আমার দেখা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ২০১৭

নারায়ন সরকার
Published : 22 Feb 2017, 07:27 PM
Updated : 22 Feb 2017, 07:27 PM

একুশ আমাদের চেতনা, একুশ আমাদের সত্ত্বা। একুশ এখন বিশ্ব সম্প্রদায়কে এক মঞ্চে এনেছে – মানুষের মাতৃভাষার অধিকারকে সমুন্নত রাখতে। প্রত্যেক মানুষের অধিকার আছে তার মাতৃভাষায় মনন চর্চার, তার সৃষ্টিশীলতাকে প্রকাশ করার। কোন সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থ মানুষের এই অধিকারকে দমিয়ে রাখতে পারে না। একুশ বাঙালির গর্ব – বাঙালির অহংকার। আমাদের এই বাঙালি জাতিই শাসকের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে রক্তের বিনিময়ে তার মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিল। আজ বিশ্বব্যাপি সেই অধিকার প্রতিষ্ঠার গৌরবগাঁথাকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। আজ একুশে ফেব্রুয়ারি – মহান শহীদ দিবস। প্রতিবছরের মতো এবারো লাখো মানুষ সমবেত হয়েছেন ঢাকা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলী দিতে। আমার এই লেখা শ্রদ্ধাঞ্জলি দিতে যাওয়ার পথের কিছু খন্ডচিত্র মাত্র।

জনবহুল এই ঢাকা নগরীর কোন পাবলিক ইভেন্ট মানেই বিশাল জনসমুদ্র। এই জনসমুদ্রের জনস্রোতে তলিয়ে যাওয়ার ভয়ে সাধারণতঃ এসব থেকে দুরে থাকি। আজ অমর একুশে ফেব্রুয়ারি – 'শহীদ দিবস' অধুনা 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস'। এই দিবস নিয়ে তারুণ্যের দিনগুলির সেই উম্মাদনা মনে আর উৎসারিত না হলেও একপ্রকার উৎসাহ তো আছেই! শরীরটা তেমন ভালো নেই, মনও কিছুটা অবসন্ন তাই ভেবেছিলাম ছুটির দিন অনেক বেলা অবধি একটা লম্বা ঘুম দেব। কিন্তু বিধিবাম! এলার্ম বন্ধ থাকলেও বেশ সকাল সকাল ঘুম ভেঙ্গে গেল। অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্বের সাথে যুদ্ধ করে শেষ পর্যন্ত ঠিক করলাম আজ একবার শহীদ মিনারে ঘুরে আসব। লক্ষ লক্ষ মানুষ গেছে সেখানে, যাই না একটু দেখে আসি?

যেমন ভাবা তেমন কাজ। শহীদ দিবসের কালো পোষাক ছিল না, তাই বিজয় দিবসের লাল সবুজের ফতুয়া গায়ে জড়িয়ে নিলাম। অতি সম্প্রতি নতুন একটা জ্যাম্বসাইজ ক্যামেরা কিনেছি- সেটা কাঁধে নিলাম। নিজেকে যাতে রিপোর্টার রিপোর্টার লাগে তাই অফিসের আইডি কার্ডটাও গলায় ঝুলালাম!

শহীদ দিবসে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলি দেয়ার জন্য আসা মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাকে বরাবরই নিরাপত্তার চাদরে মুড়ে ফেলা হয়। প্রবেশ-বহির্গমনের সকল পথেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যারিকেড বসায় এবং প্রবেশ ও বাহির হওয়ার পথ নির্দিষ্ট করে দেয়। পায়েহাটা মানুষ ছাড়া সকল প্রকার যানবাহন প্রবেশ বন্ধ করে দেয়া হয়। কাজেই নিজের বাইক নেয়ার কোন সুযোগ ছিল না বিধায় একটি সিএনজি অটো নিয়ে রওয়ানা দিলাম।

