সততার মানদণ্ডে কোথায় আমাদের শিক্ষার্থীদের অবস্থান?

রেজাউল হক নাঈম
Published : 10 May 2017, 06:03 AM
Updated : 10 May 2017, 06:03 AM

সততার সংজ্ঞা স্থান, কাল, ধর্ম, বর্ণ ভেদে ভিন্ন হতে পারে এমনটা কখনো জানা ছিল না। সৎ সঙ্গে সর্গবাস অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ, অসৎ সঙ্গ ত্যাগ কর- কতই না আদর্শলিপিতে পড়েছি, ভাব সম্প্রসারণ করেছি, সারাংশ, সারমর্ম করেছি। আদৌ কি আমরা সেই সততা অর্জন করতে পেরেছি?

সততা অনুশীলনের মোক্ষম সময় ছাত্রজীবন। আসলেই আমরা ছাত্রজীবনে কোন সততার অনুশীলন করি? ছোটবেলার শিক্ষকের বেতের বাড়ির সাথে আমরা সকলেই পরিচিত। সময়ের সাথে শিক্ষকের হাতে সেই বেত এখন আর নেই। নতুন প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীদের দুরন্তপনার ধরণ যেমন বেড়েছে শিক্ষকের বেত চালানোর মাত্রা বেড়ে এক সময় বর্বরতার দিকেই যাচ্ছিলো। ঠিক সে সময়ই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বেতের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা ছিল সময়ের দাবি।

হাই স্কুল বা কলেজে দেখতাম শিক্ষক যখন পরীক্ষা নেবার সময় পরীক্ষার হলে দায়িত্ব পালন করতেন এদিকওদিক ঘাড় ঘোরানোর কোন সুযোগ নেই। হয়তো বা কোন কারণে শিক্ষক হলের বাইরে বের হতেন কয়েক মিনিটের জন্য, শুরু হতো হৈ-হুল্লোড় ঠিক মাছের বাজারের মতো। কলেজ পেরিয়ে যখন বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আসলাম সেই একই ধরনের হৈ-হুল্লোড় ছাড়াও জানা শোনাদের মধ্যে অনেক পুকুর চুরির মতো কান্ডও দেখেছি। ভিন্ন দেশে, ভিন্ন পরিবেশে না গেলে নীতি-নৈতকতার এই অধঃপতন অনুধাবন করাটা অনেক কঠিন।

আমার আমেরিকায় প্রায় চার বছর হলো। ২০১৫ সালে টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স করে পার্ডু ইউনিভার্সিটিতে রসায়ন বিভাগে পিএইচডি করছি। টিচিং এসিস্ট্যাস হবার কারণে প্রফেসর এবং ছাত্রছাত্রী দের খুব কাছাকাছি যাবার সুযোগ হয়েছে। টেনেসিতে সরাসরি কোন বিষয় পড়ানোর সুযোগ হয়নি, শুধুমাত্র ল্যাবোরেটরিতে ছাত্রছাত্রী দের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ব্যবহারে সাহায্য, পরীক্ষার খাতা দেখা, হোমওয়ার্ক, গ্রেডিং, পরীক্ষায় প্রক্টরিং এসবে সাহায্য করাই ছিল মূল দায়িত্ব। ছাত্রছাত্রী দের সাথে বন্ধুসুলভ আচরণের মাধ্যমে ভিনদেশী এসব কোমলমতি ছাত্রদের সততার সাথে নিজেদের তরুণদের তুলনার একটু সুযোগ হয়।

পার্ডু ইউনিভার্সিটিতে টিচিং এসিস্ট্যান্ট হিসেবে অনার্স প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রদের পড়ানোর সুযোগ হয়েছে, যেখানে ২০১৬ ফল সেমিস্টারে সপ্তাহে দুইটা লেকচার আর দুইটা ল্যাব আর সেমিস্টারে ১২টা কুইজ আর চারটা পরীক্ষা একটি ক্লাসে। নানান দেশী ছাত্রছাত্রী এক ক্লাসে। পার্ডু ইউনিভার্সিটি ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট ভর্তির দিক থেকে আমেরিকার সেরা তিনে! সবার মধ্যে আমেরিকানই বেশি তার পর চাইনিজ। এখানে পড়াশোনার ধরনের মধ্যে যেমন পাথর্ক্য রয়েছে, কোমলমতী এই ছাত্রদের মধ্যে দেখলাম এক ভিন্ন ধরনের সততাও। সততায় এরা আমাদের তরুণদের চেয়ে অনেক এগিয়ে। আমাদের অনেক কিছু শিখার আছে এদের থেকে।

