হাতিরঝিলে কৃষ্ণচূড়ার বর্ণিল শোভা

নারায়ন সরকার
Published : 7 May 2016, 07:35 PM
Updated : 7 May 2016, 07:35 PM

কৃষ্ণচূড়া মানেই রক্তিম রঙের স্বপ্নিল ছোঁয়া, কৃষ্ণচূড়া মানেই বসন্ত শেষে গ্রীষ্মের আগমনী বার্তা। ঋতুরাজ বসন্তের বাহারী রঙের মেলা গ্রীষ্মের খরতাপে যখন স্তিমিত হয়ে আসে, নব বর্ষার শীতল পরশে গাছে গাছে নবীন সবুজ পাতার আচ্ছাদনে প্রকৃতি আবার নিজেকে আচ্ছাদিত করে তখনই নিজের রক্তিম রঙের ডানা মেলে প্রকৃতিতে স্বমহিমায় আবির্ভুত হয় কৃষ্ণচূড়ার ফুল। কৃষ্ণচূড়ার বাহারী সাজ মনে করিয়ে দেয় বৈশাখ এসেছে।

কৃষ্ণচূড়া একটি বৃক্ষ জাতীয় উদ্ভিদ এবং এর বৈজ্ঞানিক নাম ডেলোনিখ রেজিয়া (Delonix Regia)।কৃষ্ণচূড়া ফাবাসিয়ি (Fabaceace) পরিবারের অন্তর্গত বৃক্ষ এবং কোথাও কোথাও এটি গুলমোহর নামে পরিচিত।

শুষ্ক অঞ্চলে গ্রীষ্মকালে পাতা ঝরে গেলেও নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে কৃষ্ণচূড়া চির সবুজ বৃক্ষ।

কৃষ্ণচূড়ার ফুলের রঙ উজ্জ্বল লাল। বাংলাদেশে বসন্তের শেষের দিকে এ ফুল ফোটে। ফুলগুলো বড় চারটি পাপড়ি যুক্ত। পাপড়ি গুলোর পাতা ৮ সেঃ মিঃ পর্যন্ত লম্বা হতে পারে।

কৃষ্ণচূড়া গাছের লাল, কমলা এবং হলুদ ফুল ও উজ্জ্বল সবুজ পাতা প্রকৃতিতে অন্যরকম শোভাবর্ধন করে। ইতিহাস ঘেটে দেখা গেল কৃষ্ণচূড়া মূলতঃ একটি আফ্রিকান উদ্ভিদ এবং এর আদিনিবাস মাদাগাস্কারের পত্র ঝরা জঙ্গলে। তবে গ্রীষ্মমন্ডলীয় ও নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলেও এখন দেখতে পাওয়া যায়।

কৃষ্ণচূড়া জটিল পত্র বিশিষ্ট উজ্জ্বল সবুজ। প্রতিটি পাতা ৩০-৫০ সেঃ মিঃ লম্বা হতে পারে এবং প্রতিটি পাতা ২০-৪০ টি উপপত্র বিশিষ্ট।

উপমহাদেশে কৃষ্ণচূড়ার আগমন ঘটেছে তিন-চারশ বছর আগে। তবে সবুজের উপর লাল, হলুদ ও কমলা রঙের ফুল ধরলেও এর নাম কৃষ্ণচুড়া কেন হলো সে সম্পর্কে কোন ইতিহাস পাওয়া যায় না।

দক্ষিন পূর্ব এশিয়া ভারতীয় উপমহাদেশে এপ্রিল থেকে জুন সময় কালে কৃষ্ণচুড়ার ফুল ফোটে। তবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কৃষ্ণচূড়ার ফুল ফোটার সময় ভিন্ন ভিন্ন।

গ্রীষ্মকালে সবুজ পাতা ঝরে গিয়ে পুরো গাছ জুড়ে জমকালো লাল, হলুদ ও কমলা রঙের ফুল জায়গা করে নেয়। তারপর ফুল ঝরে যেতে যেতেই নতুন পাতার আবির্ভাব ঘটে।