স্বাভাবিক ভাবেই শাহবাগে গিয়ে সিএনজি ছেড়ে দিয়ে পায়ে হাটা পথ ধরতে হলো। অন্য সব মানুষের সাথে হাটতে হাটতে টিএসসি পর্যন্ত গেলাম – পথিমধ্যে এদিক-সেদিক উদ্দেশ্য বিহীনভাবে দু-একটা ক্লিক করলাম। টিএসসিতে গিয়ে দেখি টিএসসি থেকে যে রাস্তা শহীদ মিনারের দিকে গেছে সে রাস্তা মানুষের জন্য বহির্গামী পথ হিসাবে নির্দিষ্ট করেছে। তবুও কাছে গেলাম যদি ক্যামেরা আর আইডি কার্ডের জোরে এই সোজা পথে ঢুকতে পারি। গিয়ে দেখি সেখানে কোন একটি সংগঠনের কিছু মানুষ ও কিছু সাধারণ মানুষ ঢোকার জন্য পুলিশে সাথে জোরাজুরি করছে। হয়ত তাতে অফিসারের মেজাজও কিছুটা চড়ে গেছে! আমি একজন পুলিশকে বললাম 'ভাই ফটো তুলতে যাব'। উনি বললেন "ভাই ঐ পথে পলাশী হয়ে যান।" আমিও আর কথা বাড়ালাম না – মানুষের সাথে নেগোশিয়েশন দক্ষতা আমার এমনিতেই কম তার উপর শুধু ইউনিফর্মের জোরে বেশি কথা বলা যায় না – পরে ফেঁসে গেলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে?

পলাশী হয়ে ঘুরে যেতে রাস্তার দুরত্ব ও ভিড়ের কথা মাথায় আসতেই উৎসাহ অর্ধেকে নেমে এল। যাব কি যাব না করতে করতে গুটি গুটি পায়ে এগোতে থাকলাম। পথে কলাভবনের চত্বরে কবিতা আবৃতির একটা আসর বসেছিল সেখানে কিছুক্ষণ দাড়ালাম। আর একটু এগোতেই একটা কাক চোখে পড়ল, তখন মন নেচে উঠে বলল থাক আর শহীদ মিনারে গিয়ে কাজ নেই, এখন কাকের ছবি তুলি! আসলে আমি তো পাখির ছবি তোলার টেলিফটো লেন্স নিয়েই বের হয়েছি ইউনিফর্ম হিসাবে! এই লেন্সে কাছে মানুষের ছবি ভাল তোলা যাবে না। একটা দুটো ক্লিক করতেই সেও উড়ে গেল! "ধুর মশাই? আজ সকালটাই মাটি!" নিজে নিজে স্বগদোক্তি করে উঠলাম।

সামনে ফুলার রোড, দেখি সেটাও বহির্গামী মানুষের জন্য। কিছু মানুষ সে পথে যাওয়ার জন্য আর্মড পুলিশের সাথে দরকষাকষিতে ব্যস্ত। কোন একজন মিডিয়ার লোক গলায় পরিচয় পত্র ঝুলিয়ে নিজের গাড়ী নিয়ে যেতে চাইছে তবে পুলিশ তাকে পায়ে হেটে যাওয়ার অনুমতি দিলেও গাড়ী যেতে দিতে নারাজ। তিনিও নাছোড়বান্দা, তিনি তার কোন বড়ভাইদের ফোন করে উপায় বের করতে চাইছেন। অফিসার তাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকায় আমি এক কনস্টেবলকে বললাম ফটো তুলতে যাব। তিনি আমার দিকে তাকালেন হাতে বিশাল ক্যামেরা, গলায় চকচকে ঝুলন্ত আইডি কার্ড দেখে বললেন, "রিপোর্টার?" আমি দুরুদুরু বুকে যুধিষ্ঠিরের "অশ্বথামা হত" স্টাইলে হ্যাঁ-না বলাতে তিনি আমাকে ভিতরে ঢোকার অনুমতি দিলেন। আমিও সুযোগ বুঝে ঢুকে পড়লাম, সামনে আবার আর একটা পুলিশ ব্যারিকেড, তারাও অন্য কাউকে নিয়ে ব্যস্ত। তবে আমার চেহারা সুরত দেখে কিছু বললেন না। শেষমেশ কিছুটা কম সময়ে, কম পরিশ্রমে নির্বিঘ্নে জগন্নাথ হলের মোড় পর্যন্ত গেলাম।

