যেমন চোর তেমন পুলিশ

নারায়ন সরকার
Published : 28 May 2016, 01:00 PM
Updated : 28 May 2016, 01:00 PM

তখন ভোর প্রায় ৫টা। রোজকার মতো হাতিরঝিলের রাস্তায় হাটছি। আমি ছিলাম রামপুরা ব্রিজের পরেই উলনের দিকের রাস্তায়। রাস্তায় যানবাহনের সংখ্যা বেশি কারণ টিভি ভবনের কাছে ইউ-লুপের কাজের জন্য রাস্তা বন্ধ করে দেয়ায় উত্তরগামী সকল যানবাহন হাতিরঝিলে ঢুকে পড়েছে। হাতিঝিলের রাস্তা ওয়ানওয়ে সেটা সকলের জানা হলেও কিছু ঘাড়ত্যাড়া চালক হামেশাই সে নিয়মকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বেহুদার মতো উল্টো পথে গাড়ী চালাতে যায়। যার কারণে বিড়ম্বনাতেও পড়তে হয়। মাঝে মাঝে দেখা যায় বিশেষতঃ ভারী যানবাহন গুলো রাস্তায় ডিভাইডারে গাড়ী উঠিয়ে দিয়ে তবলা উল্টে পড়ে আছে। আজও তার ব্যাতিক্রম হয়নি। হাতিরঝিলের সিকিউরিটির বাধা না মেনেই অনেক গাড়ী উলটোপথে চলছে।

যাই হোক আমি ঝিলের ধার ঘেঁষে হাটছি এমন সময় দেখি উল্টোদিক থেকে পুলিশের একজন এএসআই কি এসআই পদ মর্যাদার অফিসার দৌড়ে আসছে। প্রথমে ভেবেছিলাম এটা তার ট্রেনিং এর পার্ট, পরে দেখি পিছনে একজন সিকিউরিটি গার্ডও দৌড়াচ্ছে আর মেরুল বাড্ডার দিকের রাস্তা লক্ষ্য করছে।  কোন কিছু জিজ্ঞাসা করার অবকাশ ছিল না। তারা যখন আমাকে অতিক্রম করে চলে গেল তখন আমিও পিছন ফিরে তাদের অনুসরণ করলাম।  একটু এগিয়ে আসতেই দেখি রামপুরা ব্রিজের কাছে থাকা অন্য সিকিউরিটি গার্ড একটা সিএনজি ধরে রেখেছে এবং পুলিশ অফিসারটি তড়িঘড়ি করে সেটাতে উঠে পড়ল সাথে সেই সিকিউরিটি গার্ডটিও। সিএনজিটি উলটোপথেই হাতিরঝিলের প্রথম ব্রিজ হয়ে মেরুল বাড্ডার দিকে রওয়ানা দিল। সঙ্গে সঙ্গে আরও একজন সিকিউরিটি গার্ড সিএনজিকে অনুসরণ করে দৌড়াতে শুরু করল। দৃশ্য দেখে আমার মনে একটি অজানা আশংকা দানা বাধল। ভাবলাম গুলশান বাড্ডার দিকে মনে হয় বড় ধরণের দুর্ঘটনা ঘটেছে। আর তাই চিন্তা না করে আমিও পড়িমরি করে দৌড় শুরু করলাম। মনের মাঝে ছোট্ট একটা ফ্যান্টাসিও কাজ করল, জার্নালিষ্ট নই, তবুও যদি এই সক্কাল সক্কাল বিডিনিউজে একটা ব্রেকিং নিউজ দিতে পারি।

যাই হোক, পুলিশের সিএনজি মেরুল বাড্ডার কোণাতে গিয়েই থামল এবং পুলিশ অফিসার ও সিকিউরিটি সিএনজি থেকে নেমে সেখানে থাকা ব্যারিকেড দিয়ে রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে দুরে আসতে থাকা একটি কন্টেইনার লরির অপেক্ষা করতে লাগল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে লরিটি সেখানে এসে থামতেই পুলিশটি লাফিয়ে গিয়ে লরির জানালা খুলে ড্রাইভারটাকে কিলঘুষি মারতে মারতে নীচে নামাল, সাথে থাকা সিকিউরিটি দুটোও তার সাথে যোগ দিয়ে সমান তালে ড্রাইভারটাকে মারতে শুরু করল। এদিক মধ্যে অন্য পাশ থেকে আরও একটি পুলিশের লেগুনা এসে হাজির হয়েছে, এবং সেখানে থাকা একজন আনসারও অত্যুৎসাহে সেই গণধোলাইতে অংশ নিল।