কৃষ্ণচূড়া খুব বেশি উঁচু হয় না, মোটামুটি ১০-১২ মিটার পর্যন্ত উঁচু হয়ে থাকলেও ঘন ডালপালা এবং পাতার কারণে গ্রীষ্মকালে গরম আবহাওয়া শীতল ছায়া প্রদানে এর জুড়ি নেই।

হাতিরঝিল ক্রমেই তার পরিপূর্ণ যৌবনে পদার্পণ করছে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

হাতিরঝিলের এর সুদৃশ্য, পরিকল্পিত ও প্রশস্ত রাস্তা, অসাধারণ নির্মাণ শৈলীর সুদৃশ্য ব্রিজ ও ফুট ওভার ব্রিজ, ইট বিছানো সবুজ ঘেরা মেঠোপথ, চারিদিকে অসংখ্য গাছগাছালিতে পরিপূর্ণ  সবুজের নয়নাভিরাম সমারোহ, লেকে অনেকটা স্বচ্ছ জল, নিয়মিত পরিস্করণের কাজ, চোখ ঝলসানো রঙবেরঙের নিয়নের আলোর তীব্র ঝলকানি সব মিলিয়ে কংক্রিটের জঙ্গলে এক প্রস্থ নীল সবুজের বেলাভূমি।

হাতিরঝিল ক্রমেই সৌন্দর্যপিয়াসী মানুষের মনে জায়গা করে নিতে পারছে। প্রায় দখল হয়ে যাওয়া একটি পরিত্যক্ত জলাভুমিকে উদ্ধার করে এত সুন্দর ও সুচারু রূপে নতুন অবকাঠামো দান করা বাংলাদেশের ইতিহাসে সত্যিই বিরল ঘটনা বলা চলে।

হাতিরঝিলে আরো অন্যান্য বাহারি গাছ-গাছালির পাশাপাশি স্থানে স্থানে নবীণ কৃষ্ণচূড়ার সারি তার শোভা বর্ধনে দারুণ নিয়ামক হিসাবে কাজ করছে। গাছগুলো এখনো নবীণ এবং এবারই প্রথম অনেক বেশি ফুল ফুটেছে, তবে তার নজরকারা শোভা সৌন্দর্য পিয়াসী মানুষকে মোহিত করেছে।

আশা করা যায় সব ঠিকঠাক থাকলে আগামি কয়েক বছরের মধ্যে কৃষ্ণচূড়া গাছগুলো তাদের প্রকৃত রূপ ফিরে পাবে।

ঢাকার প্রাণ কেন্দ্রে অবস্থিত বেগুনবাড়ি ও হাতিরঝিল খালকে সংস্কার করে হাতিরঝিল প্রকল্পটি গড়ে উঠেছে। গুলশান, বাড্ডা, রামপুরা, মগবাজার, তেজগাঁও ও কাওরানবাজার এলাকাকে সংযুক্ত করে প্রকল্পটি অবস্থিত।

প্রকল্পটির আয়তন ৩০২ একর। প্রকল্পটিতে ৭৯ একর খাস জমি ছাড়াও প্রায় ২২৩ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। তন্মধ্যে রাজউকের ৪৬ শতাংশ, 'কোর্ট অব ওয়াক্স'-এর ৮১ একর, পাবলিক ল্যান্ড ১৪১ একর ও বিটিভির ১ একর।

প্রকল্পটিতে মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ১ হাজার ৯ শত ৭১ কোটি ৩০ লাখ টাকার মধ্যে বাস্তবায়নকারী সংস্থা রাজউকের ১ হাজার ১১৩ কোটি ৭ লাখ, এলজিইডির ২৭৬ কোটি এবং ঢাকা ওয়াসার ৮৬ কোটি ৬৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা রয়েছে। এর মধ্যে জমি অধিগ্রহণে ব্যয় হয়েছে ১০৪৮ কোটি টাকা।