সেখানে গিয়ে পড়লাম মূল জনসমুদ্রের জনস্রোতে। পুরো রাস্তা মানুষে মানুষে ঠাসা কাজেই আর কোন জারিজুরি কাজ করবে না। গা ভাসিয়ে দিলাম সেই প্রবল জনস্রোতে – রোদে পুড়ে, ঘামে ভিজে, মানুষের চাপে চ্যাপ্টা হয়ে চার-পাচঁশ মিটারের মতো রাস্তা ঘন্টাধিক সময় নিয়ে গিয়ে পৌছালাম সেই অভীষ্ট লক্ষ্যস্থলের কাছে। ইতিমধ্যে হাজারো মানুষের হাজার রকমের অনুভূতি, অভিব্যক্তি, অভিজ্ঞতা ও আচরণের মুখোমুখি হয়েছি। হাজার হাজার মানুষ, হাজার হাজার ব্যানার, ফুলের বাস্কেট, ফুলের তোড়া। তবে যে উৎসাহ-উদ্দীপনা ও শ্রদ্ধা নিয়ে বাড়ি থেকে কেউ কেউ বের হয়েছিল এই ভীড়ে চাপে পড়ে তার অনেকটাই ফ্যাঁকাসে হয়ে গেছে। কেউ কেউ অর্ধ পথ থেকে ফিরতে চাইছে কিন্তু পিছপা হওয়ারও কোন সুযোগ নেই। বিশেষতঃ নারী, শিশু আর বয়স্কদেরই বেশি সমস্যা হচ্ছিল। যারা তাদের বাচ্চাদের সাথে নিয়ে গেছে তাদের অবস্থা করুণ – শ্যাম রাখি না কূল রাখির মত অবস্থা। ইতিমধ্যে একজন তৃষ্ণার্ত মানুষ আমার ক্যামেরার ব্যাগের সাইড পকেটে জলের বোতল দেখে এক ঢোক জন চেয়ে নিয়ে পান করলেন। কিছু উঠতি বয়সী ছেলে একজন মহিলাকে ঢাল হিসাবে নিয়ে মহিলা মহিলা বলে এগিয়ে যেতে চাইল কিন্তু কে শোনে কার কথা – ওখানে মানুষ সবাই নিজেরটাই নিয়ে ব্যস্ত।

মাঝে মাঝে হৈ হুল্লোড়ের শব্দ এলে মনে নানা আশঙ্কা কাজ করে। পার্সের নিরাপত্তা বিধানের জন্য তাকে ক্যামেরার ব্যাগে ঢুকিয়ে নিয়েছি। ফোন প্যান্টের সামনের পকেটেই আছে – মাঝেসাঝে সেলফি তুলব বলে। তবে হাতে ক্যামেরা থাকার কারণে সেটা তা ভাল ভাবে পারিনি। সবাই কমবেশি সেলফি নিয়ে ব্যস্ত। একটা বিষয় দেখলাম, সেলফি মানুষকে অনেক শান্ত করেছে – সবাই যেহেতু সেলফি নিয়ে ব্যস্ত, কাজেই জনস্রোত কতটা এগোচ্ছে কি এগোচ্ছে না তা নিয়ে মানুষের মাঝে তেমন কোন ভাবনা নেই। এরকম ভীড়ভাট্টা আগেও দেখেছি তখন মানুষের ভিতর যে রকম বিরক্তি কাজ করত আজকে মনে হলো তার চেয়ে অনেক কম।

