‘কুইজদাতা’ শওকত ওসমানের দুটি উপহার

রাজু আলাউদ্দিন
Published : 2 Jan 2017, 02:22 PM
Updated : 2 Jan 2017, 02:22 PM

সৃষ্টিশীলতা ও মননের আধুনিকতা তীক্ষ্ণ রসবোধ ও কৌতুকবোধের মাধ্যমে একটি পরিশীলিত রূপ লাভ করেছিল বাঙালি মুসলমান লেখকদের মধ্যে শওকত ওসমানের মধ্যেই সর্বপ্রথম, আর এই প্রকাশের বাহন ছিল তার গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ। তার মনন-নির্ভর শ্লেষ ও বিদ্রুপের শানিত রূপ তাকে আলাদা করে দিয়েছিলো তার সমসাময়িক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর সাহিত্যিক স্বভাব ও স্বরূপ থেকে, যদিও দুজনেরই সৃষ্টির প্রেক্ষাপট প্রধানত মুসলমান সমাজ ও জনগোষ্ঠী। জ্ঞান বিজ্ঞানের একটি পরিশ্রুত রূপ শওকত ওসমানের মধ্যে যেভাবে ফুটে উঠেছিল তার তুলনা পরবর্তী অন্য কোনো সৃষ্টিশীল বাঙালি মুসলমান লেখকদের মধ্যে বিরল।

জননী, ক্রীতদাসের হাসি'র মাতা স্মরণীয় উপন্যাসের পাশাপাশি তার বহু গল্পে শিল্পী হিসেবে আধুনিক রুচির রূপকার যেমন হয়ে উঠেছিলেন, তেমনি তার প্রবন্ধেও আমরা দেখতে পাই উদার ও মুক্তবুদ্ধির এক লেখককে যিনি জাতীয়তা ও ধর্মীয়বোধের সংকীর্ণ সংস্কার থেকে পুরোপুরি মুক্ত। আর তার একমাত্র কবিতার বই নিজস্ব সংবাদাতা প্রেরিতও ছিল সেই সঘন কৌতুকরস থেকে উৎসারিত কাব্যময় আত্মভাষ্য। লেখক হিসেবে শওকত ওসমানের এসব গুণ আমাদের কাছে ছিল খুবই শ্রদ্ধার ও আকর্ষণের।

আমরা যেসময় লেখালেখি শুরু করেছি তখনই তিনি সর্বজনগ্রাহ্য ও নমস্য এক লেখক। শুধু লেখকই নন, শুনেছি তিনি তুখোড় অধ্যাপকও। কিন্তু এই তুখোড় অধ্যাপক যখন নিজেকে নিয়ে জীবদ্দশায় আত্মমৃত্যুর কাব্যবার্তা ঘোষণা করেন কৌতুকরসের মিষ্টতায়, তখন অনুমান করতে অসুবিধা হয় না ব্যক্তিমানুষটি আলাপচারিতায় কতটা উপভোগ্য হতে পারেন।

দূর থেকে তাঁকে দুএকবার আগেই দেখেছিলাম। দুএক জায়গায় তার বক্তৃতাও শুনেছি। বক্তৃতা দিতেন চমৎকার। দেখলে মনে হতো বলার মতো বহু কথা তার ভেতর সারাক্ষণ ঘুর্ণিপাক দিয়ে বেড়াচ্ছে, যেন বেরিয়ে আসার জন্য সদা-উন্মুখ। একবার কেউ সেই ঢাকনা খুলে দিলে তা অনর্গল ঝরনার মতো নেমে আসতো।

বলতে পারতেন নানান বিষয়ে এবং অনর্গল। ধর্মীয় সংকীর্ণতা ও মূঢ়তায় তিনি এতটাই বিরক্ত ছিলেন যে বাঙালি মুসলমানদেরকে রীতিমত চাবকাতেন প্রসঙ্গ একেই। এই সংকীর্ণতা ও মূঢ়তা তিনি বুঝতে পারতেন অন্য যে কোন লেখকের চেয়ে বেশিই, কারণ নিজে মাদ্রাসার ছাত্র ছিলেন, ইসলামি জ্ঞানবিজ্ঞানে তিনি ছিলেন সংঘাতিক রকমের ওয়াকিবহাল মানুষ। কিন্তু চেতনায় ছিলেন পুরোপুরি প্রগতিশীল ও বিজ্ঞানমুখী। নানা ভাষার শিল্প ও সাহিত্য সম্পর্কে তার জ্ঞান এত বিস্তৃত ছিল যে তা খুব কম লেখকের মধ্যেই আমি দেখেছি।

