছিল তাকে যেন ছেড়ে দেওয়া হয়। ঐ পরিস্থিতিতে তাকে ঘিরে একটা ছোট জটলার সৃষ্টি হয়। মা তখন বলেছিলেন তিনি আর লিখবেন না, পত্রিকা বের করবেন না। এই সব কথায়ও কাজ না হওয়ায় তিনি তখন তাদের কাছে অনুনয় করে বলেছিলেন, ঘরে আমার একটা শিশু সন্তান আছে, তাকে নিয়ে এই শহর ছেড়ে চলে যাব আর ফিরবো না, অন্ততঃ পক্ষে সেই কারণে তাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। অথচ ঘাতকরা তখন তার মুখে বেয়নেট চার্জ করে মুখ ফেড়ে দেয়। মহিলা মানুষ ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন এবং ব্যথায় চিৎকার করেছিলেন, নরপিশাচেরা তখন তার বুকেও বেয়নেট চার্জ করে। তিনি মাটিতে পড়ে যান। এবং আরো জোরে সর্ব শক্তি দিয়ে চিৎকার (গোঙ্গানী) করতে থাকেন । হায়েনারা তখন তাঁকে গুলি করে হত্যা করে। এই সুযোগে দেলোয়ার হোসেন হাতের বাধন খুলে পিছন দিক থেকে দৌড়ে পালিয়ে বাঁচেন। তাকে গুলি করা হয়, অলৌকিকভাবে তিনি বেঁচে যান।


বাচঁতে পারলেন না আমার মা! কি অপরাধ ছিল তাঁর? মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে তাঁর সংশ্লিষ্টতা? দেশের প্রায় সব চিন্তাশীল বুদ্ধিজীবীদের লেখা নিয়ে প্রকাশিত পত্রিকা 'শিলালিপি'? তাঁর নিজস্ব সাহিত্য-কবিতা-লেখা? ১৯৭১ সালে নিজেকে মুক্তি সংগ্রামে জড়িয়ে ফেলা? সভা-সমাবেশে যোগ দেওয়া? যে বাসায় ভাড়া থাকতেন সেই বাসার মালিকেরই কারসাজি?

এখন আমাদের সকলের একটাই চাওয়া, তা হলো যুদ্ধাপরাধীর বিচার দেখে যাওয়া। তবেই সকল শহীদদের আত্মা শান্তি পাবে।

সুমন জাহিদ: শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের ছেলে। বর্তমানে একটি টেলিভিশন চ্যানেলে কর্মরত।