শহীদ মিনারের গেটে পৌঁছে ভিড়ের অবস্থা দেখে ভিতরে যাব কি যাব না করে সেখানেই কিছুক্ষণ থাকলাম, তারপর সিদ্ধান্ত পাল্টে বেদীর দিকে এগোতে থাকলাম, শহীদ মিনারের ঠিক মুখে স্বেচ্ছাসেবকদের একজন আমার কাছে ক্যামেরা আর আইডি কার্ড দেখে রিপোর্টার কিনা জিজ্ঞাসা করল এবং লোহার শেকলটা তুলে পাশে মিডিয়ার লোকজন যেদিকে আছে সেখানে যাওয়ার পথ করে দিল। মোটামুটি হাফ ছেড়ে বাচলাম।

শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাতে যত দল ও সংগঠন এসেছিল তাদের সিংহভাগই ছিল সরকার দলীয়। মাঝে মাঝে তাদের মধ্যে কিছুটা উত্তেজনা দেখা দেয়ায় মানুষের মধ্যে কিছুটা ভীতির সঞ্চার হয় এবং মানুষ ভয়ে এদিক-সেদিক ছুটতে থাকে এবং কিছুটা বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। তবে নিরাপত্তা বাহিনী অচিরেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

যে সেলফি মিছিলে দাড়ানো অপেক্ষমান মানুষের শান্ত থাকার সহায় সেই সেলফি শহীদ মিনারের বেদীমুলে মানুষের যন্ত্রণার অনুষঙ্গ। পুস্পস্তবক অর্পণ করে মানুষ সেলফি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ত ফলে মানুষের বহির্গমণের পথ আটকে থাকত। ধারাভাষ্যকারের বার বার নিষেধ সত্ত্বেও স্বেচ্ছাসেবকরাও সেলফি নিয়ে মত্ত থাকত। ভাষ্যকারের ধারাভাষ্য থেকে মনে হয়েছে, সরকার দলীয় সংগঠনের শ্রদ্ধা জ্ঞাপন কারীগণ শ্রদ্ধাঞ্জলি দেয়ার পরও ছবি তোলার জন্য বেশ কিছু সময় সেখানে ব্যয় করার চেষ্টা করত ফলে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন প্রক্রিয়া কিছুটা মন্থর হয়ে যেত।

এখন দেশে মিডিয়ার সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে সেই সাথে বেড়ে গেছে মিডিয়া কর্মী ও যন্ত্রপাতির সংখ্যা। ফলে শহীদ বেদীতে যত না শ্রদ্ধা জ্ঞাপনকারীর সংখ্যা তার চেয়ে বেশি ছিল মিডিয়া কর্মী। অতিরিক্ত মিডিয়াই অনুষ্ঠানের স্বাভাবিক গতিকে ব্যাহত করেছে বলে আমার মনে হয়েছে।

একটা সময় দেখি ক্যামেরার ব্যাগের সাইড পকেটে থাকা পানির বোতলখানা উধাও হয়ে গেছে, সকালে কিচ্ছু খাওয়া হয়নি, এদিকে তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে আসছে, তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাড়ির পথ ধরতে বাধ্য হলাম। একটু বলে রাখা দরকার আমি নিজেও ভাল ফটোগ্রাফার না, তার উপর ভুল লেন্স নিয়ে গেছিলাম ফলে সুযোগ পেয়েও কোন ভাল ছবি তুলতে পারি নি। আশা করি ভবিষ্যতে এই ভুল হবে না।

একুশ আমাদের স্বত্বা, একুশ আমাদের গর্ব, একুশ আমাদের ত্যাগের দিন, একুশ আমাদের শোকের দিন, একুশ আমাদের অহংকারের দিন। একুশে ফেব্রুয়ারি আজ বিশ্বব্যাপি স্বীকৃত "আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস" হিসাবে পরিচিত। এই গর্বের মুলস্থল আমাদের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। এখানেই সব থেকে বেশি মানুষ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে। কাজেই এই শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের প্রক্রিয়া আমরা যত সুশৃঙ্খল করতে পারব ততই আমাদের সুনাম হবে।

আরো ছবিঃ

যোগাযোগঃ ফেসবুক

Narayan Chakkra (http://www.facebook.com/narayan8747)