প্রকল্পটি সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রকল্পটির বাস্তবায়ন ও তদারকি করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর 'স্পেশাল ওয়ার্কস অরগানাইজেশন' (এসডব্লিউও)-এর পশ্চিম বিভাগের কর্মকর্তা ও সৈনিকরা।

হাতিরঝিল প্রকল্পটি ২০০৭ সালের অক্টোবর মাসে একনেকের সভায় অনুমোদন দেয়া হয়। ৩ বছর মেয়াদী প্রকপটির কাজ ২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসে শুরু হয়।

২০১০ সালের জুন মাসে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলে প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ করে ২০১৩ সালের জানুয়ারী মাসে জনগনের জন্য খুলে দেয়া হয়। প্রকল্পটিতে এখনও বিভিন্ন পর্যায়ের কাজ চলছে।

ঢাকা শহরের পূর্ব-পশ্চিমের যোগাযোগ ব্যবস্থার দুরত্ব দূর করতে পূর্ব-পশ্চিমের যোগাযোগ স্থাপনের জন্য ৮ দশমিজ ৮০ কিঃমিঃ দীর্ঘ এক্সপ্রেস রোড, ৮ কিঃমিঃ দীর্ঘ সার্ভিস রোড, ৪৭৭ দশমিক ২৫ মিটার দীর্ঘ চারটি ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে।

তাছাড়াও পথচারীদের সুবিধার্থে ৮ দশমিক ৮০ কিঃমিঃ ফুটপাত, ৯ দশমিক ৮০ কিঃমিঃ লেক সাইড ওয়াক ওয়ে ও ২৬০ মিটার দীর্ঘ তিনটি ডায়াডাক নির্মাণ করা হয়েছে।

প্রকল্প এলাকায় যানজট নিরসনে ৪০০ মিটার দীর্ঘ চারটি ওভারপাস নির্মাণ করা হয়েছে, ইন্টারসেকশন ও রাউনঅ্যাবাউট নির্মাণ করা হয়েছে।

ঢাকা শহরের বর্জ্য অপসারণ ও পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থাকে উন্নত করতে প্রকল্পটি ১০ দশমিক ৪৫ কোটি ঘন ফুট বর্জ্য ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন করে তৈরি করা হয়েছে এবং ১০ দশমিক ৪০ কিঃমিঃ মেইন স্যুয়ারেজ লাইন স্থাপন করে একটি কার্যকরী বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সিস্টেম দাঁড় করানো হয়েছে।

হাতিরঝিলের নিরাপত্তায় সার্বক্ষণিক পাহারার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখানে সার্বক্ষণিকভাবে পরিচ্ছন্নতা কর্মীগণও পরিষ্কারের কাজ করে থাকে।

হাতিরঝিল প্রকল্প এলাকায় মনুষ্য টানা যানবাহন যেমন – রিক্সা ও ভ্যান এবং ভারী যানবাহন প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করা আছে।

২০১৬ সালের ১লা জানুয়ারী থেকে হাতিরঝিলের প্রকল্প এলাকায় ৪টি চক্রাকার বাস সার্ভিস চালু করা হয়েছে যা মানুষের রামপুরা, মগবাজার, কাওরানবাজার, তেজগাঁও, গুলশান ও বাড্ডার মধ্যে যাতায়াত ব্যবস্থাকে অনেক সহজ করেছে।

হাতিরঝিল প্রকল্পের রামপুরা টিভি ভবন এলাকায় একটি ইউ-লুপ নির্মাণ করা হচ্ছে যা এ এলাকায় যানজট নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

হাতিরঝিল প্রকল্পটি গুলশান লেক, বনানী লেক ও রামপুরা খালের সাথে সংযোগ স্থাপন করে ঢাকা শহরের বিশাল এলাকার বৃষ্টির পানি ও বর্জ্যকে সহজে তুরাগ নদীতে ফেলার ব্যবস্থা করেছে ফলে এই এলাকার জনাবদ্ধতা অনেকাংশে দূর হয়েছে।