আমাদের সময়ে দেখতাম মুহূর্তের জন্য শিক্ষক যখন পরীক্ষার হল থেকে বের হতেন, মনে হতো যেন মাছ বাজারের নিলাম বুঝি কয়েক মিনিটের জন্য শুরু। কেউ কারো থেকে না জানা প্রশ্নটির উত্তর জেনে নিবে, ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক ওদিক তাকাবে আবার শিক্ষক ক্লাসে ফিরার সাথে সাথে আবার শুনসান নিরবতা।

এদেশের ছাত্রদের কতভাবে টেস্ট করলাম পরীক্ষার খাতা হাতে দিয়ে, পানি খাবার নাম করে বের হয়ে আসতাম কয়েক মিনিটের জন্য। নীরবতা যেমনটা ছিলো তেমনটাই আছে, কোন পরিবর্তন নাই। সাথে সাথে ভাবি নয় হাজার মাইল দূরের আমার দেশের কোন একটি স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক বিহীন কোন পরীক্ষার হলের অবস্থা। মনে হয় দুই মিনিটে ক্লাসের ভিতরে একটা আলোড়ন হয়ে যেতো।

আমাদের কাছে সততার সংজ্ঞা অনেকটা পরিবর্তিত। অনেকের কাছে বলতে শুনেছি চুরি বিদ্যা মহা বিদ্যা যদি ধরা না পড়ি। সততায় আমাদের এই বেহাল দশা কি শুধু স্কুল বা কলেজে? না, মনে হয় না, যেখান থেকে শিক্ষা জীবন শেষ করে সরাসরি কর্মজীবনে প্রবেশ করে, সেখানে একই অবস্থা নিজের চোখে দেখা। আমরা যারা শিক্ষকের সামান্য অনুপস্থিতিতে সুযোগের সদ্ব্যাবহার করে যে নৈতিক ভাবে দুর্বল কাজ করি, সেই ছাত্র যখন দেশের গুরত্বপূর্ণ পদে এক সময় উন্নিত হয় তাহলে তারা আদৌ ব্যক্তিগত স্বার্থের উর্দ্ধে থাকতে পারে? হরহামেশাই বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা, চাকরির পরীক্ষায় জালিয়াতির দায়ে অনেককে জেলে যেতে দেখি।

ভীনদেশের এইসব তরুণদের মাঝে সততা দেখলে মনে প্রশ্ন জাগে যে কিভাবে, কখন এবং কারা এদের মনে এই সততার বীজ বুনেছে? অনেক ভাবি, জানাশোনা লোকের সাথে আলাপ করার চেষ্টা করেছি, উত্তর খোজার চেষ্টা করেছি। ওদের কি এমন আছে যা আমাদের মাঝে নাই। এর কারণ কি শুধু ধনী আর গরীব জাতি? সব কিছুর মতো এর কারণও কি আমরা বলবো আমাদের অর্থনৈতিক দৈন্য দশা? পরিবার, সমাজ নাকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান- কার দায়িত্ব বাচ্চাদের সৎ করে তোলার?

আমাদের দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ুয়া ছাত্ররা কি এতটুকু সততা অর্জন করতে পারে যে, মালিকবিহীন দোকানের খাবার খেয়ে নিজ দায়িত্বে দাম রেখে যাবে? বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে একটি পরীক্ষার হলে শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে এদিক ওদিকে না তাকিয়ে নিজের চেষ্টায় পরীক্ষা দেবে?

আমাদের পরিবর্তনটা আনার খুবই দরকার। আর কতকাল আমরা পিছিয়ে থাকবো? অর্থনীতি, রাজনীতি, প্রযুক্তি এসবের চেয়ে সততায় এগিয়ে থাকা আরো বেশি সহজ। নিজের কাছে ছোট হওয়াই বড় লজ্জার, নত হয়ে যাই নিজের সততার সাথে তুলনা করলে। সবার সাথে চালাকি করে বাঁচা যায়, নিজের থেকে কি বাঁচা যায়?

পূর্ব প্রকাশিত: সমকাল, ২৮ জানুয়ারি ২০১৭