আমি যেহেতু পেশাদার সাংবাদিক না, এমন পরিস্থিতির মুখোমুখিও কখনো হইনি, তার উপর পুলিশ কর্তৃক প্যাঁদানি, ছবি তুলব কি তুলব না করে করেও কাছে থাকা ক্যামেরা দিয়ে ভয়ে ভয়ে কাঁপা হাতে কয়েকটা ছবি তুললাম। বলা তো যায় না, পুলিশ এসে যদি আমাকেও প্যাঁদানি না দিক গালিগালাজ তো করতে পারে? যাই হোক এদিক মধ্যে লেগুনায় থাকা পুলিশরা নেমে এসে তাদের শান্ত করার চেষ্টা করল, কিছু পথ চলতি মানুষও জমে গেছিল, তারাও তাদের শান্ত করতে চেষ্টা করল। পরে তারা একটু শান্ত হলে ড্রাইভারকে দিয়ে লরিটিকে সাইডে নিয়ে গেল। আমি আর অপেক্ষা না করে সেখান থেকে সরে গেলাম।

পিটুনী যখন চলছিল তখন পুলিশ অফিসারটি ও সিকিউরিটি গার্ডটির কথায় যা বুঝলাম তা হলো, লরিটি মহানগর প্রজেক্টের দিকে থাকা কালে উল্টো দিকে আসায় পুলিশ অফিসারটি সেটিকে থামতে বলেছিল, কিন্তু ড্রাইভার না থেমে বরং পুলিশের উপর দিয়েই গাড়ি চালিয়ে দিয়ে পালিয়ে এসেছে, ভাগ্য ভাল পুলিশ অফিসারটি কোন রকমে সরে গিয়ে বেঁচে গিয়েছে। কিন্তু এটা তো হাতিরঝিল! রাস্তার কনস্ট্রাকশন এমনই যে সহজে পালিয়ে যাওয়া মুশকিল সেটা মনে হয় ড্রাইভারটির জানা ছিল না, আর তাই হাতিরঝিলের প্যাঁচানো রাস্তার ফাঁদে পড়ে ঠিকই পুলিশের জালে ধরা দিতে হলো!

এখন কথা হলো আমাদের ড্রাইভারদের মধ্যে এই ধরণের বেপরোয়া মানসিকতা কেন? দেশের সড়ক দুর্ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায় বেশির ভাগ দুর্ঘটনাই ঘটে ড্রাইভারদের বেপরোয়া আচরণের কারণে। বেপরোয়া গাড়ি চালানো, রং সাইডে গাড়ি চালানো, ট্র্যাফিক আইন না মানা, অদক্ষ ড্রাইভার দিয়ে গাড়ি চালানো সড়ক দুর্ঘটনার মুখ্য কারণ এবং এতে করে প্রতি বছর বেশ কয়েক হাজার মানুষের অকাল প্রাণহানির ঘটনা ঘটে থাকে। যে ড্রাইভারটি লরিটি চালাচ্ছিল, ওর বয়স দেখে মনে হয় না ও আসলেই ঐ লরির ড্রাইভার হওয়ার যোগ্যতা রাখে। ওর কাছে সঠিক কাগজপত্র ছিল কিনা সেটা আমার জানা হয়নি। তবে আমার মনে হয়েছে সে আসল ড্রাইভার না। হেলপার বা অ্যাসিস্ট্যান্ট দিয়ে গাড়ি চালানোর কারণেও বড় সংখ্যক দুর্ঘটনা ঘটে থাকে।

প্রশ্ন হলো ড্রাইভারদের এই বেপরোয়া মানসিকতার জন্য পুলিশ কতটা দায়ী? আরও একটি কভার্ড ভ্যান উল্টোদিকে চলতে গিয়ে হাতিরঝিলের রাস্তায় পড়েছিল। মর্নিং ওয়াক সেরে ফেরার পথে সেখানে পুলিশ ও অন্য কিছু মানুষের জটলা দেখে কাছে গেলাম এবং আসতে আসতে শুনলাম, আড়াই হাজার টাকায় সেট হয়েছে তো কমেই পেয়েছেন!

যুক্তির খাতিরে যদি ধরেও নেয়া যায়, ড্রাইভারটি অপরাধী এবং সে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছে, তারপরেও একটা প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়। অপরাধী যত বড়ই অপরাধ করুক, পুলিশ সেই অপরাধীকে এভাবে প্রকাশ্য রাস্তায় মারতে পারে কিনা? দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে যে, সিকিউরিটি গার্ডরা ড্রাইভার ছেলেটিকে প্রহার করতে যে রকম করিৎকর্মার ভূমিকা পালন করেছে, তাদের সে অধিকার বা ক্ষমতা আছে কিনা?

ঘটনাটি ২৬/০৫/২০১৬ তারিখের।

যোগাযোগ ফেসবুকঃ Narayan Chakkra