হাতিরঝিলের গুলশান-তেজগাঁও প্রান্তে একটি উন্মুক্ত নভো থিয়েটার নির্মাণের কাজ চলছে। এটি চালু হলে মানুষের চিত্ত বিনোদনের ক্ষেত্রে আরো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

ঢাকা শহর পরিবেশগত ভাবে বিশ্বের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ শহর।

পরিবেশ দূষণগত কারণে ঢাকা শহর বিশ্বের বাস অযোগ্য শহরগুলোর সারিতে অবস্থান করছে।

দ্রুত ও অপরিকল্পিত শহরায়ন ঢাকা শহরের পরিবেশের ভারসাম্যকে প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছে।

দ্রুত শহরায়নের কারণে ঢাকা শহর এবং এর আশে পাশের অঞ্চলে জমির উপর প্রচন্ড চাপ তৈরি করেছে। ফলে এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদ, ইকো-সিস্টেম, জীব বৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে গেছে।

ফলে অত্র অঞ্চলে পরিবেশ দুষণ, জীবনযাত্রার মানের অবনমন ও বিভিন্ন ধরণের স্বাস্থ্যঝুঁকির প্রাদূর্ভাব ঘটেছে।

নদী, খাল, বিল ও বনভূমি দখল করে শহরায়নের ফলে একদিকে যেমন ঢাকা শহরের সবুজ ধ্বংস করা হয়েছে, অন্যদিকে অপরিকল্পিত নির্মাণ কাজের ফলে পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে।

এমতাবস্থায় ঢাকার পরিবেশ রক্ষায় ঢাকা এবং এর আশে পাশের নদী ও খাল-বিল সমূহ পুনঃউদ্ধার করে সংস্কার করা জরুরী হয়ে পড়েছে।

হাতিরঝিল এক্ষেত্রে অনন্য দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছে।

হাতিরঝিলের পাশাপাশি গুলশান ও বনানী লেককে সংস্কার করা জরুরী। অবশ্য গুলশান লেকের একাংশে সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছে।

হাতিরঝিলের পানি ও বর্জ্য সঠিক ভাবে নিষ্কাশনের জন্য রামপুরা খালকেও দখল মুক্ত করে সংস্কার করতে হবে।

দেশে পরিবেশবান্ধব নগরায়নের জন্য সরকারি পর্যায়ে সঠিক নীতিমালা প্রণয়ন ও এর বাস্তবায়ন জরুরী।

মানুষকে ঢাকা শহরমূখী অভিবাসনকে নিরুৎসাহিত করতে অর্থনীতির বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে।

গার্মেন্টস কারখানাসহ বিভিন্ন কল-কারখানা সমূহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সুপরিকল্পিত ভাবে গড়ে তুলতে হবে।

সারা দেশে  সুষমভাবে মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরী করতে হবে।

শহরে বস্তিবাসী মানুষের সঠিক পুনর্বাসন জরুরী। যাতে স্বাস্থ্য সম্মত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা গড়ে তোলা, বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করা এবং স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নত করা সম্ভব।

হাতিরঝিল প্রকল্প ঢাকা শহরকে একটি নতুন চেহারা প্রদান করেছে।

হাতিরঝিল এখনই পাখির কলকাকলিতে মুখরিত এবং চারিদিকে নান্দনিক সবুজের সমারোহে ছেয়ে গেছে। আশা করা যায় অদুর ভবিষ্যতে এর কলেবর আরো বৃদ্ধি পাবে। মানুষ একদিকে যেমন সকাল বিকাল মুক্ত হাওয়ায় বেড়ানোর সুযোগ পাবে অন্যদিকে শহরের পরিবেশ দুষণের মাত্রা কমে এসে ঢাকা শহরকে একটি বাসযোগ্য শহরে পরিণত করবে।

তথ্যসূত্রঃ

  1. Wikipedia
  2. Internet

যোগাযোগঃ http://www.facebook.com/narayan8747