‘নির্ভয়’ ঈদ রোহিঙ্গাদের

নারায়ন সরকার
Published : 18 June 2018, 09:35 AM
Updated : 18 June 2018, 09:35 AM

"সেখানে শুধু ভয়ে ভয়ে থাকতাম, ঈদ করব কেমন করে? বার্মিজ আর্মি পাঁচ জনের বেশি লোককে একত্র হতে দিত না, তাই ঈদে কখনো জামাতে নামাজ পড়া হত না।" কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঈদের নামাজ শেষে ঘরে ফিরতে ফিরতে ষাটোর্ধ্ব হাফিজ উল্লাহ বলছিলেন কথাগুলো।

হাফিজ উল্লাহর গত ঈদ গেছে চরম এক দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে। গত বছর কোরবানি ঈদের আগের দিন মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে বিতাড়িত হয়ে হাফিজ উল্লাহ বাংলাদেশে আসেন। 

ঈদের নামাজ শেষে নিজেদের মধ্যে শুভেচ্ছা বিনিময় করছে রোহিঙ্গারা

ঠিক একই সুর পাওয়া গেল নুর ইসলাম মিয়ার কণ্ঠে। তিনিও গত বছর ঈদের আগের দিন ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনিসহ নয় জনের পরিবার নিয়ে পাড়ি জমিয়েছেন বাংলাদেশে।

তার সাথে কথা হল বালুখালি-২ ময়নাঘোনা ক্যাম্পে। জানতে চাইলাম, এখানে কেমন আছেন? বললেন, ভালই আছি। অন্তত ভয়ে ভয়ে আর থাকতে হয় না। এবারের ঈদ ভালই কেটেছে। ঈদের নামাজও পড়েছি।

ঈদের সাজে রোহিঙ্গা শিশু-কিশোরীরা

শনিবার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঘুরে রোহিঙ্গাদের ঈদ উৎসব উদযাপনের দৃশ্য দেখলাম। সবার মাঝে ঈদের খুশি। কিশোরীরা ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন রঙিন পোশাকে নিজেদের সাজিয়েছে। হাতে এঁকেছে মেহেদির আলপনা আর মুখে মেখেছে চন্দনের পেস্ট জাতীয় প্রসাধনী। ভ্যানিটি ব্যাগ হাতে ঘুরছে এদিক-সেদিক। ভিড় করছে ক্যাম্পের রাস্তার ধারে গড়ে ওঠা বিভিন্ন খেলনা ও প্রসাধনীর দোকানে। যার যার সামর্থ অনুযায়ী কিনছে বিভিন্ন সামগ্রী।

খেলনা কিনছে রোহিঙ্গা শিশুরা

মেহেদির আলপনায় রাঙানো রোহিঙ্গা শিশুর হাত

ছেলেরাও কম যায় না। তারাও বিভিন্ন রঙিন পোশাক আর চশমা পড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ক্যাম্পময়। চলতে-ফিরতে পরিচিত কারো দেখা পেলে কোলাকুলি করছে।কারো হাতে খেলনা পিস্তল, কারো হাতে বেলুন। ছেলেরা মূলত সাধারণ পোশাকই পড়েছে যার সাথে আমাদের বাংলাদেশি সংস্কৃতির তেমন অমিল নেই। কতিপয় তরুণকে দেখা গেছে লম্বা জোব্বা আর টুপি পড়তে।

আমাকে দেখে জিন্স ও শার্ট পরিহিত এক তরুণ কাছে এসে দাঁড়াল। হাতে একটি কাগজ। রোহিঙ্গাদের অধিকারের কিছু বার্তা লেখা আছে তাতে। স্বাভাবিকভাবেই তার কথাবার্তায় রোহিঙ্গাদের নিরাপদে ও পূর্ণ অধিকার নিয়ে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের প্রসঙ্গ প্রাধান্য পেল।

নিজেদের অধিকারের দাবিতে প্লাকার্ড হাতে রোহিঙ্গা তরুণ

বিভিন্ন জয়গায় দেখলাম বয়সী পুরুষদের জটলা। খোঁজ নিয়ে জানলাম, সেখানে গরু জবাই হয়েছে। তাই মাংস কেনার জন্য এরা ভিড় করছে। ঈদের দিন কিছুটা ভাল-মন্দ খাওয়ার ব্যাপারে সবারই তো থাকে প্রাণান্ত চেষ্টা।

নাতিকে কোলে নিয়ে এক রোহিঙ্গা বৃদ্ধ

একজন বয়োবৃদ্ধ রোহিঙ্গা, যিনি জানেন না জীবদ্দশায় আর কোনও ঈদ নিজের জন্মভূমিতে করতে পারবেন কি না

উখিয়া থেকে বালুখালী ক্যাম্প পর্যন্ত রাস্তায় রোহিঙ্গাদের উপচে পড়া ভিড় ছিল চোখে পড়ার মত। অনেক দিন পর হয়তবা এটাই ছিল তাদের জীবনে একটি নির্ভয় ও নির্বিঘ্ন ঈদ উদযাপন। তাই আনন্দও ছিল অফুরন্ত।

সে কারণে ঈদের নামাজ পড়েই অনেকে অন্য কোন ক্যাম্পে ছুটছে তাদের আত্মীয়দের সাথে দেখা করতে। অথবা কেউ যাচ্ছে কাছাকাছি কোথাও বেড়াতে। ক্যাম্পের ১০ ফুট বাই ১২ ফুটের ঘিঞ্জি ঘরে সাত-আটজনে বাস করেও এবারে ঈদের এক অনাবিল আনন্দ উপভোগ করতে পেরেছে রোহিঙ্গারা। হয়ত সেটাই তাদের পরম সান্ত্বনা।

(রোহিঙ্গাদের কথাগুলো স্থানীয় দোভাষীর মাধ্যমে বাংলায় রূপ দেয়া হয়েছে।)