অথচ এই মানুষটির সঙ্গে কচি বয়সের চপলতা থেকে তর্কে লিপ্ত হয়েছিলাম আমি এবং ব্রাত্য রাইসু সাক্ষাৎকার গ্রহণের সূত্রে। সম্ভবত ১৯৯৪ সালের ডিসেম্বরের দিকে তার চামেলীবাগের বাসায় আমরা গিয়েছিলাম এক দুপুরে। শশ্রুমন্ডিত শওকত ওসমানকে ওই প্রথম ঘরোয়া রূপে আবিস্কার। পড়নে ছিল চেক বাথরোব। ওই পোষাকেই তিনি আমাদেরকে গ্রহণ করলেন। হাল্কা চা-নাস্তার পর আমরা তার সাথে আলাপ শুরু করেছিলাম। ঘন্টা খানেকের সেই আলাপচারিতা পরে ১৯৯৫ সালের জানুয়ারীতে প্রকাশিতও হয়েছিল তখনকার বাংলাবাজার পত্রিকায়। তার সঙ্গে এরপর আরও বহুবার দেখা হয়েছে। তার সাথে অামার পরবর্তী দুটো সাক্ষাৎ এখনও স্মরণীয় হয়ে আছে তার উপহার দেয়া দুটো বইয়ের কারণে। ৯৪, ৯৫-এর পর থেকে বিভিন্ন বিষয়ে তার ভাবনা-কণিকা ধরণের কিছু সংকলন বেরিয়েছিলো বিদ্যাপ্রকাশ থেকে। এগুলোর একটার নাম ছিল অস্তিত্বের সঙ্গে সংলাপ। মাত্র ২৬ পৃষ্ঠার একটি বই, যদিও সে বইয়ে কোথাও পৃষ্টা সংখ্যা উল্লেখ নেই। বেরিয়েছিল ১৯৯৫ সালের দুই জানুয়ারি, তার মানে লেখকের জন্মদিন উপলক্ষ্যে। বইটি আমি তাঁর কাছ থেকে উপহার হিসেবে পেয়েছিলাম তার জন্মদিনের দু'দিন পর। অর্থাৎ জানুয়ারি ৪ তারিখে। জায়গাটা ঠিক মনে নেই আজ। হতে পারে চামেলীবাগের বাসায় গিয়েছিলাম, নয়তো উনি কোন কাজ উপলক্ষ্যে বাংলাবাজার পত্রিকায় এসেছিলেন, তখন হয়তো এই বইটি উপহার দিয়েছিলেন আমাকে। কিন্তু উপহার দেয়ার কথাটা উল্লেখ করার একটা কারণ আছে। তাঁর কাছে থেকে বই উপহার যারাই পেয়েছেন তারা সবাই জানেন যে উনি কোন উপহার-গ্রহিতার নাম উল্লেখ করেই নিজের অটোগ্রাফ দিতেন না, বাড়তি প্রাপ্তি হিসেবে থাকতো দুচার লাইনের বুদ্ধি ও কৌতুকরসের কাব্যকণিকা। আমাকে দেয়া বইটিতে তিনি মার্কার পেন-এর কালিতে লিখেছিলেন:

নববর্ষে
রাজু আলাউদ্দীন
স্নেহভাজনেষু-
আগত অনেক আগে
সমান ওয়েভ-লেংথ পাও কী?
অন্যথায় সিলেট যেতে
পৌঁছে যাবে ডাউকী।

অশেষ কল্যাণ কামনা-সম্বলিত
শওকত ওসমান
৪/১/১৯৯৫


আমার পরম সৌভাগ্য এই যে আমারই প্রিয় লেখকের কাছ থেকে নববর্ষের শুভেচ্ছা-সম্বলিত এই কাব্যকণিকাসহ তাঁর একটি বই উপহার পেয়েছিলাম।

এই উপহারের বছর দুয়েক পর, সে-ও জানুয়ারি মাসেই, ১৪ তারিখে (৯৭ সালে), পেলাম আরেকটি বই। এটিও আগের মতো কৃশতনু গ্রন্থ আর এক ধারাভাষ্য। আগের বইয়ের সাথে এর পার্থক্য হলো এই যে এটিতে আছে পৃষ্ঠা সংখ্যা, আর এতে একটি মাত্র লেখা নয়, সংকলিত হয়েছে ছোট ছোট দশটি লেখা। লেখাগুলো স্বভাবে প্রবন্ধের নিকটবর্তী। এই বইটিও উপহার দেয়ার সময় তাঁর স্বভাবসুলভ কাব্যকণিকায় উৎর্কীণ করে দিয়েছিলেন উপহার গ্রাহককে।

এ বইয়ে তিনি লিখলেন, সেই একই ধরণের মার্কার পেন-এর কালিতে:
স্নেহভাজনেষু-
রাজু আলাউদ্দীন
অভিমুখে
দেশ কি বাজার?
কিভাবে নির্ধারিত হয় সীমা
ক্রেতা-বিক্রেতার?
কুইজদাতা
শওকত ওসমান
ঢাকা ১৪/১/১৯৯৭


এই শেষ কাব্যকণিকায় তিনি আমার জন্য যে কুইজ দিয়ে গেছেন তার উত্তর আমার এখনও জানা নেই। শুধু, এটুকু জানি তাঁর মতো একজন প্রথম সারির লেখক তাঁর দেশ জাতি ও সংস্কৃতির বিকাশে যতটা ভাবিত ছিলেন তা আজকের লেখকদের মধ্যে খুব কমই দেখা যায়। আত্মপ্রচারকামী অসার লেখকদের ভীড়ে তিনি ছিলেন সত্যিকারের মননদীপ্ত ও সৃষ্টিশীল এক লেখক। তার জন্ম শতবর্ষে তাকে জানাই সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা।

আর্টস-এ প্রকাশিত রাজু আলাউদ্দিনের অন্যান্য প্রবন্ধ:
বোর্হেস সাহেব